সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্ব-১৫

0
1413

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ১৫

কথায় আছে ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়।’ এই মুহূর্তে মুনার অবস্থাও ঠিক একইরকম। যে বিপদকে সে সারাক্ষণ এড়িয়ে যেতে চায়, সেই বিপদই আজীবনের জন্য তার ঘাড়ে চেপে বসতে চলেছে। কথাটা ভেবেই মুনার মাথা ভনভন করে ঘুরতে লাগল। মুনা ডান হাতের আঙুলে কপাল চেপে ধরল। এক গ্লাস পানি খাওয়া নিতান্ত প্রয়োজন। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনোকিছুই তার বোধে আসছে না। আফসার স্যার সূক্ষ্ম চোখে নিরীক্ষণ করে বোধহয় বুঝতে পারলেন মুনার অবস্থা। তিনি প্রশ্ন করলেন,“পানি খাবে?”

মুনা কোনো উত্তর দিলো না। সে মাথা নিচু করে কপাল চেপেই বসে রইল। স্যার মুনার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে ধরে বললেন,“পানি খাও।”

মুনার কানে কথাটা পৌঁছল কি না কে জানে? সে এক চুলও নড়ল না। স্যার এবার কিছুটা জোরেই বললেন,“পানিটা খেয়ে নাও।”

মুনা কিছুটা চমকে মাথা তুলে তাকাল। পানির গ্লাসের দিকে চোখ পড়তেই ঠাহর হলো এই পানিটুকু গলধঃকরণ করা এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। মুনা কাঁপা হাতে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে পুরোটাই খেয়ে ফেলল। খালি গ্লাসটা টেবিলে রেখে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিল। এখন অনেকটা ভালো লাগছে। কিন্তু সেই ভালো লাগাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আফসার স্যার প্রশ্ন করলেন,“আর ইউ ওকে?”

রাগে মুনার মাথাটা দপ করে উঠল। এমন লোক সামনে বসে থাকলে আবার ঠিক থাকা যায় না-কি? মুনা না তাকিয়েই মাথা দোলালো, যার অর্থ সে ঠিক আছে। স্যার গম্ভীর মুখে মুনার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুনা না তাকিয়েও সেটা বেশ বুঝতে পারল। ইচ্ছা করছে এখনই উঠে চলে যেতে। কিন্তু সামনে তো সাক্ষাৎ যম বসে আছে। শত হলেও স্যার তো, বেয়াদবি হয়ে যাবে। স্যার বলে উঠলেন,“অনেকক্ষণ জ্যামে আটকে ছিলে বলে বোধ হয় শরীর খারাপ লাগছে।”

মুনা এবারও নিশ্চুপ। বিয়ের কথা মনে হতেই আবার তার মাথা ঘুরতে শুরু করল। তবে এবার আর আগের মতো অত বেশি না। কী থেকে কী হচ্ছে কিছুই যেন তার বোধগম্য হচ্ছে না। স্যারের নাম দিহান এটা না হয় বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু তার সাথে বিয়ে! এটা কী করে সম্ভব? কীভাবে কী হলো? বাবা কি আর কোনো ছেলে খুঁজে পেল না? আর স্যার? সে কি আগে থেকেই সব জানত? বিয়ের ভূতটা কি তার মাথায় এসেছে না-কি তার ফ্যামিলির মাথায়? পাত্রী যে তার ছাত্রী এটা জেনেও নির্দ্বিধায় এই বিয়েতে মত দিয়ে দিলো? এক মিনিট, এমন নয় তো যে স্যার নিজে পছন্দ করে ফ্যামিলিকে গিয়ে বলেছে এই মেয়েকেই সে বিয়ে করতে চায়? হায় আল্লাহ্! মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। মুনা যখন হাজারো প্রশ্নের ভিড়ে হারিয়ে গেছে তখন স্যার আবার তার মুখের সামনে তুড়ি বাজালেন। মুনা খানিক চমকে উঠল। নড়েচড়ে বসে এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করল। স্যার শান্ত স্বরে বললেন,“তোমার কোনো প্রশ্ন থাকলে আমাকে করো। এত ভাবতে হবে না।”

