ভোরের_আলো পর্ব-৫৫

0
815

#ভোরের_আলো
৫৫.

বিছানায় শুয়ে আছে অর্পিতা। পাশেই শুয়ে আছে মুক্তা। বাহিরে প্রচুর ঠান্ডা। তবুও অর্পিতা জানালার একটা অংশ খুলে রেখেছে। বদ্ধ ঘরে শুয়ে থাকতে প্রচুর অস্বস্তি লাগছিলো। তাই জানালাটা খুলে দিয়েছে। ঘরটাতে কনকনে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে, তবুও একপ্রকার শান্তি লাগছে অর্পিতার। বিছানায় শুয়ে আকাশটা স্পষ্ট দেখা যায়। আকাশে আজ চাঁদ নেই। পুরো আকাশ জুড়ে শুধু তারা দেখা যাচ্ছে। একদম জোনাকি পোকার মত দেখাচ্ছে তারাগুলো। নিষ্পলক চোখে তারাদের দিকে তাকিয়ে আছে অর্পিতা। বারবার আশফাকের কথা মনে পড়ছে আজ। মানুষটা রাতের খাবার খেয়েই কৌশিকদের সাথে বেরিয়ে পড়েছে বাসার উদ্দেশ্যে। যাওয়ার আগে কানের কাছে ক্ষীনকন্ঠে বলে গিয়েছে,

– গেলাম। আগামীকাল ডক্টরটা অবশ্যই দেখিয়ে নিও। আমাকে নিয়ে যেতে ইচ্ছে না হলে অন্য কাওকে নিয়ে যেও। তবুও প্লিজ যেও।

মানুষটার কথা ভেবে আজও ঘৃণা হচ্ছে। তবে তুলনামূলক কম। ঘাটতি জায়গাটুকুতে আফসোস জায়গা করে নিয়েছে। বড্ড আফসোস হচ্ছে আজ স্বামীর জন্য। মানুষটার না পাওয়ার সংখ্যাটা খুব বেশি। স্বামীর অপ্রাপ্তিগুলো কি তার ভালোবাসায় মিটছিলো না? কোনো ঘাটতি রয়ে গিয়েছিলো কি? তার হিসেব মতে তো একদম নিখাঁদ ভালোবাসাটুকুই উজাড় করে দিয়েছিলো মানুষটাকে। তবে কেনো মানুষটা তার ভালোবাসা বুঝলো না? কেনো মনে হলো সবটাই মেয়েটার নাটক? আসল নকলের পার্থক্য করার ক্ষমতাটুকুও কি মানুষটার নেই? বেশ ভালোই তো যাচ্ছিলো প্রতিটাদিন! ঘুম ভাঙতো মানুষটার ফোনকল পেয়ে। চোখে ঘুমের নেশাটুকু মাখানো অবস্থাতে ফোনটা কানে নিতেই ওপাশ থেকে ভরাট কন্ঠে একটা কথা ভেসে আসতো প্রতিদিন,

– শুভ সকাল অর্পি। কফি হাতে বসে আছি। তোমার ঐ ঘুম জড়ানো কন্ঠে একবার “ভালোবাসি” কথাটা শুনবো এরপর কফির মগে চুমুক দিবো। জলদি বলো।

ব্যস,,,,, মূহূর্ত্বেই চোখ থেকে ঘুমের নেশাটুকু কেটে ভালোবাসার নেশা ভর করতো তীব্রভাবে। ঠোঁটের কোণের মুচকি হাসিটা দেখে যে কেউ বলে দিতে পারতো হাসিটাতে কতখানি আহ্লাদ জড়িয়ে আছে।

প্রতিদিনের সকালের শুরুটা ঠিক এভাবেই হতো। এরপর সারাদিনে কিছুক্ষণ পরপর টেক্সট আর কল তো চলতোই। সবশেষে চলতো রাত সাড়ে এগারোটা থেকে একটা পর্যন্ত কথা বলা। মানুষটার সব কথাতেই নেশা লাগতো। ভালোবাসি কথাতেও নেশা জাগতো, তোমাকে ধরে থাপ্পর লাগাবো কথাতেও নেশা জাগতো। ভালোবাসার কথাগুলো শোনার সময় চোখজোড়া বন্ধ করে রাখতো সে। মস্তিষ্কের সমস্ত মনোযোগ ঢেলে কথাগুলো শুনতো। ওপাশের একটা শব্দও বাদ পড়তো না সেই মনোযোগ থেকে। মানুষটার নিঃশ্বাসের শব্দ, ঘরের মধ্যে ঘুরতে থাকা ফ্যানের শব্দ, কথার ফাঁকে গ্লাসে পানি ঢালার শব্দ, সিগারেট মুখে নিয়ে লাইটার জ্বালানোর মূহুর্ত্বে কথা বলার মাঝে জড়ো ভাবটুকু,,,,, ফোনের ওপাশের কোনো কিছু বাদ যেতো না তার খেয়াল থেকে। চোখ বন্ধ করে সমস্ত কিছু অনুভব করতো। সেই সাথে মানুষটাকেও,,,,,

রাতে ফোন কাঁটার আগ মূহূর্ত্বে আশফাক ছোট্ট করে বলতো, ” ভালোবাসি অর্পিতা।”
ছোট্ট ঐ কথাটার মাঝে সে এতটাই গভীরতা অনুভব করতো যেনো মানুষটা বুঝি ওকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ক্ষীণকন্ঠে কথাটা বলছে। কানের কাছে মানুষটার গরম নিঃশ্বাসটুকু অনুভব করতে পারছে। সপ্তাহে দু একদিন তো ঘুরতে যাওয়া হতোই। তার চুল এলোমেলো করে কাকের বাসা বানানো ছিলো মানুষটার প্রিয় কাজ। তার পাশে যেয়ে বসার কিছুক্ষণ পরই দুহাত দিয়ে এলোমেলো করে দিতো চুলগুলো। আবার খানিক বাদে নিজেই চুলে হাত বুলিয়ে ঠিক করে দিতো আর বলতো,

