ভোরের_আলো পর্ব-৫৯

0
1360

#ভোরের_আলো
৫৯.

-খোঁজ নিয়েছিলে?
– নাহ্। নিতে পারিনি।
– কেনো?
– সেদিন আটটার দিকে কলেজের জন্য বের হয়ে গেলাম৷ দুইটায় ক্লাস শেষ হতো৷ কলেজের গেট দিয়ে আমি আর কৌশিক বের হচ্ছি এমন সময় দেখি রাত্রি দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখ ফুলে লাল হয়ে আছে। আমাকে দেখামাত্রই আমার হাত টানতে টানতে রিকশা পর্যন্ত নিয়ে গেলো। আমাকে বললো, চুপচাপ রিকশায় উঠো। কোনো কথা আমি শুনতে চাই না।
আমি একবার না করতেই ও আমাকে বললো, গতকাল সারারাত তুমি আমাকে কাঁদিয়েছো। এখন আবার আমার সাথে যেতে চাচ্ছো না। সমস্যা কি? কি চাও? দেখো আশফাক মেজাজ কিন্তু খুব খারাপ হয়ে আছে। তুমি আমার রাগ সম্পর্কে জানো না। তুমি আমার সাথে না গেলে অনেক কিছু হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি।
– কি হবে?
– আমি বাসের সামনে দাঁড়িয়ে পড়বো৷ যাবে কি যাবে না বলো?
– পাগলের মত আচরন করো না রাত্রি।

ও আর কোনো কথা বাড়ালো না। আমার হাতটা ছেড়ে রাস্তার দিকে পা বাড়ালো৷ ঐ রোডটা দিয়ে ক্রমাগত বাস গাড়ি আসা যাওয়া করে। মূহুর্ত্বে গলা শুকিয়ে গেলো আমার। ওর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো ও সত্যি কোনো কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে। আমি পিছন থেকে দৌঁড়ে যেয়ে ওকে এক প্রকার টেনে হিঁচড়ে রাস্তার পাশে নিয়ে এসেছি। সেদিন লোকজন সব আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। যে যার যার কাজ ফেলে আমাদের দেখছিলো। এরপর ওকে নিয়ে রিকশায় উঠে বসলাম। পুরো রাস্তা ও সেদিন কেঁদেছে। ওর কান্না দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিলো । মনে হচ্ছিলো অকারণে একটা মানুষকে আমি কষ্ট দিচ্ছি। ফর্সা মুখটার মাঝে লাল নাকটা কি যে সুন্দর লাগছিলো! গায়ের ওড়নাটা দিয়ে বারবার চোখ মুছে যাচ্ছিলো৷ খুব কাছ থেকে রাত্রিকে দেখেছিলাম সেদিন। ভালোবাসাটা যেনো প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে বেড়ে যাচ্ছিলো। ওর চোখের নিচে একটা তিল আছে৷ তিলটা বারবার দেখছিলাম। ইচ্ছে হচ্ছিলো চোখের পানি মুছে দেয়ার বাহানায় ওর তিলটাও একটু ছুঁয়ে দিই। কলেজ থেকে সোজা চলে গেলাম রমনাতে৷ ওখানে একটা বেঞ্চে বসলাম। ও কোনো কথা বলছিলো না৷ আমিও কোত্থেকে শুরু করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না৷ অনেকক্ষণ দুজনে এভাবেই চুপচাপ বসে ছিলাম। কতক্ষন এভাবে চুপচাপ বসে থাকতাম বলো? পরে আমিই মুখ খুললাম।

– শুনুন, আপনি তো আমার সবই জানেন। আপনার সাথে আমার সম্পর্কটা খুব বেমানান।
– তুমি কাকে ভালোবাসো?
– কাউকে না। গতকাল আপনাকে মিথ্যা বলেছি।
– কেনো?
– আপনি আমার কথা বুঝতে চাচ্ছিলেন না তাই।
– আমি যে তোমাকে ভালোবাসি এটা কি তুমি বুঝো?
– হুম।
– তাহলে দূরে ঠেলে দিচ্ছো কেনো?

আমি ওর প্রতিউত্তরে কিছু বলতে পারিনি। আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো ও। এরপর হঠাৎ করেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ও আমাকে এমন ভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো মনে হচ্ছিলো একটু ছাড়লেই বুঝি আমি কোথাও হারিয়ে যাবো। ও আমাকে আর কোনো কিছু বলার সুযোগ দিলো না৷ নিজেই বলতে লাগলো,

– তোমার সব আমি জানি৷ সবকিছু৷ সব জেনে আমি তোমাকে ভালোবেসেছি৷ আমার শুধু তোমাকে দরকার। সংসারে খুব বেশি কিছু আমি চাইনা৷ ছোট্ট একটা বাসাতে আমরা আমাদের সংসার বানাবো। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসবো আর তুমিও আমাকে অনেক ভালোবাসবা৷ ব্যস। আর কিছু লাগবে না।

