সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্বঃ৪৮

0
1047

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৪৮

ছাদের রেলিংয়ের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে ঘুটঘুটে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে এরেন। দৃষ্টি তার অনুভূতিশূন্য। মনের অবস্থা ঐ অন্ধকার আকাশের মতোই। আজ একমাত্র আকাশটাই যেন তার সব মন খারাপের সঙ্গি। আজ বিকালে সাজিদ হোসেন জাকির জামানকে ফোন করে বলেছেন তিনি ইলোরার বিয়েটা ভাঙতে পারবেন না। তাহলে তার এত বছরের পুরোনো বন্ধুর সাথে সম্পর্ক নষ্ট হবে। তার মতে বিয়ের পর ইলোরা এরেনকে ভুলে যাবে, আর এরেনও আস্তে আস্তে ভুলে যাবে। তাই তিনি বন্ধুর ছেলের সাথেই ইলোরার বিয়ে দিতে চান। এ খবর শুনে এরেন থমকে গিয়েছিল। করুণ দৃষ্টিতে শুধু মায়ের দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু আন্নি হকের এখানে কিছুই করার নেই। এমনকি জাকির জামানেরও। তিনি তো এমনিতেই রাজি ছিলেন না। এরপর যখন সাজিদ হোসেন নিজেই না বলে দিয়েছেন তখন তিনিই বোধ হয় সবথেকে বেশি খুশি হয়েছেন। এরেন যখন বলেছিল সাজিদ হোসেনকে আরেকবার বুঝিয়ে বলতে, তখন তিনি সাফ-সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি কারো কাছে দ্বিতীয়বার অনুরোধ করতে পারবেন না। যতই হোক তার কাছে নিজের আত্মসম্মানটাই মূল্যবান। জারিন তো প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল। দিশা না পেয়ে এরেন সাকিবকে কল করেছিল। কিন্তু গতদিন থেকেই সাকিব তার ফোন ধরছে না। এবারেও তাই হলো। ওদিকে বাবার সিদ্ধান্ত শুনে ইলোরা এরেনকে ফোন করে পাগলের মতো কান্না জুড়ে দিয়েছে। তার স্পষ্ট কথা, সে অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে না। আর না এরেনকে ছাড়তে পারবে। এরেন ইলোরার থেকে নাম্বার নিয়ে অনন্যার সাথেও কথা বলেছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে অনন্যার করার কিছু নেই। দিশেহারা এরেন এখন পড়েছে সমুদ্রের মধ্যবর্তী স্থানে। না একূল খুঁজে পাচ্ছে, আর না ওকূল। সন্ধ্যা থেকে ইলোরা ননস্টপ ফোন করে যাচ্ছে। এরেন মেয়েটার কান্নার শব্দ সহ্য করতে না পেরে ফোনটাও সাইলেন্ট করে রেখেছে। মায়ের আর বোনের গোমড়া মুখ দেখে ছাদে এসে বসে আছে। এই মুহূর্তে পৃথিবীটাই তার অসহ্য লাগছে। যেই পৃথিবীতে তাকে বুঝার মতো কোনো মানুষই নেই, সেই পৃথিবীকে তার আপন মনে হওয়ার কথাও না। হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে এরেন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে পাশে বসা অবয়বটা চিনতে এরেনের ভুল হলো না। তবু সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সেভাবেই বসে রইল। মিনিট তিনেক পর ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রনি বলল,“ভেঙে পরার মতো ছেলে তুই না এরেন। দুই পরিবারই যখন নারাজ তখন আর এটা ভেবে কষ্ট পাস না। হয়তো আল্লাহ্ তোর জন্য সামনে ভালো কিছু রেখেছে।”

অন্ধকারের মধ্যেই এরেন গম্ভীর মুখে রনির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,“তুই পারবি মিথিলাকে ছাড়তে?”

রনি চুপ হয়ে গেল। এরেন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,“পারবি না। তো আমাকে স্বান্তনা দিচ্ছিস কোন বিবেকে? অন্যকে স্বান্তনা দেয়ার জন্য যেকোনো কথা বলাটা সহজ, কিন্তু নিজে করাটা অত সহজ না। সারা পৃথিবীর মানুষ বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেও আমি ওকে ছাড়তে পারব না।”

“কোনো উপায় আছে তোর কাছে? একমাত্র পালিয়ে যাওয়া ছাড়া? তা-ও তো তুই করবি না। তোকে আমি ভালো করেই চিনি।”

“সব পথ যখন বন্ধ থাকে তখন স্বয়ং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখাই একমাত্র পথ। হয়তো ম্যাজিকের মতো সব পাল্টেও যেতে পারে। আমি সেই ম্যাজিকের অপেক্ষায় আছি।”

