ভরসার_দুহাত শেষ পর্ব_

0
3104

#ভরসার_দুহাত
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৩২(শেষ পর্ব)

উমায়ের জানালার সাথে হেলান দিয়ে রুম্মান আর মোবিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা মোবিনকে হসপিটাল নিয়ে এসেছে। মোবিনকে রুম্মান খাবার খাইয়ে দিচ্ছে। উমায়ের দুজনকে দেখে আফসোস করছে। যদি বুরাক মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতো এমনটা হতো না। উমায়ের ঘাড় ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে দেখলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবলো বুরাকেরও এতে দোষ নেই। অপরাধের ব্যাপারে ভাবলে তার মাথা কাজ করে না। উমায়ের মুচকি হাসলো। রুম্মান উমায়েরকে দেখে বলল-
“তুই চিন্তা করিস না, আমার মন বলছে বুরাক ঠিক ভাবছে।”
উমায়ের রুম্মানের কথা শুনে তার দিকে তাকাল। আপাতত উমায়ের কারো কথা শুনে মনে আশা বাঁধবে না। কারণ তার নিজের ভাগ্যের উপর এক ফোঁটাও বিশ্বাস নেই। মোবিন বলল-
“আমরা জানি উমায়ের তোমার খুব টেনশন হচ্ছে। কিন্তু এই সময় তোমাকে নিজেকে শক্ত রাখতে হবে।”
উমায়ের বলল-
“আমি টেনশন করছি না। আমি ভাবছি বুরাক যদি খালিদ খানকে মেরে ফেলে আর পুলিশ তাকে ধরে ফেলে ফাঁসির আদেশ দিবে কিনা।”
উমায়ের খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল কথাটা। রুম্মান আর মোবিন একে অপরকে এক নজর দেখলো। রুম্মান আবার উমায়ের এর দিকে তাকিয়ে বলল-
“এমন কিছুই হবে না। যদি বুরাক এরেস্টও হয়ে যায় আংকেল কোনো ব্যবস্থা করবেন আমি জানি।”
“বুরাক আব্বুকে বলেছে তাকে নিয়ে আর না ভাবতে। বাবা এখন চেয়ারম্যান। কোনো ক্রিমিনালকে বাঁচালে উনার নাম খারাপ হবে।”
মোবিন বলল-
“কথাটা সঠিক কিন্তু সম্পূর্ণ না। বুরাক খুব ভালো মানুষ। একটা মেয়ের সম্মানের কথা ভেবে সে আমাকে যেভাবে পিটিয়েছে আমি কখনো ভুলবো না।”
বলেই মোবিন গালে হাত দিয়ে শব্দ করে হাসলো। উমায়ের মন খারাপ করে বলল-
“ওর তরফ থেকে আমি মাফ চাচ্ছি ভাইয়া।”
“কোনো প্রয়োজন নেই। আমি ওর ফিলিংসের খুব সম্মান করি। এখন আমি খুব লজ্জিত, এক সময় তার ছোটো বোনকে খারাপ নজরে দেখেছিলাম আমরা। সেদিন খুব নেশা করেছিলাম। কিভাবে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝে উঠতে পারি নি।”
রুম্মান মুখ বাঁকা করে বলল-
“উমায়ের, তোর আর আমার ভাগ্যে ক্রিমিনালই লিখা ছিল? তোরজন তো ভালো কাজ করে ক্রিমিনাল। আর আমারজন খারাপ করে ক্রিমিনালের ট্যাগ লাগিয়ে এখন ভালো হয়েছে।”
মোবিন রুম্মানের কথা শুনে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল। রুম্মান ভেংচি কেটে বলল-
“সত্য বললে গায়ে লাগে তাই না?”
“আমি ওয়াদা করেছি না তোমার চোখে দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো মানুষ আর স্বামী হয়ে দেখাবো?”
“দেখা যাবে, এখন হা করো।”
“আর খাবো না পেট ভরে গিয়েছে।”
“মার খাবেন?”
মোবিন বিরক্ত ভাব নিয়ে রুম্মানকে ইশারায় উমায়েরকে দেখালো। রুম্মান রাগী দৃষ্টি বানিয়ে কিছু বলতে নিলো তার আগেই উমায়ের বলল-
“আচ্ছা আচ্ছা অনেক হয়েছে। আমি এখন আসি বাসায় যেতে হবে। আর রুম্মান তুই ভাইয়াকে নিয়ে বাসায় পৌঁছে আমাকে মেসেজ করে জানিয়ে দিস।”
“একা যেতে পারবি?”
উমায়ের হাসিমুখে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। রুম্মান আর মোবিনকে বিদায় জানিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। রুম্মান তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। মোবিন রুম্মানের হাত ধরে বলল-
“কি ভাবছো?”
