সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্বঃ৪২

0
899

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৪২

সোফায় গা এলিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে গম্ভীর মুখে বসে আছেন জাকির জামান। সামনের সোফায় মুখোমুখি বসে তার দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এরেন আর আন্নি হক। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটিয়ে এরেন বলে উঠল,“বাবা, এবার তো বলো কেন ডেকেছ।”

জাকির জামান এবার মুখ খুললেন,“রনির বড়ো ভাই শাকিলের সাথে আমার কথা হয়েছে।”

এরেন আর আন্নি হক মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। আন্নি হক প্রশ্ন করলেন,“কী নিয়ে?”

জাকির জামান উত্তর দিলেন,“বিয়ে নিয়ে।”

এরেন অবাক হয়ে কিছুটা জোরে বলে উঠল,“হোয়াট!”

জাকির জামান কপাল কুঁচকে ছেলের দিকে তাকালেন। আন্নি হক বললেন,“এসব কী বলছো তুমি?”

“কেন? শুনতে পাওনি?”

এরেন বলল,“কিন্তু বাবা, রনি অন্য কারো সাথে রিলেশনে আছে।”

“তো? বিয়ের আগে ওমন কত ছেলেরই অন্য কারো সাথে রিলেশন থাকে। পরে ভুলে যাবে।”

“ব্যাপারটা অতটাও স্বাভাবিক না বাবা।”

আন্নি হক বললেন,“আগে বলো শাকিল কী বলল।”

জাকির জামান সন্তুষ্টির হাসি হেসে বললেন,“ওদের কারোরই আপত্তি নেই। সবাই জারিনকে খুব পছন্দ করে। আমি বলেছি এই মাসের মধ্যে বিয়ের পাকা কথা বলব।”

এরেন দাঁড়িয়ে গেল। উত্তেজিত কন্ঠে বলল,“বাবা প্লিজ। এসব বন্ধ করো। রনি এতে রাজি হবে না। আর বুড়ির মতামত জানাও দরকার। তাছাড়া ওদের পড়াশোনা শেষ হয়নি এখনও।”

জাকির জামান এরেনের দিকে তাকিয়ে বললেন,“এসব কোনো বিরাট ব্যাপার না। ক্যারিয়ারের জন্য অনেক সময় পাবে। আর রনিকে ওর ভাই রাজি করাবে।”

“আর জারিন?”

জাকির জামান ধমকে উঠে বললেন,“তুমি চাও না তোমার বোন সুখী হোক?”

“অবশ্যই চাই। কিন্তু আরেকজনের সুখ কেড়ে নিয়ে না। আমার মনে হয় রনি আর জারিনের সাথে আগে কথা বলা উচিত।”

আন্নি হক এরেনের সাথে সম্মত হয়ে বললেন,“আমারও তাই মনে হয়। বিয়ের মতো এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত আগেই নেয়া ঠিক হবে না। পরে দেখবে ওরা কেউই সুখী হতে পারবে না।”

জাকির জামান একটু ভেবে বললেন,“ঠিক আছে। শাকিল আগে কথা বলুক রনির সাথে। তারপর আমি জারিনের সাথে কথা বলব। তোমরা আগেই এ বিষয়ে ওর সাথে আলোচনা করবে না।”

এরেন মুখ দিয়ে ফুস করে একটা বিরক্তিকর শব্দ করে বলল,“ঠিক আছে। কিন্তু আমি এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি যে রনি এই বিয়েতে রাজি হবে না।”

জাকির জামান মাথা দুলিয়ে বললেন,“দেখা যাক।”

এরেন আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াল না। গটগট করে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।


ছাদের এক কোণে পা গুটিয়ে বসে শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে জারিন। অনেকক্ষণ ধরে এভাবেই বসে আছে সে। হঠাৎ ফোনের রিংটোনের শব্দে হুঁশ ফিরল তার। ঘাড় ঘুরিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রনি নামটা দেখেই বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। কিছুটা অবাকও হলো। কারণ রনি কখনও নিজ থেকে তাকে ফোন করে না। সবসময় সে-ই ফোন করে। ভাবতে ভাবতে ফোনটা কেটে গেল। পরক্ষণেই আবার বেজে উঠল। জারিনের বুকটা ধুকধুক করতে লাগল। রনি নিজ থেকে কেন ফোন করল সেটাই বুঝতে চেষ্টা করছে সে। কাঁপা হাতে ফোনটা উঠিয়ে রিসিভ করে কানে ধরে মৃদু কন্ঠে হ্যালো বলল। সঙ্গে সঙ্গে ফোনের ওপাশ থেকে রনি গম্ভীর গলায় বলল,“এসব কী হচ্ছে জারিন?”