মুনা জানে এটা সে কখনোই করতে পারবে না। স্যার বলে কথা। বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে দ্বিধা আর লজ্জা দুটোই এসে জেঁকে বসবে। মুনা এবারও চুপ করে বসে রইল। স্যারের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে ভেবেই তার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। স্যার বেশ সিরিয়াস ভাবেই বললেন,“তুমি লজ্জা পাচ্ছ সেটা বুঝতে পারছি। একটা কথা মাথায় রাখো, এখানে তুমি তোমার উডবি হাসবেন্ডের সাথে মিট করতে এসেছ, কোনো স্যারের সাথে না। আমি জানি লজ্জা লাগাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তোমাকে তো আমার সামনে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কারণ দুদিন বাদে বিয়ে হয়ে গেলে তারপর আর বলতে পারবে না যে বিয়ের আগে বরের সাথে কথা বলতে পারোনি। কথা বলার সুযোগ তোমাকে দেয়া হয়েছে। তাই কিছু জানার বা বলার থাকলে আজই বলে দাও।”

মুনা বুঝল কথাটা মন্দ বলেনি লোকটা। কথা বলা উচিত। স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া উচিত যে সে এই বিয়ে করতে চায় না। আর এটাও জিজ্ঞেস করা উচিত যে এই বিয়েটা ঠিক করল কে‌। কিন্তু মুখ দিয়ে তো কথাই বেরোচ্ছে না। শব্দগুলো সব গলায় এসে আটকে যাচ্ছে। কেমন যেন বিব্রত বোধ হচ্ছে। স্যার বললেন,“টেনশন কোরো না। তোমাকে ভাবার সময় দিলাম। ভাবো তারপর কথা বলো।”

মুনা ভাবার জন্য ভালো একটা সুযোগ পেল। সে ঘটা করে ভাবতে বসল। কিছুক্ষণ গভীরভাবে চিন্তা করে হঠাৎ মাথায় এল এই লোকের সাথে কথা না বললেও চলবে। বাড়ি গিয়ে সে আগে বাবার সাথে কথা বলবে। আর সরাসরি জানিয়ে দিবে যে সে এই বিয়েটা করতে চায় না। কিন্তু এনগেজমেন্ট তো হয়ে গেছে! এখন কি বিয়ে ভাঙা সম্ভব? পরক্ষণেই ভাবল কেন সম্ভব না? সে তো কিছুই জানত না। জানলে তো আগেই না বলে দিত। স্যারের কথা সবাই তার কাছে লুকিয়েছে এটা সবার ভুল। তাকে অন্তত একবার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। আচ্ছা? বাবা কি বললেই বিয়েটা ভেঙে দিবে? সে যদি তার সম্মান বাঁচানোর জন্য বলে যে বিয়েটা ভাঙা সম্ভব না, তাহলে? সে তো কিছুতেই এই পাজি স্যারকে বিয়ে করতে পারবে না। বাবাকে বুঝালে অবশ্যই বুঝবে। সে তো সবসময় বলে তার মেয়ের চাওয়াই তার চাওয়া। তার মানে সে তার মেয়ের চাওয়াকে ফিরিয়ে দিবে না, বরং ভেবেচিন্তে অবশ্যই বিয়েটা ভেঙে দিবে। সে জানে তার বাবা তাকে কতটা ভালবাসে। তাই সে বাবার উপর ভরসা করে স্যারকে এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করার আগ্রহ দেখাল না। তবে একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে পোকার মতো কিলবিল করছে। স্যার ইচ্ছে করে তার ফ্যামিলিকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে? না-কি তার অজান্তেই তার ফ্যামিলি এই বিয়েটা ঠিক করেছে? সে কি তার ফ্যামিলির জন্য বিয়েটা করতে রাজি হয়েছে? এটা জানার ইচ্ছে জাগছে মনে। কিন্তু স্যারকে এই প্রশ্ন করবে কীভাবে? থাক, এই প্রশ্নের উত্তরও না হয় বাবার কাছেই জানা যাবে। মুনাকে আকাশ-পাতাল ভাবতে দেখে স্যার হেসে বললেন,“আজ সারাদিন কি এখানে বসে ভাবতেই থাকবে? কিছু বলবে না?”

মুনা একটু নড়ে বসল। স্যার কিছু একটা ভেবে বললেন,“বুঝেছি, তুমি কিছু বলবে না। তার চেয়ে বরং আমিই বলছি। কিন্তু তার আগে খাবার অর্ডার দিতে হবে। কী খাবে বলো?”

