ভরসার_দুহাত পর্ব_২৯

0
486

#ভরসার_দুহাত
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_২৯

“রিসিভ করে বল আর একটা মেয়ে পেয়ে গিয়েছি আজই ১০০জন মেয়ে পাচারের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।”
আকলিমা তাদের কথা শুনে অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে লোকটা কল রিসিভ করে কথা বলছে। পাশের লোকটা পকেট থেকে একটা ইনজেকশন বের করে আকলিমার দিকে তাকাল। আকলিমা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। লোকটা কল কেটে বলল-
“তারাতাড়ি ইনজেকশন পুশ কর। মানুষজন এসে পরলে সমস্যা হবে।”
লোকটা মাথা নাড়িয়ে আকলিমার দিকে হাত বাড়ালো। আকলিমা তার হাত ধরে টেনে সামনে এনে চেহারায় সজোরে ঘুষি মেরে দিলো। লোকটা নাক ধরে পিছিয়ে গেল। সাথের লোকটা অবাক হয়ে আকলিমার দিকে তাকাতেই দেখে আকলিমার উঠে দৌড়ে পালালো। লোকটা নাক ধরে দেখেই বলল-
“মেয়েটাকে ধর তারাতাড়ি।”
লোকটা দৌড়ে আকলিমার পেছনে গেল। আকলিমা দৌড়াতে দৌড়াতে বার বার পেছনে দেখছে। লোকটা দৌড়ে অনেকটাই কাছে এসে পরেছে। আকলিমা দৌড়ের গতি বাড়ালো। সামনে ডান দিকে যাওয়ার গলি দেখা যাচ্ছে। আকলিমার সেই গলিতে ঢুকে পরলো। গলিটা খুব লম্বা। শেষ সীমানা পর্যন্ত দৌড়ে গেল। সেখানে গিয়ে আকলিমা থমকে দাঁড়াল। শেষ সীমানায় দেয়াল। যাওয়াড কোন রাস্তা নেই। আকলিমার মনে হচ্ছে সে আর ফিরে যেতে পারবে না তার মা বাবাদের কাছে। হঠাৎ পেছন থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ করার শব্দ আসলো। আকলিমা পেছনে ফিরে দেখে দু’টো কুকুর সেই লোকটাকে তাড়া করছে। লোকটা এগিয়ে আসতেই নিলেই তারা ঘেউ ঘেউ করছে। আকলিমা ভাবলো এই সময়ে তার ববিকে কল করা উচিত। মোবাইলে দ্রুত ববির নাম্বার খুঁজে। কল করে কানে ধরলো। রিং বাজছে, গভীর রাত হয়তো ববি ঘুম। তিনবার রিং বাজার পর রিসিভ হলো।মোবাইলের অপর পাশ থেকে ববির ঘুমন্ত কন্ঠ ভেসে আসলো।
“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম”
“ববি? ববি বলছেন?”
আকলিমার ভীতু কন্ঠ শুনে ববি ধরফরিয়ে উঠে বসে বলল-
“হ্যাঁ আমি ববি কি হয়েছে আপনার?”
“ববি আমি খুব বিপদে পরেছি।”
“বলেন কি? কি হয়েছে?”
“দু’টো লোক আমাকে তাড়া করছে। প্লিজ আমার সাহায্য করুন।”
“আপনি কোথায় এখন?”
“হসপিটাল থেকে কিছুটা দূরে।”
“কোন হসপিটাল?”
আকলিমা হসপিটালের নাম বলে ববিকে এড্রেস জানালো। ববি আসছি বলে দ্রুত বিছানা ছেড়ে নেমে কাঁপা কাঁপা হাতে তার শার্ট খুঁজতে লাগলো। বুরাকের ঘুম ভাঙলো। ববিকে তারাহুরোয় দেখে উঠে বসে বলল-
“তোর আবার কি হলো?”
“আমাকে এখনই যেতে হবে।”
“কোথায়? আর কেন?”