জারিন কিছু না বুঝতে পেরে বলল,“কোনসব?”

“বুঝতে পারছো না?”

জারিনের মনে সন্দেহ জাগল, রনি কী তার কান্নাকাটির খবর পেয়েছে না-কি? সে কিছু বলার আগেই রনি আবার বলে উঠল,“আমি তোমাকে বোন ভেবেছিলাম জারিন। এমন কিছু আমি মোটেও আশা করিনি। তোমার বাবা এসব কী করছে বলো তো? তোমার সাথে আমার বিয়ের কথা বলছে! লাইক সিরিয়াসলি!”

জারিন চমকে উঠল। কাঁপা গলায় বলল,“মানে?”

“কেন? তুমি জানো না?”

“না।”

“হোয়াট! তুমি জানো না, আমিও জানতাম না। তাহলে এসবের মানে কী? ভাইয়া এইমাত্র এসে আমাকে জানাল আমাদের বিয়ের কথা হচ্ছে। তারপর এই নিয়ে ভাইয়ার সাথে আমার কথা কাটাকাটিও হয়েছে। আমার আর তোমার ফ্যামিলির সবাই বিয়েতে রাজি, অথচ আমরাই জানি না। মানে কী এসবের? আর ভাবির থেকে শুনলাম তুমি না-কি অনেক পাগলামি করছো? তোমার পাগলামির কারণেই না-কি আঙ্কেল এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে? কী হচ্ছে এসব? তুমি কেন এমন করছো বলবে আমাকে? সবটাই তো আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।”

জারিনের চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। গলাটাও ভারী হয়ে এল। ঠোঁট জোড়া মৃদু কাঁপতে লাগল। জারিনের সাড়া না পেয়ে রনি আবার বলল,“দেখো জারিন, তুমি যদি সত্যিই আমার জন্য পাগলামি করে থাকো তাহলে সেটার কারণ কী? এতদিন তো এমন কিছু হয়নি। তাহলে এখন কেন?”

জারিন এবারও উত্তর দিলো না। নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। রনি ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“এমন কিছু আমি একদমই আশা করিনি তোমার থেকে। তোমার জেনে রাখা দরকার, আমি অন্য কাউকে পছন্দ করি। আর বিয়ে করলে তাকেই করব। জানতে চেও না সে কে।”

জারিন ধরা গলায় বলে উঠল,“মিথিলা।”

রনি চুপ হয়ে গেল। মিনিট খানেক পর বলল,“তার মানে তুমি জেনেশুনেই এমন পাগলামি করছো? কিন্তু কীভাবে জানলে? এই কথাটা তো কেউ জানে না।”

জারিন বাঁ হাতে মুখ চেপে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল। এবারও জারিনের উত্তর না পেয়ে রনি কিছুটা নরম কন্ঠে বলল,“হঠাৎ করে এমন কিছু শুনতে হবে আমি ভাবতেও পারিনি। যাইহোক, আঙ্কেল বোধ হয় তোমার খুশির কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু আমি সবসময় তোমাকে বোন ভেবে এসেছি। তোমার সেটা বুঝা উচিত ছিল। তোমার ভুলের জন্য ভাইয়া আমার সাথে রাগারাগী করছে। আমাকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। জানি না ব্যাপারটা এখন কতদূর গড়াবে। তোমার কাছে রিকোয়েস্ট করছি, প্লিজ তুমি তোমার বাবাকে একটু বুঝাও। আমি এরেনকে ফোন করেছিলাম কিন্তু ওর ফোন সুইচ অফ।”

এটুকু বলে রনি থামল। তারপর জারিনের উত্তরের অপেক্ষা করল। এবারও সে হতাশ হলো। জারিন তো তখন কান্না সামলাতে ব্যস্ত। রনি বলল,“জারিন, বুঝতে পারছো আমার কথা? কিছু তো বলো। আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। ফিলিংসটা সবার প্রতি আসে না। বুঝার চেষ্টা করো।”