মুনা ইতস্তত করে বলল,“আমি কিছু খাব না।”

“লজ্জা পাচ্ছ? আচ্ছা আমিই অর্ডার দিচ্ছি।”

স্যার একজন ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার করলেন। তারপর টেবিলের উপর দুহাত রেখে মুনার দিকে তাকিয়ে বললেন,“তোমার মনে এখন হাজারো প্রশ্ন জমা হয়েছে, সেটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিব না আজ। শুধু একটা উত্তর দিচ্ছি। এই বিয়েটা আমার নিজের ইচ্ছেতে ঠিক হয়েছে। আমিই আমার ফ্যামিলিকে বলেছি তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে। তারা আমার কথায় প্রস্তাব পাঠিয়েছে আর তোমার বাবা-মাও রাজি হয়ে গেছে। আমার ফ্যামিলির সবাই তোমাকে খুব পছন্দ করেছে। সবকিছু তোমার অজান্তেই হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম তোমার বাবা তোমার মতামত নিবেন। কিন্তু তিনি বললেন তুমি না-কি তার পছন্দের উপরে কথা বলবে না। তাই আমিও এই নিয়ে ভাবিনি। আর আমার ডাকনাম দিহান। আমার ফ্যামিলির সবাই আমাকে দিহান বলেই ডাকে। আমি জানতাম তুমি এখানে এসে আমাকে দেখে চমকে যাবে। কিন্তু এনগেজমেন্ট যখন হয়ে গেছে তখন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করাই ভালো। এই সপ্তাহের মধ্যেই হয়তো বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে যাবে। আমি চাই তুমি তার আগেই নিজেকে স্বাভাবিক করো।”

কথাগুলো বলে স্যার থামলেন। মুনা অবাক হয়ে তার কথা শুনছে। সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। স্যার নিজে তার ফ্যামিলিকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে! কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না। স্যার প্রশ্ন করলেন,“তুমি কি বুঝতে পারছো আমার কথা?”

অগত্যা মুনা উপর নিচে মাথা দোলালো। তার যেটুকু জানার ছিল জানা হয়ে গেছে। বাকিটা বাড়ি গিয়ে বাবার কাছে জানলেই হবে। ওয়েটার এসে দুজনের সামনে খাবার সাজিয়ে রেখে গেল। স্যার মুচকি হেসে বললেন,“অনেক ভেবেছ। ক্ষুধা পায়নি? এবার চুপচাপ খাও।”

মুনা খাবারের দিকে তাকালই না। স্যারের সামনে বসে খেতে অস্বস্তি হবে তাই বসেই রইল। স্যার বুঝতে পেরে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,“সামনে খাবার রেখে এভাবে বসে থাকতে নেই, জানো না? তাছাড়া তুমি কিন্তু টিচারের কথা অমান্য করছো।”

কথাটা শুনেই মুনা হা হয়ে গেল। একটু আগেই বলল ‘এখানে তুমি তোমার উডবি হাসবেন্ডের সাথে মিট করতে এসেছ, কোনো স্যারের সাথে না।’ আর এখন আবার বলছে টিচারের কথা অমান্য করছো! কী লোক রে বাবা! লোকটার মাথায় অসংখ্য জিলাপির প্যাঁচ! স্যার আবার বললেন,“কী হলো? খাও।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুনা একরকম বাধ্য হয়ে খাবার মুখে দিলো। কিন্তু ভুল করেও স্যারের দিকে তাকাল না। স্যার মুচকি হেসে বিড়বিড়ালেন,“অবিডিয়েন্ট গার্ল।”


রেস্টুরেন্টে একটা বড়ো টেবিল দখল করে বসেছে ইলোরা, ডালিয়া, নাদিয়া, অরিশা, টুম্পা, তাহসিন আর অন্তর। সবাই বেশ ক্ষুধার্ত। তাহসিন যেই মুহুর্তে ওয়েটারকে ডাকার জন্য উদ্যত হয়েছে সেই মুহূর্তেই হঠাৎ তার চোখ চলে গেল রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে সে হাসিমুখে ডেকে উঠল,“এরেন ভাই।”

নামটা শুনেই ইলোরা চমকে উঠল। তাহসিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই তার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। দেখল এরেন হাসিমুখে এদিকেই আসছে। মুহুর্তে ইলোরার হার্টবিট বেড়ে গেল। দমটা যেন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। কেন জানি খুব খুশি লাগছে। এমন কেন হচ্ছে? এর আগে তো এরেনকে দেখে তার এতটা খুশি লাগেনি। দুদিন পর দেখা হওয়ায় এমনটা হচ্ছে? হয়তো তাই হবে। এরেন এসে তাহসিন আর অন্তরের সাথে করমর্দন করে কুশল বিনিময় করল। তারপর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,“কেমন আছো তোমরা?”

