ভোরের_আলো পর্ব-২১

0
985

#ভোরের_আলো
২১.

আশফাকের সাথে শপিংয়ে এসেছে অর্পিতা। কেনাকাটার ভূত মাথায় চেপেছে ওর। অর্পিতার সাথে মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে আশফাক বিরক্ত। ভাগ্যিস শীতকাল! নয়তো গরমের মধ্যে নিউমার্কেট আর চাঁদনীচকে ঘুরলে বোধহয় এতক্ষণে অসুস্থ হয়ে যেতো৷ সব কেনাকাটা শেষ৷ জামার সাথে মিলিয়ে দুটো ওড়না কেনা বাকি। এই দুটো ওড়নার জন্য সাতটা দোকান ঘুরা হয়ে গেছে৷ জামার সাথে কালার ম্যাচ হয় তো কাজ পছন্দ হয় না, কাজ পছন্দ হয় তো কালার ম্যাচ হয় না। এত্ত ম্যাচিং ম্যাচিং-এর কি আছে ভেবে পায় না আশফাক। সব মিলিয়ে কি পাওয়া যায় নাকি? কালার তো একেবারে হুবহু মিলিয়ে পাওয়া যাবে না। একটু তো গড়মিল থাকবেই। আজব ব্যাপার-স্যাপার। সেই কখন থেকে একগাদা শপিংব্যাগ হাতে নিয়ে অর্পিতার পিছন পিছন হাঁটছে। শীতের মধ্যেও হালকা ঘামছে সে। কোন দুঃখে যে এই মেয়ের সাথে আসতে গেলো? নকল বিয়ে হওয়ার পর থেকে বিগত পনেরোদিন যাবৎ নিজেকে ছাগল মনে হচ্ছে আশফাকের। অর্পিতা যেটা বলে একান্ত বাধ্য হয়ে সেটাই শুনে। ওর মুখ থেকে বের হওয়া প্রতিটা কথা যেনো মায়ামন্ত্রের মতন লাগে। অদ্ভুত একটা টান কাজ করে মেয়েটার প্রতি। ওর কোনো আবদারই ফেলতে পারে না। ওর প্রতি আলাদা একটা অধিকার আর দায়িত্ববোধ জাগে। মনে হয় যেনো অর্পিতার সমস্ত কিছুর উপর একমাত্র ওরই অধিকার আছে। এইতো গত পরশুদিনের ঘটনা, রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছিলো ওরা দুজন। পাশের টেবিলে বসা ছেলেটা বারবার অর্পিতার দিকে তাকাচ্ছিলো। গা জ্বলে যাচ্ছিলো আশফাকের। সহ্য হচ্ছিলো না৷ একদম না। খাওয়া শেষ না করেই সেখান থেকে অর্পিতাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো আশফাক। বের হয়েই ভ্রুঁ কুঁচকে অর্পিতাকে বললো,
– লাল জামা পড়ে কক্ষনো বাহিরে বের হবা না।
-কেনো?
– তোমাকে অস্বাভাবিক সুন্দর দেখায়। লোকজনের নজরে পড়ে যাও। এসব আমার ভালো লাগে না।
– হিংসে হয় আশফি?
– জানি না আমি।

আশফাকের উত্তরে খুব হেসেছিলো অর্পিতা। মাথা নিচু করে সেই হাসির শব্দ শুনেছে সে।

অর্পিতা….. আশফাকের জীবনে একটি গোলকধাঁধার নাম। মেয়েটা এমন একজন মানুষ যাকে নিজের সবটা বিলীন করে দিয়ে ভালোবাসা যায়। যার দিকে তাকিয়ে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হওয়া যায়৷ যার স্পর্শে মাতাল হওয়া যায়। তার কোলে মাথা রাখলে শত দুশ্চিন্তায়ও স্বস্তি পাওয়া যায়। চোখ বন্ধ করে তার হাত ধরে সারাটাজীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। সমস্ত হিসেবের মিল পেলেও অর্পিতা নামক গোলকধাঁধার অন্তিম হিসাবটুকু মিলাতে পারেনা আশফাক৷ তালগোল পেঁকে যায়। বহুবার চেয়েছে অর্পিতাকে সরাসরি সত্যিটা জিজ্ঞেস করবে, সেদিন অর্পিতা কার কথা বলছিলো? একটা ভাবনা বারবার আটকে দিয়েছে আশফাককে,

‘ যদি অর্পিতা সত্যিটা না বলে? যদি সে মিথ্যা কোনো গল্প শোনায়? তাহলে অহেতুক জিজ্ঞেস করে লাভটা কোথায়?’

