ভরসার_দুহাত পর্ব_৩০

0
602

#ভরসার_দুহাত
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৩০

ভোর ৭ টা, উমায়ের হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। বাবা কল দিয়ে বলেছে তারা সবাই হসপিটালে আছে বুরাক বাদে। উমায়ের মাথা তুলে পা সোজা করে ঘড়ির দিকে তাকাল। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই তার চোখে ঘুম নেই। ভার্সিটি যেতে হবে। বিছানা ছেড়ে নেমে বাথরুমে চলে গেল। ভার্সিটির জন্য তৈরী হয়ে উমায়ের ঘর থেকে বের হলো। মা রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছে। উমায়ের মায়ের সাথে দেখা করে নাস্তা না করেই বেরিয়ে পরলো। আজ উমায়ের এর ভালো লাগছে না। গাড়িতে বসে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে জানালার সাথে। ভার্সিটি পৌঁছে দেখে মাত্র ভার্সিটির দরজা খোলা হলো। আজ খুব তারাতাড়ি এসেছে। উমায়ের গাড়ি থেকে নেমে মাঠে গেল। বেঞ্চের উপর ব্যাগ রেখে হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে পায়চারি করতে লাগলো। বুরাক কোথায় গিয়েছে সে বুঝতে পারছে না। বেঞ্চে বসে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে বুরাকের নাম্বারে কল করলো। নাম্বার বন্ধ বলছে। উমায়ের এর এখন ভয় করছে খুব। বেঞ্চে ঠাই বসে রইলো।

বুরাক শরীরের সব শক্তি লাগিয়ে দৌড়াচ্ছে। সামনেই নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালাচ্ছে মাহমুদউল্লাহ বনি। সে দৌড়াতে দৌড়াতে লঞ্চের ছাদে উঠে গেল। উঠে ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। এখন পালাবে কিভাবে সে তো সাঁতার জানে না। হঠাৎ পেছন থেকে বুরাক বলল-
“বলেছিলাম না আমার কাছ থেকে পালাতে পারবি না।”
বনি পেছনে ফিরে বুরাককে দেখে বলল-
“আমি কি ক্ষতি করেছি তোর? আমার পেছনে হাত ধুয়ে পড়ে আছিস কেন?”
“মাছ, মাংস, শাক-সবজির ভেতর লিকুইড ড্রাগ পুশ করে বিক্রি করা হচ্ছে। আইডিয়া কিন্তু খারাপ না।”
“হ্যাঁ তো? আজকাল যদি সবাই নেশা করতে চায় তো আমাদের কি দোষ?”
“তোরা যদি এসব বিক্রি করা বন্ধ করে দিস তাহলে আর কেও নেশা করতে পারবে না। ২ থেকে ৩ বছরের বাচ্চারাও মরে যাচ্ছে ড্রাগস এর ওভার ডোজের কারণে।”
“আমাদের কাছে সবসময় সেই কাস্টোমাররা আসে যারা জানে এসব খাবারে ড্রাগস মিশ্রিত। তারা যদি তাদের সন্তানকে এই খাবার দেয় আমাদের কি দোষ?”
