সৃজা” পর্ব – ৮

0
1507

#সৃজা
পর্বঃ৮
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী

আজও স্যার একই শার্ট পরে এলেন।আচ্ছা স্যারের কি আর কোনো জামা নেই?অথবা স্যারের কি এই রংটা অনেক বেশি পছন্দ।সৃজার মনের প্রশ্নগুলো মনেই রইলো।

স্যার পড়ানো শুরু করার আগেই বললাম আজকে গল্প করবো।ওনার বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানবো।স্যার কিছুক্ষণ তার বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বলে আবার পড়ানো শুরু করলেন।আমার সন্দেহ হচ্ছে।হয়তো সাফওয়ান কিছু বলেছে স্যারকে।

 

সারাদিন পড়াশোনা করে কেটে যায় আমার।আমি এ বাসার বউ হলেও পড়া ছাড়া আর কোনো কাজই নিজেকে করতে হয় না।অথচ পাড়া-প্রতিবেশিদের কাছে কত শুনেছি পড়াশোনা করে কি হবে শেষে তো চুলোই ঠেলতে হবে।প্রাচীন মানুষগুলোর ধারণার পরিবর্তন হয়না অথচ সময় এবং ব্যবহারের ঠিকই পরিবর্তন হয়।

বিকেলের দিকে কল এলো সাফওয়ানের।খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে বললো

 

” বাসায় আজ প্রেস-মিডিয়ার লোক আসবে। তুমি ভয় পাবেনা।আর আমার উপর বিশ্বাস রেখো।তোমার হাজবেন্ড কখনো ভুল কাজ করেনি আর করবেও না।কিন্তু আপাতত আমাকে পরিস্থিতি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত দেশের বাইরে যেতে হবে।প্লিজ সোনা রাগ করো না।আমি খুব শীগ্রই চলে আসবো।কোন শা….ত আমার পেছনে লেগেছে তাও দেখে ছাড়বো।”

উনি এতো বিশ্রী বকাগুলো কেনো দেয়।উনি কি জানেনা আমি এসব সহ্য করতে পারি না।এখন এটা বাদ দিয়ে আমার মনে চিন্তারা ভর করলো।তাকে বললাম

“আপনি কোথায় যাবেন আর কেনো যাবেন?আমার কিন্তু ভয় করছে।প্লিজ আমাকে সত্যিটা বলুন সাফওয়ান।”

এই প্রথম সৃজা তার স্বামীর নাম ধরে ডাকলো।সাফওয়ান অবাক হলেও বিস্ময় কাটিয়ে তাকে বললো পাঁচ মিনিট পর পেছনের দরজায় দাড়াতে তাকে আর আম্মাকে।

সে তখনই গেলো শাশুড়ীর কাছে জানতে কি হয়েছে কিন্তু উনি বললেন আগে তোমার স্বামীর নিরাপত্তা জরুরি তারপর বলছি।সাফওয়ান দশ মিনিটের মাথায় আসলো।তার পুরে শরীর কালো পোশাকে ঢাকা আর মাথায় ক্যাপ কিন্তু কেনো।তাকে দেখে সেখাইনেই আমার কান্না পেয়ে গেলো।আম্মার কাছে বিদেয় নেয়ার পর আম্মা আমাদের একা ছেড়ে গেলেন।সাফওয়ান তার দুহাতের আজলায় আমার মুখটা তুলে চোখের পানি মুছে দিলো।বললো

“এই সৃ কেঁদো না।তোমাকে আম্মার মতো শক্ত হতে হবে।তুমি না বাঘিনী। আমার কিচ্ছু হবেনা।ফ্যাক্টরিতে একটা ঝামেলা হয়েছে তাই আসল অপরাধী ধরা না পরা পর্যন্ত আমাকে বাইরে থাকতে হবে।নিজের খেয়াল রাখবে।আর পড়াশোনা বেশি করে করবে একদিন কারণ আমি আসার পর তুমি পড়ার সময় কম পাবে।”

………………….

“আমি সবসময়ই তোমার সাথে যোগাযোগ করবো প্রমিজ।”বলেই সৃজার চোঁখে,ঠোঁটে,মুখে ঠোঁট ছোঁয়ালো।সৃজা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।এরপর দৌড়ে গিয়ে বারান্দায় দাড়ালো গাড়িটা চলতে শুরু করেছে যতদূর দেখা যায় ততক্ষণ এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো।

সৃজার ধ্যান ভাঙলো চেঁচামেচির শব্দে।ও দৌড়ে বাইরে আসলো।গেটের বাইরে সাংবাদিকরা ঢোকার চেষ্টা করছে।আর অনেকেই ক্যামেরা অন করে কথা বলছে।সৃজার শাশুড়ী সদর দরজা লাগিয়ে দেয়ার অনুমতি দিলো আর সাংবাদিকদের ভিতরে ঢুকতে না দেয়ার অর্ডার করলো দারোয়ানদের।

সৃজা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার শাশুড়ীর দিকে তাকালো।তিনি চোখের ইশারায় সোফায় বসতে বলে টিভি ছাড়লো।টিভিতে প্রচার হচ্ছে “চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির তৈরিকৃত পণ্য জুস খেয়ে শতাধিক ছাত্র অসুস্থ হয়ে পরেছে।৩জন ছাত্র ইতিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে।পুরো হাসপাতাল জুড়ে স্বজনদের হাহাকার।এই কোম্পানির বর্তমান এমডি সাফওয়ান চৌধুরী এই ব্যাপারে এখনো কিছু বলেনি।তাকে গ্রেপ্তার করার পরোয়ানা জারী হয়েছে।….