“আকলিমার কল এসেছে দু’টো লোক তার পেছনে পড়েছে। সময়ের মতো না গেলে অনেক বড়ো অঘটন ঘটবে।”

হঠাৎ কুকুরদের শব্দ আসা বন্ধ হলো। লোকটা দৌড়ে গলি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে আর তার পেছনে কুকুররাও যাচ্ছে। আকলিমা ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। গলি থেকে বেরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে কেও নেই। আশে পাশে ভালো মতো চোখ বুলালো। কাওকে দেখা যাচ্ছে না। আকলিমা দৌড়ে হসপিটালের দিকে রওয়ানা দিলো। যত দ্রুত সম্ভব হসপিটাল পৌঁছাতে হবে তার। হঠাৎ সে খেয়াল করলো সামনে আর একটা লোক যে ছিলো সে দৌড়ে আসছে। আকলিমা দাঁড়িয়ে পরলো। লোকটা কাছে আসছে। সে আবার ঘুরে দৌড়ে গেল৷ দৌড়াতে দৌড়াতে দেখলো সাথের লোকটা কুকুরদের ইট মেরে তাড়াচ্ছে। আকলিমা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে সে একবার ডান দিকে তাকাচ্ছে আর একবার বাম দিকে৷ ববি এখনো আসছে না কেন। ভয়ে তার কলিজার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। মাটিতে চারপাশে চোখ বুলালো। এইখান থেকে যেভাবেই হোক পালাতে হবে। মাটির আশে পাশে কিছু পাচ্ছে না। হঠাৎ একটা ইটের টুকরা তার পায়ের কাছে এসে পরলো। ইটের টুকরো তো একটু বড়ো। মাথায় লাগলে মাথা ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেই লোকটা কাছে এসে বলল-
“অনেক দৌড়াতে হয়েছে মেয়েটাকে ধরতে। এখনই কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে।”
আকলিমা নিচু হয়ে ইটটা হাতে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো সেই লোকটার কপালে। লোকটা কপালে হাত দিয়ে চিৎকার মেরে পিছিয়ে গেল। ইট লোকটার কপালে লেগে কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে। আকলিমা এই সুযোগে দৌড়ে পালালো। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ মাথায় আঘাত অনুভব করলো। মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। হাত সামনের দিকে এনে দেখে রক্তে মাখা। আকলিমা ধীরে ধীরে পেছনে ফিরে দেখে একটা লোক দৌড়ে আসছে। মাটির দিকে তাকিয়ে দেখে সেই ইটের টুকরোটা। আকলিমার চারপাশে ঘোলাটে লাগছে। লোকটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে। হঠাৎ আকলিমার মনে হলো কেও তাকে পেছন থেকে ডাক দিলো। আকলিমা ধীরে ধীরে পেছনে ফিরে দেখে কেও একজন তার দিকে দৌড়ে আসছে। কিন্তু চারপাশ অন্ধকার আর চোখে ঘোলাটে দেখছে বলে কিছু বুঝতে পারছে না। লোকটা আবার তার নাম ধরে ডাকলো। তার কন্ঠটা বেশ চেনা চেনা। আকলিমার মন বলছে মানুষটা ববি। এলোমেলো পায়ে দৌড়ে তার দিকে গেল। লোকটা দাঁড়িয়ে পরেছে সামনে থাকা ছেলেটাকে দেখে। আকলিমা দৌড়ে গিয়ে লোকটার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। চেহারার দিকে তাকিয়ে ছেলেটা ববি বুঝতে পেরে জড়িয়ে ধরে কেদে উঠলো। ববি জাপ্টে ধরে রেখেছে আকলিমাকে। চোখ তুলে রাগী দৃষ্টিতে তাকাল সেই লোকটার দিকে। আকলিমা ববির দিকে তাকিয়ে বলল-
“তারা বলল আমাকে পাচার করে দিবে। আর আমার মাথায়ও মেরেছে।”
ববি আকলিমার মাথায় হাত দিয়ে দেখে রক্ত ঝরছে। ববি দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো। আকলিমা আবার জড়িয়ে ধরলো ববিকে।
“চিন্তা করো না, তোমার কিছু হতে দিবো না আমি।”
সেই লোকটা পালাতে নিলো। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে তার সাথের লোকটা দৌড়ে আসছে।
“কি হলো এখনো মেয়েটাকে ভরিস নি কেন?”
“আরে সুপারহিরোর মতো কে জানি টপকে পরেছে। চল পালিয়ে যাই দুনিয়াতে কি মেয়ের অভাব?”