বুরাক দাঁতে দাঁত চেপে উঁচু স্বরে বলল-
“তোর কি দয়া মায়া নেই মনে? সেই বাচ্চারা যদি তোর পরিবারের অংশ হতো? ধ্যাত আমি কাকে বুঝাচ্ছি? যে নিজের বাবাকে নিজের হাতে খুন করেছে তাকে? না আজ বোঝাপড়া শেষ করতে হবে সারাজীবনের জন্য।”
“ভাই তুই কেন আমাকে মারতে চাচ্ছিস? আমাকে..আমাকে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দিলেও তো হয়।”
বুরাক বনির কথা শুনে দু কদম কাছে এসে বলল-
“কিছু কিছু সমস্যা নিজেরই সমাধান করতে হয়।”
বুরাকের কথা শুনে বনি ঢোক গিলে পিছিয়ে গেল। কখনো বিপদ আসেনি তাই নিজের রক্ষা করার জন্য কোনো অস্ত্রও রাখে না নিজের কাছে। এখন কিভাবে নিজের প্রাণ বাঁচাব বুঝতে পারছে না। বুরাক হঠাৎ বনির গালে সজোরে ঘুষি মেরে দিলো। বনি মাটিতে পড়ে গালে হাত দিয়ে বুরাকের দিকে তাকাল। গাল ব্যাথা করছে তার। বুরাক এক কদম বাড়তেই বনি ভয়ে ভয়ে বলল-
“ভাই ভাই মাফ কর আমাকে। তুই যা বলবি তাই করবো। আমি নিজেকে সারেন্ডার করবো ওয়াদা করছি।”
“কিন্তু আমি তো চাচ্ছি না তুই সারেন্ডার কর।”
“তো তুই কি চাস বল। তুই যা চাইবি আমি দিতে রাজি।”
“নিজের হাতে পাপ ধুতে অনেক আনন্দ লাগে বিশ্বাস কর। হ্যাঁ আমি জানি পাপ ধুতে গিয়ে আমি আরেকটা পাপ করছি। কিন্তু এতে আমার ভয় নেই। কারণ আমি মরে গেলে আমার সাথে আমার পাপও মরে যাবে।”
বলেই বুরাক বনির পেটে লাথি মারলো। বনি পেট ধরে মাটিতে শুয়ে পরলো। বুরাক তাকে ইচ্ছে মতো ঘুষি লাথি মেরে দেহের জায়গায় জায়গায় দাগ করে ফেলল। হাঁটু গেড়ে বসে বুরাক পকেট থেকে রিভলবার বের করে বনির কলার টেনে বসালো। বনি চারপাশ অন্ধকার দেখছে। নাক মুখ দিয়ে তার রক্ত ঝরছে। বুরাক বনির মাথার সামনে রিভলবার ধরতেই বনি চমকে উঠে বলল-
“মারিস না আমাকে। আমাকে তুই পুলিশের কাছে নিয়ে চল আমি আমার প্রত্যেক গুনাহ কবুল করবো।”
“একটা প্রশ্ন করার আছে। যদি তুই আমাকে সঠিক উত্তর দিস আমি তোকে মারবো না।”
“বল বল কি প্রশ্ন?”
“তোর পুরানো বন্ধু টগর রাশিদ আর মোবিন কোথায়?”
বনি ভ্রু কুঁচকাল বুরাকের প্রশ্ন শুনে। বুরাক উত্তরের আশায় বনির দিকে তাকিয়ে আছে। বুরাক আবার বলল-
“কোথায় তারা তিনজন?”
বনি মাথা নিচু করে বলল-
“রাশিদ আর নেই, শুনেছি কে জানি তার মার্ডার করেছে। টগর আর মোবিন কোথায় তা আমি জানি না। তাদের কারো সাথে আমার যোগাযোগ নেই।”
বুরাক রাগী কন্ঠে বলল-
“মিথ্যে বলবি না। আমি জানি তোর সাথে ওদের যোগাযোগ আছে।”
বনি বুরাকের দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি সত্যি বলছি। টগর আর মোবিন কোথায় আমি জানি না। রাশিদের সাথে যোগাযোগ ছিলো কারণ ও আমার থেকে ড্রাগস কিনতো।”
বুরাক বনির মাথার সামনে আবার রিভলবার ঠেকিয়ে বলল-
“মেরেই ফেলবো, বল মোবিন কোথায়? এখনই বল নাহলে…”
“ভাই বিশ্বাস কর আমি জানি না। টগর আর মোবিনের সাথে আমার ঝগড়া হয়েছিল একবার তারপর থেকে আমার আর কথা হয়নি তাদের সাথে।”
“আমি ৫ পর্যন্ত গুনবো, তুই যদি না বলিস মোবিন কোথায় সব গুলি তোর মগজে গিয়ে ঠাই নিবে।”
বুরাক কাউন্টডাউন শুরু করলো। বনি বুরাকের দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে তার হাত পা কাঁপছে। বুরাক ৫ বলতেই বনি চোখ বন্ধ করে নিলো।

কেও হঠাৎ উমায়ের এর চোখ ধরলো পেছন থেকে। উমায়ের তার হাত ছুঁয়ে রুম্মানের নাম নিলো। রুম্মান হাসিমুখে সামনে এসে দেখে উমায়ের এর বেচারা লটকিয়ে রেখেছে। রুম্মান উমায়ের এর পাশে বসে চোখের ইশারায় কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলো। উমায়ের মাথা নিচু করে নিজের ওড়না আঙুলে পেচাতে লাগলো। রুম্মান একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল-
“কি হয়েছে না বললে আমি সমাধান বোর করবো কিভাবে?”
