সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্বঃ৩৪

0
1002

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৩৪

শীতের প্রকোপকে বিদায় জানিয়ে বসন্তের আগমনে নতুন সাজে সজ্জিত হয়েছে প্রকৃতি। নতুন ঋতুকে সংবর্ধনা জানাতে গাছগুলো নতুন ফুল-পাতায় পরিপূর্ণ হয়েছে। কোকিলের কন্ঠে বসন্তকে বরণ করার মধুর সুর। শহরের মানুষগুলো মেতে উঠেছে বসন্ত বরণে। কোলাহলপূর্ণ ব্যস্ত শহরটা আজ একটু বেশিই ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। রাস্তার ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে অসংখ্য তরুণ-তরুণী। বাসন্তী শাড়ি আর পাঞ্জাবির ভীর দেখে মনে হচ্ছে যেন বাসন্তী রঙের এক ঝাঁক পাখি। একেক দলের তরুণ-তরুণীরা দলবেঁধে প্রাণোচ্ছল হাসিতে শহর কাঁপাচ্ছে। আবার কোনো কোনো প্রেমী যুগল হাত ধরাধরি করে বেড়িয়েছে অজানা গন্তব্যে। প্রেমিকের ফিসফিস শব্দমালায় প্রেমিকা লজ্জায় মুখ নত করছে,কিংবা মুচকি হেসে হাতের বন্ধনটা শক্ত করছে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে গালে হাত দিয়ে উদাসী দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে ইলোরা। সকালের চকচকে মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে তার চোখেমুখে। উদাসী দৃষ্টিতেও তাকে কেমন মায়াবী লাগছে! ডালিয়া এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে ঠোঁট উল্টে আফসোসের সুরে বলল,“জীবনে আমাদের উন্নতি হইত না। দেখ,পুরো ঢাকা শহরের মেয়েরা আজ বসন্ত উদযাপন করতে উঠেপড়ে লাগছে। আর আমরা? ছুটি পইছো তো ঘরের মধ্যে খাও-দাও,ফুর্তি করো আর ঘুমাও। বিরক্তিকর! মনডায় চাইতাছে আজকেই বিয়ে করে ফেলি। তারপর দেখি কে ঘরের মধ্যে আটকাইয়া রাখে। আমার না হয় ফাটা কপাল। কিন্তু তোর? তোর তো জামাই আছে। সে কী করে? বউ বিষন্ন মনে মাইনষের বসন্ত উদযাপন দেখতাছে তা কি জানে না?”

ইলোরা মুখ ফুলিয়ে বলল,“সে তো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। ফোন করেছিলাম আপু ধরেছিল। বলল তোমার জামাই এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। এক কাজ করো তুমি আজ বাসায় চলে আসো। এসে ওর গায়ে এক বালতি পানি ঢালো।”

“তোর শ্বশুর-শাশুড়ি?”

“ওনারা তিনদিন আগে চট্টগ্রাম গেছে। ওর ফুপি অসুস্থ তাই।”

ডালিয়া উত্তেজনা নিয়ে বলল,“আরে বাহ্! তাহলে যা গিয়ে মহারাজের ঘুম ভাঙা।”

ইলোরা ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,“বললেই হলো? ওই বাড়িতে আমি এর আগে কোনোদিনও যাইনি,চিনিও না। না চিনলেও সমস্যা নেই। আপু এসে আমাকে নিয়ে যাবে বলেছে। বড়ো সমস্যা হচ্ছে ভাই। আব্বু-আম্মু আর মিথি না হয় তোদের বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু ভাই? সে তো বাড়িতেই থাকবে।”

ডালিয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,“ভাইও যাচ্ছে।”

“কে বলল?”

“আমি মাত্রই দেখে এলাম। বাবা ফোন করে ভাইকেও যেতে বলেছে। ভাই গিয়ে রাতের মধ্যেই আবার ফিরে আসবে আমরা বাসায় একা থাকব বলে।”

“ওহ্!”