“আমরা দুজন আর ও একা। তোর কি মনে হয় আমাদের সাথে ও পারবে। ছেলেটাকে মেরে মেয়েটাকে ইনজেকশন দিয়ে নিয়ে চল।”
“আরে এই মেয়েটাই কেন?”
“এই মেয়েটাকেই লাগবে। ওর সাহস কি করে হলো আমার মাথায় ইট মারার? অনেক দৌড়িয়েছি। এই মেয়েকে না নিয়ে আমি যাব না।”
“ভেবে নে”
“ভেবে নিয়েছি”
তারা সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলেটার মেয়ের মাথা রুমাল দিয়ে ধরে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। একটা লোক দাঁতে দাঁত চেপে বলল-
“আরে এই সুপারহিরোকে মার আর মেয়েটাকে নিয়ে আয়। মেয়েটা হয়তো জ্ঞান হারিয়েছে।”
ববি তাদের দিকে তাকিয়ে বলল-
“সুপারহিরো আমি না। মারামারি থেকে আমি যতদূর সম্ভব থাকি। কারণ এই জিনিসটা আমি ঘৃণা করি এখন।”
“শুনলি? বেটা মারামারি পারে না। যা এখন নিয়ে আয় মেয়েটাকে।”
সাথের লোকটা মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে গেল। আকলিমা ধীরে ধীরে চোখ খুলে লোকটাকে আসতে দেখে ভয়ে আরো ঘেষে দাঁড়াল। লোকটা কিছুটা কাছে আসতেই ববির পেছন থেকে একটা কাঠের বাঁশ দিয়ে কেও তার মাথায় আঘাত করলো। লোকটা মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার করে মাটিতে শুয়ে পরলো। বুরাক ববির পেছন থেকে বেরিয়ে ববি আর আকলিমার দিকে তাকাল। আকলিমা বুরাককে দেখে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো৷ বুরাক সামনের লোকের দিকে তাকিয়ে ববিকে উদ্দেশ্য করে বলল-
“তুই আকলিমাকে নিয়ে হসপিটাল যা। আমি এদের দুজনকে নিয়ে আসছি।”
ববি আকলিমার দিকে তাকিয়ে বলল-
“আপনার মাথায় ব্যান্ডেজ করতে হবে। চলুন আমার সাথে।”
“বুরাক ভাইয়া?”
“ওর চিন্তা করতে হবে না।”
ববি এক হাত দিয়ে আকলিমার কাঁধ ধরে আর এক হাত দিয়ে আকলিমার হাত শক্ত করে ধরে হাঁটা ধরলো। আকলিমার হাঁটতে পারছে না। মাথায় আঘাত লাগার কারণে পায়ে শক্তি পাচ্ছে না। ববি আকলিমাকে কোলে তুলে নিলো। আকলিমা অবাক হওয়ার পর্যন্ত সময় পেলো না তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। ববি হাঁটা ধরলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

মাটিতে পড়ে থাকা লোকটা মাথা ধরে ধীরে ধীরে দাঁড়াতেই বুরাক তার পেটে বাঁশ দিয়ে সজোরে আঘাত করলো। লোকটা পেট ধরে পিছিয়ে গেলো। হাতে থাকা বাঁশ দিয়ে এলোপাথাড়ি ভাবে পিটাতে লাগলো বুরাক তাকে। তার মার খাওয়া দেখে তার সাথের লোকটা দৌড়ে পালালো। তাকে আধমরা করে রেখে বুরাক সাথের লোকটার পেছনে দৌড়ে গেল। লোকটা বার বার পেছনে ফিরে বুরাককে দেখার কারণে পাথরের সাথে পা বেজে মাটিতে পড়ে গেল। বুরাক দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে কলার ধরে টেনে তুললো। বুরাক তাকে বাঁশ দিয়ে মারার আগেই বলল-
“ভাই আমাকে ছেড়ে দে আমরা ওয়াদা করছি সেই মেয়েটাকে ছুঁয়েও দেখবো না।”
বুরাক তার কলার ছেড়ে বাঁশ দিয়ে লোকটার মাথায় মেরে বলল-
“ওর মাথায় আঘাত করার সাহস কি করে হলো?”
লোকটা মাথা ধরে চিৎকার করছে। বুরাক তাকে থাপ্পড় দিয়ে বলল-
“আস্তে চিৎকার কর নাহলে এই বাঁশটা গলার ভেতরে ঢুকিয়ে দিব।”
“ভাই পা ধরছি তোর ছেড়ে দে আমায়।”
“এক শর্তে ছাড়বো”
“কি শর্ত?”