রুম্মান দরজার দিকে চোখ রেখেই বলল-
“জানেন উমায়ের খুব বদলে গিয়েছে? সে এমন একদমই ছিল না। এই মেয়েটা অন্ধকার ভয় পেতো। হিংস্র প্রানীর সম্পর্কে শুনলে ভয়ে কেঁদে দিতো। ভূতের মুভি থেকে শুরু করে মার্ডার শব্দটা শুনলেও ভয়ে কান চেপে ধরতো। আর আজ এই মেয়েটাকে দেখলে মনে হয় না তার মধ্যে এসব বলতেও কিছু ছিল। এমন একজন মানুষকে ভালোবাসে যে মানুষের প্রান এমনভাবে নিতে পারে যেভাবে মানুষ পিঁপড়াকে মারে।”
“সময়ের সাথে মানুষ বদলায়। তুমি সবসময় উমায়ের এর পাশে থেকো।”
রুম্মান মোবিনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে মাথা নাড়াল।

উমায়ের বাসায় পৌঁছে হলরুমের সোফায় ধপ করে বসলো। মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করছে তার। উসমান উজ্জ্বল পুরো হলরুম জুড়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। উমায়ের ২ বার তাদের বলল চুপচাপ বসতে কিন্তু তারা শুনলো না। উমায়ের রেগে উঠলো। টি টেবিলের উপর একটা কাঁচের গ্লাস ছিল। গ্লাস হাতে নিয়ে ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দিলো। উসমান আর উজ্জ্বল দাড়িয়ে পরলো। উমায়ের এর দিকে তাকিয়ে তারা ঢোক গিলল। উমায়ের চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে রেগে আগুন হয়ে আছে। মা বাবা কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ পেয়ে দৌড়ে বাহিরে আসলো। এসে দেখে উমায়ের রাগে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। মা দ্রুত এসে উমায়ের এর সামনে দাঁড়াল। উমায়ের রাগী দৃষ্টিতে কাঁচগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মা উমায়ের এর মাথায় হাত রেখে কি হয়েছে উমায়ের জিজ্ঞেস করতেই উমায়ের এক ঝটকায় মায়ের হাত ছাড়িয়ে রাগী দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে উঁচু স্বরে বলল-
“কি হয়েছে মানে কি? তোমার ছেলেদের বুঝাতে পারো না বড়োদের কথা মেনে চলতে হয়? কতবার বললাম চুপচাপ বসতে কিন্তু না তারা তো নিজের এলাকার রাজা। আমি ওদের বড়ো বোন না-কি অন্য কিছু বুঝতে পারি না। সময় আছে ওদের ভালো শিক্ষা দিয়ে মানুষ করো।”
বলেই উমায়ের রাগে হনহন করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেল। বাবা মা উসমান উজ্জ্বল চারজনই হা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উমায়ের এর কাছ থেকে এমন ব্যবহারের আশা তারা করেনি৷ বাবা উসমান আর উজ্জ্বলের দিকে তাকাল। তারা মন খারাপ করেছে। বাবা এগিয়ে গিয়ে উসমান আর উজ্জ্বলের মাথায় হাত রেখে বলল-
“তোমরা মন খারাপ করো না। আপু এখন অনেক টেনশনে আছে তাই এমন ব্যবহার করছে। সে তোমাদের অনেক ভালোবাসে। এখন তোমরা ঘরে গিয়ে কার্টুন দেখো, ওকে?”
উসমান উজ্জ্বল মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। মা কাঁচের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল-
“আমার মেয়েটা তো এমন ছিল না।”
“চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমরা বার বার না করেছিলাম কোনো প্রয়োজন নেই আপনার চেয়ারম্যান হওয়া। কিন্তু না, আপনি কারো কথা শুনেন নি। আপনি যবে থেকে চেয়ারম্যান হয়েছেন আমাদের সবার জীবন বদলে গিয়েছে। বিপদের উপর বিপদ আসছে।”
“আমার এখন মনে হচ্ছে তোমরা সঠিক ছিলে। আমি শত্রু রাখতে চাই নি। চেয়ারম্যান হওয়ায় এত বিপদ আসবে কল্পনাও করি নি। তুমি এক কাজ করো। মেয়ের জন্য খাবার নিয়ে যাও ঘরে। ওকে খাইয়ে লো পাওয়ারের ঘুমের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিও।”
মা কিছু না বলেই রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। বাবা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল।

উমায়ের ঘর অন্ধকার করে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। চোখের কোণা বেয়ে পানি পরছে তার। চিৎকার করে কান্না করতে পারবে তার মন হালকা হতো। দরজা খোলার শব্দ আসলো। উমায়ের সোজা হয়ে বসে দ্রুত চোখের পানি মুছলো। মা ঘরের লাইট জ্বালিয়ে উমায়ের এর দিকে তাকাল। উমায়ের মাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে বসলো। মা এগিয়ে এসে উমায়ের এর পাশে বসে খাবারের ট্রেটা পাশে রাখলো। উমায়ের এর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ট্রে থেকে প্লেট নিয়ে বলল-
“এখন বলো না যে খেতে ইচ্ছে করছে না বা ক্ষুধা নেই। কারণ আমি কেমন তুমি জানো।”
“আমার খেতে মন চাচ্ছে না।”
“আমরা কি মনের জন্য খাবার খাই? আমরা আমাদের পেটের জন্য খাবার খাই। আর পেট কখনো খাবার খেতে না করে না।”
উমায়ের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল-
“তোমরা এমন কেন? কোনো না কোনো ভাবে মানিয়েই ফেলো আমাকে।”
মা হেসে উমায়ের এর নাক ধরে টেনে বলল-
“কারণ আমরা তোমার জন্মদাতা মা-বাবা। এবার চোখ মুছে সুন্দর করে বসুন আমি নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছি।”
উমায়ের জানে না করেও লাভ হবে না। চুপচাপ মায়ের দিকে ঘুরে বসলো৷ মা নানা ধরনের কথা বলতে বলতে উমায়েরকে খাইয়ে দিলো। উমায়ের কোনো কথা বলল না। শুধু মা কি বলেছে তা-ই শুনলো। খাইয়ে দিয়ে মা উমায়ের এর জন্য ঘুমের ঔষধ বের করবো। উমায়ের এর এখন মানসিক শান্তি দরকার। আর ঘুমের চেয়ে আর ভালো কোনো ঔষধ নেই শরীর মন সুস্থ করার। মা উঠে চলে যেতে নিলো উমায়ের মায়ের ঘরে বলল-
“আমাকে ক্ষমা করে দিও আম্মু।”
মা উমায়ের এর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। উমায়ের এর মাথায় চুমু দিয়ে এগিয়ে গেল। দরজার দিকে গিয়ে উমায়ের এর দিকে ঘুরে বলল-
“যার জন্য তোমার টেনশন হচ্ছে তার জন্য মন থেকে দোয়া করলেই হবে। আর বিশ্বাস রাখতে হবে যে তার কিছু হবে না।”
উমায়ের কিছু বলল না। মা কথাটা শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। উমায়ের চুপচাপ বসে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তার ঘুম আসতে লাগলো। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখের সামনে বুরাকের চেহারা ভাসছে। দুচোখ বেয়ে পানি পরছে আবার তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে উমায়ের এর চোখ বন্ধ করে ফেলল।

অন্যদিকে…..