অর্পিতার ডাকে ভাবনায় ছেঁদ পড়লো আশফাকের। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো একটা মেয়ে অর্পিতার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচন্ড উৎসুক নজরে আশফাকের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অর্পিতার বান্ধবী নিশি৷ নিশিকে আশফাক আগে থেকেই চিনে। তবে এই মেয়েটা আশফাকের অপরিচিত। পরিচয় পাবার আশায় অর্পিতার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো সে।

– এটা সুমি আপু। নিশির বড় বোন। আর আপু এটা আশফাক। নিশি তোমাকে বলেছে তো ওর কথা তাইনা?
– হুম। তোর হাজবেন্ড। বিয়ের আগে আমাকে একটু তো বললিও না।
– বিয়ে তো করেছি লুকিয়ে৷
– লুকিয়ে হোক আর যেভাবেই হোক, থাকতাম তোর সামনে। দেখতাম কিভাবে বিয়ে হয়৷ নিজের তো আর হলো না৷ ছোটবোনদের বিয়ে দেখে মন খুশি করি।
– আপু বাদ দাও না সেসব। চলো কোথাও বসি। একসাথে কিছুক্ষন আড্ডা দেয়া যাবে।

খাবার দোকানে বসে খাবার খাচ্ছে ওরা চারজন। বেশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে চারজন মিলে। কথার একফাঁকে আরাফাতের প্রসঙ্গ টেনে আনলো সুমি।

– জানিস অর্পি, আরাফাত গতকাল ফোন করেছিলো৷ মাফ চাচ্ছিলো খুব। কাঁদছিলোও। আমি কেমন যেনো হয়ে গেছি রে! যেই আরাফাতের একটু মন খারাপই আমার সহ্য হতো না সেই ছেলের চোখের পানি নির্দ্বিধায় হজম করে ফেলি। নূন্যতম টান ওর প্রতি কাজ করে না।

আরাফাত…… হ্যাঁ এই নামটাই তো শুনেছিলো সেদিন অর্পিতার মুখে৷ অর্পিতা যে ছেলেটাকে ঠকাচ্ছিলো তার নাম তো আরাফাতই ছিলো। কিন্তু সুমির সাথে আরাফাতের কি সম্পর্ক? এই মূহূর্ত্বে পুরো ব্যাপারটা খোলাসা হওয়া খুব জরুরী মনে হচ্ছে আশফাকের। এতদিনের পুরোনো জট খোলার একটা রাস্তা বোধহয় পাওয়া গেলো। এবার বুঝি হিসেবটা মিললো বলে!
একরাশ প্রশ্ন মনে নিয়ে সুমিকে জিজ্ঞেস করলো,

– আরাফাত আপনার কি হয়?
– সময় আছে তো শোনার?
– হুম, হুম আছে৷ আপনি বলুন।
– সে আমার প্রাক্তন। অতি প্রিয় প্রাক্তন যে আমাকে মিথ্যা নাটকের ঘুটঘুটে অন্ধকারে রেখে দিয়েছিলো বহুদিন। আমিও অন্ধকারকে ভালোবেসে ওর মাঝে ডুবে রয়েছি দিনের পর দিন। জানেন আশফাক ভাই, আপনি একটা পরীকে বিয়ে করেছেন৷ আলো ছড়ানো পরী৷ একদিন এই পরীটা এলো, আমার অন্ধকার জগতে আলো ছড়িয়ে দিলো। সেই আলোতেই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা চোখে ধরা পড়েছিলো। যাকে প্রেমিক ভেবেছিলাম সে তো প্রেমিক না। সে আসলে পিশাচ।
– বুঝলাম না৷ আরাফাতকে পিশাচ বললেন কেনো?
– ভাইয়া আজকে আমি উঠি। বাসায় আসার দাওয়াত রইলো। অবশ্যই আসবেন।

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলো সুমি। তার পিছন পিছন নিশিও খুব দ্রুত বেরিয়ে গেলো। মেজাজ খারাপ হচ্ছে আশফাকের। এটা কেমন ফাজলামি? পুরো ঘটনা ক্লিয়ার না করেই উঠে পড়লো। বাকি কাহীনি শোনার জন্য অস্থিরতা বাড়ছে। না শোনার আগ পর্যন্ত অস্থিরতা কোনোভাবেই কমবে না।

– অর্পি….
– হুম।
– উনি চলে গেলো কেনো?
– আপু তিন চার মাস যাবৎ অসুস্থ। হুটহাট মাথায় যন্ত্রণা হয়৷ হতে পারে শরীর খারাপ লাগছে।
– কাহীনি তো ক্লিয়ার না করেই চলে গেলো। তুমি এখন বাকিটা শোনাবে।
– বাদ দাও তো৷ তুমি শুনে কি করবে?
– কি করবো মানে? বললে তোমার অসুবিধা কোথায়?
– কি আশ্চর্য! তুমি ক্ষেপে যাচ্ছো কেনো?
– বাকি কাহীনি শোনাবে কিনা বলো?
– হ্যাঁ, শোনাচ্ছি তো। তুমি ঠান্ডা হও। হুটহাট যে কি হয় তোমার৷ কিচ্ছু বুঝি না। কখন যে কোন কথায় রিএ্যাক্ট করে বসো!
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here