উমায়ের হাতের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল-
“তার মোবাইল বন্ধ। কোনো খোঁজ খবরও পাচ্ছি না। খুব টেনশন হচ্ছে আমার।”
“কি ব্যাপার সবাই মোবাইল বন্ধ রেখে কোথায় যাচ্ছে?”
উমায়ের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রুম্মানের দিকে তাকাল। রুম্মান ঠোঁট উল্টে বলল-
“মোবিনেরও খবর পাচ্ছি না। প্রতিদিন সকালে সে আমাকে কল দেয় কিন্তু আজ দেয় নি। আমি কল করেছি কিন্তু নাম্বার বন্ধ বলছে।”
উমায়ের এর কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো রুম্মানের কথা শুনে। বুরাক বলেছিল তাদের কাওকে ছাড়বে না। উমায়ের এর মন বলছে বুরাক মোবিনকে মারতে গিয়েছে। আবার মনে মনে বলছে তার ভাবনা যাতে ভুল হয়। ক্লাসের ঘন্টা বেজে উঠলো। রুম্মান আর উমায়ের উঠে ক্লাসের দিকে হাঁটা ধরলো। দুজনেরই মন খারাপ। ক্লাসে কারো মন বসছে না। রুম্মান আরে কয়েকবার মোবিনের নাম্বারে কল করলো কিন্তু নাম্বার এখনো বন্ধ বলছে। উমায়ের আড়চোখে রুম্মানকে দেখে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। তার খুব ভয় করছে। মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে অনেক বড়ো তুফান আসতে চলেছে তার জীবনে। দুটো ক্লাস করে রুম্মান দাঁড়িয়ে উমায়ের এর দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমার খুব অস্থির লাগছে উমায়ের। চল বাহিরে গিয়ে বসি।”
উমায়ের মাথা নাড়াল। দুজন ব্যাগ গুছিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। মাঠে গিয়ে ঘাসের উপর বসে আছে দুজন। কারো মুখে কোন শব্দ নেই। দুজনেরই টেনশন হচ্ছে খুব। উমায়ের চোখ তুলে রুম্মানের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের হাতে থাকা মোবাইলের দিকে তাকাল। রুম্মান হঠাৎ বলল-
“উমায়ের, একটা কথা বলার আছে তোকে।”
উমায়ের রুম্মানের দিকে তাকিয়ে বলল-
“কি কথা?”
“মোবিন গত পরশু রাতে আমাদের বাসায় রাত কাটিয়েছে। আমি তাকে অনেক জোর করে জিজ্ঞেস করেছি যে সে আমাকে কি বলতে চায় তা আজই বলতে।”
“তারপর?”
“সে আমাকে বলেছে সব।”
উমায়ের আগ্রহ দেখিয়ে বলল-
“কি বলেছে?”