খালিদ খান ভয়ে মুখ চেপে ধরে টেবিলের নিচে লুকিয়ে আছে। পুরো বাড়ির ইলেকট্রন পাওয়ার সে বন্ধ করে দিয়েছে। সে ভেবেছিল কি আর হয়ে গেল কি। ভেবেছিল বুরাককে মন ভরে টর্চার করে তিলে তিলে শেষ করবে। কিন্তু না, জ্ঞান হারানোর ৫ মিনিটের মধ্যে বুরাকের জ্ঞান ফিরে এসেছে। মাথায় আঘাত লাগার কারণে সে আরো পাগলামি করছে। জ্ঞান ফিরতেই খালিদ খানকে ইচ্ছে মতো থাপ্পড় মেরেছিল। শেষমেশ বাগান থেকে লাঙল নিয়ে খালিদ খানকে মারার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। খালিদ খান এখন নিজেকে ইচ্ছে মতো গালাগাল করছে। তার উচিত হয়নি লাঙলটা বাগানে রাখা। এটা দিয়ে বুরাক তাকে আঘাত করলেই অর্ধেক প্রাণ বেরিয়ে যাবে। হঠাৎ হেটে আসার শব্দ আসলো। খালিদ খান নিশ্বাসও নিতে পারছে না ঠিক মতো কারণ হলো চারপাশ নিরব আর নিশ্বাস নিলে শব্দ হয়। বুরাক অন্ধকার বলে কিছু বুঝতে পারছে না। চারপাশ ভালো মতো দেখে বলল-
“টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার
আই এম ইওর মার্ডারার হোয়ার ইউ আর?”
খালিদ খান থতমত খেয়ে গেল। বুরাকের মাথা হয় তো সত্যি খারাপ হয়ে গিয়েছে তাই এমন কথাবার্তা বলছে। বুরাক আবার উঁচু স্বরে বলল-
“বের হো খালিদ খান। আমি যদি তোকে খুঁজে বের করি আস্ত গিলে খাবো।”
খালিদ খান ভয়ে ফুপাচ্ছে। বুরাক আশে পাশে না থাকলে কিছুক্ষণ সে শব্দ করে কাঁদবে ভেবে নিয়েছে। বুরাক ঘুরেফিরে সব জায়গা দেখে ডাইনিং রুম থেকে বের হলো। ভাবলো বাহিরে গিয়ে মেইন সুইচবোর্ড চেক করে চারপাশ আলোকিত করে নিলে ভালো হয়। এতে সে খালিদ খানকে তারাতাড়ি খুঁজে পাবে। বুরাক বাহিরের দিকে হাঁটা ধরতেই খালিদ খান ভাবলো বুরাক হয়তো চলে গিয়েছে তাকে না পেয়ে। বা সে ভেবেছে খালিদ খান বাহিরে। খালিদ খান নিশ্চিন্তের নিশ্বাস ফেলল। টেবিলের নিচ থেকে বের হয়ে বাহিরে গেল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুরাককে না পেয়ে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। এখন তার মনে হচ্ছে সে সেফ। হঠাৎ চারপাশের লাইট জ্বলে উঠলো। লাইট জ্বলতেই খালিদ খান চমকে উঠল। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। পেছন থেকে হেটে আসার শব্দ আসলো। পেছনে ফিরতেই দেখে বুরাক মাত্র দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো। বুরাক আর খালিদ খান একে অপরকে দেখে দাঁড়িয়ে আছে। একজনের চোখে ভয় আরেকজনের চোখে রাগ ফুটে উঠলো। খালিদ খান ঢোক গিলে ডান বাম দেখে ভাবছে কোথায় পালানো যায়। বুরাক চোখ ঘুরিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা লোহার রডের দিকে তাকাল। খালিদ খান বুরাকের চাহনি দেখে বুঝতে পারলো বুরাক কি করতে চলেছে। বুরাক নিচু হয়ে রড হাতে নিতেই খালিদ খান দৌড়ে চলে গেল। বুরাক তার পালানো দেখে হাসলো। ধীরপায়ে হেটে খালিদ খানের পেছনে গেল। খালিদ খান দৌড়াতে দৌড়াতে ছাদে চলে গিয়েছে। ছাদে গিয়ে সে আরো ভয় পেয়ে গেল। এখন তো পালানোর মতো কোনো জায়গা নেই। পেছন থেকে হেটে আসার শব্দ আসছে। খালিদ খান পেছনে ফিরে দরজার দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপছে। বুরাক ছাদে এসে খালিদ খানের দিকে তাকাল। খালিদ খান তাকে দেখে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল-
“আমাকে ছেড়ে দে বুরাক। আমি আর কখনো এমন করবো না। আমি ওয়াদা করছি কারো ক্ষতি করবো না।”
“সবাই ওয়াদা করে কিন্তু নিজের দোষ শিকার করে না।”
“আমি করছি৷ আমি সব শিকার করছি। তুই বললে আমি পুলিশকেও সব বলে দিবো।”
“ঠিক আছে, তার আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দে।”
“কি প্রশ্ন?”
“হায়াতের সাথে তোর ভাই রাশিদ খান কি করেছিল?”
বুরাকের প্রশ্ন শুনে খালিদ খান ভ্রু কুঁচকে কি যেন ভাবতে লাগলো। বুরাক তার জবাবের আশায় তাকিয়ে আছে। খালিদ খান বুরাকের দিকে তাকিয়ে বলল-
“কোন হায়াত?”
“কেন? তোর ভাই কয়টা হায়াতের জীবন নষ্ট করেছে?”
“আমি গুনে দেখি নি। রাশিদ যত পাপ করেছে সব পাপে পর্দা দিতে দিতে আমি ভুলে গিয়েছি।”
বুরাক খালিদ খানের সামনে এগিয়ে এসে বলল-
“এখন কি নিজের ভুল বুঝতে পারলি তুই?”
“আমি ভুল করেছি সেটা অস্বীকার করছি না। রাশিদ আমার ভাই না। আমার ছেলে ছিল সে। ওকে এতোই ভালোবাসি যে ওর পাপকে পাপ মনে হতো না। মনে হতো সে বাচ্চামি করছে ঠিক হয়ে যাবে খুব শীগগিরই। ওর ভুল ধরিয়ে দেয়ার বদলে আমি ওর পাপ ঢেকেছি।”
“এখন এসব বলে লাভ নেই। এই ভালোবাসার কারণে কত মানুষের জীবন নষ্ট হয়েছে জানিস?”
