অমিশা ভিলা | পর্ব :১

0
5919

যখন আমি প্রথমবার এ-বাড়িতে পা রেখেছিলাম তখন বাড়ির দারোয়ান আমাকে ইশারায় কী যেন বলতে চেয়েছিল। বাড়িওয়ালার ধমকে পরে আর বলেনি। তবে আমি বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম ওরা আমার থেকে কিছু একটা আড়াল করছে। কিন্তু কী আড়াল করছে ওরা?

ক্যানাডায় পড়াশোনা শেষ করেছি কিছুদিন হলো। আপন বলতে পৃথিবীতে কেউ নেই আমার। মা ছিলেন। বছর দশেক আগে মা’কে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলাম ক্যানাডায়। তিনি গত বছর হার্টের অসুখে পরলোকগমন করেছেন। এরপর তাঁকে ক্যানাডার মাটিতেই সোপর্দ করা হয়েছে। দেশে আমাদের জমিজামা বিশেষ নেই। যা ছিল তা অনেক আগেই বিক্রি করা হয়ে গেছে। বাকি ছিল মায়ের কাবিনের জমিটা। সেটা স্মৃতি হিসেবেই রেখে দিতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু গেল বছর একদল লোকের কুনজর পড়েছে সেই জমিতে। যার ফলে সব ছেড়ে মা’র শেষ স্মৃতি আঁকড়ে ধরার জন্য ক্যানাডা ছেড়ে দেশে এসেছি।

গত দশ বছরে বাংলাদেশের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রাস্তাঘাট আর আগের মতো নেই। আগের পতিত জমিগুলোতে এখন মজবুত গাঁথুনি দিয়ে বড়ো বড়ো দালান তোলা হচ্ছে। বাড়িঘরগুলোও আগের মতো নেই। আমরা যে বাড়িটায় থাকতাম সেই বাড়িটাও যাবার আগে বিক্রি করে দিয়েছিলাম। তবে দেশে ফিরেই সেই পুরনো বাড়িটার কথা মনে পড়ল। বাড়িটার নাম ছিল আনোয়ারা মঞ্জিল। আমার মায়ের নাম আনোয়ারা। তাঁর নামেই বাড়িটার নামকরণ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখছি পুরো বাড়িটা বদলে গেছে। আগের সেই দোতলা বাড়িটা এখন চারতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। একসময় দেয়ালের রং ময়লা হয়ে গিয়েছিল। এখন বাড়িটা বেশ চকচক করছে। বাড়ির গেটের ঠিক পাশে দেয়ালে বড়ো মার্বেল পাথরে খুদাই করে লেখা,

অমিশা ভিলা
বাসা নং ০৩, রোড নং —-
টিলাগড়, সিলেট।

খবর নিয়ে জানতে পারলাম বাসার মালিক এ-বাড়িতে থাকেন না। এবং আরো জানতে পারলাম যে, উপযুক্ত ভাড়াটিয়া পেলে বাসাটা ভাড়া দেওয়া হবে। ভাবলাম দেশে যখন এসেছি তখন অন্য কোথাও কেন, নিজের পুরনো বাড়িটায় থাকা যাক!

বাসার মালকিন এক ভদ্রমহিলা। তার নাম রেবা বেগম। তিনিই আমাকে জানালেন আমরা যার কাছে বাড়িটা বিক্রি করেছিলাম সেই ভদ্রলোক এই ভদ্রমহিলার কাছে বিক্রি করে দূরে কোথাও চলে গেছেন। আমি এ-বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকব শুনে ভদ্রমহিলার ভ্রু কুঁচকে গেল। তিনি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন। তার মুখে যে আতঙ্কের ছাপ এসেছিল সেটা আড়াল করে মুচকি হেসে বললেন, “বেশ তো! যতদিন ইচ্ছে থাকুন। সময়মতো ভাড়াটা মিটিয়ে দিলেই হয়!”