“সবাই বেরিয়ে পড়লে তুই ঐ বাসায় যাস।”

“আর তুই একা থাকবি না-কি বাসায়? গেলে তুইও আমার সাথে যাবি। ”

ডালিয়া একটু ভেবে বলল,“আচ্ছা ঠিক আছে। চল গিয়ে দেখি ওরা কখন বেরোবে।”

ডালিয়া আর ইলোরা রুম থেকে বেরিয়ে দেখল সাজিদ হোসেন,মালিহা বেগম আর মিথিলা রেডি হয়ে সাকিবের জন্য অপেক্ষা করছে। ওদের দুজনকে দেখেই মালিহা বেগম এক বস্তা আদেশ উপদেশ দিতে শুরু করলেন। এটা করবি,ওটা করবি না,এটা খাবি,ভয় পাস না,সাকিব চলে আসবে ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। ডালিয়া আর ইলোরা তার সব কথায় আচ্ছা আচ্ছা বলে গেল। সাকিব রেডি হয়ে আসতেই সবাই বেরিয়ে গেল কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে। ডালিয়া ইলোরাকে খোঁচাতে শুরু করল এরেনের বাসায় যাওয়ার জন্য। ইলোরাকে ভয়,লজ্জা,অস্বস্তি আঁকড়ে ধরেছে। তার মধ্যেই আবার জারিন ফোন করে জিজ্ঞেস করল সে যাবে কি না। ডালিয়ার ধাক্কাধাক্কিতে ইলোরা রাজি হয়ে গেল। জারিন তাকে রেডি হয়ে গেটের সামনে দাঁড়াতে বলে ফোন কেটে দিলো। ইলোরা আর ডালিয়া তাড়াতাড়ি করে রেডি হতে লেগে পড়ল। ইলোরা ড্রেস বের করতেই ডালিয়া বাঁধা দিয়ে বলল শাড়ি পড়তে। যেহেতু প্রথমবারের মতো শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে সেহেতু বউয়ের মতো যাওয়া উচিত। কিন্তু ইলোরা রাজি হলো না। পরে ডালিয়ার জোরাজুরিতে সে তার মায়ের আলমারি থেকে বাসন্তী রঙের একটা হাফ সিল্ক শাড়ি নিয়ে এল। তারপর ডালিয়ার সাহায্যে সুন্দর করে শাড়ি পড়ে হালকা সাজগোজ করল। বাসা তালা মেরে গেটের সামনে গিয়ে জারিনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ডালিয়া বলল,“আপু এই বাসা চেনে কীভাবে?”

ইলোরা বলল,“জানি না। বলল তো চেনে।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই জারিন চলে এল। তার পরনেও বাসন্তী রঙের শাড়ি। জারিনকে এমন সাজগোজে এই প্রথম দেখল ইলোরা। মুগ্ধও হলো। আজ কয়টা ছেলের মাথা ঘুরাবে কে জানে? জারিন এসেই মিষ্টি হেসে ইলোরাকে জড়িয়ে ধরে বলল,“মা শা আল্লাহ্ ভাবি! তোমাকে তো দারুণ লাগছে। ভাইয়া তো আজ মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।”

ইলোরা লাজুক হেসে বলল,“তোমাকেও খুব মিষ্টি দেখতে লাগছে আপু।”

“থ্যাংক ইউ ভাবি। ডালিয়া,তুমি শাড়ি পড়লে না কেন?”

ডালিয়া বলল,“আমি শাড়ি সামলাতে পারি না আপু। অনেক কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে ইলো জোর করে পড়ায়। আর আজ আমিই ওকে জোর করে পড়িয়েছি। সে তো লজ্জা পাচ্ছিল।”

জারিন ইলোরাকে বলল,“লজ্জা পেতে হবে না গো ভাবি। তোমারই তো শ্বশুরবাড়ি। চলো।”