খালিদ খান বুরাকের ধমক শুনে ভয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। বুরাক রাগী দৃষ্টি বানিয়ে আবার বলল-
“রাশিদের বন্ধু মোবিন আর হায়াত। সেই হায়াত যাকে ধর্ষণ করার অপরাধে মোবিন জেলে গিয়েছিল।”
“ও আচ্ছা সেই ঘটনা?”
বুরাক হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। খালিদ খান বলল-
“আমি ঘটনা চলাকালীন এসব সম্পর্কে জানতাম না। হায়াতের মৃত্যুর পর রাশিদ আমাকে সব বলেছে। মোবিন তার ছোটবেলার বন্ধু হওয়ার পরও একটা মেয়ের জন্য তার সাথে ঝগড়া করেছিল। রাশিদ এটা মেনে নিতে পারছিল না। সে অপেক্ষায় ছিল মোবিনের একটা ভুলের। একদিন সে জানতে পারে মোবিন আর হায়াত মোবিনের ফার্মহাউসে রাত কাটিয়েছে। রাশিদ হায়াতের সাথে দেখা করে। হায়াতকে হুমকি দিয়ে রাতের সম্পর্কে সব জানে। সব শুনে রাশিদ ভাবে এটাই সঠিক সময় প্রতিশোধ নেয়ার। রাশিদ হায়াতকে হুমকি দেয় সে তার কথা না শুনলে হায়াতের পরিবারকে মেরে ফেলবে। হায়াত ভয় পেয়ে যায়। রাশিদ যা বলে তাই করে হায়াত জানতো। সে রাশিদের কথায় মোবিনের নামে ধর্ষণের মামলা করে। কিছুদিন পর আমি জানতে পারি হায়াত আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছিল কেন জানি। রাশিদকে আমি বকাঝকা করে জিজ্ঞেস করায় সে আমাকে সব বলে। আর এটাও বলে হায়াতের সাথে জোর করে শারীরিক সম্পর্ক করে রাশিদ। যার কারণে হায়াতের মৃত্যু হয়। কিন্তু সে হায়াতের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বানিয়ে ফেলে।”
বুরাক হাতমুঠো শক্ত করে রেখেছে। খালিদ খান একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বুরাকের দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি জানি ও পাপী, কিন্তু বুরাক আমি রাশিদকে অনেক ভালোবাসি। তুই ঠিক করিস নি ওকে মেরে।”
বলেই খালিদ খান বুরাকের গলা চেপে ধরলো। বুরাকের হাত থেকে লোহার রড পড়ে গিয়েছে। খালিদ খান শরীরের সব শক্তি দিয়ে ধরে রেখেছে বুরাকের গলা। বুরাকের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। সজোরে খালিদ খানের পেটে লাথি মেরে নিজেকে ছাড়ালো। খালিদ খান ছিটকে পরতেই বুরাক তার গলা ধরে কাশতে লাগলো। নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে তার। খালিদ খান উঠে আবার দৌড়ে আসলো বুরাকের দিকে। বুরাক দাঁতে দাঁত চেপে দৌড়ে গিয়ে খালিদ খান গালে ঘুষি মারলো। এলোপাথাড়ি ভাবে খালিদ খানকে মারতে মারতে ছাদের রেলিঙের দিকে নিয়ে গেল। খালিদ খান মুখ নাক বেয়ে রক্ত ঝরছে। বুরাক খালিদ খানের কলার চেপে ধরে বলল-
“তোর পাপের গর্ত ভরে গিয়েছে। এখন গিয়ে জবাবদিহি কর।”
বলেই বুরাক খালিদ খানকে ছাদ থেকে ফেলে দিলো। বুরাক ছাদ থেকে উঁকি দিয়ে খালিদ খানের দিকে তাকাল। রক্তে মাটি ভেসে যাচ্ছে। বুরাক ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। তখনই রাস্তা থেকে পুলিশের গাড়ি আসার শব্দ আসলো। বুরাক মেইন গেইটের দিকে তাকাল। দরজা ঠেলে অনেকগুলো পুলিশ দৌড়ে আসলো। বুরাক খেয়াল করলো ববি আর ফিরোজ আনোয়ারও এসেছে। পুলিশ খালিদ খানকে দেখে ছাদের দিকে টর্চ দিয়ে দেখে বুরাক দাঁড়িয়ে আছে। ফিরোজ আনোয়ার চোখ বন্ধ করে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। পারলেন না উনি বুরাককে বাঁচাতে। আজ খুব আফসোস হচ্ছে। বুরাক ছাদ থেকে নেমে বাহিরে আসলো। এগিয়ে এসে পুলিশের বরাবর দাঁড়িয়ে দু’হাতে এগিয়ে দিলো। পুলিশ মাথা নিচু করে বুরাকের দুহাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দিলো। ববি বুরাকের কাঁধে হাত রাখতেই বুরাক ববির দিকে তাকিয়ে বলল-
“মিস করবো তোকে।”
ববির চোখের পানি জমে গেল। মুখ ঘুরিয়ে ফেলল সাথে সাথে। পুলিশ বুরাককে নিয়ে পুলিশ জিপে উঠে গেল। বুরাক ফিরোজ আনোয়ারের দিকে তাকাতেই তার চোখের সামনে উমায়ের এর চেহারা ভেসে আসলো। এসব কিছুর মাঝে সে মেয়েটার কথা একটুও ভাবলো না। বুরাক মাথা নিচু করে ঢোক গিলে কান্না থামালো। কিছু কিছু ভালোবাসা পূর্ণতা না পাওয়াই ভালো।

২দিন পর……
সকাল ৬ টা বেজে ৪৫ মিনিট। ঠিক ৭ টায় বুরাকের শাস্তি শোনানো হবে। উমায়ের নিজেকে ঘরবন্দী করে বসে আছে। বুরাককে পুলিশ ধরার পর সে একবারো কান্না করেনি। ভেবেছে কান্না করে লাভ নেই। যদি কান্না করায় বুরাকের শাস্তি মাফ করে দেয়া হতো সে অনেক কান্না করতো। উমায়ের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। সে অপেক্ষায় আছে কখন ববি তাকে কল দিয়ে জানাবে বুরাকের শাস্তির সম্পর্কে। বাবা তাকে বলেছিল তাদের সাথে যেতে। কিন্তু উমায়ের যায়নি। হয় তো বুরাককে দেখলে সে নিজেকে সামলাতে পারবে না। ফিরোজ আনোয়ার বুরাকের বাবা ভাইকে কল দিয়ে আসতে বলেছে। উমায়ের ভাবছে সে বুরাকের মাকে কি জবাব দিবে। সে তো মাকে ওয়াদা করেছি বুরাকের কিছু হবে না। উমায়ের চোখ বন্ধ করে ঢোক গিলল।