– বুঝলে অর্পিতা, তোমাকে এলোমেলো চুলেই বেশি মানায়। প্রচন্ড আদুরে লাগে দেখতে।

হালকা হেসে প্রতিবারই অর্পিতা জিজ্ঞেস করতো,
– তাহলে থাকুক এলোমেলো। চুল ঠিক করছো কেনো?
– ঠিক করি কে বললো? ঐ যে বললাম না আদুরে লাগে দেখতে। তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেই। আদর করতে করতে দেখি চুলগুলো আবার জায়গামতো চলে এসেছে। আমি তো ইচ্ছে করে ঠিক করি না।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আপন মনেই হেসে উঠলো অর্পিতা। পানির পিপাসা পেয়েছে সেই কখন৷ ভাত খাওয়ার পর আর পানি খাওয়া হয়নি। এতক্ষণ আলসেমি করে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে পানি খেতে ইচ্ছে হয়নি। কয়েক সেকেন্ড হলো ক্রমাগত হেঁচকি উঠছে। আর শুয়ে থাকা সম্ভব না। এখন উঠে পানি খেতেই হবে। লেপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো সে। ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসে খুব ধীর গতিতে পানি খাচ্ছে অর্পিতা। বেশ ক’দিন ধরে ছাদে যাওয়া হয়না। বিয়ের দুদিন আগে শেষ যাওয়া হয়েছিলো। এরপর আর যাওয়া হয়নি। ছাদে যাওয়া দরকার। ওয়্যারড্রব থেকে শাল বের করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে মোবাইলটা হাতে নিলো। ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে চলে এলো ছাদে। ছাদের দক্ষিণ দিকের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে অর্পিতা। এখন পর্যন্ত আশফাক যতবার মাঝরাতে ছাদে এসেছে অর্পিতার সাথে দেখা করতে ততবার ঠিক এখানটাতেই পাশাপাশি দুজনে রেলিংর উপর বসে সময় কাটিয়েছে। এখানটাতে বসে নিচুস্বরে কত গল্প করেছে দুজনে তার কোনো হিসেব নেই। মানুষটা প্রায়ই ফোনে কথা বলতে বলতে চলে আসতো এখানে। বাড়ির পিছনের ছোট গেইটটার সামনে দাঁড়িয়ে বলতো,

– গেইটটা খুলো তো। আমি দাঁড়িয়ে আছি।

শেষ এই ছাদে আশফাকের সাথে লুকিয়ে দেখা হয়েছিলো বিয়ের দুদিন পর। কথা শেষ করে রাত সোয়া একটার দিকে ঘুমিয়ে ছিলো অর্পিতা। ঠিক ২.২৩ মিনিটে আশফাক ফোন করে বললো সে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। কি জরুরি কথা নাকি আছে। সেজন্যই এত রাতে আসা৷ এতরাতে কিসের জরুরী কথা আছে সে কথা ভাবতে ভাবতে আশফাককে নিয়ে ছাদে এসেছিলো সে। চেহারা মোটামুটি কুঁচকে গিয়েছিলো দুশ্চিন্তায়। ছাদে উঠা মাত্রই দরজাটা আটকে আশফাককে জিজ্ঞেস করেছিলো,
– কি ব্যাপার আশফি?খুব সিরিয়াস কিছু?

প্রতিউত্তরে কোনো কিছু না বলেই অর্পিতার কোমড় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে গভীর চুমু এঁকে দিয়েছিলো আশফাক। অর্পিতার কানের পাশে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিতে দিতে বলেছিলো,

– এরচেয়ে জরুরী বিষয় আর কি হতে পারে?

আশফাকের কথায় নিঃশব্দে খুব হেসেছিলো অর্পিতা। আশফাকের প্রতিটা স্মৃতি আজকাল সুইয়ের মতো শরীরে বিঁধে। খুব কি প্রয়োজন ছিলো এমনটা করার? তার ভালোবাসার উষ্ণতায় কি এতটাই ঘাটতি ছিলো যে সে অনুভবই করতে পারলো না। সেদিনের ঘটনাটা না ঘটলে হয়তো গল্পটা আজ ভিন্ন হতো। তার প্রতি ভালোবাসা আগে যেমন ছিলো এখনও হয়তো ঠিক তেমনই থাকতো। তার জীবনে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয়া যেতো। হয়তোবা তার দুঃখগুলো শেষ হয়ে সুখ উঁকি দিতো। সেই সাথে কাননের এতবছরের প্রশ্ন দুটোর অবসান ঘটতো।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো অর্পিতা। ফোনের গ্যালারীতে এখনো আশফাকের সাথে তোলা দুটো ছবি রয়ে গিয়েছে। কয়েকবার ছবিগুলো ডিলিট করতে যেয়েও করা হয়নি৷ আগে অনেক ছবি ছিলো। অবসর সময়গুলোতে জুম করে আশফাকের চোখ নাক থুতনি খুঁটে খুঁটে দেখতো। সেদিনের পর থেকে আর দেখা হয়নি৷ ছবি দুটো দেখতে ইচ্ছে করছে খুব৷ মোবাইলের স্ক্রিন স্ক্রল করে গ্যালারি অপশনে আশফাকের ছবি খুঁজছে অর্পিতা। বহুদিন পর আজ আবার আশফাকের মুখটা খুঁটে খুঁটে দেখবে সে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here