ওরা তিনজন একটা সিএনজিতে উঠে বসল। প্রায় আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেল গন্তব্যে। বাড়ির গেটে পা রাখতেই ইলোরার বুকটা ধড়াস-ধড়াস করতে লাগল। এই প্রথম শ্বশুরবাড়িতে পা রাখল তা-ও লুকিয়ে চুরিয়ে। এরেন তো এখনও কিছুই জানে না। ঘুম থেকে উঠে নিজের বাসায় বউকে দেখলে নির্ঘাত ভ্যাবাচ্যাকা খাবে। মেইন দরজা খুলে ইলোরাকে আগে ভেতরে ঢুকতে বলল জারিন। ইলোরা আল্লাহর নাম নিয়ে ভেতরে ঢুকল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে জারিন দাঁত বের করে হেসে বলল,“আমরা তোমাদের মধ্যে কাবাবের হাড্ডি হতে চাই না। তোমরা নিজেদের মতো এনজয় করো। আমরা ঘুরে আসি।”

ইলোরা কিছু বলার আগেই জারিন বাইরে থেকে দরজা আটকে দিলো। ইলোরা চমকে উঠল। দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে টানাটানি করে বুঝল বাইরে থেকে লক করা। তার কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। একটা শুকনো ঢোক গিলে সে ভেতরের দিকে পা বাড়াল। কিন্তু কোন রুমটা এরেনের তা তো সে জানে না। প্রথমে একটা রুমের সামনে গিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিলো। রুম দেখে বুঝল এটা এরেনের মা-বাবার রুম। তারপর অন্য একটা রুমের দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিতেই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। কোমর অবধি চাদর টেনে এরেন ঘুমে মগ্ন। পরনে একটা হোয়াইট টি-শার্ট। ইলোরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগল ভেতরে যাবে কি যাবে না। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে তারপর ঢুকেই গেল। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে এরেনের বিছানার পাশে দাঁড়াল। লোকটার ঘুমন্ত মুখটা দেখে কেমন যেন মায়া লাগছে। ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে জাগছে। ইলোরা এরেনের বাঁ পাশে বসে ভাবতে লাগল এরেনকে ডেকে তুলবে কি না। তারপর তার দিকে কিছুটা ঝুঁকে বাঁ হাতটা এরেনের কানের কাছে নিয়ে নাড়তে লাগল। তার বাঁ হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি গুলো রিনিঝিনি শব্দে বাজতে শুরু করল। মিনিট খানেক পর এরেন চোখ কুঁচকে হালকা নড়েচড়ে উঠল। কানের কাছে হাত নিয়ে ঘুমের মধ্যেই সে ইলোরার হাতটা ধরে ফেলল। হাতের মুঠোয় মেয়েদের চুরির অস্তিত্ব টের পেয়ে এরেন ফট করে চোখ খুলে তাকাল। সামনে নিজের প্রেয়সীকে নতুন রূপে দেখে সত্যিই সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। লাফ দিয়ে উঠে বসে সে বড়ো বড়ো চোখ করে ইলোরার দিকে তাকিয়ে বলল,“তুমি!? আমি কি সত্যি দেখছি না-কি স্বপ্ন?”

এরেনের কান্ড দেখে ইলোরা ফিক করে হেসে ফেলল। ওর খিলখিল হাসির শব্দে এরেন বুঝল সে ভুল দেখছে না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে ইলোরার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এরেনের দৃষ্টি দেখে ইলোরা হাসি থামিয়ে লজ্জায় মাথানত করে ফেলল। এরেন কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ইলোরার এক গালে আলতো করে হাত রেখে বলল,“লজ্জাবতী,হঠাৎ এই রূপে আমার বাসায় হাজির হলে যে?”

ইলোরা বলল,“আপু নিয়ে এসেছে।আমি আর ডালিয়া ছাড়া সবাই কিশোরগঞ্জ গেছে। অনু আপ্পিকে আজ ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে।”

“আচ্ছা? সেই সুযোগে সেজেগুজে সোজা শশুরবাড়ি চলে এসেছ?”