ঠিক ৭ টা বেজে ৪০ মিনিট হতেই উমায়ের এর মোবাইলে কল আসলো। উমায়ের তারাতাড়ি মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে ববি কল করেছে। রিসিভ করে কানে ধরলো। কিন্তু উমায়ের কিছু বলছে না। অপরপাশ থেকে কথা ভেসে আসলো।
“শুনলাম গতকাল আমার বিরুদ্ধে আগের সব কেস বন্ধ করে দিয়েছে ফিরোজ স্যার। খালিদ খান, রাশিদ খান, টগর, বনি সবাই ক্রিমিনাল ছিল। আমি সেই ক্রিমিনালদের মেরেছি। কিন্তু মানুষ খুন করা অপরাধ হোক সে মানুষটা অপরাধী। আইন নিজের হাতে নেয়ার কারণে আমাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।”
বুরাকের কন্ঠ শুনে উমায়ের এর চোখ বেয়ে পানি পরলো। ৭ বছর, এই বছর উমায়ের কিভাবে কাটাবে বুঝতে পারছে না। সে জানে না এই ৭ বছরে কি কি ঘটবে। যদি উমায়ের মরে যায় সে বুরাককে ৭ বছর পর দেখবে কিভাবে? বা বুরাকের যাতে কিছু হয়ে যায় কারাগারে থাকতে থাকতে? উমায়ের এর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বুরাক বলল-
“আমি দুইদিন অনেক ভেবেছি উমায়ের। তোমার সাথে জীবন কাটানোর লোভ ঢুকে গিয়েছে মনে।”
উমায়ের নিঃশব্দে কাঁদলো। তার অনেক কিছু বলতে মন চাচ্ছে কিন্তু কিভাবে বলবে। কেও যেন তার গলা চেপে ধরে রেখেছে। হঠাৎ ববির কন্ঠ ভেসে আসলো-
“বুরাক, তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে।”
“আসছি”
বুরাকের আসছি শুনে উমায়ের কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল-
“আমি অপেক্ষা করবো।”
উমায়ের এর কথা শুনে বুরাক মুচকি হাসলো। কান থেকে মোবাইল সরিয়ে ববির দিকে হাসিমুখে তাকাল। উমায়ের কল কেটে হাঁটুতে মুখ গুঁজে শব্দ করে কেঁদে উঠলো।

৭ বছর পর…..
মোবাইলের রিং বাজার শব্দে উমায়ের নড়েচড়ে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। মাথার কাছ থেকে মোবাইল বের করে দেখে রুম্মানের নাম ভাসছে। উমায়ের বিছানার সাথে হেলান দিয়ে রিসিভ করে কানে ধরলো।
“হ্যাঁ বল”
“আত্তামালাইকুম আন্তি, মাম্মাম তথা বলবে।”
৪ বছরের রাইশার কথা শুনে উমায়ের হাসলো।
“ওয়ালাইকুম আসসালাম মামনি, কোথায় তোমার মাম্মাম?”
“পাপ্পার তাই বাদতে”
উমায়ের রাইশার কথা শুনে কিছুক্ষণ বসে ভাবলো। কিছুক্ষণ ভাবার পর সে বুঝতে পারলো রাইশা বলেছে মাম্মাম তার পাপার টাই বেঁধে দিচ্ছে। রাইশার হাত থেকে রুম্মান মোবাইল নিয়ে কানে ধরে বলল-
“এই মেয়েটাকে নিয়ে আমি আর পারি না। মাত্র বললাম আমি কিছুক্ষণ পর উমায়েরকে কল দিবো। ব্যস, তোর না শুনেই সে সাথে সাথে তোকে কল দিয়ে দিলো।”
উমায়ের হেসে বলল-
“কতবার বলেছি ওর হাতে মোবাইল দিস না। স্কুলে ভর্তি করিয়েছিস বেশী মোবাইল দেখলে পড়াশোনার দিকে মন বসবে না।”
“এটা আমাকে না বলে ওর বাপকে বল। আমাকে না জিজ্ঞেস করে জন্মদিকে ট্যাব কিনে দিয়েছে মেয়েকে। ব্যস মেয়ে আমার থেকেও বেশী পারে এখন মোবাইল চালাতে।”
উমায়ের শব্দ করে হেসে সোজা হয়ে বসলো। রুম্মান লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল-
“বলেছিলি আজ দেখা করবি।”
“হ্যাঁ, তুই রাইশাকে স্কুলে দিয়ে ভার্সিটির সামনে আয়।”
“আজ বুরাক আসছে আর তুই ঘুরতে বের হোবি? বাসায় থাক ছেলেটার জন্য রান্নাবান্না কর।”
“পারবো না, তুই রাইশাকে নিয়প স্কুলে যা আমি অপেক্ষা করবো।”
“তুই শুধরাবি না।”
উমায়ের হেসে কান থেকে মোবাইল সরিয়ে কেটে বিছানা ছেড়ে নামলো। ঘাড় ঘুরিয়ে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল। আজকের দিনের অপেক্ষা সে ৭ বছর করেছে। এই ৭ বছর তার জন্য ৭০ বছরের মতো কেটেছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না ৭ বছর কেটে গিয়েছে। আজ তার বুরাক ফিরে আসবে। উমায়ের নিজেকে এক নজর আয়নায় দেখলো। লজ্জা লাগছে হঠাৎ। বিরক্ত হয়ে ড্রয়ার থেকে জামা বের করে বাথরুমে চলে গেল।

আকলিমার ডাকে ববির ঘুম ভাঙলো। ববি আর আকলিমার বিয়ের ৩ বছর চলছে। ববি আকলিমার সাথে তার আশ্রমেই থাকে। দুজন মিলে আশ্রম দেখা শোনা করে। ববি ফিরোজ আনোয়ারের সাথে উনার ব্যবসা সামলায়। সব মিলিয়ে তাদের জীবন বেশ ভালো কাটছে। ববি উঠে বসলো। আকলিমা ববির পাশে বসে বলল-
“আজকের দিন তোমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ আমি জানি। নিজ চোখে দেখেছি কিভাবে কাঁদতে বুরাক ভাইয়ার জন্য।”
