#ভোরের_আলো
৬০.
-তোর সমস্যা কোথায় বলবি আমাকে একটু?
– এমনিতেই আমি টেনশনে আছি। তোর কি উচিত হচ্ছে আমার সাথে এভাবে রেগে কথা বলা?
-তোমার কাছে কি মনে হচ্ছে কৌশিক ভাইয়ের রাগ করাটা উচিত না?
– আবিদ তোমার বোনের সামনে আগের মত ফিলিংসগুলো বুঝাতে পারি না। লজ্জা লাগে আমার। এতবড় অন্যায়ের পর তো…… বুঝতে পারছো আমার সমস্যাটা?
– কিন্তু এই মূহূর্ত্বে ভালোবাসা বুঝানোটা তো জরুরী তাই না? অর্পিতার মনে তো নতুন সন্দেহ ঘর বাঁধছে। তোমার কি উচিত না ওর ভুলটা ভেঙে দেয়া?
– ও ভুল কি ভাঙবে? উল্টা আরো সুন্দর করে নিজের প্রেমকাহিনী শুনিয়েছে।
– ও শুনতে চেয়েছে তাই বলেছি।
– গল্পটা সাধারণভাবেও শোনাতে পারতি আশফাক। ও লাল নাকের প্রশংসা করতে বলেছে কে তোকে? তোকে জড়িয়ে ধরেছে এসব বলারই কি দরকার ছিলো? এতকিছু তো ও জানতে চায়নি।
– ভুলে বলে ফেলেছি। তখন এতকিছু তো মাথায় আসেনি।
– ভুল না৷ একের পর এক ভুল মানুষ করতে পারে না৷ দিন দিন বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে তোর।
– আমার মতে তোমার উচিত ওকে একটু ভালোমত সময় দেয়া ।
– আমি তো দিতেই চাই। ও তো আমার সাথে কথা বলতে চায় না৷
– গতকালের পর অনেকটাই তোমার প্রতি রাগ কমে এসেছে।
– ও তোকে সবসময়ই ভালোবেসে এসেছে। নয়তো শুধু ওর বাবার কথায় তোর কাছে আসতো না৷ আবিদের কথা শুনে চলে যেতো দূরে কোথাও৷ রাগ করেছিলো এজন্য এমন করেছে এতদিন৷ ওর এমন রিএ্যাক্ট করাটা খুব স্বাভাবিক৷ আর এখন যেটা হচ্ছে সেটা হলো ও তোকে নিয়ে দ্বিধায় আছে৷ তোকে কাছে টানতেও ইচ্ছে হচ্ছে আবার তুই ওকে আদৌ ভালোবাসিস কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহে ভুগছে৷ কষ্ট পাচ্ছে। আমি বলবো ওকে আবারো আঁকড়ে ধরার জন্য এই সময়টা একদম পারফেক্ট। ওর দ্বিধা কাটানোর জন্য তোকেই এখন এগিয়ে আসতে হবে৷ দ্বিধা কেঁটে গেলে সম্পর্কটা আবার আগের জায়গায় ফিরে আসবে।
– আবিদ?
– হুম?
– ও বাসায় না?
– আর কোথায় যাবে?
– তুমি কি এখন বাসায় যাবে?
– নাহ্। বন্ধুদের সাথে একটু দেখা করবো৷ এখানেই আসতে বলেছি৷ এখানে থাকবো আরো ঘন্টা দুই তিনেক।
– আমি গেলাম তাহলে?
– আমাদের বাসায় যাচ্ছো?
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা যাও।
– একটা কথা শুনে যা।
– কি?
– ওর সাথে প্রেম শুরু করার আগে যেভাবে কোমড় বেঁধে পিছনে লেগেছিলে ওভাবে লেগে পড়।
কৌশিকের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি হেসে চলে গেলো আশফাক।
বাসার সামনের বাগানের দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে অর্পিতা৷ হাতে একটা গল্পের বই। চোখজোড়া বইয়ের পাতার ভাঁজে থাকলেও অন্যমনস্ক হয়ে আছে সে। বারবার গতরাতের কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরেই যাচ্ছে। আশফাক রাত্রিকে খুব বেশিই ভালোবাসতো৷ ওর কথা শুনলেই বুঝা যায়৷ হয়তোবা এখনও ভালোবাসে৷ কেনো ভালোবাসে? কি দিয়েছে মেয়েটা ওকে ধোঁকা ছাড়া? এতখানি ধোঁকা পাওয়ার পরও এই মেয়েটাকে এখনো ভালোবাসার কি আছে সেটাই আপাতত খুঁজে পাচ্ছে না সে৷ আর সে নিজে আশফাককে এত ভালোবাসার পরও তার মন পেলো না!
– বই পড়ার ভান ধরে বসে আছো কেনো?
আশফাকের কন্ঠ পেয়ে চমকে উঠলো অর্পিতা। বইটা বন্ধ করে খানিকটা নড়েচড়ে বসলো। অর্পিতার গা ঘেষে দোলনায় বসলো আশফাক।
– ভান ধরেছি মানে?
– ভানই তো! তুমি তো বই পড়ছো না। বই খুলে অন্য কিছু ভাবছো।
– আমি বইটাই পড়ছিলাম।
– মিথ্যা বলো না। তুমি অন্যকিছু ভাবছিলে।
– কি ভাবছিলাম?
– সেটা তো ঠিক বলতে পারবো না।
-……………
– আমাকে নিয়ে ভাবছিলে তাই না?
– মোটেও না।
– ধরা খাওয়া একটা চেহারা হয়েছে তোমার। তুমি ধরা পড়ে গেছো।
– ধরা পড়ার কিছু নেই৷ তোমাকে নিয়ে ভাবলে অবশ্যই বলতাম।
– কই বলছো না তো?