বিশ্বাস করো অর্পিতা সেদিন সেই মূহূর্ত্বে আমার খুব কান্না পাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো অবশেষে আমি আমার সুখটাকে পেয়েছি৷ এমন কাউকে পেয়েছি যাকে আমি নিজের সবটা দিয়ে উজাড় করে ভালোবাসবো৷ এমনকি ওকে ভালোবেসেছিও।

আশফাকের কথাগুলো কানে বিঁধছে অর্পিতার৷ সহ্য হচ্ছে না কথাগুলো৷ অনেকক্ষণ ধরে সহ্য করে যাচ্ছে। এখন আর সম্ভব হচ্ছে না৷ চোখ ফেটে পানি বের হওয়ার উপক্রম৷ চোখের পানি আশফাককে দেখাতে নারাজ অর্পিতা৷ ব্যস্ত ভঙ্গিতে মোবাইলের স্ক্রিন অন ঘড়ির সময় দেখে বললো,

– ইয়ে, আশফাক,,, বাসায় যাও। রাত হয়েছে৷
– তাতে কি হয়েছে?
– না, তুমি এখন বাসায় যাও৷
– হঠাৎ করে চলে যেতে বলছো কেনো?
– এমনি। তোমার সাথে ওর কি হয়েছিলো সেসব শুনতে আর ভালো লাগছে না।
– স্যরি অর্পিতা৷ রাত্রির ব্যাপারে আমার এতকিছু বলা উচিত হয়নি।
– আচ্ছা সেদিন যে মেয়েটাকে তোমার বাসায় দেখেছিলাম ওর চোখের নিচেও তো তিল ছিলো। ওটা কি রাত্রিই ছিলো?
– হুম।
– তুমি ওকে খুব ভালোবাসতে তাই না?
– অর্পি আমার বুঝা উচিত ছিলো তুমি হয়তোবা ওর আর আমার কথাগুলো শুনে কষ্ট পাবে। আমি না বুঝেই……. স্যরি।
– তুমি বাসায় যাও।
– স্যরি।
– আশফাক আমি একটু ঘুমাবো৷ তুমি যাও প্লিজ।
– তুমি আমার কথাটা একটু শুনো। ও আমার শুধুমাত্র অতীত। ও বর্তমানে আমার কেও না৷ যা অনুভূতি ছিলো সবটাই অতীত। তুমি প্লিজ এসব মনে রেখে কষ্ট পেও না।
– আমি কষ্ট পাচ্ছি না।
– তোমার চেহারা দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।
– নাহ্।
– দেখো এমনিতেই তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি চাই না নতুন করে আর কোনো কষ্ট পাও।

এগিয়ে এসে অর্পিতার হাত ধরলো আশফাক। হাতটা সাথে সাথেই ছাড়িয়ে নিলো অর্পিতা৷ করুন দৃষ্টিতে অর্পিতার দিকে তাকিয়ে আছে সে।

– তুমি এখন যাও।
– পাঁচ মিনিট বসি?
– উহুম।
– বিরক্ত হচ্ছো?
– কথা প্যাঁচাচ্ছো কেনো? ভালো লাগছে না আমার। একটু একা থাকতে চাই। প্লিজ বাসায় যাও।

বাসা থেকে বেরিয়ে এলো আশফাক। নিজের উপর নিজেরই মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কি প্রয়োজন ছিলো ঐ মেয়ের কথাগুলো এত বিস্তারিত বলার?

সারারাত ঘুমায়নি অর্পিতা। এপাশ ওপাশ করে কাঁটিয়ে দিয়েছে গোটা রাতটা৷ অনেক কিছু ভেবেছে পুরো রাতটা জুড়ে। সকালের আলো ফুটেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। সারারাত ভেবে যা কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেগুলো নিয়ে একবার আবিদের সাথে কথা বলবে ভাবছে। বহুদিন হলো আবিদের সাথে মন খুলে কথা বলা হয়নি৷ অন্যান্য সময় আবিদ দেশে আসা মানেই এদিকে সেদিক বেড়াতে যাওয়া লেগেই থাকতো৷ এবার এতসব ঝক্কি ঝামেলার জন্য কোথাও যাওয়া হলো না। নিজের ঘর ছেড়ে আবিদের ঘরে এলো অর্পিতা। গায়ে আলতো ধাক্কা দিয়ে আবিদকে ডাকছে সে,
– ভাইয়া…. এই ভাইয়া……

কোনোমতে চোখ মেলে তাকালো আবিদ। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো

– কি?
– চল হেঁটে আসি।

আড়মোড়া দিতে দিতে আবিদ বললো,
– এই ঠান্ডায় বের হবি?
– চল না যাই।
– আচ্ছা জামা বদলে নে। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