ববি আকলিমার কাঁধে মাথা রেখে বলল-
“আমার ছোটোবেলার বন্ধু সে। আমার ছোটো থেকে ছোটো বড়ো থেকে বড়ো বিপদে পাশে ছিল। আমি আজ কতটা খুশী বলে বুঝাতে পারবো না।”
“তা জানি, এখন তারাতাড়ি উঠে তৈরী হয়ে নাও। তারপর আমরা বুরাক ভাইয়াকে নিতে যাব।”
ববি আকলিমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আকলিমার কপালে চুমু দিলো। আকলিমা তারাতাড়ি বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল-
“তারাতাড়ি যাও”
“যাচ্ছি যাচ্ছি”
ববি আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে নেমে ফ্রেশ হতে চলে গেল। আকলিমার ববির জামা বের করে বিছানায় রেখে রান্নাঘরে চলে গেল। কাজের মানুষরা সবার জন্য খাবার বানিয়ে রেখেছে। আকলিমা সব বাবা মাদের খাবার দিয়ে ববি আর তার খাবার নিয়ে ঘরে আসলো। ববি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা মুছছে। আকলিমা বিছানার উপর খাবারের ট্রে রেখে ববির দিকে হেটে এসে ববিকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরলো। ববি আয়নার দিকে তাকিয়ে আকলিমাকে দেখে বলল-
“হঠাৎ রোমান্টিক মুডে কেন?”
“তোমাকে জড়িয়ে না ধরলে আমার সকাল শুরু হয় না।”
ববি হেসে ঘুরে আকলিমাকে জড়িয়ে ধরলো।

রোদে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা পানির মাথায় ঢেলে যাচ্ছে বুরাক। শীতকালেও ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে করতে তার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে তার৷ কারাদণ্ডে তার অনেকগুলো বন্ধু হয়েছে। আজ সবাই বেশ খুশী বুরাকের জন্য। বুরাক ধীরে ধীরে চোখ খুলে সূর্যের দিকে তাকাল। আজ সে ৭ বছর পর বাহিরের পরিবেশ দেখবে। সে অপেক্ষায় আছে কখন মা আর উমায়েরকে দেখবে। এই দুজনক সে সবচেয়ে বেশী মিস করেছে। হঠাৎ পেছন থেকে একটা ভারী কন্ঠ ভেসে আসলো।
“হয়েছে তোর? তারাতাড়ি চল কমিশনার স্যার এসে পরেছে।”
বুরাক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে একজন পুলিশ এসেছে। বুরাক মুচকি হেসে মাথা নাড়াল। বুরাক গোসল সেরে জামা বদলে বাহিরে আসলো। কারাগারে সবার সাথে দেখা করে বিদায় নিয়ে পুলিশটার সাথে এগিয়ে গেল। কমিশনার স্যার বসে আছেন। বুরাক উনাকে দেখে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কমিশনার স্যার বুরাকের জেলে আসার কারণ দেখে বলল-
“আইন হাতে কেন নিয়েছিলে জানতে পারি?”
“খালিদ খানের সাথে আমার পুরানো শত্রুতা ছিল তাই।”
“তার বিরুদ্ধে তোমার কাছে প্রমাণ ছিল?”
“না, আমি নিজেই একজ প্রমাণ তার প্রত্যেক অপরাধের।”
“হ্যাঁ তুমি তো ওর স্পেশাল লোক ছিলে।”
“জি”
“আজ তুমি মুক্ত হতে চলেছো। আশা করছি আর বাজে কাজে জড়াবে না।”
“ফিরোজ আনোয়ার স্যার আমাকে বলেছিলেন কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর উনার সাথে উনার ব্যবসায় সাহায্য করতে।
“ফিরোজ আনোয়ারের উপর আমার বিশ্বাস আছে। তুমি উনার ভরসা কখনো ভেঙো না।”
“জি স্যার”
“এখন যেতে পারো। তোমার অপেক্ষা করছে তোমার পরিবার।”
বুরাক মুচকি হাসলো। ধীরপায়ে হেটে বাহিরের দিকে গেল। একজন পুলিশ তার সাথে আছে দরজা পর্যন্ত দিতে। বুরাক বড়ো লোহার দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। সিকিউরিটি গার্ড দরজা খুলে দিলো বুরাককে দেখে। বুরাক পুলিশ আর সিকিউরিটি গার্ডকে সালাম দিয়ে বিদায় নিয়ে বের হলো। চারপাশের পরিবেশ দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। হঠাৎ চোখ গেল ডান দিকে। একটা গাড়ির সামনে তার পরিচিত চেহারা দেখা যাচ্ছে। মাকে দেখে বুরাকের বুক মোচড় দিয়ে উঠলো। মায়ের স্বাস্থ্য এমন ছিল না। মা বুরাককে দেখে এক কদম এগিয়ে আসতেই বুরাক দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মা হাউমাউ করে কাঁদছে বুরাককে জড়িয়ে ধরে। বুরাক মাকে ছেড়ে চোখের পানি মুছে দিলো। মা বুরাকের চেহারায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিলো। বুরাক বাবাকে দেখে এগিয়ে গেল। বাবা বুরাককে জাপ্টে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। বুরাকের বুক আবার ভারী হয়ে আসলো বাবার কান্না দেখে। নিজেকে সামলে নিয়ে বাবার চোখ মুছে দিলো। ববি আর আকলিমাকে একসাথে দেখে বুরাক হাসলো। বুরাক কাছে আসতেই ববি বুরাককে জড়িয়ে ধরলো। সবার কান্না দেখে বুরাক বলল-
“হয়েছে তো আর কত কাঁদবে তোমরা? প্লিজ এবার থামো। আমি ফিরে এসেছি আর কোথাও যাবো না।”
ববি বুরাককে ছেড়ে বলল-
“তোকে আর কোথাও যেতেও দিবো না।”
“ঠিক আছে, তো এখন বল আমার বোনের খেয়াল রাখছিস তো?”
