ভোরের_আলো পর্ব-৫৪

0
877

#ভোরের_আলো
৫৪.

বিস্মিত চোখে রাজিয়ার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে অর্পিতা। দুই ঠোঁটের ভাঁজের মাঝে সামান্য ফাঁক দেখা যাচ্ছে। চেহারায় বিস্ময়ের পরিমানটুকু স্পষ্ট। বিস্ময়ের তাল সামলাতে পারছে না সে৷ মনে হচ্ছে যেনো পুরো শরীরটাই জমে যাচ্ছে। কানের মাঝে একটা কথা ঘন্টার মতন বেজে চলছে,

“গল্পটা আশফাকের। ”

অর্পিতার দিকে তাকিয়ে আছেন রাজিয়া৷ ওর চেহারার ভাব ভঙ্গি বুঝার চেষ্টা করছেন। আপাতত দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘোরে তলিয়ে যাচ্ছে৷ এতক্ষণ ধরে যে উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলেছেন, সে উদ্দেশ্যে এখন যাওয়া দরকার৷ অর্পিতার দিকে সামান্য ঝুঁকে বললেন,
– আশফাক এমনি এমনি কুলাঙ্গার হয়নি অর্পিতা৷ জন্ম থেকে কেও কুলাঙ্গার হয়ে পৃথিবীতে আসে না। প্রতিটা মানুষের নষ্ট হওয়ার পিছনে কোনো না কোনো ঘটনা থাকে। এই যে একটু আগে যখন শুনেছিলে গল্পের ছোট বাচ্চাটাকে ওর মামার বাড়ির লোকজন কুকুর বলেছে আমি কিন্তু তখন তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। দাঁত কিটমিট করছিলে প্রচন্ড ঘৃনায়। একটা মাসুম বাচ্চাকে কুলাঙ্গার বলেছে শুনে তোমার সহ্য হয়নি। তাও সে তোমার জন্য তখন অপরিচিত কেও ছিলো। আর তোমার পেটে যে সন্তান, যে এখন পর্যন্ত দুনিয়ার আলোটুকুই দেখতে পেলো না সে কি করে কুলাঙ্গার হয়? সে তো তোমার নিজের সন্তান। নিজের সন্তানকে এত বড় কথাটা তুমি বলে ফেললে অথচ তোমার একটুও খারাপ লাগলো না? আশফাকের সাথে তোমার যা কিছু হয়েছে সেক্ষেত্রে তোমার রাগ করাটা একদম স্বাভাবিক৷ তুমি যদি আশফাকের কাছ থেকে চিরতরে সরে যেতে চাও সেটাকেও আমি দোষের কিছু বলবো না। কারন আশফাক তোমাকে অকারনে কষ্ট দিয়েছে৷ কিন্তু তোমার পেটের সন্তানটা আশফাকের বলে যে তুমি ওকে এ্যাবর্ট করতে চাচ্ছো এটা কোনো যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত না৷ বরং আমি বলবো এবার তুমিও একটা অন্যায় করতে যাচ্ছো।

