সৃজা” পর্ব -৩

0
2012

#সৃজা
পর্বঃ৩
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী

সারাটাদিন সৃজার ভাবনার মাঝেই কেটে গেলো।বারবার শুধু সাফওয়ানের বলা কথাগুলো মনে পড়ছে।মন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই যেনো উদাসিনতা তাকে ঘিরে রেখেছে।কোনোকিছুই তাকে আকর্ষন করছেনা।বই পড়তেও ইচ্ছে করছে না।বারান্দায় দাড়িয়ে দূরের আকাশ দেখে মনে হলো আমার মনটা আকাশের মতো বিশাল হলো না কেনো?তবেই তো মন খারাপকে পাত্তা দেয়ার প্রয়োজন হতো না।সাফওয়ান যেতেই হাতের ফোনটা শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ভেঙে ফেলেছে।তাতেও নিজের রাগ মেটেনি।পরে মনে পরলো কার উপর রাগ করলাম আমি।সাফওয়ানের উপর,নাকি নিজের ভাগ্যের উপর!??আদৌ কি এর জন্য আমার ভাগ্য দায়ী??তার ভাগ্যে যে এরকম বর ছিলো তাতো ভাবতেও পারেনি কখনো।

তার আগেই তার বরের বুকে কেউ মাথা রেখেছে,তাকে গভীরভাবে ছুঁয়েছে।এসব ভাবতেই গাঁ টা শিউরে উঠছে।এত ঘৃণা হচ্ছে কেনো আজ নিজেকে।সারাটা জীবন কিভাবে কাটাবো এই লোকের সাথে।একটা রাতেই তো তার জীবন নরকে পরিণত হলো।আচ্ছা সাফওয়ানতো এই কথাটা না বললেই পারতো।তবে কি সে বদলাতে পারে।

শাশুড়ী মা তাহলে এর ইঙ্গিতই দিয়েছে আমায়।নিজের স্বামীকে ধরে রাখতে বলেছে।আমি কিভাবে ধরে রাখবো তাকে??শরীর দিয়ে!!না সেতো কদিন পরেই পুরোনো হয়ে যাবে।মন দিয়ে বাধতে হবে তাকে, সৃজার মন এতেই সায় দিলো।শরীরের বাঁধন ছুটে গেলেও মনের বাঁধন তো আলগা হবেনা।সে আমার শরীর ছুঁয়েছে, এখন তার মন ছোঁয়ার পালা।

দুপুরে ঠিক করে খেতে পারলোনা সৃজা,একে নতুন বউ তারউপর সকালের কথাটা।টিউলিপ কতক্ষণ এসে নিজে নিজেই বকবক করেছে তার কথাও মাথায় ঢুকলো না কিছু।সন্ধ্যার দিকে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলো সে।চোখের জলে কপোল ভাসিয়ে কখন ঘুমিয়ে পরেছে তার খেয়াল নেই।

অধরে কারো গভীর চুম্বনে ঘুম ভাঙলো তার।তারপরই ছিটকে দূরে সরে গেলো।

সাফওয়ান বললো “রিল্যাক্স, আমি এখানে।”

সৃজা স্বামীর দিকে এক করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিছানা থেকে নেমে দাড়ালো। দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো ৭টা বাজে তারপরই বললো

” কখন আসলেন আমি টের পাইনি”।

” টের পাবে কিভাবে তুমি তো কঠিন ঘুম দিয়েছিলে তাই ভাবলাম একটু আদর করে জাগিয়ে দেই।”

তারপর টি-টেবিল থেকে একটা ফোন হাতে নিয়ে বললো এখন থেকে তুমি এটা ইউজ করবে,আমি বাইরে থাকলে প্রয়োজন পরলেই ফোন দিতে পারবে।আজ প্রথমবার অফিসে গিয়ে শুধু বাড়ি আসতে মন চাচ্ছিলো।তাই তারাতারি এসে পরলাম, কিন্তু এসে দেখি বেগম ঘুমাচ্ছে।

