ভোরের_আলো পর্ব-৫৬

0
1071

#ভোরের_আলো
৫৬.

বহুদিন হলো আশফাকের কন্ঠস্বরটা শুনে মাতাল হওয়া হয় না। কথার ফাঁকে মুগ্ধ হয়ে মানুষটার মুচকি বাঁকা হাসিটুকুও দেখা হয় না। গল্পের মাঝে এক চুমুক করে পানি খাওয়ার দৃশ্যটুকুও মন দিয়ে দেখা হয়না বহুদিন হলো। তাকে ঘিরে সমস্ত প্রিয় মূহূর্ত্বগুলোকে আবার উপভোগ করার নেশা চেপে যাচ্ছে ক্রমশ৷ হাত পা জোড়া ঠান্ডা হয়ে আসছে খুব বেশি। তার উষ্ণতাটুকুও গায়ে মাখেনি প্রায় দুমাস হয়ে যাচ্ছে। মানুষটা বড্ড ভালোবাসার ছিলো। আসলে ছিল বলাটা ঠিক হবে কিনা তা বুঝে পাচ্ছে না অর্পিতা৷ ভালোবাসা বোধ হয় আজও রয়ে গেছে। নয়তো মানুষটার শূন্যতা আজ এত কেনো ভোগাচ্ছে তাকে? গায়ের চাদরটুকু দিয়ে শরীরটা আরেকটু ভালো করে ঢেকে নিলো সে৷ নেশাটাকে আর সংবরন করা যাচ্ছে না৷ মানুষটাকে তার চাই৷ এক্ষুনি চাই৷ দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে এলো অর্পিতা। বেডরুমে এসে বালিশের নিচে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে আশফাকের নাম্বারে ডায়াল করলো। একবার রিং হতেই কলটা রিসিভ করলো আশফাক।

– হ্যালো অর্পি…..
– ঘুমাওনি তুমি?
– উহুম।
– একটা কথা বলার ছিলো।
– কি কথা?
– একটু বাসায় আসবে?
– পেছনের গেইটটা খুলো।
– এখনই কেনো খুলবো? আগে আসো। এসে আমাকে ফোন দাও।
– আমি তোমার বাসার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছি।
– বলো কি! আচ্ছা দাঁড়াও। আসছি আমি।

ডাইনিংরুমে গিয়ে ফ্রিজের উপর থেকে চাবির গোছাটা নিয়ে, পেছনের দরজা খোলার উদ্দেশ্যে বাড়ির বাহিরে বেরিয়ে এলো অর্পিতা। দরজা খুলে আশফাকের মুখোমুখি হতেই অর্পিতা জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি এতো রাতে এখানে কি করছিলে?
– ভিতরে যেয়ে কথা বলি?
– হ্যাঁ,,,, হ্যাঁ আসো।

অর্পিতার ঘরে মুক্তা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। অহেতুক ওকে ডেকে তোলার চেয়ে মুক্তার ঘরে বসে কথা বলাটাই শ্রেয় মনে হলো অর্পিতার৷ বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে আশফাককে বললো,

– শুনো, মুক্তার ঘরে চলো।
– কেনো?
– ও আমার ঘরে ঘুমাচ্ছে। শুধুশুধু ওকে ডেকে লাভ কি বলো?
– হুম সেটাই। ওকে ডেকে লাভ নেই। চলো, ওর ঘরেই চলো।

মুক্তার ঘরে এসে দরজাটা আটকে বিছানায় এসে বসলো অর্পিতা। বেশ খানিকটা দূরেই বসে আছে আশফাক। তার চোখের দিকে তাকিয়ে একান্তে কথা বলতে বেশ অস্বস্তি লাগছে অর্পিতার। যার চোখে চোখ রেখে কথা বলা প্রিয় কাজ ছিলো সেটা করতেই আজ অস্বস্তি হচ্ছে! ভাবতেই হাসি পাচ্ছে অর্পিতার। সম্পর্কে বেশ দূরত্ব চলে এসেছে। তাই হয়তো এতটা অস্বস্তি হচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে অর্পিতা বললো,

– বললে না তো এতরাতে এখানে কি করছিলে?
– বাসায় ভালো লাগছিলো না। অস্থির লাগছিলো। তোমাকে সামনে বসিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো খুব। তাই এসেছিলাম আরকি। কিন্তু তোমাকে ফোন করে বলার সাহস পাচ্ছিলাম না গেটটা একটু খুলো। তাই গেটের বাইরে ঘুরঘুর করছিলাম।
– পেছনের গেট দিয়ে আসার দরকারটা কি ছিলো? সামনের গেট দিয়ে আসলেই তো পারতে।
– আমার পেছনের দিকটা দিয়ে আসতেই ভালো লাগে।

আশফাকের কথায় হেসে ফেললো অর্পিতা। বললো,

– এটা কি বললে তুমি?