তবে তার হাসির আড়ালে যে রহস্য লুকিয়ে ছিল তা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। মুখেমুখি বসে চা খেলাম আমরা। এর ফাঁকে কিছু আলাপও হলো। পুরোটা সময় কেন জানি বারবার মনে হচ্ছিল রেবা বেগম নামের এই ভদ্রমহিলা কিছু একটা আড়াল করতে চাইছেন। তবে তিনি সহজে ধরা দিতে চাইছেন না।

ভদ্রমহিলা আমাকে অমিশা ভিলার সামনে নিয়ে গেলেন। গেটে তালা ঝুলানো ছিল। বাইরে পাহাররত দারোয়ান। প্রায় পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ বছর বয়সি শ্যামলা বেঁটেমতো ভদ্রমিলা ষাটোর্ধ বৃদ্ধ দারোয়ানকে কড়া গলায় নির্দেশ দিলেন, “রুমন মিয়া, গেট খুলে দাও। উনি ক্যানাডা থেকে এসেছেন। আজ থেকে এ-বাড়িতেই থাকবেন।”

ভদ্রমহিলার কথা শুনে দারোয়ান রুমন মিয়ার মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি মুখ বেজার করে গেটের তালা খুলে দিলেন। তবে আমি যখন বাড়ির ভেতরে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন দারোয়ান আমাকে ইশারায় কী যেন বলতে চেয়েছিলেন। ব্যাপারটা বাড়ির মালকিন অর্থাৎ ভদ্রমহিলা রেবা বেগম টের পেয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিয়ে বললেন, “রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছো কেন! সরো! সরে দাঁড়াও! যাও বাইরে থেকে ঘুরে এসো।”
কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক ভালো ঠেকল না। এ-বাড়িতে থাকতে চাওয়ার কথা শুনে বাড়ির ভদ্রমহিলার আঁতকে উঠা। কিংবা দারোয়ান আমাকে আড়ালে আবডালে ইশারা করা। সবকিছু কেমন যেন গোলমেলে লাগছিল। তবে আমি তখনও অতোটা গুরুত্ব দেইনি।

যখন দেশে ছিলাম তখন এক চাওয়ালাকে চিনতাম। তার হাতের চায়ের স্বাদ নিয়ে এলাকায় বেশ নামডাক ছিল। কলেজ লাইফের এমন একটি দিনও ছিল না যেদিন তার হাতে বানানো চা খাইনি। আজ এত বছর পর আবার সেই চায়ের দোকানে এসেছি। অবশ্য আগের সেই ঠুনকো চায়ের দোকানটা আর আগের মতো নেই। এখন সেটা মজবুত ইট-সিমেন্টের চার দেয়ালে ঘেরা বেশ সুন্দর চায়ের দোকানে পরিবর্তিত হয়েছে। সেই সাথে পরিবর্তিত হয়েছে চাওয়ালাও। আগের সেই নামকরা হাড় ঝিড়ঝিড়ে বৃদ্ধ আর নেই। সে নাকি ক’বছর আগে মারা গেছে। এখন তার ছেলে দোকানে বসে। এই দোকানে এখন শুধু চা নয়, ভাত, পরোটা, ডাল-সবজি এমনকি বিরিয়ানিও পাওয়া যায়। আমি কেবল চা অর্ডার করলাম। মৃত চাওয়ালার ছেলে ক্যাশে বসে থেকে জিজ্ঞেস করল, “ভাইজানরে তো আগে দেখিনাই। নতুন নাকি?”

আমি সবেগে মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ, নতুন এসেছি। পাশের গলিতে যে চারতলা বাড়িটা। সেখানেই উঠেছি।”

“পাশের গলিতে চারতলা বাড়ি?” বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। আমি বললাম, “হ্যাঁ, তিন নম্বর বাড়িটা।”

“অমিশা ভিলা?” বলে ভ্রু কুঁচকাল লোকটা। আমি মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ।”

সঙ্গে সঙ্গে কেশে উঠল লোকটা। ঢুকঢুক করে পানি খেয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল৷ বাকি যতটা সময় তার দোকানে ছিলাম, লোকটা আর একটি বারের জন্যও আমার দিকে ফিরে তাকায়নি। একটি কথাও বলেনি। তার এমন আচরণে বিষয়টা আরো ঘোলাটে হয়ে এল। কিছু তো আছে ওই বাড়িতে যার কথা সবাই জানে। অথচ কেউ মুখ ফুটে বলতে চাইছে না। কিন্তু কী সেটা?