আকলিমা হেসে বলল-
“আমার ভাই ফিরে এসেছে। এখন থেকে আমার রাজত্ব চলবে। আমাকে কিছু বললেই ভাইয়ার কাছে বিচার দিবো বলে দিলাম।”
ববি আহত কন্ঠে বলল-
“এমনভাবে বলছে যেন আমি অনেক নির্যাতন করি ওর উপর। অথচ আমি একজন অবলা পুরুষ যে নির্যাতনের শিকার হয়।”
“এখন একটু বেশী হয়ে গেল।”
বুরাক শব্দ করে হেসে উঠলো তাদের কথা শুনে। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেল বুরাক। পেছনে ফিরে দেখে ফিরোজ আনোয়ার দাঁড়িয়ে আছে। বুরাক উনাকে দেখে সালাম দিলো। ফিরোজ আনোয়ার বুরাককে জড়িয়ে ধরে সালামের উত্তর নিলো। বুরাকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-
“আমার ভরসার মানুষ ফিরে এসেছে। এখন অনেক শান্তি লাগছে আমার।”
বুরাক মুচকি হাসলো ফিরোজ আনোয়ারের কথা শুনে। ফিরোজ আনোয়ার বুরাককে ছেড়ে চোখ মুছে বলল-
“চলো এখন বাসায় যাওয়া যাক।”
বুরাক মাথা নাড়াল। সবাই গাড়িতে উঠে বসতে নিলো তখনই ফিরোজ আনোয়ার বুরাকের হাত ধরে বলল-
“তুমি এখন বাসায় যাবে না।”
বুরাক বুঝতে পারলো না ফিরোজ আনোয়ারের কথার মানে। ফিরোজ আনোয়ার মুচকি হেসে বলল-
“ভার্সিটির সামনে কেও একজন তোমার অপেক্ষা করছে। তাকে নিয়ে তারপর বাসায় আসবে।”
বুরাক ফিরোজ আনোয়ারের কথা বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে ফেলল। সবাই গাড়িতে উঠে বসলো। বুরাক দাঁড়িয়ে আছে। আকলিমা বুরাকের দিকে তাকিয়ে বলল-
“অনেক অপেক্ষা করিয়েছেন তাকে। এখন তার অপেক্ষায় ইতি টেনে দিন।”
বুরাক মাথা নাড়াল। ববি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। বুরাক লম্বা নিশ্বাস ফেলে হাসিমুখে ভার্সিটির পথে হাঁটা ধরলো।

“মামা আপনার তৈরী মুড়ি ভর্তায় সত্যি ম্যাজিক আছে। খেলে একদম মন ভালো হয়ে যায়।”
উমায়ের এর কথা শুনে মামা হাসলেন। রুম্মান বলল-
“তুই এক চিজ রে উমায়ের। ভার্সিটির পড়া শেষ হওয়ার পর আমি কসম খেয়েছিলাম আর কখনো এই ভূত বাংলোর সামনে আসবো না। তুই দিলি সব শেষ করে।”
“পড়াচোর কোথাকার।”
রুম্মান ভেংচি কাটলো উমায়ের এর কথা শুনে। উমায়ের নিঃশব্দে হাসলো। তারা দাঁড়িয়ে মুড়ি নিয়ে বেঞ্চের দিকে এগিয়ে এসে বসলো। রুম্মান তার সংসারের আলাপ নিয়ে বসেছে। বেশ সাংসারিক হয়ে উঠেছে সে। উমায়ের মুচকি হাসছে তার কথা শুনে। হঠাৎ রুম্মান রোডের দিকে তাকিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে বলল-
“তোর মজনুকে দেখতে পাচ্ছি কেন আমি?”
উমায়ের এর বুকের বা পাশ ধুক করে উঠলো রুম্মানের কথা শুনে। সেও রোডের দিকে তাকাল। প্রায় ২০ হাত দূর হবে বুরাক দাঁড়িয়ে আছে। উমায়ের এর মাথা শূন্য হয়ে গেল। কিছু ভাবতে পারছে না সে। বুকের বা পাশে ধুকপুক ধুকপুক শুরু হয়ে গিয়েছে। উমায়ের উঠে দাঁড়াল। রুম্মানও দাঁড়াল তার সাথে। বুরাক ধীরপায়ে উমায়ের এর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। উমায়ের এর লজ্জা লাগছে হঠাৎ৷ লজ্জা লাগার কারণ বুঝতে না পরলে খুব বিরক্ত হয় সে। রুম্মান বাম হাতের কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে বলল-
“রাইশার স্কুলে ছুটি হয়ে যাবে কিছুক্ষণ পর। আমি যাই তাহলে।”
উমায়ের রুম্মানের দিকে তাকিয়ে তার হাত ধরলো। উমায়ের এর চোখে নার্ভাসনেস স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রুম্মান উমায়ের এর হাতের উপর হাত রেখে বলল-
“চিন্তা করিস না। ও অপরিচিত কেও না।মনে নেই তোদের যখন প্রথম দেখা হয়েছে? জায়গা সেইটাই আর মানুষটাও। যা উমায়ের।”
উমায়ের রুম্মানের কথা শুনে বুরাকের দিকে তাকাল। বুরাক কিছুটা দূর দাঁড়িয়ে আছে। রুম্মান উমায়ের এর হাত ছেড়ে বুরাকের দিকে তাকিয়ে উঁচু স্বরে সালাম দিলো। বুরাক মুচকি হেসে সালামের উত্তর নিলো। রুম্মান বিদায় নিয়ে দ্রুত হাঁটা ধরলো। উমায়ের রুম্মানকে একবার নিচু স্বরে ডেকে আবার বুরাকের দিকে তাকাল। প্রচুর নার্ভাস হচ্ছে সে। বুরাক ধীরপায়ে হেটে এসে উমায়ের এর সামনে দাঁড়াল। মুড়িওয়ালা মামাকে দেখে বুরাক হাসিমুখে সালাম দিলো। মামা বুরাককে দেখে বলল-
“আরে বাবা আপনে? কই আছিলেন এত বছর। আমি তো ভাবছিলাম আপনের আর দেহা পামুনা।”
“আমি তো সবসময় এখানেই ছিলাম। কেও আমাকে আমার স্মৃতি থেকে আলাদা করতে পারেনি।”
বলেই বুরাক উমায়ের এর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। উমায়ের লজ্জায় মাটির দিকে তাকাল। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। বুরাক মামার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উমায়ের এর দিকে তাকিয়ে বলল-
“চলো বাসায় যাওয়া যাক।”
উমায়ের মাথা নিচু রেখেই মাথা নাড়াল। দুজন হাঁটা ধরলো বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। দুজন পাশাপাশি হাঁটছে চুপচাপ। বলার মতো অনেক কিছু আছে। কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। কিছুক্ষণ হাঁটার পর বুরাক নিরবতা ভাঙলো।
“কেমন আছো?”