রুম্মান মাথা নিচু করে বলল-
“সে তার ভার্সিটি জীবনে অনেক বড়ো একটা পাপ করেছিলো। যেটার শাস্তি সে আজও পাচ্ছে। আমি তার কথা শুনে অনেক রেগেছিলাম কিন্তু পরে তার প্রত্যেক কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে আমরা নিজ চোখে যা দেখি তা সবসময় সত্য হয় না। কাওকে দোষারোপ করার আগে আমাদের প্রথম ভাবা উচিত সে মানুষটার দোষ কতটুকু।”
উমায়ের রুম্মানের দিকে তাকিয়ে আছে। রুম্মানের চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে এখনই কান্না করে দিবে। রুম্মান একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি তোকে সব বলবো, কিন্তু আজ না।”
উমায়ের রুম্মানের হাত ধরে বলল-
“তোর অতিরিক্ত পার্সোনাল বিষয়ে আমি নাক গলাতে চাই না। তোর যখন মনে হবে আমাকে তুই বলতে চাস, বলিস। আমি কখনো জোর করবো না এই বিষয়ে।”
রুম্মান হাসিমুখে উমায়ের এর হাতের উপর হাত রেখে বলল-
“তুই আমার সবচেয়ে প্রিয় বেস্টফ্রেন্ড। তোর মতো ফ্রেন্ড উপর ওয়ালা সবাইকে দিক।”
উমায়ের হাসলো রুম্মানের কথা শুনে। রুম্মান অনেকটা চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে। এই চেঞ্জটা উমায়ের এর বেশ পছন্দ হয়েছে। হঠাৎ উমায়ের এর কল টন বেজে উঠলো। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে মা কল দিয়েছে। মা কখনো এই সময় কল দেয় না। উমায়ের তারাতাড়ি রিসিভ করে কানে ধরলো।
“হ্যাঁ আম্মু বলো।”
“উমায়ের, বুরাকের সাথে তোর কোনো যোগাযোগ হয়েছে?”
মায়ের কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে মা অনেক চিন্তায় আছে। মা যখন অনেক টেনশনে থাকে তখনই উমায়েরকে তুই করে বলে। উমায়ের বলল-
“না আম্মু আমার সাথে ওর যোগাযোগ হয় নি। এবং কি আমি নিজেই ওকে বার বার কল দিচ্ছি নাম্বার বন্ধ বলছে।”
“সত্যি বলছো?”
“একদম সত্যি, কি হয়েছে আম্মু?”
“পুলিশ এসেছিলো বাসায়। একটা জেলে বুরাককে লঞ্চের উপর মানুষ খুন করতে দেখেছে। সে ভিডিও পর্যন্ত করেছে বুরাকের।”
উমায়ের ধরফরিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভয়ে তার হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। রুম্মান উমায়ের এর চেহারা দেখে উঠে দাঁড়াল। মা মোবাইলের অপরপাশ থেকে আবার বলল-
“পুলিশ বলেছে বুরাককে দেখলে ইনকাউন্টার করে ফেলবে।”
উমায়ের শরীর ছেড়ে দিলো। হাঁটু কিছুটা ভাঙতেই রুম্মান তাকে শক্ত করে ধরে ফেলল। উমায়ের থমকে আছে। রুম্মান উমায়ের এর হাত থেকে মোবাইল নিয়ে কানে ধরে বলল-
“হ্যালো আন্টি আসসালামু আলাইকুম আমি রুম্মান বলছি।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম রুম্মান, কি হলো হঠাৎ উমায়ের চুপ হয়ে গেল যে?”
“আন্টি ও আসলে, আন্টি কি হয়েছে বলুন তো। উমায়ের আপনার কথা শুনে থমকে গেল কেন?”