“জীবন এতটাও সহজ না এরেন। কখনও খুব আনন্দদায়ক আবার কখনও খুব নিষ্ঠুর। একটা কথা শোন দোস্ত। এভাবে কষ্ট না পেয়ে ইলোরাকে নিয়ে………….।”

রনির কথা শেষ না হতেই এরেন বলল,“পরিবার থেকে পালিয়ে বেড়ানো আমার দ্বারা সম্ভব না। আমি জানি আমার সব পথ বন্ধ। সবাই আমার বিপরীত দিকে। কিন্তু তবু আমি এটাই বলব আমি না ওকে ছাড়ব, আর না পরিবারকে। এমনকি ওর পরিবার থেকেও ওকে আলাদা করব না।”

“ছাড়বি না তো ধরে রাখবি কীভাবে? শোন ভাই,‌ পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ নিজের ভালোবাসার মানুষকে হারাচ্ছে শুধু পরিবারের জন্য। ভেবে নে তার মধ্যে তুইও একজন।”

এরেন মেকি হেসে বলল,“তুই বুঝবি না।”

রনি ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“তো কী করবি এখন?”

এরেন বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে বলল,“ভেবে দেখব।”

তারপর কিছুক্ষণ দুজনেই নীরব। নীরবতা ভেঙে রনি বলল,“সাকিব তোর ওপর রেগে নেই। কিন্তু খুব অভিমান করেছে। ও খুব কষ্ট পেয়েছে রে। তোরা যদি আগেই ওকে জানাতি তাহলে ও এই বিয়েটা প্রথম দিনই ভেঙে দিত। কিন্তু এখন ও আঙ্কেলের সিদ্ধান্তের ওপর কিছুই করতে পারবে না। ছেলেটা একদিকে বন্ধুর থেকে কষ্ট পেয়েছে, আরেকদিকে নিজের বোনের থেকে। অথচ এই দুজন মানুষই ওর থেকে কোনো কথা লুকায় না।”

এরেন কোনো উত্তর দিলো না। সাকিবের অভিমানটা সেও বুঝতে পারছে। কিন্তু এটা কী করে বুঝাবে যে তাদের সম্পর্কের শুরুটা স্বাভাবিক ছিল না। এমনকি তারা স্বামী-স্ত্রী। প্রায় এক ঘন্টার মতো রনি এরেনের পাশে বসে ওর মন ভালো করার চেষ্টা করল। তারপর এরেনের সাথে ছাদ থেকে নামতেই জারিনের সামনে পড়ল। রনি-জারিন দুজনেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। রনিই স্বাভাবিক হয়ে আগে কথা বলল। মুচকি হেসে বলল,“কেমন আছো জারিন?”

জারিন মুখে হাসি টেনে উত্তর দিলো,“ভালো আছি। আপনি?”

“ভালো। আচ্ছা আজ আসি তাহলে।”

এরেন বলল,“ডিনার করে যা।”

রনি বলল,“বাড়ি ফিরে করব। বাই।”

রনি চলে গেল। জারিনের হঠাৎ বুকটা ভারী হয়ে এল। আগের সময় হলে সে রনিকে ডিনার না করে যেতেই দিত না। কিন্তু আজ সে কিছু বলার শব্দটুকুও খুঁজে পেল না। এরেন ঘুরে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতেই জারিন বলল,“ভাইয়া, ডিনার করবি না।”

“ক্ষুধা নেই।” কথাটা বলেই এরেন রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। জারিন কিছুক্ষণ একই জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল।

এই পর্যন্ত এরেনকে না হলেও একশবার ফোন করেছে ইলোরা। কিন্তু এরেন একবারও ফোন তোলেনি। মেয়েটা কেঁদেকেটে চোখ-মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। এদিকে এরেন রুমে ঢুকে পকেট থেকে ফোন বের করে ইলোরার এত এত কল দেখে কল ব্যাক করল। অন্য সময় হলে ইলোরা ফোন রিসিভ না করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকত। কিন্তু আজকের দিনগুলো সেই দিনগুলোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এরেনের ফোন আসার সাথে সাথে ইলোরা রিসিভ করে কানে ধরে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,“ফোন ধরছিলে না কেন? জানো আমি কত চিন্তায় ছিলাম? কতবার ফোন করেছি আর তোমার এখন কল ব্যাক করার সময় হলো? ছেড়ে দেওয়ার ডিসিশন নিয়েছো না-কি? সেজন্যই ফোন ধরছিলে না?”

এরেন বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে শান্ত স্বরে বলল,“রনি এসেছিল। ওর সাথে কথা বলছিলাম। ফোন সাইলেন্ট ছিল তাই শুনতেও পাইনি। এতবার ফোন করেছ কেন? দু একবার দিলেই হত। আমি তো পরে দেখলে কল ব্যাক করতামই‌।”

“কথার দরকার ছিল।”

ইলোরার কন্ঠ ভালোভাবে শুনতেই এরেন বলে উঠল,“আবার কান্নাকাটি করেছ কেন? তোমার জামাই মরছে না-কি?”