“তোরা মেয়েদের ধরে কোথায় পাচার করিস সেটা বল।”
“এটা বস জানে, প্রতি ৫ মাস পর পর বস মেয়েদের কিডন্যাপ করে অন্যান্য দেশে পাচার করে।”
“বস? এত সম্মান?”
“উনার আন্ডারে আমি কাজ করি।”
“এটাকে কাজ না পাপ বলে।”
বলেই বুরাক তার গালে ঘুষি মারলো। লোকটা গাল ধরে হাঁটু গেড়ে বসে বলল-
“জানি জানি, মেরে মনে করাতে হয়? আমি ওয়াদা করছি এসব কাজ ছেড়ে দিবো। এখন আমাকে আমার প্রাণ নিয়ে ফিরতে দে।”
“আগে তোর বসের ফুল ডিটেইলস আমাকে দে তারপর যেতে দিব।”

উমায়ের এর মনে হলো সে পাহাড় থেকে পড়ে গিয়েছে। সাথে সাথে ধরফরিয়ে উঠে বসলো। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। সে তার ঘরে আছে নিশ্চিত হলো৷ কিন্তু উমায়ের এর ভয় করছে খুব। এত ভয় করার কারণ সে খুঁজে পেলো না। বিছানা ছেড়ে নেমে ঘর থেকে বের হলো। রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে পানি বের করে গ্লাসে ঢেলে নিলো। তিন ঢোকে পানি খেয়ে রান্নাঘর থেকে বের হলো। তার হঠাৎ বুরাককে দেখতে ইচ্ছে করছে৷ নিজের ঘরে ফিরে এসে খাটে বসলো। বুরাক হয় তো এখন ঘুম। কিন্তু উমায়ের এর মনে হচ্ছে বুরাককে দেখলে তার ভয় কমে যাবে। কিন্তু এই গভীর রাতে তার ইচ্ছে পূরণ হওয়া সম্ভব না। বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। মন অতিরিক্ত ছটফট করছে তার। হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিয়ে দেখে ৩ টা ৫০ বাজছে। উমায়ের লম্বা নিশ্বাস ফেলে মোবাইল রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। তখনই বাবা মায়ের গলা শোনা গেল। উমায়ের উঠে ঘর থেকে বাহিরে গেল। বাবা এত রাতে তৈরী হয়ে কোথায় যাচ্ছে। উমায়ের ভ্রু কুঁচকাল। বাবা রাগী কন্ঠে বলল-
“ওদের সাহস কি করে হলো আমাকে না জানিয়ে একা চলে যাওয়ার? আমার এলাকায় এমন ঘটনা ঘটছে আর আমি অজানা থাকবো? লোকে কি বলবে আমার সম্পর্কে?”
উমায়ের দ্রুত হেটে গিয়ে বলল-
“কি হলো আব্বু? কি হয়েছে এলাকায়?”