সাফওয়ান আমাকে ডিনার করতে ডাইনিংয়ে নিয়ে গেলো, এই দুদিন রুমেই খেয়েছি।সাফওয়ানদের বাড়ির সবকিছুতেই যেনো আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে।আমাকে তার পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলো।দেখলাম পরিবারের সবাই সেখানে উপস্থিত।আমার শশুরকে বিয়ের পর এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখলাম।গম্ভীর মানুষ তিনি।রুমটাতে পিনপতন নিরবতা বজায় রেখে সবাই খাচ্ছে।ভেবে ভালো লাগলো স্বামী স্ত্রী একসাথে বসে খাওয়ার নিয়ম এখানে।আমাদের বাড়িতে সবসময় আগে বাবা খেতো তারপর মা।সেটা যদি গভীর রাত হয় তারপরও মাকে জেগে থাকতে দেখতাম।

ডিনার সেরে রুমে আসার পরই সাফওয়ান বললো যাও এটা পরে আসো।আমি কোনো কথা না বলে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে গেলাম।জামাটা দেখেই রাগ লাগলো।এরকম জামা আমি কখনো পরিনি।তাই সাফওয়ানের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে একটু পরেই চ্যাঞ্জ না করে বেরিয়ে আসলাম।

ও হয়তো উৎসুক হয়ে বসে আছে।আমাকে চেঞ্জ না করে বেরোতে দেখে অসন্তুষ্ট হলো।তারপর বললো

” স্বামীর সামনেই তো পরবে এতে লজ্জার কি আছে??”

আমি কোনো কথা না বলে বিছানার একপাশে ফিরে শুয়ে পরলাম।

ওপাশ ফিরলেই বুঝতে পারতো সাফওয়ান তাকে গিলে খাওয়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।তারপরও রাগটাকে সংযত করে লাইটটা নিভিয়ে সৃজার শরীর ঘেসে শুয়ে পরলো।একটু পরই তার হাত সৃজার নরম শরীরে বিচরণ শুরু হলো।সৃজা কয়েকবার তার হাত সরিয়ে দিলো।কিন্তু সরিয়ে দেয়ার ফলে তার স্পর্শ গভীর হতে থাকলো।একসময় অধৈর্য হয়ে অন্ধকারেই বিছানা থেকে উঠে সোফায় গিয়ে শুলো।সাফওয়ান এবার রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো।লাইটটা জ্বালিয়ে জোর করে কোলে নিয়ে তাকে বিছানায় ছুরে ফেললো।ব্যথা পেলেও সেই মুহূর্তে সৃজাও তার কঠিন রূপ ধারণ করলো।বিছানার উপর দাড়িয়েই সাফওয়ানকে কাটকাট গলায় বললো

“আমাকে একদম ছুবেননা।আমি চিৎকার করবো।আপনার বাবা যেহেতু বাড়ি আছে, তাকেই বলবো আপনার নোংরামির কথা।বিয়ের আগে আপনি কত মেয়েকে ছুয়েছেন তা বলে দেবো।”

আমার কথা শুনে সাফওয়ান প্রথমে অবাক হলেও পরে বললো

“ওহ তুমি এজন্য রাগ করেছো।আমি ভাবলাম কি না কি।আরে ওটাতো আমার বিয়ের আগে ছিলো।এখনতো আর নেই।আর এতো সুন্দরী বউ রেখে আমি অন্য কারো কাছে কেনো যাবো।আমি এখন আমার বউকে ভালোবাসি।আর বাবার কথা বলছো,বাবাইতো আমাকে এসব কারণে বিয়ে দিলো যাতে আমি এগুলো ত্যাগ করি।আচ্ছা এই তোমাকে কথা দিচ্ছি তুমি ব্যতিত আর কোনো মেয়েকে আমি ছোঁবোনা।”

সৃজার মনে হলো তাকে ভোলানোর জন্য এগুলো বলা হচ্ছে।কিন্তু সৃজার মনও চাইছিলো সাফওয়ান এরকম কিছু বলুক। পরে আবার ভাবলো সে হয়তো সত্যিই এসব ত্যাগ করছে।ভাবনাটাকে প্রশ্রয় দিয়ে সৃজা ঠান্ডা হলো।এবং বিছানার এক কোণে ধপ করে বসে পরলো।

আর সাফওয়ানও পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরলো।চুলে ঠোঁট ছুইয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো

“তুমি আমাকে ঠিক থাকতে সাহায্য করবে সৃজা।তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী।আমার প্রথম ভালোবাসা এবং শেষ ভালোবাসা তুমিই হবে।আগে যেসব নারীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল তা ছিল শরীরী কিন্তু তোমার সাথে হবে আমার আত্মার সম্পর্ক। “অনুনয়ের ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সৃজাকে।