মা রুম্মানকে সব বলল। রুম্মান অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। কল কেটে উমায়েরকে মাটিতে বসিয়ে বলল-
“তুই চিন্তা করিস না কিছু হবে না উমায়ের। বুরাক নিশ্চয়ই এমন কাওকে মেরেছে যে খুব খারাপ মানুষ। তুই তো বলেছিলি বুরাক ভালো কাজ করে ভুল রাস্তার সাহায্যে। আংকেল আছেন তো উনি কিছু হতে দিবে না বুরাকের।”
উমায়ের রুম্মানের দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি এমন একজন মানুষকে ভালোবেসেছি যাকে ছাড়া না আমি বাঁচতে চাই না তাকে ছাড়া মরতে চাই। আমি তাকে আজও চিনতে পারি নি রুম্মান। সে ভালে না-কি খারাপ তাও জানি না। আজ আমি এমন এক ঝড়ের মধ্যে আছি যেটার দ্বারা আমি সব হারিয়ে ফেলবো।”
“উমায়ের প্লিজ তুই এইভাবে বলিস না। কিছু হবে না বুরাকের। সে খুব ভালো মানুষ। হতে পারে তার কাজ করার নিয়ম ভয়ংকর। কিন্তু তার এমন কাজের কারণে শতশত প্রাণ বেঁচেছে।”
“এই কথা আইন বুঝবে না রে। আমি সব হারাতে চলেছি সব। তোকেও হারিয়ে ফেলবো আমি।”
“আমাকে? আমাকে কেন?”
উমায়ের পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রুম্মানের দিকে।

বুরাক শতশত লোকের ভীরে হারিয়ে আছে। তার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চারপাশ দেখছে। তার দৃষ্টি মোবিনকে খুঁজছে। বুরাকের সামনে ১৭ তলার একটা বিল্ডিং। সেখানে কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। বুরাক শুনেছে মোবিন প্রায়ই এই বিল্ডিং-এ আসে। বুরাকের আগে জানতে হবে মোবিন কেন আসে এই বিল্ডিং-এ কিছুদিন পর পর। হঠাৎ বুরাক দেখলো বিল্ডিং এর সামনে একটা গাড়ি থেকে থামলো। গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভার বের হয়ে পেছনের দরজা খুললো। পেছনের সিট থেকে মোবিনকে বের হতে দেখে বুরাক মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। মোবিন যাতে টের না পায় বুরাক তাকে ফলো করছে৷ মোবিন মোবাইলে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল ভেতরে। ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। বুরাক ডান বাম দেখে এগিয়ে বিল্ডিং-এর দিকে হাঁটা ধরলো। মোবিন এক তলায় দাঁড়িয়ে মোবাইলে কাকে যেন ধমক দিয়প বলছে সে জানে না টগর আর বনির মৃত্যুর সম্পর্কে। মোবিন রাগে মোবাইল কেটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে গেল। বুরাক আশে পাশে দেখে মোবিনের পেছনে গেল। ৪ তলা যেতেই বুরাক একটা ভারী কন্ঠ শুনতে পেলো। কেও একজন মোবিনকে বলছে তার মোবাইল তাদের কাছে রেখে তারপর ভেতরে যেত হবে। বুরাক উঁকি দিলো। একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির সামনে। মোবিন জবাব না দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে লোকটার হাতে দিয়ে এগিয়ে গেল। বুরাক ভাবছে সে কিভাবে ভেতরে যাবে। তার কাছে রিভলবার আছে যদি লোকটা তাকে ভেতরে যেতে না দেয়? চাপা গলায় কথা বলার শব্দ আসছে কিন্তু বুরাক বুঝতে পারছে না। কি কথা হচ্ছে সেখানে? বুরাক ভাবনার গহীনে ছিলো তখনই খালিদ খানের চিল্লানোর শব্দ ভেসে আসলো-
“তুই তর্ক করবি না আমার সাথে। তোর তিন বন্ধু মরে গিয়েছে বুঝতে পারছিস?”
মোবিন কি জবাব দিলো বুরাক জানে না। খালিদ খান আবার উঁচু স্বরে বলল-
“যখন তোকে ও মারতে আসবে তখন বুঝবি আমি কেন বলেছিলাম এই কথা। এখন আমার সামনের থেকে যা তুই।”
খালিদ খানের কথা শেষ হতেই হেঁটে আসার শব্দ আসলো। বুরাক দেখলো মোবিন হেঁটে আসছে। বুরাক দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে লুকিয়ে পরলো। মোবিন হনহন করে নিচে নামতেই তার আবার মোবাইল বেজে উঠলো। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে লম্বা নিশ্বাস ফেলে রিসিভ করলো। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে সে তার প্রেমিকা বা স্ত্রীর সাথে কথা বলছে। কথা বলতে বলতে ধীরপায়ে হাঁটা ধরলো। বুরাক কিছুক্ষণ পর বের হয়ে উপরের দিকে তাকাল। খালিদ খানের কাছে মোবিন কেন আসে বার বার বুরাক বুঝতে পারলো না। কিন্তু বুরাক এইটুকু বুঝতে পেরেছে মোবিন নিশ্চয়ই বাজে কোনো কাজে জড়িত।

রাতেরবেলা…..