উমায়ের বুরাকের দিকে তাকাল। বুরাক সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। বুরাক আর আগের মতো নেই। অনেক চিক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ঘন দাড়িতে ভীষণ মায়াবী লাগছে তাকে। উমায়ের নজর সরিয়ে বলল-
“আলহামদুলিল্লাহ”
“আমি তো ভেবেছিলাম ভুলে যাবে আমাকে।”
“অপেক্ষা করবো বলেছিলাম।”
“অপেক্ষা করা খুবই কঠিন।”
“ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করার মজাই আলাদা।”
উমায়ের এর কথা শুনে বুরাক দাঁড়িয়ে গেল। বুরাককে দাঁড়াতে দেখে উমায়েরও দাঁড়াল। বুরাকের দিকে তাকিয়ে দেখে বুরাক তার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উমায়ের এর আবার লজ্জা লাগলো। উমায়ের বিরক্ত হয়ে অন্য দিকে তাকাল।
“একটু বেশীই অপেক্ষা করিয়েছি তাই না?”
উমায়ের বুরাকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বুরাক উমায়ের এর দিকে তার ডান হাত এগিয়ে দিয়ে বলল-
“অন্ধকার জগৎ থেকে একমাত্র তোমার কারণে বের হতে পেরেছি। এখন আমার হাত ধরে নিজের জগতে নিয়ে যাবে প্লিজ?”
উমায়ের বুরাকের হাতের দিকে তাকাল। গলা ধরে আসছে তার। কাঁপা কাঁপা হাত তুলে বুরাকের হাতের উপর রেখে আবার বুরাকের দিকে তাকাল।
“আমার জগতে তেমন কিছু নেই। চলো নতুন জগৎ তৈরী করা যাক। যেখানে না থাকবে বিপদ না শত্রু। শুধু আমরা থাকবো সেখানে। আর আমাদের পরিবার।”
“তুমি সত্যি আমাকে এত ভালোবাসো উমায়ের? এত ভরসা আমার উপর কেন?”
“এর উত্তর আমার কাছে নেই বুরাক। আমি শুধু জানি আমি তোমাকে অনেক ভরসা করি। তোমার #ভরসার_দুহাত ধরে আমি বিপদে ভরা পথে চোখ বন্ধ করে হাঁটতে পারবো।”
বুরাক তাকিয়ে রইলো উমায়ের এর দিকে। খুব ভয় করছিল তার যদি ফিরে দেখে উমায়ের আর তার অপেক্ষায় নেই। অনেক আগে বেড়ে গিয়েছে। বুরাক তখন কি করবে। এখন তার মনে হচ্ছে সঠিক মানুষকে সে ভালোবেসেছিল। ভার্সিটির ছুটির হতেই স্টুডেন্টরা বের হতে লাগলো। বুরাক আর উমায়ের পেছনে ফিরে তাকাল। অনেকেই মুড়িওয়ালার মামাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার ওপাড়ে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে কাকে যেন খুঁজছে। প্রিয় মানুষটাকে দেখে সে হাসিমুখে দৌড়ে গেল। মেয়েটা ছেলেটাকে দেখে ডান বাম দেখে কি যেন বলে ভেংচি কেটে অন্যদিকে হাটা ধরলো। ছেলেটা মেয়েটার হাত ধরে নিজের এক কান ধরে সরি বলল। মেয়েটা হেসে ছেলেটার হাত ধরে না ইশারায় বলল সরি না বলতে। বুরাক আর উমায়ের মুচকি হাসলো তাদের দেখে। সাড়ে ৭ বছর আগে তাদের ভালোবাসার শুরু এখানেই হয়েছিল। তাদের ভালোবাসার সাক্ষী এই পরিবেশ। বুরাক আর উমায়ের একে অপরের দিকে তাকাল। বুরাক ইশারায় বলল হাঁটতে। উমায়ের মাথা নাড়াল। দুজন আবার হাঁটা ধরলো নতুন জীবন শুরু করতে। যেখানে থাকবে তাদের পরিবার, সুখ, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব আর ভরসা।

❤️❤️সমাপ্ত❤️❤️

[শেষ হলো গল্প। অনেক অপেক্ষা করিয়েছি আপনাদের পর্বগুলো দিতে। আপনারা ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করেছেন এর জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। আজ থেকে অপেক্ষা শেষ হলো। আপনার ওর আপনার পরিবারের খেয়াল রাখবেন। বেঁচে থাকলে নতুন গল্প নিয়ে হাজির হবো। সত্যি বলছি নতুন গল্প লিখবো শিগগিরই😑 ভালোবাসা সবার জন্য। আল্লাহ হাফেজ সবাইকে❤️❤️❤]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here