“আমি আসতে চাইনি। আপু আর ডালিয়া অনেক জোরাজুরি করেছে। আর ডালিয়া জোর করে শাড়ি পড়িয়েছে।”

এরেন এবার ইলোরারার আপাদমস্তক ভালো করে নিরীক্ষণ করে মুচকি হাসল। এরেনের চাহনিতে ইলোরার আত্মা কেঁপে উঠল। এরেন ইলোরার চিবুক স্পর্শ করে মুখটা উঁচু করে ধরে কপালে চুম্বন রেখা এঁকে দিলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

বসন্তের রাণী,তুমি কি বোঝো না তোমার
নতুন নতুন রূপ আমার হৃদয়ে কম্পনের সৃষ্টি করে?
তোমার লাজুক বদনকান্তি আমার মনে কতশত
নিষিদ্ধ বাসনা জাগাতে সক্ষম।
তোমার ঐ আবেদনময়ী বদন খানি
আলতো ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিতে দেবে কি আমায়?

ইলোরা লজ্জায় অন্যদিক ফিরে বলল,“অসভ্যতামি করবা না।”

এরেন ধপ করে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে করুণ চোখে তাকিয়ে বলল,“দিলে আমার রোমান্টিক মুডের বারোটা বাজিয়ে। আচ্ছা গুড নাইট।”

এরেন চোখ বন্ধ করতেই ইলোরা হন্তদন্ত হয়ে তার হাত টেনে ধরে বলল,“গুড নাইট মানে কী? বেলা এগারোটা বেজে গেছে। ওঠো বলছি।”

এরেন চোখ খুলে ভ্রু কুঁচকে ইলোরার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হেঁচকা টানে ইলোরাকে নিজের বুকের উপর ফেলল। আকস্মিক ঘটনায় ইলোরা হকচকিয়ে গেল। এরেন হঠাৎ এমন কিছু করবে ভাবতেও পারেনি সে। এর আগে সবসময় এরেন কপালে বা গালে শুধু চুমু খেয়েছে। কিন্তু কখনও এতটা কাছে আসেনি। ইলোরা তাড়াহুড়ো করে উঠতে যেতেই এরেন দুহাতে শক্ত করে তার কোমড় জড়িয়ে ধরল। ইলোরা এরেনের থেকে ছাড় পাওয়ার জন্য ছুটোছুটি করতে লাগল। সে এরেনের বলিষ্ঠ হাত সরানোর অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। এদিকে এরেন তার বউয়ের নাজেহাল অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হাসছে। ইলোরা লজ্জায় এরেনের মুখের দিকে তাকাতেও পারছে না। এরেন হেসে বলল,“এত ছোটাছুটি করে লাভ নেই। সময়মতো আমি নিজেই ছেড়ে দেবো।”

ইলোরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,“প্লিজ ছাড়ো। আমার ভয় লাগছে।”

এরেন একইভাবে বলল,“নিজের হাসবেন্ডকে ভয় লাগছে তোমার? তোমার কি ধারণা আমি তোমার একাকীত্বের সুযোগ নেব?”

ইলোরা থমকে গেল। এই প্রশ্নের কী উত্তর দিবে সে? যদিও তার উপর এরেনের সম্পূর্ণ অধিকার আছে কিন্তু সে জানে এরেন তেমন কোনো অধিকার ফলাবে না। তাহলে সে ভয় কেন পাচ্ছে? ইলোরার ভাবনার মাঝেই এরেন হঠাৎ প্রশ্ন করল,“তুমি আমাকে এখনও মন থেকে বিশ্বাস করতে পারোনি?”