উমায়ের খাটে চুপচাপ বসে আছে। ববি এসেছিলো, সে এখনো বুরাকের কোনো খোঁজ পায় নি। উমায়ের এর সাথে রুম্মানের কথা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। রুম্মান বলল তার সাথে মোবিনের কথা হয়েছে। উমায়ের শুনে নিশ্চিত হলো। তার মানে বুরাক বাকি দুজন থেকে কাওকে মেরেছে। উমায়ের ঘড়ির দিকে তাকাল। ১ টা বেজে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। এখনো বুরাকের কোনো খোঁজ পায়নি সে। বুরাকের খোঁজ সে রাত শেষ হওয়ার আগে না পেলে হয় তো হার্ট অ্যাটাক করবে। প্রচন্ড খারাপ লাগছে তার। হঠাৎ বাহির থেকে কথা বলার শব্দ আসলো। বাবা কারো সাথে উঁচু স্বরে কথা বলছে। উমায়ের ভাবলো উসমান উজ্জ্বল হয় তো ঘুমায়নি এখনো তাই বাবা রাগ করছে। কিন্তু বুরাকের কন্ঠ ভেসে আসতেই উমায়ের দ্রুত বিছানা ছেড়ে নামলো। ঘর থেকে বের হয়ে দৌড়ে হলরুমে গেল। বুরাক আর ববি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। বাবা বুরাককে বকছে। বুরাক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। উমায়ের এর খুব শান্তি লাগছে বুরাককে দেখে। হঠাৎ উমায়ের এর চোখ গেল বুরাকের হাতের দিকে। বুরাকের হাতে রক্ত দেখা যাচ্ছে। উমায়ের এর ভয়ে বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে। বাবা এক সময় বুরাকের কলার ধরে বলল-
“কি দরকার ছিলো নিজের নামের আরেকটা কেস খোলার জন্য? বলেছিলাম না আমি তোমার সাহায্য করবো? কেন করলে এমনটা?”
বুরাক ফিরোজ আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল-
“আপনার কি মনে হয় না স্যার আপনিও অবৈধ কাজে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছেন?”
ফিরোজ আনোয়ার ভ্রু কুঁচকাল। বুরাক আবার বলল-
“আপনি আমাকে খুন করার জন্য সাহায্য করতে চাচ্ছেন। হ্যাঁ আমি যাদের খুন করতে চাই তারা ভালো মানুষ না। কিন্তু ফিরোজ আনোয়ার এমন একজন মানুষ যে খারাপ মানুষদেরও ক্ষতি করার কথা ভাবতে পারে না।”
ফিরোজ আনোয়ার বুরাকের কলার ছেড়ে দিলো। পরিবেশ হঠাৎ নিরব হয়ে গেল। ফিরোজ আনোয়ার নিচের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। বুরাক শান্ত গলায় বলল-
“কথায় আছে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। আমি যবে থেকে আপনার জীবনে এসেছি আপনি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছেন। আপনি জানেন আমি একজন খুনী আপনাদের মারতে পর্যন্ত এসেছিলাম তবুও আমাকে নিজের বাড়িতে জায়গা দিয়েছেন। আমার নামের কেস বন্ধ করাতে চাচ্ছেন। শুধু তাই না খুন করার জন্য আমাকে সাহায্যও করতে চাচ্ছেন। আপনার কি মনে হয় না আপনিও বাজে কাজের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছেন?”