সাফওয়ান ঘুমিয়ে পরলেও তার বুকে মাথা রেখে সৃজা ঠিকই জেগে আছে।ঘুমানোর আগ পর্যন্ত ওকে জোর করে নিজের বাহুবন্ধনে আটকে রেখেছে সাফওয়ান।সৃজাও আর ছোটার চেষ্টা করেনি।সাফওয়ানের কথাগুলো তার মনটাকে অনেকটাই শান্ত করেছে।সে ও তো সাফওয়ানের আত্মা ছুঁতে চায় শরীর নয়।তার ভাবনাগুলো এলোমেলো।তবে এবার সে স্থির করলো সৃষ্টিকর্তা তার ভাগ্যে যা রেখেছে তা-ই হবে।ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিলো।ভোরের দিকে সেও ঘুমিয়ে গেলো।

সকালে সৃজা সাফওয়ানের আগেই উঠলো।গোসল করে নিজের লাগেজ থেকে শাড়ীগুলো বের করে কাবার্ডে রাখলো।বারান্দায় দাড়িয়ে ভোরের সূর্যের দিকে তাকিয়ে কতক্ষন রাতের কথাগুলো ভাবলো।এক নতুন আশা নিয়ে জীবন শুরু করার প্রত্যয় উকি দিলো মনে।

তারপর সাফওয়ানকে ডাকলো।ঘুম ঘুম চোখে তার স্নিগ্ধ বউকে দেখে আদর করতে ইচ্ছে হলো।ইচ্ছেটাকে প্রশ্রয় দিয়ে সৃজার কোমর আকরে নিজের উপর ফেললো তাকে।সৃজা অবাক হলো।নিজেকে সংযত করে বললো উঠুন অফিসে যাবেন না??

“না” ম্যানেজারকে সব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।এক সপ্তাহ আমি অফিস যাবোনা।গতকাল না গেলেই নয় তাই গিয়েছিলাম।সাফওয়ানের গভীর দৃষ্টি দেখেই সৃজা বুঝলো আজ তাকে আরেকবার গোসল করতে হবে।

সাফওয়ানের জন্য কফি বানাতে রান্নাঘরে প্রথমবার পা রাখলো সৃজা।রান্নার জন্য আলাদা লোক আছে তাদের।সে বাধা দিলেও নিজ হাতেই কফি বানালো সৃজা।রুমে এসে দেখলো সাফওয়ান রেডি হচ্ছে।সৃজাকে দেখে বললো

“একটু জরুরী প্রয়োজন আছে।ছুটি নিলেও না গেলেই নয় তাই যাচ্ছি।নিজের খেয়াল রেখো।”সৃজার কপালে ঠোঁট ছুইয়ে বেরিয়ে গেলো।এই প্রথম সাফওয়ান ওর কপালে চুমু দিলো।কপালে হাত দিয়ে অজান্তেই মুখে হাসি খেলে গেলো।

একটু পরই একজন কাজের লোক এসে বললো

“বড় মেম আপনাকে ডাকছে।”

শাশুড়ীমার রুমে নক করলাম।উনি হাসিমুখে আমাকে রুমে ঢুকতে বললো।বিয়ের পর এই প্রথম ওনার মুখে হাসি দেখলাম।হয়তো কোনো কারণে খুব খুশি উনি।ওনার রুমটা খুবই সুন্দর করে গোছানো।ঘরের আসবাবপত্র দেখেই বোঝা যায় উনি খুবই সৌখিন।তার কথা,ব্যবহার,ব্যবহার্য জিনিস সবকিছুতেই আভিজাত্যের ছাঁপ রয়েছে।আমাকে বসতে বললেন তার পাশে।বসার সাথে সাথে উনি আমার হাতের স্বর্ণের মোটা বালা দুটো খুলে দুটো চীকন হীরের বালা পরিয়ে দিলেন।

“বাহ!সুন্দর মানিয়েছে।তারপর আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললেন আমার ঘরের লক্ষ্মী হয়ে এসেছো তুমি।কদিন পরতো এ সংসার তোমাকেই সামলাতে হবে।সাফিকে এভাবেই সামলে রাখবে।আমার ছেলেটা অনেক পছন্দ করেছে তোমাকে।ওর কথামতো চলবে।তাহলে সব পাবে।পুরুষ মানুষকে হাতে রাখতে সব করা উচিৎ মেয়েদের।শাশুড়ী হয়ে এসব বলছি কারণ…

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here