ইলোরা ছাড়া সবাই তার প্রশ্নের উত্তর দিলো। এরেন সরাসরি ইলোরার দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। এরেন মুচকি হাসল। ইলোরা তা দেখে লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিল। এরেনের চাহনিতে একরাশ প্রশান্তি স্পষ্ট। আকাঙ্ক্ষিত মুখটা দেখার জন্য দুদিন ধরে সারাক্ষণ তার মনটা খুব আঁকুপাঁকু করছিল। ভাবতেই পারেনি আজ এভাবে হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে। মনে মনে আল্লাহকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাল এরেন। অরিশা এরেনকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল,“ভাইয়া কি লাঞ্চ করতে এসেছেন?”

এরেন বলল,“হ্যাঁ। এক্সাম শেষে প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে। তাই ভাবলাম কিছু খেয়েই বাড়ি যাই। আমি এই রেস্টুরেন্টে প্রায়ই খেতে আসি। কিন্তু তোমরা এখানে?”

তাহসিন বলল,“আমরা ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। ঘুরেফিরে এখন লাঞ্চ করতে এলাম।”

এরেন ভ্রুকুটি করে বলল,“ক্লাস কামাই করে?”

সবাই জিহ্বায় কামড় দিলো। অন্তর দাঁত বের করে হেসে বলল,“দুইটা ক্লাস করে এসেছি ভাই।”

এরেন মুচকি হেসে বলল,“আচ্ছা তাহলে তোমরা লাঞ্চ করো। আমিও বেশ ক্ষুধার্ত।”

কথাটা বলে এরেন অন্যদিকে পা বাড়াতেই তাহসিন পথ আটকে বলল,“আরে ভাই, কোথায় যাচ্ছেন?”

“বললাম তো লাঞ্চ করব। তো বসব না?”

“আমাদের টেবিলে তো জায়গা আছে। আপনি একা অন্য টেবিলে বসতে যাবেন কেন?”

নাদিয়া তাল মিলিয়ে বলল,“হ্যাঁ তাই তো। ভাইয়া আপনি আমাদের সাথেই বসুন।”

এরেন বলল,“না না। তোমরা সবাই মিলে আড্ডা দাও। আমি থাকলে তোমাদেরই অস্বস্তি লাগবে।”

ইলোরা বেশ বুঝতে পারল এরেন তাকে উদ্দেশ্য করেই কথাটা বলেছে। সে নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল এরেনের দিকে। টুম্পা বলল,“আমাদের অস্বস্তি হবে না ভাইয়া। বসুন না।”

সবার জোরাজুরিতে শেষে এরেন রাজি হলো ঠিকই কিন্তু শর্ত জুড়ে বসল সবার বিল সে দেবে। এরেনের শর্তে কিছুটা ইতস্তত বোধ হলেও কেউ আপত্তি জানাল না। কিন্তু বসতে গিয়ে ঘটল আরেক ঘটনা। ইলোরার পাশের চেয়ার ছাড়া অন্য কোনো চেয়ার খালি নেই। এরেনকে সেখানেই বসতে বলল সবাই। এরেন একবার ইলোরার দিকে তাকাল। ইলোরা লজ্জায় মাথা নত করে রেখেছে। বাধ্য হয়ে এরেন ইলোরার পাশে গিয়ে বসল। ওয়েটারকে ডেকে সবার জন্য খাবার অর্ডার দিলো। তারপর শুরু হলো সবার ননস্টপ কথা। সবার চোখের আড়ালে এরেন হঠাৎ ইলোরার দিকে কিছুটা ঝুঁকে মিনমিনে গলায় বলল,“এতগুলো মানুষের মধ্যে একজন চুপ থাকলে ভালো দেখায় না।”

ইলোরা আড়চোখে একবার এরেনের দিকে তাকাল। এরেন মুচকি হেসে আবার সোজা হয়ে বসল। ইলোরাও মুচকি হাসল। এই হাসির কারণ তার নিজেরও জানা নেই। ইলোরার হাসিমুখটা এরেনের দৃষ্টিগোচর হলো না। মেয়েটার হাসিমুখটা দেখেই মনে এক অজানা প্রাশান্তি খেলে গেল। খাবার চলে আসতেই সবাই মিলে খাওয়া আরম্ভ করল। ইলোরা প্রচন্ড অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। সেই প্রথমদিন যেদিন বাসে দেখা হয়েছিল সেদিন এরেন তার পাশের সিটে বসে ছিল। তারপর আড়াই মাস পর আজ আবার পাশে বসে আছে। প্রথমদিন ব্যাপারটা একদম স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। কারণ তখন দুজনেই দুজনের অপরিচিত মানুষ ছিল। আজ নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কটার জন্যই অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে। ইলোরা খাবার মুখে না দিয়ে নাড়াচাড়া করছে দেখে এরেন কিছুটা জোরেই বলল,“তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না। খিদে নেই?”