ফিরোজ আনোয়ার বুরাকের দিকে তাকাল। উনি এই প্রশ্নের দিকে উত্তর দিবেন নিজেও বুঝতে পারছে না। বুরাক একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল-
“এইবার আমাকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিন। ববি আছে, সে সবসময় আপনার সাথে থাকবে। আমি আর পারবো না লুকিয়ে থাকতে। আর মাত্র দুজন বাকি। তাদের শাস্তি দিয়ে আমি নিজেকে পুলিশের কাছে দিয়ে দিবো।”
উমায়ের বুরাকের কথা শুনে দৌড়ে এগিয়ে আসলো। বাবার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বুরাকের দিকে তাকিয়ে আছে। বুরাক এক নজর উমায়েরকে দেখে চোখ সরিয়ে ফেলল। বাবা উমায়েরকে দেখে বুরাকের দিকে তাকিয়ে বলল-
“কেও একজন তোমার জন্য দিন-রাত দোয়া করে। তোমাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে, তার কি হবে বুরাক?”
বুরাক অবাক দৃষ্টিতে তাকাল ফিরোজ আনোয়ারের দিকে। ফিরোজ আনোয়ার উমায়ের এর দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি আমার মেয়ের মনের খবর রাখি। সে তোমাকে….”
ফিরোজ আনোয়ার পুরো কথা শেষ করার আগে বুরাক বলল-
“স্যার এমন কিছু বলবেন না যেটা বললে আমার খারাপ লাগবে।”
ফিরোজ আনোয়ার বুরাকের দিকে তাকাল। বুরাক উমায়েরকে এক নজর দেখে বলল-
“আপনার মেয়ে আমার মতো কাওকে ডিজার্ভ করে না৷ আপনি একজন বাবা হয়ে কিভাবে এই কথা ভাবতে পারলেন? আপনি আমার অতীত জানেন। তবুও এত ভরসা? কখনো একজন ক্রিমিনালকে এত বেশী বিশ্বাস করতে নেই।”
বাবা কিছু বলার আগে উমায়ের বলল-
“আব্বু তোমার উপর বিশ্বাস করছে না। উনি শুধু আমার মনের কথা তোমাকে জানালো। বুরাক তোমাকে পাওয়ার আশা আমি করছি না। আমি চাই তুমি সুস্থ সবল নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যাও।”
“যাব, চলে যাব আমি। কখন যাব তা জানি না। কিন্তু আমার এই মুহূর্তে আপনাদের জীবন থেকে যেতে হবে। পরিস্থিতি খুব বেশী বিগড়ে গিয়েছে।”
“বুরাক আমাকে ওয়াদা করো নিজের ক্ষতি হতে দিবে না।”
“এমন কোনো ওয়াদা আমি করতে পারবো না। কিন্তু আমি যথেষ্ট চেষ্টা করবো নিজের খেয়াল রাখার।”
বলেই বুরাক ঘুরে হাঁটা ধরলো। উমায়ের তাকিয়ে আছে বুরাকের যাওয়ার পথে। ববি বুরাকের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে তার পেছনে গেল। ফিরোজ আনোয়ার ধীরপায়ে হেটে গিয়ে সোফায় ধপ করে বসে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। উমায়ের ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। এক মুহূর্তে তার জীবন এভাবে পাল্টে যাবে কল্পনাও করে নি।

সারারাত দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি উমায়ের। কান্নাও আসছে না। নাহলে কান্না করে মন হালকা করে নিতো। বুরাক যাওয়ার পর থেকে মনে আবারো নানা ধরণের কথা ঘুরছে। উমায়ের জানালার গ্রিল ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। জীবন বড়োই কঠিন। এতটা কঠিন আমরা যেটা কল্পনাও করতে পারি না। হঠাৎ উমায়ের এর মোবাইল বেজে উঠলো। একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বিছানার দিকে হেটে আসলো। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে রুম্মান কল করেছে। আজ উমায়ের ভার্সিটি যায় নি তাই হয় তো কল দিয়েছে। উমায়ের কল ধরতেই রুম্মান রাগ আর কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল-
“সমস্যা কি বুরাকের? সে কেন মোবিনকে রাস্তার মাঝে ধরে পেটালো?”