নিজেদের এলাকাতেই রাস্তার ধার ধরে হাঁটছে দুই ভাইবোন। রাস্তায় তেমন মানুষ নেই বললেই চলে। টুংটাং শব্দ করে কয়েকটা রিকশা শুধু আসা যাওয়া করছে।

– দেখ তুই যা বলছিস তা ভুল। রাত্রির প্রতি উনার বিন্দুমাত্র ফিলিংস নেই৷ ও যা করেছে এরপর এমন একটা মেয়ের প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
– না রে৷ ভালো তো ও এখনো বাসে।
– ভুল ধারনার নিয়ে থাকলে যে সম্পর্কটা আরো নষ্ট হবে জানিস?
– ভালোবাসা তো একতরফা ভাইয়া। এখানে সম্পর্কের কি দেখলি?
– উনি তোকে ভালো না বাসলে কি তোকে পাওয়ার জন্য এত কাঠখড় পোড়াতো?
– জানি না রে।
– রাত্রিকে উনি ভালোবাসে না অর্পিতা। দেখ তুই কথাগুলো জানতে চেয়েছিস এজন্যই কিন্তু উনি কথাগুলো বলেছে। নয়তো বলতো না। উনার তখনকার ফিলিংসগুলো তোকে বলতে চেয়েছিলো৷ মেয়েটা কিভাবে উনার সব অনুভূতিগুলো পা দিয়ে পিষেছে সেটা তোকে বুঝানোর জন্যই ঐ কথাগুলো বলেছে। তোকে বুঝাতে চাইলো কি আর তুই বুঝে নিলি কি?
-…………..
– আমি জানি ঐ একটা ঘটনা তোকে আজীবন তাড়া করে বেড়াবে। তোকে কিন্তু আমি আগেই বলেছিলাম তোকে নিয়ে বাহিরে চলে যাই৷ তোকে কেও খুঁজেও পাবে না৷ নিজের মত করে থাকবি, বাঁচবি৷ তুই নিজে বাবার নেয়া সিদ্ধান্তটা এক্সেপ্ট করেছিস৷ তাহলে কেনো এসব ভেবে লাইফটা কমপ্লিকেটেড করছিস? যেহেতু বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিস সেহেতু আমার মতে তোর স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করা উচিত। এভাবে দূরত্ব রেখে কতদিন চলবি তুই? রাগ করে একমাস দুইমাস কাটানো যায়৷ বছরের পর বছর না। একটা সুযোগই তো অর্পিতা। দিয়েই দেখ না। এক ছাদের নিচে থাকলে এই সমস্যাটার সমাধান হতো না৷ বরং আরো বিগড়ে যেতো। এজন্য তোকে এখানে এনেছি। এখানে থাক। একদম নিজের মত করে। দূরে থাক কয়েকমাস। দূর থেকে সম্পর্কটা ঝালাই করে নে। যা হয়ে গেছে তুই আমি আমরা কেও বদলাতে পারবো না। বাবা অনুষ্ঠানটা করার আগ পর্যন্ত তোর কাছে রাস্তা খোলা ছিলো দুইটা৷ তুই আশফাক ভাইয়ের পথটা বেছে নিলি। এখন বেছে যেহেতু নিয়েছিসই উনার সাথেই আজীবন কাটাতে হবে। তাহলে এসব আর ভেবে লাভ কি বলতো? যত বেশি ভাববি তত বেশি কষ্ট পাবি। অস্বাভাবিক একটা জীবন কাটাতে হবে তোকে। এখন তুই কি চাস এমন অস্বাভাবিক জীবন কাটাতে?
– না।
– ব্যস,,, ঐ ঘটনাটা যতটা সম্ভব ইগনোর করার চেষ্টা কর। তোর কথা যদি ধরেও নেই আশফাক ভাই তোকে ভালোবাসে না তাহলে বলবো না বাসলে নাই৷ তুই তো ভালোবাসিস। চলবে। কয়টা সংসারে ভালোবাসা থাকে বলতো অর্পিতা? কয়টা ঘরের খবর তুই জানিস? এমনও সংসার আছে যেখানে ভালোবাসা, সম্মান, বন্ধুত্ব কোনোটাই থাকে না৷ উনি তোকে ভালো না বাসুক এটলিস্ট পুরো সম্মানটা তো দিচ্ছে। তোকে বন্ধু তো ভাবছে। এটাও অনেক। এমন বহু মেয়ে আছে যারা এটাও পায় না। তুই উনার স্বস্তির জায়গা৷ দিনশেষে উনি তোর মাঝে উনার স্বস্তিটুকু খুঁজে পায়। হোক সেটা বন্ধু হিসেবে বা ভালোবাসার মানুষ হিসেবে। এই স্বস্তিটা কারো কাছে উনি পায়না। এজন্যই বারবার তোর কাছে ছুটে আসে। একটা সংসার করার জন্য এগুলো কি যথেষ্ট না?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here