“তেমন কিছু না তুমি গিয়ে ঘুমাও।”
“আমার ঘুম আসবে না না জানা পর্যন্ত প্লিজ বলো।”
বাবা দাঁড়িয়ে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল-
“এলাকায় কিছুদিন ধরে মেয়েদের হারিয়ে যাওয়ার খবর শোনা যাচ্ছিল। এখন জানলাম তাদের পাচার করার জন্য কিডন্যাপ করা হচ্ছিল। ববি একটা মেয়েকে পছন্দ করে আজ তাকে কিডন্যাপ করতে নিয়েছিল মেয়েটা বুদ্ধি করে ববিকে কল করেছে। ববি আর বুরাক সেখানেই গিয়েছে। এখন আমি আসি পুলিশ স্টেশন যেতে হবে।”
উমায়ের থমকে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা দ্রুত বেরিয়ে পরলো বাসা থেকে। মা উমায়ের এর কাঁধে হাত রেখে বলল-
“চিন্তা করো না তাদের কারো ক্ষতি হবে না। তারা তো ভালো কাজ করতে যাচ্ছে। তুমি এখন রুমে গিয়ে ঘুমাও।”
উমায়ের মায়ের দিকে আহত দৃষ্টি বানিয়ে তাকাল। মা চোখের ইশারায় বলল নিশ্চিন্তে থাকতে৷ উমায়ের হেটে তার ঘরে চলে আসলো। বিছানায় বসে নানা ধরণের কথা বার্তা ভাবছে। উল্টা পাল্টা চিন্তাভাবনা আসছে মাথায়। উমায়ের বিছানায় হেলান দিয়ে হাতমুঠো শক্ত করে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

বুরাক চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। এই নিরব স্থান অবৈধ কাজের জন্য একদম পারফেক্ট। বুরাক পকেট থেকে মাস্ক বের করে পড়ে নিলো। ধীরপায়ে হেটে সামনের দরজায় ঠকঠক করলো। ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। বুরাক দরজা ভালো মতো চেক করলো। ভেতর থেকে বন্ধ। কিভাবে ভেতরে যাবে বুঝতে পারছে না। দুই কদম পিছিয়ে উপরের জানালা গুলোর দিকে চোখ বুলালো। একটা জানালা হালকা ফাঁকা হয়ে আছে। আইডিয়া পেয়েছে, কিন্তু এই আইডিয়াতে রিস্ক খুব। বাড়ির পাইপ বেড়ে উপরের জানালা দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। বাড়িটা বেশী বড়ো না কিন্তু পুরোনো খুব। আর বাড়িটা এলাকার শেষ পর্যায়ে। এখানে মানুষজনের চলাফেরা কম হয়। বুরাক হঠাৎ কারো হেটে আসার শব্দ শুনতে পেল। আলমারির পেছনের জায়গায় গিয়ে লুকিয়ে উঁকি মেরে দেখলো কে। একটা লোক এসে চৌকির নিচ থেকে একটা ব্যাগ করে নিয়ে গেল। বুরাক আলমারির পেছন থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে হেটে গিয়ে ঘর থেকে বের হলো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে যাওয়ার রাস্তা আছে। বুরাক ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামলো। সে বুঝতে পারছে না এখানে লোক এত কম কেন। যেখানে মেয়েদের কিডন্যাপ করে এনে রাখা হয় সেখানে মানুষ কম। বিষয়টা বেশ আজব লাগলো বুরাকের কাছে। হঠাৎ বুরাকের পেছন থেকে কেও বলল-
“এই তুই এখানে কি করিস?”
বুরাক পেছনে ফিরলো লোকটা দ্রুত এসে বলল-
“বস তোদের কেন কাজে রাখলো আমি বুঝলাম না।”
বুরাক বুঝতে পারছে না লোকটা কি বলছে। লোকটা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
“কি দেখোস? যা আন্ডারগ্রাউন্ডে, আর মেয়েগুলোকো ইনজেকশন দিয়ে আয় অকারণে চেচামেচি করছে।”
বুরাক বুঝতে পারলো এই লোকটা তাকে তাদের গ্যাং এর নতুন সদস্য ভাবছে। বুরাক একবার কেশে বলল-
“আমি তো নতুন, আন্ডারগ্রাউন্ড কোথায় দেখিয়ে দিলে ভালো হয়।”
“ঠিক এই কারণেই তোদের খোঁজ খবর আমি রাখি না। সকালে এসেছিস কিন্তু এখনো আন্ডারগ্রাউন্ডে যাস নি?”
“আমি আসলে অন্য কাজে ছিলাম।”
“থাক আর বাহানা বানাতে হবে না আমার পেছনে আয়।”
বুরাক মাথা নাড়িয়ে লোকটার পেছনে যাচ্ছে। লোকটা তাকে একটা গুপ্ত দরজা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নিয়ে গেল। সেখানে আরো অনেকজন লোক আছে। সেই লোকটা বুরাকের দিকে তাকিয়ে বলল-
“ইনজেকশন টেবিলের উপর আছে সবগুলাকে দিয়ে দে। আর হ্যাঁ খেয়াল রাখবি কেও যাতে মেয়েগুলো ছুঁতে না পারে। সবগুলো একটা একটা লু্চ্চা এখানে।”
বুরাক মাথা নাড়াল। সেই লোকটা একা একা বকবক করতে করতে চলে গেল। বুরাক সবার দিকে এক নজর দেখে সামনের দিকে এগোলো। সেখানে যেতেই তার চোখ কপালে উঠে গেল। বাঁধা অবস্থায় এখানে অনেক গুলো মেয়ে পড়ে আছে মাটিতে। সবার অবস্থা বেশ খারাপ। বুরাকের রাগে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা মেয়েকে দেখে তার মনে আসলো সেদিন পুলিশ তাদের যে ছবিটা দেখিয়েছিল এই মেয়েটার ছবি ছিল। বুরাক পেছনে ফিরে বলল-
“বস কখন আসবে?”