চায়ের দাম মিটিয়ে তখনকার মতো বেরিয়ে এলাম। বাসার গেটে এসে দেখি দারোয়ান পোঁটলা কাঁধে নিয়ে রওনা দিচ্ছে। তাকে বললাম, “কোথায় যাচ্ছেন?”

বৃদ্ধ দারোয়ান মুখ বেজার করে জবাব দিলেন, “যেইখানে যাওনের কথা। আমার ঘরে। চাকরিটা তো খাইলেন। দেইখেন শেষে কেউ না আপনেরেই খেয়ে ফেলে।”

আমি আতঙ্কিত হয়ে বললাম, “আমাকে খাবে মানে! কে খাবে? তাছাড়া আপনার চাকরি আমি খেতে যাব কেন?”

“আপনে খাননাই। খাইছে আমার কপাল। এতদিন ভাড়াটিয়া ছিল না। তাই পাহারাদার হিসেবে আমারে রাখছিল। যেন বাড়ির জিনিসপত্র চুরি-টুরি না হয়। এখন তো বিশ্বস্ত ভাড়াটিয়া পাইছে। এখন কি আর আমারে লাগব?” খানিক থেমে বিড়বিড় করে বললেন, “তবে…” বলে আবার থামলেন। আমি জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বললাম, “তবে?”

“তবে আপনে এইখানে টিকতে পারবেন না।” বলে বাঁকা হাসলেন তিনি। আমি ফের প্রশ্ন করলাম, “টিকতে পারব না মানে? কী হবে আমার?”

এই প্রশ্নের জবাব তিনি দিলেন না। চিবুকে ঝুলে থাকা পাকা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে অভিজ্ঞ ভঙ্গিতে বললেন, “রাইতে সাবধানে থাইকেন।”

“রাইতে সাবধানে থাইকেন।” কথাটা বারবার কানে বাজতে লাগল আমার। রাতের খাবার খেয়ে যখন নিশ্চিন্ত মনে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম তার খানিক পরে আবারো সেই রহস্যময় কণ্ঠটা ভেসে এল। মনে হলো এক পশলা শীতল হাওয়া জানালা ভেদ করে এসে কানে কানে বলছে, “রাইতে সাবধানে থাইকেন।” দ্রুত উঠে গিয়ে জানালায় পরদা টেনে দিচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল, কাচের জানালার ওপাশে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে মানুষটা খুঁড়িয়ে চলছে। এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। আমি দ্রুত পরদা টেনে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম। তখন আরো একবার স্পষ্ট শুনতে পেলাম, “রাইতে সাবধানে থাইকেন।”

দ্রুত বাতি নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় চাদরের নিচে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। ভেবেছিলাম বাতি নিভে যাওয়ার সাথে সাথে অমিশা ভিলা’র সব রহস্যও নিভে যাবে। কিন্তু না। একটা আওয়াজ। একটা বিক্ষিপ্ত বিকট আওয়াজ রহস্যটা আরো গাঢ় করে তুলল। দ্রুত ছুটে গিয়ে জানালার পরদা ফাঁক করে বাইরে দৃষ্টি রাখলাম। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে পেছন ফিরে তাকিয়েই আঁতকে উঠলাম। অন্ধকার ঘরে বিছানার উপর কে যেন বসে আছে। আমি কাঁপা গলায় বললাম, “ক-কে আপনি?”

আশ্চর্যজনক বিষয় হলো অন্ধকারে বসে থাকা মানুষটা অর্থাৎ মেয়েটা কোমল গলায় জবাব দিলো, “আমি অমিশা।”

চলবে
গল্প : অমিশা ভিলা | পর্ব : এক

[বহুদিন পর থ্রিলার টাইপ কিছু লিখছি। আমার লেখা শেষ থ্রিলার ছিল “মাইন্ড ট্রাভেল”। এরপর আর থ্রিলারে মনোযোগ দেইনি। বহুদিন কেটে গেছে। পুনরায় একই জনরায় লিখছি। এ-নিয়ে বেশ কৌতূহল বোধ করছি। দেখা যাক কী হয়! সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে কাল সন্ধ্যায় পরবর্তী পর্ব পোস্ট করব৷ আর হ্যাঁ, পাঠকদের জন্য শুভকামনা রইল।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here