আর শুনতে পারলোনা সৃজা তার মাথাটা হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সে তার শাশুড়ীর কোলে ঢলে পরলো।

জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে তার রুমে আবিষ্কার করলো সৃজা।তার পাশে একজন সার্ভেন্ট বসেছিলো।সে এসে বললো

“ম্যাম এখন কেমন লাগছে।”

সৃজা তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তারপর ঘড়ি দেখলো, ১০টা বাজে।সার্ভেন্ট আবারো বললো

“ম্যাম, বড় ম্যাম আপনাকে কিছু খেয়ে নিতে বলেছে।ডিনার করার পর ওনার সাথে দেখা করতে বলেছে।”

“আম্মা এখন কোথায়?আর বাইরে যারা ছিলো তারা কি চলে গেছে।”

“ম্যাম প্রথমে তারা যেতে চায়নি বড় স্যারের সাথে পুলিশ আসার পর কিসব আলোচনা হলো পরে অনেকেই চলে গেছে।তবে কিছু রিপোর্টার বাইরে অপেক্ষা করছে এখনো।”

“পুলিশ এসেছিলো!!” আম্মার কাছে যাওয়া দরকার আমার সবটা জানতে হবে।নিজেকে সামলে সার্ভেন্টের কথা অগ্রাহ্য করে আমি আম্মার রুমের দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু উনি ড্রইংরুমে আছেন সাথে আমার শ্বশুর এবং সানিয়া বুবু।আমি তাদের দিকেই পা বাড়ালাম।

আমাকে দেখে শাশুড়ীমা উঠে এলেন।বললেন

“এখন কেমন লাগছে?”

আমি সরাসরি শ্বশুর আব্বার কাছে গেলাম।তাকে বললাম

“আব্বা বেয়াদবি নিবেন না।আমাকে সত্যি করে বলবেন এই ঘটনার জন্য দায়ী কে?আমি জানতে চাই।প্লিজ আব্বা বলুন।নাহলে আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে।”

সৃজার শ্বশুরকে দেখে মনে হলো তিনি অবাক হননি।সৃজাকে তার পাশে বসতে বললো।সৃজা তাই করলো।তিনি বললেন

“এখানে সাফওয়ান চৌধুরীর কোনো দোষ নেই।আপাতত এটা জেনে রাখো, বাকিটা তোমার আম্মার থেকে শুনে নিবে।এই বাড়ির বউ হিসেবে তোমাকে আরো শক্ত হতে হবে।যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নিতে হবে।আমি বেঁচে থাকতে তোমার স্বামীর কিছু হবে না। মনে রাখবে।” সৃজার মাথায় তার হাতটা ছুঁইয়ে গম্ভীর পায়ে উপরে চলে গেলেন।

সানিয়া চৌধুরীও সৃজার দিকে একবার মায়ার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলো।যাওয়া আগে বললো

“আর যাই মনে করো না কেনো এটা মনে রাখবে সানিয়া চৌধুরীর ভাই অপরাধী না।”

সৃজা তার শাশুড়ীর কাছে গেলো।করুণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো

“আম্মা আপনার ছেলে অপরাধী না হয়েও কেনো অপরাধীর মতো দেশ ছেড়ে পালালো।”

“সৃজা এভাবে কেনো বলছো।তার নিরাপত্তা জরুরি ছিলো।যেসব বাচ্চা মারা গেছে তাদের অভিভাবকদের কাছে চৌধুরী গ্রুপের এমডি অর্থাৎ সাফী অপরাধী। তাই আসল অপরাধী ধরার পূর্বে তারা সাফীকে গ্রেফতার করে রাখবে।পুলিশ গ্রেফতার করলেও তাকে জনগনের রোষে পরতে হতে পারে।আমার ছেলে এতো কষ্ট কেনো ভোগ করবে।তাই আপাতত সে বাইরে থাকবে।পুলিশের সাথে এখানে আমরা কোওপারেট করবো।”

“আসল অপরাধী কে আম্মা?”

৷ “শুনো সৃজা এই দেশে অনেক কোম্পানি আছে যারা চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রিকে টপকাতে চায়।তাই আপাতত জেনে রাখো তাদেরই কারো ঘৃণ্য কাজ এটা।”

…………………

“তুমি চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে।পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। সাফওয়ান খুব শীগ্রই এসে পরবে।আর ও এসে যদি জানতে পারে তুমি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছোনা,পড়াশোনায় মনোযোগ দিচ্ছো না তাহলে অনেক মন খারাপ করবে।আমাকে ফোন দিয়ে বারবার বলেছে

“মম সৃজাকে কঠিন দেখা গেলেও ও কিন্তু মন থেকে অনেক নরম ওর সবকিছু তুমি পার্সোনালি খেয়াল রাখবে।আর নিজেরও খেয়াল রাখবে।”

৷ রুমে আসলাম ঠিকই কিন্তু এখন আমার এটাকে দমবন্ধ লাগছে।এই রুমে যার বেশি আধিপত্য সেই তো নেই।এই দিনগুলো কিভাবে কাটাবো আমি।সাফওয়ানের কথা মনে পরছে অনেক।খাটের পাশে এক কোণায় হাটু গেড়ে বসে পরলো সৃজা।সেখানেই সে ঘুমিয়ে পরলো।

সকালে সূর্য তীর্যক ভাবে কীরণ দেয়ায় তার আলোয় সৃজার ঘুম ভেঙে গেলো..

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here