একটা লোক বলল-
“সকালে হয় তো, তুই কি আজকে যে ২০ জন মানুষ যে কাজে জয়েন হলো তাদের মধ্যে একজন?”
বুরাক হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।
“তাহলে নিজের কাজের দিকে মনোযোগ দে।”
বুরাক ঘুরে মেয়েগুলোর দিকে তাকাল। একটা মেয়ে নিচু স্বরে পানি চাচ্ছে। বুরাকের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠছে বার বার। সে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে টেবিলের উপরে একটা পানির বোতল আর গ্লাস আছে। বুরাক গিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে নিয়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ একটা লোক তার কাঁধে হাত রেখে বলল-
“পানি কোথায় নিয়ে যাস?”
“মেয়েগুলোর গলা শুকিয়ে গিয়েছে।”
“তোর মনে মায়া দয়াও আছে তবুও বস তোকে কাজে রাখলো? তুই কে রে?”
“মানুষ”
বলেই বুরাক হেটে যেতে নিলো আবার একজন তার পথ আটকিয়ে বলল-
“তোকে আমার সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না।”
“বস আমাকে অর্ডার দিয়েছে একটা মেয়েরও যাতে ক্ষতি না হয়। তাদের সুস্থ সবল অন্য দেশে পাঠাতে হবে। পিপাসার কারণে যদি মেয়েগুলো মরে যায় বসকে কি জবাব দিবি তোরা?”
সবাই বুরাকের কথা শুনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ভাবলো ছেলেটা ঠিক বলছে। একজন দৌড়ে গেল পানি নিয়ে আসার জন্য। বুরাক সেই মেয়েটাকে ধরে ধীরে ধীরে উঠিয়ে মুখের সামনে পানির গ্লাস ধরলো। মেয়েটা নিভু নিভু চোখ করে বুরাককে দেখে গ্লাসে চুমুক বসালো। ঢোক ঢোক করে গ্লাসের পানি শেষ করে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। লোকটা পানি নিয়ে এসে বুরাকের কাছে দিলো। বুরাক সবাইকে পানি পান করাচ্ছিল তখনই বাহির থেকে চিৎকার চেচামেচির শব্দ ভেসে আসলো। একটা লোক দৌড়ে এসে বলল-
“বস যাদের মেয়ে খুঁজে আনতে পাঠিয়েছিল মেইন দরজার সামনে তাদের দুজনের মরদেহ পড়ে আছে। তারাতাড়ি আয় তোরা।”
তার কথা শুনে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা প্রত্যেক লোক দৌড়ে উপরে গেল। বুরাক বাঁকা হাসি দিলো তারা যেতেই। বুরাক এক এক করে সবার বাঁধন খুলে সোজা হয়ে দাঁড়াল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ড্রাফটে যে মেসেজ লিখা ছিল সেটা ফিরোজ আনোয়ারের নাম্বারে সেন্ড করে দিলো। হেটে গিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে আসার সব দরজা বন্ধ করে মেয়েদের দিকে হেটে আসলো। সবাই অবাক হয়ে বুরাককে দেখছে। বুরাক চেহারার মাস্ক খুলে হাসিমুখে বলল-
“আপনারা কেও চিন্তা করবেন না। আমি এসেছি আপনাদের উদ্ধার করতে। নিচে পুলিশরা আছে তাদের সবাইকে আজ এরেস্ট করে নিয়ে যাবে। আর আপনাদের সবাইকে সুস্থ সবল যার যার বাসায় পৌঁছে দিবে।”
বুরাকের কথা শুনে মেয়েগুলোর চেহারায় কান্নাজড়িত হাসি ফুটে উঠলো। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ আসলো। মেয়েরা ভয়ে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে চোখ বুলাচ্ছে। উপরের দেয়াল মনে হচ্ছে ভেঙে পরবে দৌড়াদৌড়ির কারণে। বুরাক সবাইকে বলল চিন্তা করার কারণ নেই। কিছু হবে না। আন্ডারগ্রাউন্ডে আসার দরজায় ঠকঠক শব্দ আসছে। আর কেও একজন মিনতি করছে যে দরজা খুলে ফেলতে। আবার গুলি করার শব্দ আসতেই লোকটার শব্দ আসা বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরোজ আনোয়ারের কল আসলো। বুরাক রিসিভ করে কানে ধরলো।