রনি আর কিছু বলার আগেই জারিন ফট করে ফোনটা কেটে দিলো। তারপর হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠল। তার বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সে তো ইচ্ছে করে পাগলামি করছে না। তার কষ্ট হচ্ছে তাই তো সবকিছু এলোমেলো লাগছে। সে মন থেকে ভালোবেসেছিল রনিকে। তখন তো বুঝতে পারেনি এমন কোনো পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। হুট করেই সে ভালোবেসে ফেলেছিল। কিন্তু তার ফল কী হবে তা কখনও ভাবেনি। কিছুক্ষণ কান্নার পর সে কিছুটা শান্ত হলো। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে নেমে গেল। মায়ের রুমে গিয়ে দেখল সে ঘুমাচ্ছে। তাই নিজের রুমে ফিরে এল। ফোনটা রেখে বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়ল। তারপর ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকে। বিছানা ছেড়ে যখন উঠল তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বাজে। আন্নি হক বলে গেলেন ফ্রেশ হয়ে নিচে যেতে। জারিন মায়ের কথামতো ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে দেখল বাবা-মা, ভাই একসাথে বসে চা খাচ্ছে। তাকে দেখে জাকির জামান একগাল হেসে বললেন,“আয় মা।”

জরিন গিয়ে বাবার পাশে বসল। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল সে গম্ভীর মুখে বসে চা খাচ্ছে। জারিন বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,“কিছু বলবে বাবা?”

জাকির জামান চায়ের কাপটা রেখে বললেন,“হ্যাঁ, তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”

“কোন বিষয়ে?”

“তোমার বিয়ে নিয়ে।”

অন্যসময় হলে হয়তো জারিন অবাক হত। কিন্তু এখন এই ব্যাপারটা সম্পর্কে সে অবগত। তাই স্বাভাবিকভাবেই বলল,“তার আগে আমার কথা শোনো।”

জাকির জামান প্রশ্ন করলেন,“কী কথা?”

জারিন বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে বলল,“বিয়েটা আমি করব না বাবা। শাকিল ভাইয়াকে না বলে দাও।”

জাকির জামান, আন্নি হক আর এরেন অবাক দৃষ্টিতে জারিনের দিকে তাকাল। এরেন বলে উঠল,“তুই জানলি কীভাবে? আম্মী বলেছে?”

জারিন মাথা দুলিয়ে না বলল। এরেন প্রশ্ন করল,“তাহলে?”

“রনি ভাইয়ার সাথে আমার কথা হয়েছে।”

জাকির জামান বললেন,“ও কী এমন বলল যে তুমি বিয়ে করবে না বলছো?”

জারিন বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,“সে কী বলল তা জরুরি নয় বাবা। আর আমি তার কথায় না, নিজের বিবেক থেকে বলছি আমি বিয়ে করব না।”

আন্নি হক বললেন,“তাহলে কী চাইছিস তুই? পাগলামিও করছিস আবার বলছিস বিয়ে করবি না?”

জারিন মাথা নিচু করে বলল,“সেজন্য আমি সরি। ভুলটা আমারই। আমার বুঝা উচিত ছিল রনি ভাইয়া কী চায়। উনি অন্য একজনকে খুব পছন্দ করে। তাকে ভুলে আমাকে বিয়ে করতে রাজি না সে। আর আমিও এতটা স্বার্থপর হতে পারব না। আমি কারও সুখ কেড়ে নিতে চাই না। তাই আর এগিয়ো না বাবা। এখানেই থেমে যাও। তোমরা চিন্তা করো না। আমি নিজেকে সামলে নিব।‌ প্রমিজ করছি।”

কথাগুলো বলে জারিন উঠে ওপরে চলে গেল। জাকির জামান, আন্নি হক আর এরেন বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। এরেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে চলে যেতে যেতে বলল,“আমি জানতাম এমন কিছুই হবে।”

জাকির জামান এখনও চুপ মেরে বসে আছেন। আন্নি হক বললেন,“তোমার মেয়ে এখন আর ছোটো নেই। বড়ো হয়ে গেছে। ভালো মন্দ বুঝতে শিখেছে। আমার মনে হয় ও ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওদেরকে ফোন করে না বলে দাও।”