উমায়ের থতমত খেয়ে গেল রুম্মানের কথা শুনে। উমায়ের আমতা আমতা করে বলল-
“বু..বুঝিয়ে বল কি..কি হয়েছে?”
“মোবিন এসেছিল আমাকে নিতে ভার্সিটিতে। হঠাৎ করে বুরাক এসে তাকে মারতে শুরু করলো। শুধু তাই না সে মোবিনকে কোথায় যেন নিয়ে গিয়েছে। উমায়ের আমি সত্যি বলছি যদি মোবিনের কিছু হয় আমি বুরাকের জান নিয়ে নিবো।”
বলেই রুম্মান কল কেটে দিলো। উমায়ের এর পুরো শরীর কাঁপছে। বুরাক এটা কেন করলো রুম্মানের সামনে। উমায়ের তার জীবনের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে হারাতে চলেছে। উমায়ের দৌড়ে ঘর থেকে বের হলো। বাসা থেকে বের হয়ে স্টোররুমের দিকে দৌড়ে গিয়ে দরজা ঠকঠক করলো৷ ববি দরজা খুলে উমায়েরকে দেখে চমকে উঠল।
“কি হলো উমায়ের? তোমাকে দেখে কেন মনে হচ্ছে কোনো অঘটন ঘটেছে?”
“বুরাক কোথায় এখন?”
“জানি না, আমি তাকে অনেকবার কল করেছি নাম্বার বন্ধ বলছে।”
“একটা সাহায্য চাই আপনার থেকে।”
“কি সাহায্য?”

বুরাক মোবিনের বরাবর বসে আছে। মোবিন দাঁতে দাঁত চেপে বুরাকের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বুরাক তাকে মেরে চেহারা রক্তাক্ত করে ফেলেছে৷ বুরাক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল-
“৫ মিনিট শেষ, এখন বল রিপোর্ট গুলো কোথায়?”
“বললাম না সেসব রিপোর্ট ভুল ছিলো।”
“মিথ্যে বলবি না মোবিন। তুই নিজে শিকার করেছিলি যে তুই রেইপ করেছিলি।”
“সেটা আমাকে হুমকি দেয়া হয়েছিল।”
বুরাক রাগে গজগজ করতে করতে আবার মোবিনের গালে থাপ্পড় মেরে দিলো। মোবিন মাটিতে থুথু ফেলে বুরাকের দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি সত্যি বলছি, আমি রেইপ করি নি। আমার আর তার সম্মতি ছিলো আমাদের সহবাসে।”
“তো সে আত্মহত্যা করেছিলো কেন?”
“আমি জানি না আমি সত্যি বলছি আমি কিছু জানি না।”
বুরাক একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। এখন আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই সে বুঝলো। উঠে দাঁড়িয়ে মোবিনের কলার ধরে টানতে টানতে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। বড়ো টিনের তৈরী বোলে মোবিনের মাথা চুবিয়ে দিলো। মোবিন ছটফট করছে। কিছু সেকেন্ড পর বের করে বলল-
“বলবি না? নাহলে এভাবেই তিলে তিলে শেষ করে ফেলবো।”
মোবিন ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে বলল-
“মেরে ফেল, তবুও আমার জবাব একটাই হবে। আমি ধর্ষক না।”
বুরাক দাঁতে দাঁত চেপে আবার মোবিনের মাথা চুবিয়ে দিলো পানিতে। হঠাৎ রুম্মানের কন্ঠ ভেসে আসলো-
“বুরাক মোবিনকে ছেড়ে দাও। নাহলে আমি উমায়েরকে মেরে ফেলবো।”
বুরাক মোবিনকে করে দরজার দিকে তাকাল। বুরাক রুম্মানকে দেখে ভয় পেয়ে গেল। রুম্মান উমায়ের এর মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here