নিরুত্তর আশফাক তাকিয়ে আছে অর্পিতার দিকে। মেয়েটার গলার স্বরে আজ কোনো তিক্ততা বা অভিমান পাওয়া যাচ্ছে না৷ আজ কতগুলো দিন পর মনে হচ্ছে মেয়েটা স্বাভাবিক কথা বলছে। একটু হেসেছে। মেয়েটার হাসি দেখে তার ঠোঁটের কোনেও বাঁকা হাসিটা একটু আধটু বুঝা যাচ্ছে। আড়চোখে আশফাকের তাকিয়ে থাকাটুকু লক্ষ্য করছে অর্পিতা৷ মূহূর্ত্বেই হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলে,

– এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?
– কতদিন পর একটু হাসছো। আমি দেখবো না?
– ভালো লাগে আমার হাসি?
– ভীষন।
– তাহলে আমাকে কাঁদিয়ে কি সুখ পেলে?
– কে বলেছে সুখ পেয়েছি?
– পাওনি?
– তোমার চেয়ে বেশি কষ্ট আমি পেয়েছি। তুমি শুধু আমার প্রতারনার কষ্টটুকু পেয়েছো। আর আমি তোমাকে হারানোর কষ্ট তো পেয়েছিই, অনুশোচনার আগুনেও জ্বলেছি। অর্পিতা তুমি আমার কি হও তা তুমি জানো না৷ বুঝো না। কখনো বুঝাতে পারবোও না৷ সেই তুমি দূরে চলে গিয়েছো৷ বেঁচে থাকাটাই তো আজকাল কষ্টের হয়ে গিয়েছে।
– আমার হাতটা একটু ধরবে?

খানিকটা এগিয়ে এসে অর্পিতার ডান হাতটা দুহাতের মুঠোয় নিয়ে নিজের গালের সাথে মিশালো আশফাক। ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। চোখের পানিতে অর্পিতার হাত ভিজে যাচ্ছে।