জাকির হোসেন কোনো কথা বললেন না। শুধু একবার মাথা ঝাঁকালেন।


পরপর কয়েকবার এরেনকে কল করার পরও এরেন ফোন ধরল না। এই নিয়ে দশবার ফোন করেছে ইলোরা। আরও পাঁচবার কল করেও যখন হতাশ হলো তখন তার রাগ উঠে গেল। ফোনটা বিছানায় ফেলে রেখে গাল ফুলিয়ে বসে রইল। তার প্রায় পনেরো মিনিট পর এরেনের ফোন এল। ইলোরা দেখেও ফোন রিসিভ করল না। পরপর তিনবার কল করার পরও সে অভিমান করে বসে রইল। মনে মনে ঠিক করল আজ সে ফোন রিসিভ করবেই না। তখনই মেসেঞ্জারে এরেনের মেসেজ এল। সে লিখেছে,“সরি, ফোন চার্জে ছিল। সাইলেন্ট মুডে থাকায় শুনতে পাইনি। ফোন রিসিভ করো।”

ইলোরা মেসেজটা সিন করে রেখে দিলো। তারপর আবার এরেনের ফোন এল। ইলোরা এবার ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখল। সে একবার যেহেতু ঠিক করেছে ফোন রিসিভ করবে না তো করবেই না। কয়েক মিনিট পর ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল এরেন ফোন করা থামিয়ে দিয়েছে। ইলোরা শুয়ে শুয়ে ফেসবুকিং করতে লাগল। হঠাৎ করেই তার খারাপ লাগা শুরু হলো। কেমন যেন অপরাধ বোধ হচ্ছে। মানুষটা নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে। শুধু শুধু রাগ দেখাল সে। ইলোরা তাড়াতাড়ি কললিস্টে গিয়ে এরেনের নাম্বারে ডায়াল করল। কিন্তু এরেন এবার আবার ফোন রিসিভ করল না। ইলোরা ভাবল এরেন হয়তো রেগে গেছে। সে মন খারাপ করে ফোনটা শিয়রের পাশে রেখে শুয়ে রইল। প্রায় বিশ মিনিট পর জানালায় একটা শব্দ হওয়ায় ইলোরার কাঁচা ঘুম ছুটে গেল। চোখ মেলে তাড়াতাড়ি উঠে বসল সে। আবার শব্দ হতেই সে কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। তারপর আবারও সেই একই শব্দ হলো। মনে হলো কেউ জানালায় ইট বা পাথর জাতীয় কিছু ছুঁড়ে মারছে। ইলোরা ঢোক গিলে ফোনের দিকে তাকাতেই দেখল এরেন ফোন করেছে। সে এবার কোনোরকম অভিমান না রেখে তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করল। মুখ খুলে কিছু বলার আগেই এরেন বলে উঠল,“বেলকনিতে আসো।”

ইলোরা ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেলল। তার বুঝতে বাকি রইল না যে এরেন রাগ ভাঙানোর জন্য এই রাতবেলা ছুটে এসেছে। সে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে নেমে বেলকনিতে ছুটল। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল এরেন গাড়িতে হেলান দিয়ে কানে ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে একটা লাল টি-শার্ট আর অফ-হোয়াইট কালার ট্রাউজার। ইলোরাকে দেখেই এরেন মুচকি হাসল। ইলোরা মুখ গোমড়া করে বলল,“এত রাতে কেন এসেছ? তোমার স্বভাব কবে যাবে বলো তো?”

এরেন হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,“যেদিন বউ আমার কাছে থাকবে সেদিন। তাছাড়া আমার কষ্ট হয়নি ম্যাডাম। বাবার গাড়ি নিয়ে চলে এসেছি। কী করব বলো? আমার বউ তো আমাকে এই পর্যন্ত আনবে বলেই রাত-দুপুরে রাগ করে বসে থাকে।”

ইলোরা মুখ কাচুমাচু করে বলল,“সরি। আমার অযথা রাগ করা উচিত হয়নি।”

“আচ্ছা বুঝলাম। অনুগ্রহ করে এবার একটু হাসবেন বেগম সাহেবা?”