“বলুন স্যার”
“আমি আমার বডিগার্ডদের আগে আন্ডারগ্রাউন্ডে পাঠাবো। তুমি তাদের মাঝে লুকিয়ে যাবা যাতে পুলিশরা তোমাকে না দেখতে পারে।”
“জি স্যার”
বুরাক কল কেটে গিয়ে দরজা খুলল। ফিরোজ আনোয়ারের সব বডিগার্ডরা দৌড়ে ভেতরে আসলো। বুরাক তাদের মাঝে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। ফিরোজ আনোয়ার আর পুলিশরা এসে মেয়েদের রেস্কিউ করে নিয়ে গেল। সবাই ফিরোজ আনোয়ারের হাত ধরে ধন্যবাদ জানালো। ফিরোজ আনোয়ার আড়চোখে বুরাকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

ফজরের আযান চারপাশে ভাসছে। একটা গাড়ি সেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়ির ভেতর থেকে একটা লোক বেরিয়ে দৌড়ে এসে বাড়ির ভেতরে গেল। মাটিতে চারপাশে রক্ত দেখে লোকটা হাতমুঠো শক্ত করে ফেলল। দৌড়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে দেখে একটা মেয়েও নেই। লোকটা নিজের চুল টেনে ধরে চিৎকার দিলো। আবার চুল ছেড়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। রাগে তার কপালের রগ ফুটে উঠছে। হঠাৎ পেছন থেকে কাচ ভাঙার শব্দ আসলো। লোকটা পেছনে ফিরে দেখে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা ছেলেটাকে চিনলো না। ভালো মতো দেখে বলল-
“কে তুই?”
ছেলেটা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার বরাবর দাঁড়িয়ে বলল-
“তোর কাল আই মিন রাশিদ খানের খুনী, আর তোরও।”
লোকটা চমকে উঠল। নিজের পকেটে হাত দিয়ে পিস্তল বের করার চেষ্টা করতেই বুরাক তার পেটে সজোরে লাথি মেরে দিলো। সে পিছিয়ে যেতেই বুরাক আবার কাছে গিয়ে তার চেহারায় ঘুষি মেরে দিলো। এলোপাথাড়ি ভাবে তাকে ঘুষি লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিলো। যে মানুষটা নিজের প্রাণের রক্ষার জন্য শত শত বডিগার্ড নিয়ে ঘুরে সে মানুষটা কমজোর হয়। বুরাকের চোখের সামনে বর্ষার আর সেই কিডন্যাপ হওয়া মেয়ে গুলোর চেহারা ভাসছে। রাগে বুরাক কটমট করা শুরু করলো। টগর উঠতে যাবে তার আগে আবার বুকে লাথি মেরে দিলো। যে কাচের বোতল একটু আগে ভেঙেছে সেটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে এসে টগরের গলার বরাবর ঢুকিয়ে দিলো। টগরের গলা আর নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। মাছকে পানি থেকে বের করলে যেভাবে মাছ যেভাবে কষ্টে লাফায় ঠিক সেভাবেই টগর মোড়চাচ্ছে। বুরাক তার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার এত শান্তি কখনো লাগে নি। টগর বুরাকের দিকে তাকিয়ে আছে। বুরাক হাঁটু ভেঙে তার দিকে বসে বলল-
“মৃত্যুর আগে জানিয়ে দেই। বর্ষা শাহরিয়ার শাহ এর কেস মনে আছে? সেই বর্ষার ভাই আমি।”
টগর বড়ো বড়ো চোখ করে বুরাকের দিকে তাকিয়ে থেকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। বুরাক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হেটে আসতে নিলো তখনই টগরের মোবাইল বেজে উঠলো। বুরাক ফিরে এসে তার মোবাইল পকেট থেকে বের করে স্ক্রিনে থাকা নাম দেখে থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। ফোনের স্ক্রিনে “বনি” নাম ভাসছে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here