-……………
– আমার সাথে একটু বাসায় যাবে অর্পিতা? ঘন্টা দুয়েকের জন্য?
– বাসায়ই তো আছি।
– আমার বাসার কথা বলছি।
– কেনো?
– তোমাকে অনেক কিছু বলার ছিলো।
– বলো।
– এখানে না প্লিজ। আমার বাসায় চলো।
– এখানে আর তোমার বাসার মাঝে পার্থক্য কোথায়?
– আছে। না থাকলে বলতাম না।
– আম্মু তো তোমাকে বলেছেই তিন চারমাস আমি এখানে থাকবো।
– হ্যাঁ থাকবে তো। আমি তো শুধু দু-ঘন্টাই সময় চেয়েছি। আমি নিজে এসে আবার তোমাকে দিয়ে যাবো।
– আমার এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
– বাহিরে তো ঘুরতে হবে না। এখান থেকে গাড়ীতে উঠবে, বাসায় যাবে এরপর আবার গাড়ীতে করে চলে আসবে।
– আমি যাবো না। যা বলার এখানেই বলো।
অর্পিতার কাঁধ জড়িয়ে ধরলো আশফাক। কন্ঠে একরাশ আহ্লাদ ঢেলে দিয়ে বললো,
– এ্যাই অর্পি,,,,,, চলো না প্লিইইজ।
– কি এমন কথা জমে আছে যে তোমার বাসায় যেয়ে শুনতে হবে? উফফফ! অহেতুক এখন কাপড় পাল্টে আবার রেডি হতে হবে। যাও সরো। রেডি হয়ে আসছি আমি।
সন্ধ্যা নেমেছে বেশ অনেকক্ষণ হলো। বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে অর্পিতা। বাসার সামনেই ছোট্ট একটা চটপটির দোকান আছে৷ সরু বেঞ্চটাতে পাশাপাশি বসে আছে দুটো ছেলেমেয়ে। বয়স খুব একটা বেশি না৷ জমিয়ে গল্প করছে দুজন। ফাঁকে ফাঁকে আবার ছেলেটা মেয়েটাকে মুখে তুলে খাইয়েও দিচ্ছে। হাজবেন্ড ওয়াইফ হবে হয়তো! হুম সেটাই হবে৷ মেয়ের দুহাতে চিকন একজোড়া চুড়ি চিকচিক করছে৷ ওদেরকে দেখে আপনমনেই মুচকি হেসে উঠলো অর্পিতা। ভালো লাগে কারো ভালোবাসা দেখতে। আশফাক আর তার এমন অনেক স্মৃতি আছে। সম্পর্কটা যে খুব বেশিদিনের ছিলো ঠিক তা না। তবে ঐ স্বল্প সময়ের স্মৃতি আছে অনেক। সম্পর্কটা খুব দ্রুত থমকে দাঁড়াবে তাই হয়তো কম সময়ে এতগুলো স্মৃতি জমা হয়েছে…..
– কি দেখছো এত মনোযোগ দিয়ে?
-হুম?
চমকে উঠলো অর্পিতা। পাশেই দুহাতে কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আশফাক। একটা মগ অর্পিতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে পাশের টুলে বসে পড়লো সে।
– তুমি কি কফি খাওয়ার জন্য আমাকে এখানে এনেছো?
– হ্যাঁ কফি খাওয়ানোটাও একটা কারণ। তবে এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে।
– তো বলছো না কেনো? আধাঘন্টা ধরে আমাকে বসিয়ে রেখেছো। দু-ঘন্টার কথা বলে এনেছো। আধাঘন্টা তো এমনি এমনি পার করে দিলে।
– কেনো অর্পিতা? দু-ঘন্টার বেশি সময় আমার সাথে কাটালে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?
– দু-ঘন্টার কথা তো তুমি বলেছো। আমি তো বলিনি।
– এখন যদি তোমার কাছে আরো কিছু সময় বাড়তি চাই তাহলে?
– তাহলে আমার এখনই চলে যাওয়া উচিত।
– যাকে ভালোবাসো তার সাথে এতটা রুডলি কথা বলা কি ঠিক?
– আমার ভালোবাসা বুঝো তুমি? বুঝেছো কোনোদিন? কোনোদিন বুঝোনি, আজও বুঝো না।
– চুমুক দিয়ে দেখো তো কফিটা ভালো হয়েছে কি না?
বিরক্তির ভরা চোখে আশফাকের দিকে তাকিয়ে আছে অর্পিতা৷ মেজাজ বিরক্তির শেষ সীমানায় এসে ঠেকেছে । একটা মানুষ এমন গুরুত্বপূর্ণ মূহূর্ত্বে এতটা হেয়ালী ধাঁচের প্রশ্ন কিভাবে করতে পারে?
– এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?
-……………..
– তুমি ভ্রু কুঁচকে তাকালেও খুব সুন্দর লাগে। একদম পেঁচা সুন্দরী।
মুখ টিপে নিঃশব্দে হাসছে আশফাক। এবারে অর্পিতার বিরক্তির পরিমাণ শেষ সীমানাকেও অতিক্রম করে ফেলেছে। দাঁত মুখ শক্ত করে সে আশফাককে বলো,
– তুমি কি জানো তুমি যে একটা বুদ্ধিহীন লোক? কখন কোথায় কি বলতে হবে সেটার জ্ঞান তোমার নেই? সেই সাথে তুমি একটা প্রচন্ড বিরক্তিকর এবং নির্লজ্জ মানুষও বটে।
– হ্যাঁ জানি। এবং এটাও জানি তুমি এই বোকা, বিরক্তিকর এবং নির্লজ্জ মানুষটাকে প্রচন্ড ভালোবাসো।
(চলবে)