ইলোরা এরেনের কথা শুনেই হেসে ফেলল। এরেন বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বলল,“এই হাসিমুখটা প্রাণভরে দেখে মরেও শান্তি পাব।”

নিমিষেই ইলোরার মুখে একরাশ কালো মেঘ এসে ভর করল। সে কিঞ্চিত রেগে গিয়ে বলল,“মুখে কি কোনো ভালো কথা রোচে না তোমার? এতরাতে এই ফালতু কথা বলতে এসেছ? যাও এখান থেকে। দরকার নেই তোমার রাগ ভাঙানোর।”

কথাটা বলেই ইলোরা পেছন ঘুরে দাঁড়াল। এরেন হেসে বলল,“আচ্ছা মহারানি, আমার ভুল হয়ে গেছে, মাফ চাইছি। আর কখনও বলব না। এবার এদিক ফিরে তাকান।”

“এর আগেও তুমি এই কথাই বলেছিলে। সেদিনও বলেছিলে আর বলব না। আজ তো আবার ঠিকই বললে।”

“বললাম তো বাবা ভুল হয়ে গেছে। আর এতে এত রেগে যাওয়ার কী আছে? আমি কি আজীবন বেঁচে থাকব? আমরা সবাই-ই তো একদিন না একদিন চলে যাব। আল্লাহ্ নিয়ে গেলে কি কেউ ধরে রাখতে পারে?”

ইলোরা থমথমে মুখে বলল,“যাও এখান থেকে।”

এরেন প্রশ্ন করল,“অমার শ্বশুর-শাশুড়ি কী করছে?”

ইলোরা বুঝল এরেন কথা ঘুরানোর চেষ্টা করছে। সে থমথমে মুখেই জবাব দিলো,“এত রাতে মানুষ ঘুম বাদ দিয়ে কি তোমার মতো বাজে বকবে?”

“তোমার কাকা-কাকি চলে গেছে?”

“হ্যাঁ। তুমি যাবে এখান থেকে?”

“আচ্ছা চলে যাচ্ছি।”

কথাটা বলার পর আর এরেনের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। ফোনটাও কাটেনি এখনও। ইলোরা এবার ঘুরে দাঁড়াল। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল এরেন নেই অথচ তার গাড়ি এখনও দাঁড় করা আছে। ইলোরা কপাল কুঁচকে ফেলল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে এরেনকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু আশেপাশে এরেনকে পেল না। সে বেশ অবাক হয়ে গেল। কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করল তবু এরেনের সাড়া পেল না। হঠাৎ ফোনের ওপাশ থেকে এরেনের কন্ঠ ভেসে এল,“দরজা খোলো।”

ইলোরা চমকে উঠল। বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। সে কাঁপা গলায় বলল,“কোথায় তুমি?”

“বাড়ির দরজার সামনে। খুলবে না দাঁড় করিয়ে রাখবে?”

ইলোরা এক দৌড়ে বেলকনি থেকে রুমে গেল। রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে ফোনের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে বাবা-মায়ের রুমের দিকে তাকাল। তারপর গুটি-গুটি পায়ে মেইন দরজার সামনে গিয়ে আস্তে করে খুলে ফেলল। দরজা খোলার সাথে সাথে এরেন ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। ইলোরা ঢোক গিলে চাপা স্বরে বলল,“ভেতরে কেন এলে? কেউ যদি টের পেয়ে যায়? আমার খুব ভয় লাগছে। প্লিজ চলে যাও।”

এরেন ইলোরাকে এক টানে কাছে টেনে নিয়ে ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে চাপা স্বরে বলল,“চুপ, একটা কথাও বলবে না।”

ভয়ে ইলোরার হাত-পা মৃদু কেঁপে উঠল। এরেন হুট করে তাকে পাঁজাকোলা করে তার রুমের দিকে হাঁটা দিলো। এরেনের এহেন কান্ডে ইলোরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সে হাত-পা ছুঁড়ে ছাড়তে বললেও এরেন শুনল না। তাকে নিয়ে সোজা রুমে ঢুকে গেল। ইলোরাকে কোল থেকে নামিয়ে দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিলো। ইলোরা শুকনো একটা ঢোক গিলে বলল,“কী করছো?”

এরেন ইলোরার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে দুষ্টু হেসে বলল,“করিনি, তবে করব। এখনও কিন্তু আমাদের বাসর হয়নি। তাই না বউ?”