– কখনো আমাকে আপন ভাবোনি তাই না?
-………..
– নিজের জীবনের এতবড় সত্যিটা এভাবে চেপে গেলে আমার কাছ থেকে? কখনো কি একটুখানি জায়গাও আমি তোমার মনে করতে পারিনি? কখনো কি একবারের জন্যও তোমার মনে হয়নি অর্পিতা কথাগুলো শোনার উপযুক্ত। ওকে কথাগুলো বলা যেতে পারে?
– এভাবে বলছো কেনো?
– আ’ম শকড আশফাক। রিয়েলি শকড। এতটা ভয়ংকর গল্প একটা মানুষ নিজরে মাঝো লুকিয়ে রেখে ভালো থাকার নাটক কিভাবে করতে পারে?
– নাটক করে পার পেলাম কোথায়। ধরা তো ঠিকই পড়েছি তোমার কাছে।
– হ্যাঁ মাঝেমধ্যে তোমার চেহারা দেখে সন্দেহ আমার হতো। কিন্তু তুমি তো কখনো আমাকে বলোনি৷ বরাবরই অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছো।
– জানো, আমার চেহারা পড়ার ক্ষমতা কারো নেই শুধু তুমি ছাড়া।
– ভালোবাসতাম তোমাকে। চেহারা পড়তে পারাটা কি খুব বড় কিছু?
– এখন আর বাসো না তাই না?
-…………….
– আমি কি করলে আবার তুমি আমাকে ভালোবাসবে?
-………………
– শোনো, আর কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। বাবা মা দুজনই আমার সাথে প্রতারনা করেছে। রাত্রি আমাকে অনেকগুলো স্বপ্ন দেখিয়েছিলো৷ আমি ওর হাতটা ধরে একটু বাঁচতে চেয়েছিলাম। ও সমস্ত স্বপ্নগুলোকে শেষ করে আমার হাতটা ছেড়ে চলে গেলো। স্বপ্নছাড়া মানুষ আর মৃত মানুষের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে? নেই৷ আমাকে ওরা সবাই মিলে একটু একটু করে মেরে ফেলেছে অর্পিতা৷ বিশ্বাস করো, তোমাকে আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি। কিভাবে বুঝতাম বলো? ঐ মেয়েটা আমার সব অনুভূতিগুলো মাটিচাপা দিয়ে গিয়েছে। কারো অনুভূতি বুঝার মত অবস্থা এতগুলো বছর আমার ছিলো না। তোমাকে বুঝতে পারিনি আমি। পারলে কখনোই তোমার সাথে এমনটা করতাম না।
-…………..
– এ্যাই অর্পি, আমার কথাগুলো বিশ্বাস কেনো করছো না? বিশ্বাস করো।
– আমি কি আদৌ কখনো তোমার ভালোবাসা ছিলাম?
– ছিলে। অবশ্যই ছিলে। তুমি না আমার চেহারা দেখলে সব বুঝে ফেলো? এখন কেনো বুঝো না তুমি?
– আমি তোমার ভালোবাসা না। আমি তোমার অনুশোচনা। তোমার ভালোবাসা রাত্রি। এখনও তুমি ওকে ভালোবাসো। নয়তো আমার সম্পর্কে সব সত্যি জানার পর তুমি আমাকে ফেলে ওকে কাছে টানতে না। তুমি আমাকেই আগলে রাখার চেষ্টা করতে। তুমি আমার মাঝে তোমার মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাও। গভীর অনুশোচনা হয় তোমার। সেটাকে তুমি ভুল করে ভালোবাসার নাম দিচ্ছো।
– ঐ মেয়েকে আমি ভালোবাসি না অর্পিতা। সব তোমার ভুল ধারনা।
– ভালোবাসা ছাড়া অন্য কারো শরীরের ঘ্রানে কি ডুব দেয়া সম্ভব? তুমি কিভাবে ডুবে ছিলে তা তো আমি নিজেই দেখে এসেছি।

যথেষ্ট ঠান্ডা কন্ঠে আশফাককে কথাগুলো বলছে অর্পিতা। কথাগুলো ও চেঁচিয়ে বললে এতটা গায়ে বিঁধে না আশফাকের আজ যতটা না বিঁধছে। চোখের পানি আজ কোনোমতেই বাঁধ মানছে না৷ মাথা নিচু করে আশফাক বললো,

– আমি নিজেও বুঝি না এটা আমি কি করলাম? কেনো করলাম?

সামনের মানুষটাকে এভাবে আর কাঁদতে দেখতে ভালো লাগছে না অর্পিতার। মানুষটার কান্না দেখার জন্য এখানে ওকে নিয়ে আসেনি৷ নিয়ে এসেছিলো মানুষটার মুখের বাঁকা হাসিটা একটু দেখার জন্য। কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেললো নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না৷ সেদিন সকালে যা কিছু চোখের সামনে দেখেছিলো সে প্রসঙ্গে কথা বলার নূন্যতম চিন্তাও ছিলো না। তবুও,,,,,, ,
কথার প্রসঙ্গ খুব দ্রুত পাল্টে ফেললো অর্পিতা। বললো,

– আমাকে গল্প শোনাবে তুমি?
-……………..
– শুনতে পাচ্ছো? শুনাবে না?
– কিসের গল্প?
– তোমার।
– খালাম্মা তো বললোই।
– তোমার অনুভূতিটুকু তো উনি বলেননি।
– এসব শুনে লাভ কি?
– এমনি শুনবো। একজনকে ভালোবাসতাম তো। বরাবরই তার সুখের ভাগীদার ছিলাম। কষ্টের ভাগটুকু সে কখনো আমাকে নিতেই দেয়নি। আজ ইচ্ছে হচ্ছে সেই ভাগটুকু নিতে। তুমি বলো, আমি শুনবো।

চোখজোড়া বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশফাক। পুরোনো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ছুটোছুটি করছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here