কয়েকদফা ঢোক গিললো অর্পিতা৷ খানিকটা ধাতস্থ হয়ে রাজিয়াকে ক্ষীনকন্ঠে বললো,
-আপনি আমার অবস্থাটা একটু ভেবে দেখেছেন কি?
– হুম ভেবেছি। ভেবেছি দেখেই বলছি ওকে যদি তুমি ডিভোর্সও দাও তাহলে সেক্ষেত্রে আমি অন্যায়ের কিছু দেখছি না।
– পারিবারিক ভাবে সমাধানের জন্য কিন্তু আপনারাই এসেছিলেন। আমাকে আশফাকের হাতে তুলে দেয়ার জন্য আমার বাবাকে আপনারাই বুঝিয়েছিলেন। যদি ওকে তালাক্ব দেয়াটা আপনার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হয় তাহলে কেনো এসেছিলেন বাবাকে এসব বলতে?
– দেখো তালাক্ব চাইলে তুমি দিতে পারতে। কিন্তু আমরা কেউই চাইনি তালাক্বটা হোক৷ আমরা চাচ্ছিলাম এটার একটা সমাধান হোক। সুষ্ঠু সমাধান। এতগুলো বছর ধরে আমরা ওর সুখের চাবি খুঁজে যাচ্ছিলাম। অবশেষে আমরা চাবিটা খুঁজে পেয়েছি। ও তোমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না অর্পিতা। তোমার প্রতি ওর ভালোবাসাটা কতটুকু গভীর হয়ে গিয়েছে তা তুমি আপাতত চিন্তাও করতে পারবে না৷
– ও আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি আন্টি। ও ওর সমস্ত কিছু আমার কাছ থেকে লুকিয়েছে। এমনকি রিমন ওর আপন ভাই না এটা পর্যন্ত আমি জানতাম না৷ বিয়ের আগের দিন আমি আমার বড় ভাইয়ের কাছে শুনেছি। যে আমাকে ভালোবাসবে সে কখনো আমার কাছ থেকে নিজেকে বা নিজের অস্তিত্বকে লুকাবে না।
– শুধুমাত্র এই একটা জের ধরে কিন্তু তুমি বলতে পারো না আশফাক তোমাকে ভালোবাসে না।
– আমি শুধু এই একটা কথার প্রেক্ষিতে বলছি না। শুধুমাত্র একটা রাতের ব্যবধানে ভালোবাসা কিভাবে জন্ম নেয়?
– মানে?
-আমি যেদিন সুইসাইড এটেম্পট নিলাম এর আগেরদিন রাতে ও নিজে আমার এই ঘরে এই বিছানাটাতে বসেই বলে গিয়েছিলো ওর ভালোবাসাটা মিথ্যে ছিলো। পুরোটা নাটক ছিলো।এরপরদিন সকালে আমি নিজে ওকে দেখেছি আরেক মেয়ের সাথে ঐ অবস্থায়৷ সে যদি আমাকে ভালোবাসতো কখনোই আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলতো না৷ আর অন্য মেয়ের শরীরে হাত দেয়াতো দূর দূরান্তের ব্যাপার। আপনি হয়তোবা এখন আমাকে বলবেন আশফাক কান্নাকাটি করে, মরে যেতে চায়, আমাকে ছাড়া সে চোখে অন্য কিছু দেখে না। এমনটা ও আসলে অপরাধবোধ থেকে করছে। আন্টি জাস্ট একটা রাতের ব্যবধান ছিলো। আমি সুইসাইড এটেম্পটটা নেয়ার পর থেকেই ও মরিয়া হয়ে গেলো আমাকে পাওয়ার জন্য। একরাতে এত ভালোবাসা বেড়ে গেলো কি করে বলুন তো? এগুলো আসলে ভালোবাসা না৷ ওর বাবার প্রতারনার কারনে ওর মা যে পথটা বেছে নিয়েছিলো সেই পথেই কিন্তু আমি গিয়েছিলাম। এতগুলো বছর ধরে ও ওর বাবাকে এসব কারনে ঘৃনা করে এসেছে। আজকে ও সেই কাজটাই করলো। নিজের কাছেই ও নিজে ছোট হয়ে গিয়েছে। নিজের মাঝে ও ওর বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে আর আমার মাঝে ওর মায়ের। এখন ও আমাকে পূর্ণ সম্মানটুকু দিয়ে নিজের কাছে নিজে ভালো সাজতে চাচ্ছে। মোটকথা নিজের অন্যায়ের উপর পর্দা ফেলতে চাচ্ছে যাতে নিজেকে ওর বাবার সমতূল্য মনে না হয়৷ এ ছোটবয়সে ওর মামার বাড়ির বলা কথাটা যেনো সত্যি না হয়ে যায়,
“বাচ্চার শরীরে একটা কুকুরের রক্ত আছে।”
– তোমার ধারনা ভুল অর্পিতা৷ ও তোমাকে আসলেই ভালোবাসে।
– হয়তোবা,,,, আবার নাও হতে পারে। তবে আন্টি আপনাকে একটা কথা বলবো। ধন্যবাদ আপনাকে। একচুয়ালি আমি বর্তমানে যে সিচুয়েশনে আছি এই অবস্থায় সেই মানুষটার বাচ্চা আমার মাঝে আমি ক্যারি করবো এটা মেনে নেয়াটা খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো আমার জন্য৷ বলতে পারেন দম আটকে আসছিলো আমার৷ একতরফা ভেবে আসছিলাম এতক্ষণ৷ বাচ্চা তো শুধু আশফাকের না। বাচ্চাতো আমারও। নিজের কাছেই এখন গিল্ট ফিল হচ্ছে এটা আমি কি ডিসিশন নিয়েছিলাম।
– আমি যেনো আর কখনো না শুনি তুমি এ ধরনের কথা বলেছো।
– শুনবেন না আন্টি।
– আর আশফাকের ব্যাপারটা একটু ভেবো অর্পিতা। যদি সম্ভব হয় তো রিলেশনটা একটু স্বাভাবিক ভাবে দেখার চেষ্টা করো।