ইলোরা এবার অসহায় মুখে এরেনের চোখের দিকে তাকাল। এরেন প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা কি কষ্ট পেয়েছে না-কি? ইলোরা কিছু না ভেবে এরেনের বুকে মুখ গুঁজে দুহাতে আকড়ে ধরল। এরেন মুচকি হেসে শক্ত করে ইলোরাকে বুকে জড়িয়ে রাখল। কিছুক্ষণ বাদে মৃদু কন্ঠে বলল,“ইলোনি,তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি কোনোদিনও তোমাকে ওইভাবে স্পর্শ করব না,কাছেও যাব না। অন্তত তোমাকে পারমানেন্টলি এই বাড়িতে নিয়ে আসার আগে তো না-ই। বিশ্বাস করতে পারো আমাকে। তুমি শুধু এভাবেই আমার বুকে মুখ লুকাবে আর আমি শক্ত করে তোমাকে জড়িয়ে রাখব। ব্যাস,তাতেই হবে।”

ইলোরার চোখে পানি এসে গেল। মানুষটা যে তাকে কতটা ভালবাসে তা পরিমাপ করার মতো না। বুকে ফোঁটা ফোঁটা পানির স্পর্শ পেয়ে এরেন ইলোরার মুখটা তুলে ধরল। চোখ দুটো মুছে দিয়ে ইলোরার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,“এই পাগলী,তুমি এত আবেগী কেন বলো তো? কতবার বলেছি ছোটো-খাটো কারণে এভাবে কাঁদবে না।”

ইলোরা কান্নাভেজা থমথমে গলায় বলল,“তুমি এত ভালো কেন?”

এরেন দুষ্টুমি করে বলল,“ভালো না-কি? কিন্তু তুমি তো বলো আমি অসভ্য। আজ বলবে না? না-কি কোনো অসভ্যতামি করব?”

ইলোরা এরেনের বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে লাজুক হেসে উঠে বসল। এরেন শব্দ করে হাসতে হাসতে উঠে বসে ইলোরাকে পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রেখে প্রশ্ন করল,“আমাদের বিয়ের কত মাস হলো?”

ইলোরা ভেবে বলল,“ছয় মাস।”

এরেন অবাক হয়ে বলল,“এত মাস হয়ে গেল! মনে তো হচ্ছে বিয়ের এক বছর পর তোমাকে এবাড়িতে আনতে পারব।”

ইলোরা ছোটো একটা শব্দ করল,“হুম।”

“তোমার অনু আপ্পির বিয়েটা ঠিকঠাক হলে ভালো হবে।”

“কেন?”

“তাহলে বোধ হয় আমারও যাওয়া হবে বিয়েতে।”

“মামার সাথে এখনও যোগাযোগ হয় তোমার?”

“হ্যাঁ। মাঝে মাঝে উনিও ফোন করেন আবার আমিও করি। আমি ভাবছি বিয়ে বাড়িতে তোমার সাথে অনেকটা সময় কাটাতে পারব। তাছাড়া একসাথে আবার কিশোরগঞ্জ যাওয়ারও খুব ইচ্ছে আমার। মাঝখানে যখন ছোটো খালার বাসায় গেলাম তখন তোমাকে খুব মিস করেছিলাম।”

তারপর দুজনেই কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপচাপ একে অপরের শরীরের ঘ্রাণ উপভোগ করল। বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ এরেন চোখ খুলে মৃদু কন্ঠে ডাকল,“ইলোনি?”

এই ডাকটা শুনলেই ইলোরার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। শিরায় উপশিরায় আলাদা শিহরণ খেলে যায়। সে চোখ বন্ধ অবস্থাতেই সাড়া দিলো,“হুম।”

“এমন রূপে আর কখনও একা আমার সামনে এসো না। নির্ঘাত উল্টাপাল্টা কিছু করে বসব। তুমি হয়তো অধিকারের কথা ভেবে কিছু বলতে পারবে না। কিন্তু আমি সেটা চাই না।”

ইলোরা মৃদু হেসে বলল,“আমি জানি তুমি এমন কিছুই করবে না।”

“এতটা বিশ্বাস করো?”

“আমারই তো বর।”

এরেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে ইলোরার বন্ধ চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে রইল। ইলোরা হঠাৎ চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে বলল,“যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। আর ব্রেকফাস্ট কখন করবে? দুপুরে? আমাকে রান্নাঘর দেখিয়ে দাও। কিছু একটা বানিয়ে ফেলি।”

এরেন ইলোরার নাক টেনে দিয়ে বলল,“তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না মিষ্টি বউটা। ব্রেকফাস্ট বাইরে করব।”

“তাহলে শুধু চা করে আনি?”