সবাই একসাথে ইলোরার দিকে তাকাল। ইলোরা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে নড়েচড়ে বসল। ডালিয়া বলল,“খাচ্ছিস না কেন?”

ইলোরা অপ্রস্তুত হেসে বলল,“খাচ্ছি।”

ইলোরা তাড়াতাড়ি খাবার মুখে তুলল। এরেন প্রশ্ন করল,“তোমরা কি ফুলের মার্কেটে গিয়েছিলে না-কি? সবার কাছে এত ফুল!”

সবাই হেসে মাথা দোলালো। এরেন হেসে বলল,“বাহ্! তোমরা তো পুরো একটা দোকানই উঠিয়ে নিয়ে এসেছ।”

অন্তর বলল,“এই মাইয়াগো লাইগা তাও কম হইয়া গেছে ভাই।”

“মেয়েরা সাধারণত একটু বেশিই ফুলপ্রেমী হয়। তাই ওদের জন্য এই ফুলগুলো কমই। এমন মেয়ে বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না যে ফুল পছন্দ করে না।”

অরিশা তাল মিলিয়ে বলল,“একদম ঠিক বলেছেন ভাইয়া।”

এরেন আবার হাসিমুখে বলল,“এতগুলো জুনিয়রের মধ্যে আমি একা সিনিয়র! তোমাদের সাথে লাঞ্চ করতে বসে তো নিজেকে এখন বাচ্চা মনে হচ্ছে। তবে খুব ভালো লাগছে।”

তাহসিন বলল,“বাচ্চা হয়ে যদি একটু আনন্দ পাওয়া যায় তবে বাচ্চাই ভালো।”

তাহসিনের কথায় সবাই হাসল। হাসি আড্ডায় একসময় সবার খাওয়া শেষ হলো। খাওয়া শেষ হলেও কারো আড্ডা শেষ হলো না। ইলোরাও এতক্ষণে সব অস্বস্তি পাশে রেখে সবার সাথে আড্ডায় মনোযোগ দিয়েছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই কথায়-কথায় এরেনের দিকে তাকালেই তার সাথে চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। যতবার চোখাচোখি হচ্ছে ততবারই এরেন ঠোঁট টিপে মুচকি হাসছে। ইলোরাও লজ্জা মিশ্রিত হেসে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সব মিলিয়ে সময়টা দারুণ কেটেছে। কারোরই ইচ্ছে করছে না জমে যাওয়া আড্ডাটা শেষ করতে। কিন্তু এরেনের মা বারবার ফোন করছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে আড্ডায় ইতি টানতে হলো। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল,“এখন উঠতে হবে আমাকে। তোমাদের সাথে আড্ডাটা দারুণ কেটেছে। সময় করে আবার এমন আড্ডায় বসব একদিন। আজ আসছি।”

সবাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও এরেনকে বিদায় জানাল। নিমেষে ইলোরার মনটা হুট করেই খারাপ হয়ে গেল। সে শান্ত দৃষ্টিতে এরেনের দিকে তাকাল। এরেন তাকাতেই আবার চোখাচোখি হলো। কিন্তু এবার আর ইলোরার চোখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে হলো না। যেভাবে তাকিয়ে ছিল সেভাবেই তাকিয়ে রইল। এরেন বোধ হয় সেই দৃষ্টিতে কোনো অর্থ খুঁজে পেল। হঠাৎ সে ইলোরার সামনে থাকা কয়েক রকমের ফুল থেকে একটা গোলাপ হাতে নিয়ে মুচকি হেসে বলল,“আই লাইক ইট‌। একটা নিলাম। আপত্তি জানালে পরে একদিন না হয় সুদে আসলে শোধ করে দিব।”

ইলোরা কিছুটা অবাক হলো। অপ্রস্তুত হেসে বলল,“একটা গোলাপই তো। শোধ দিতে হবে না।”

এরেন হাসিমুখে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। এরেনের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে ইলোরা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। মাথায় একটা প্রশ্ন উঁকি মারল,“লোকটার মনে কী আছে?”

চলবে……………………🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here