– কি ভাববো আন্টি? ওকে মাফ করে দেয়ার কথা বলছেন?
– হুম।
– আমি মানছি ওর খুব খারাপ একটা পাস্ট ছিলো। শুনছি পর থেকে ওর জন্য আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে৷ মানুষটার জীবনে প্রাপ্তি বলতে গেলে কিছুই নেই৷ ওর প্রতি কষ্টটা আমার তখনই কাজ করছে যখন আমি ওকে শুধুমাত্র একজন মানুষ হিসেবে চিন্তা করছি। কিন্তু যখন আমি মানুষটাকে হাজবেন্ড হিসেবে ভাবছি তখন ওর ধোঁকাটা আমার নজরে সবার আগে ভেসে উঠছে৷ সেই মূহূর্ত্বে ওর জন্য আমার একফোঁটা কষ্টও হচ্ছে না। বরং নিজের জন্য আফসোস হচ্ছে৷ এটা আমি কাকে ভালোবাসলাম? আশফাক নির্দোষ ছিলো। অথচ ওকে এত কিছু সাফার করতে হয়েছে। এজন্য ও এমন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমার দোষটা কোথায় ছিলো আন্টি? আমি তো কখনো কাউকে ঠকাইনি। অথচ দেখুন তো সবচেয়ে বড় ধোঁকাটা কিন্তু আমি পেলাম৷ এখন কি তাহলে আমারও আশফাকের মত নষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত?
– তোমার এই যুক্তির প্রেক্ষিতে আমি আর কিছুই বলতে পারবো না অর্পিতা। কোনো কিছু বলার মত মুখ আশফাক আমার জন্য রাখেনি৷
– আন্টি ও আমার সাথে সম্পর্ক হওয়ার আগে যা খুশি করেছে, একশোটা মেয়ের সাথে শুয়ে এসেছে সেসব আমি মাথায় রাখতাম না৷ আপনি আজকে যেসব কথা শুনিয়েছেন সেগুলো শোনার পর আমি সত্যিই ওর আগের ভুলগুলো ভুলে যেতাম৷ কিন্তুু আমার সাথে রিলেশনে থাকা অবস্থায় ও আরেক মেয়ের সাথে ইন্টিমেট হয়েছে। এটা আমি বাদ দিতে পারবো না৷ ওর সাথে যেমন অন্যায় হয়েছে, তেমনি ও আমার সাথে অন্যায় করেছেও৷ আমি ওর সাথে বিছানায় শুতে চাইনি বলে বিয়ের নাটক পর্যন্ত সে সাজিয়ে ফেলেছে। কতটা নোংরা মেন্টালিটি ভেবে দেখুন তো। রিমন ভাইয়া বিয়ের কাগজগুলো আর কাজীকে সত্যিকারের বিয়ের জন্য তৈরী করে এনেছিলো তাই বিয়েটা হয়েছে। আর নয়তো বিয়েটা কিন্তু নকলই হতো। আর আন্টি সব কথার শেষ কথা আশফাক আমাকে কখনো ভালোবাসেনি, এখনো ভালোবাসে না। তাছাড়া সেদিনের পর থেকে ওর প্রতি আমার আর নূন্যতম ভালোবাসা জাগে না। ভালোবাসার জায়গাটুকু ঘৃনা দখল করে নিয়েছে৷ যদি ভালোবাসা থাকতো তাহলে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা আপনাকে বলতে হতো না। সম্পর্কটাও এই অবস্থায় এসে দাঁড়াতো না।
– দেখো আমি তোমাকে কোনো অবস্থাতেই আশফাককে মাফ করে দেয়ার জন্য জোর করতে পারবো না৷ এটা সম্পূর্ণই তোমার ব্যাপার। আমি শুধু তোমাকে ভেবে দেখার জন্য বলতে পারবো। ব্যস এতটুকুই। তাছাড়া আশফাকের ভালোবাসা তুমি যদি অনুভবই না করতে পারো সেখানে সম্পর্ক ঠিক হওয়ার কথাটা আসবে কি করে তাই না? আমার যতটুক বলার দরকার ছিলো আমি বলেছি। বাকিটা তুমি ভালো বুঝো। তোমার কষ্টটুকু তুমি যতটুক উপলব্ধি করতে পারছো তা কিন্তু আমি পারবো না। কারন তোমার জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে নেই। তবে এতটুক বলতে পারি তুমি যেহেতু বুঝতে পারছো ওর মাঝে অপরাধবোধ জেগেছে তাহলে এতটুক বুঝে নিও সে এখনো পুরোপুরি অমানুষ হয়ে যায়নি৷ অমানুষ হয়ে গেলে অপরাধবোধটুকু জাগতো না। সে তোমাকো ভালোবাসুক আর নাইবা বাসুক, সে তোমার হাতটুকু ধরে ভালো হতে চাচ্ছে, সুখে থাকতে চাচ্ছে। এখন তুমি কি তার হাতটা আঁকড়ে ধরে ভালোভাবে বাঁচতে শিখাবে নাকি দূরেই সরিয়ে রাখবে সেটা একান্তই তোমার সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে আমি কিছু বলবো না।

বিছানা ছেড়ে উঠে বাহিরে গেলেন রাজিয়া। জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে অর্পিতা। চোখে তার পানি ছলছল করছে৷ কান্নার কারনটুকু আপাতত তার জানা নেই। সে শুধু এতটুকু জানে এই মূহূর্ত্বে তার প্রচুর কান্না পাচ্ছে এবং কিছুক্ষণ তাকে দরজা বন্ধ করে একা কাঁদতে হবে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে অর্পিতা। দরজার ছিটকিনিটা আটকাতে হবে।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here