ইলোরা চোখ বড়ো বড়ো করে এরেনের দিকে তাকাল। ইলোরার মুখের অবস্থা দেখে এরেন ঠোঁট টিপে হাসল। এরেন ইলোরার একদম কাছে এসে হঠাৎ ট্রাউজারের পকেট থেকে পাঁচটা কিটক্যাট বের করে সামনে ধরল। ইলোরা কিটক্যাটের দিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে গেল। এরেন বাঁ হাত দিয়ে তার এক কান ধরে বলল,“সরি বউ।”

ইলোরা এবার হাসি আটকে রাখতে পারল না। নিঃশব্দে হেসে ফেলল। এরেনের হাত থেকে কিটক্যাটগুলো নিল। এরেন এগিয়ে গিয়ে ইলোরাকে আলিঙ্গন করল। ইলোরা মৃদু হাসল। এরেন হঠাৎ তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল,“তোমার ওড়না কোথায় নিরুদ্দেশ হলো ইলোনি?”

ইলোরা থতমত খেয়ে গেল। অতিরিক্ত উত্তেজনায় সে ভুলেই গিয়েছিল যে তার গায়ে ওড়না নেই। এতক্ষণ অবধি এরেনের সামনে এই অবস্থায় ছিল ভাবতেই তার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল। সে তাড়াতাড়ি এরেনের বাহুবন্ধন থেকে সরে বিছানার দিকে পা বাড়াল ওড়নাটা নেয়ার জন্য। কিন্তু বিছানা পর্যন্ত যাওয়ার আগেই এরেন তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। সে লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে গেল। এরেন ইলোরার কাঁধে থুতনি রেখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,“এত লজ্জার কী আছে ম্যাডাম? আমি তো কোনো পরপুরুষ না। আপনার একমাত্র হাসবেন্ড।”

ইলোরা লজ্জায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। এরেন নিঃশব্দে হেসে ইলোরাকে ছেড়ে দিয়ে সে-ই বিছানার ওপর থেকে ওড়নাটা হাতে নিয়ে ইলোরার গায়ে জড়িয়ে দিলো। ইলোরা তার হাতের কিটক্যাটগুলো বিছানায় রেখে দিলো। এরেন ইলোরার কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে বলল,“এবার মুখ তুলে তাকাও আমার লাজুকতা।”

ইলোরা মুখ তুলে এরেনের দিকে তাকাতেই একে অপরের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। এরেন ইলোরার নাকে নাক ঘষে দিয়ে বলল,“লজ্জা পেলে এত সুন্দর দেখায় কেন তোমাকে? ইচ্ছে করে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে দেই।”

এরেনের কথায় ইলোরা হেসে ফেলল। তারপর এরেনের বুকে দুহাত রেখে বলল,“আমি অতটাও আহামরি সুন্দরী না। তোমার দৃষ্টি সুন্দর তাই তোমার চোখে আমি সুন্দরী।”

এরেন ইলোরার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিতে দিতে বলল,“আমার কাছে আমার ইলোনিই সেরা।”

ইলোরা মৃদু হেসে বলল,“বাসার কী খবর?”

“জানোই তো কী খবর। আপাতত সব ঠিক আছে।”

ইলোরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এরেন বলল,“অনেক রাত হয়েছে। এবার ফিরতে হবে। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি জেগে গেলে আবার ঝামেলা বাঁধাবে।”

ইলোরা মুখটা ছোটো করে বলল,“এখনই চলে যাবে?”

এরেন সরু চোখে তাকিয়ে বলল,“একটু আগে তো তাড়িয়ে দিচ্ছিলে। আর এখন মন খারাপ হচ্ছে? তো থেকে যাব?”

কথাটা বলে এরেন ভ্রু নাচাল। ইলোরা হেসে এরেনের বুকে মাথা রাখল। দুহাতে এরেনের টি-শার্ট খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে বলল,“কবে এই বুকে মাথা রেখে ঘুমাব?”

এরেন ইলোরাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মাথায় চুমু খেয়ে বলল,“খুব শীঘ্রই।”

তারপর কিছুক্ষণ দুজন চোখ বন্ধ করে চুপচাপ একে অপরকে অনুভব করল। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর এরেন ইলোরাকে ছেড়ে দিয়ে হাত ধরে রুম থেকে বেরিয়ে এল। মেইন দরজার সামনে গিয়ে ইলোরার কপালে ভালোবাসাময় চুম্বন রেখা এঁকে দিয়ে বিদায় জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। ইলোরা দরজা বন্ধ করে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে এরেনের স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করে মুচকি হাসল।

চলবে………………….🍁

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here