এরেন এবার আর বাঁধা দিলো না। ইলোরাকে রান্নাঘর দেখিয়ে দিয়ে সে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখল ইলোরা হাতে এক কাপ চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরেন মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে চা টা হাতে নিয়ে বলল,“পাক্কা গৃহিণী আমার।”

ইলোরাও হেসে ফেলল। এরেন প্রশ্ন করল,“তোমার জন্য আনলে না।”

“উঁহু। আমি বাসায় একবার খেয়েছি। আমি অত চা পছন্দ করি না।”

“জানি। এখন কোথায় যাবে বলো। রবীন্দ্র সরোবর যাবে?”

ইলোরা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে বলল,“কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না আর।”

এরেন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,“তাহলে? বরের আদর খাওয়ার শখ জাগছে?”

“বাজে কথা বলবা না তো।”

“এটাও বাজে কথা? আচ্ছা বলো কী করবে? আমার আসলে বিশেষ কোনো দিনে বাইরে বের হলে মানুষের ভীরে মাথা ধরে যায়। তাই তোমাকে নিয়ে বের হওয়ার কোনো প্ল্যানও করিনি। তাছাড়া আমি তো ভেবেছিলাম তুমি বাড়ি থেকেই বেরোতে পারবে না। অথচ তুমি আমার বাড়িতেই চলে এলে।”

“তাহলে বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। আমি কিছুক্ষণ পর চলে যাব।”

এরেন বাঁধ সেধে বলল,“বিকেলে যাবে। আমি খাবার অর্ডার করব। দুপুরে এখানেই লাঞ্চ করবে। তাছাড়া ডালিয়াও তো জারিনের সাথে আছে। ওদের ফিরতে হয়তো অনেক লেট হবে।”

“এখন কী খাবে তাহলে?”

“তুমি বসো। আমি দেখছি কী আছে। সামান্য কিছু খেয়ে নিচ্ছি।”

ইলোরা ঘাড় কাত করল। এরেন রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই ইলোরা ভালো করে রুমটায় চোখ বোলাতে লাগল। এরেনের রুমটা বেশ বড়ো আর গোছালো। এই বাড়িতে এসে সেও এরেনের সাথে এই রুমেই থাকবে ভাবতেই কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে। দুই মিনিটের মাথায় এরেন চলে এল। ইলোরার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে সে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ইলোরা মুচকি হেসে এরেনের মাথার সিল্কি চুলের ফাঁকে আঙুল বুলাতে লাগল। দুজন মিলে হাস্যোজ্জ্বল মুখে হাজারো কথার ডালা সাজাতে শুরু করল। এরেন মুগ্ধ কন্ঠে বলল,“তোমাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। শোনো,এ বাড়িতে আসার পর কিন্তু সবসময় তুমি শাড়ি পড়বে।”

ইলোরা হেসে বলল,“পাগল! সারাক্ষণ শাড়ি সামলানো কত ঝামেলা জানো? আমি বরং মাঝে মাঝে শাড়ি পড়ব।”

এরেন ভেবে বলল,“ওকে।”

কথার মাঝেই এরেন দুপুরের খাবার অর্ডার করল। দুপুর একটার দিকে জারিন আর ডালিয়া বাসায় ফিরল। তারা এসেই এরেন আর ইলোরাকে নিয়ে মজা করতে লেগে পড়ল। খাবার চলে আসার পর এরেন গোসল সেরে সবাইকে নিয়ে খাবার টেবিলে বসে পড়ল। সবাই একসাথে হাসি,আড্ডায় খাওয়া শেষ করল। এরেন যদিও বলেছিল ইলোরা আর ডালিয়াকে বিকেলে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে কিন্তু ইলোরা দুপুরের খাবারের পরেই বাসায় ফিরতে চাইল। শেষে ইলোরা আর ডালিয়াকে তখনই বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে আসতে রাজি হলো এরেন।

চলবে………………….🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here