ইলোরা ভার ভার কন্ঠে বলল,“আজেবাজে কথা বলবে না। আমার কথা শোনো।”

“বলো।”

“আম্মু বলেছে কাল না-কি ঐ লোকটার সাথে আমায় দেখা করতে যেতে হবে।”

এরেন বলল,“স্বাভাবিক। বিয়ের আগে একে অপরকে চেনার জন্য লোকটা এটা চাইতেই পারে।”

ইলোরা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,“আমি পারব না যেতে। ঐ লোকটার সাথে আমি কী কথা বলব? আমি না বলে দিয়েছিলাম কিন্তু তাতে উলটো আম্মুর বকা শুনেছি।”

এরেন কিছু একটা ভেবে বলল,“তুমি দেখা করবে।”

ইলোরা অবাক হয়ে বলল,“কী? তুমি আমাকে ঐ লোকটার সাথে দেখা করতে বলছো?”

“হ্যাঁ, করবে। কিন্তু একে অপরকে জানার জন্য না। তুমি লোকটাকে বুঝিয়ে বলবে যে তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো আর বিয়ে করলে তাকেই করবে। বুঝিয়ে বললে আশা করি লোকটা বুঝবে। হবু বউ অন্য একজনকে ভালোবাসে শুনেও নিশ্চয়ই লোকটা চাইবে না তোমাকে বিয়ে করতে।”

ইলোরা ভীতু কন্ঠে বলল,“আমার ভয় লাগছে।”

“ভয় পেলে চলবে না ইলোনি। আমাদের সম্পর্কটা বাঁচিয়ে রাখতে হলে এটুকু তোমাকে করতেই হবে। আর কোনো পথ নেই।”

ইলোরা মিনিট খানেক ভেবে বলল,“ঠিক‌ আছে। কিন্তু তুমিও থাকবে আমার সাথে। মানে একই রেস্টুরেন্টে আলাদা টেবিলে বসবে। তাহলে আমি সাহস পাব। যাবে?”

“হুম আচ্ছা। এটা নিয়ে বেশি চিন্তা কোরো না।”

“তুমি নিজে কি চিন্তামুক্ত আছো?”

এরেন কোনো উত্তর দিলো না। কারণ তার নিজেরই চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। এরেন কথা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল,“খেয়েছ?”

ইলোরা প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করল,“তুমি খেয়েছ?”

“আমার পেট ভরা তাই খাব না।‌ তুমি খাওনি তাই না?”

“আমারও পেট ভরা।”

“মিথ্যা বলবে না। আমি জানি তুমি খাওনি। এক্ষুনি খেয়ে নাও।”

ইলোরা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল,“তুমিও তো মিথ্যা বললে। আচ্ছা? ঐ লোকটা যদি বিয়ে না ভাঙে? কী হবে তাহলে? আমি তো শেষ হয়ে যাব।”

ইলোরা আবার কেঁদে উঠল। এরেন মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিল। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল,“নিজেকে সামলাও ইলোনি। এখন ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে।”

ইলোরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,“কী ভাববে তুমি? কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছ? নেই কোনো উপায়। শোনো না, চলো কোথাও পালিয়ে যাই। তুমি আমাকে এমন কোথাও নিয়ে চলো না যেখানে কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না। প্লিজ, আমি পারব না তোমাকে ছাড়া থাকতে। চলো আমরা…….……….।”

কথাটা সম্পূর্ণ শেষ না করেই ইলোরা হঠাৎ থেমে গেল। সাথে থেমে গেল তার কান্না। দরজার সামনে নবে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মালিহা বেগম। ইলোরা ফোনটা কেটে দিয়ে বিছানায় রেখে নড়েচড়ে বসল। মালিহা বেগম ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বিছানার পাশে দাঁড়ালেন। ইলোরা চোখ মুছে চঞ্চল দৃষ্টি এদিক-ওদিক বিচরণ করতে লাগল। মালিহা বেগম গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করলেন,“ফোন কেটে দিলি কেন? কথা শেষ হয়েছে?”

ইলোরা ছলছল চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকাল। মালিহা বেগমকে এরেন অনেক বুঝিয়েও কোনো ফল পায়নি। ইলোরা জানে তার আম্মু তার জন্য ঠিকই মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু তার করার কিছুই নেই। ইলোরা হঠাৎ বিছানা থেকে নেমে হাঁটু গেড়ে বসে মালিহা বেগমের পা জড়িয়ে ধরল। তারপর শব্দ করে কেঁদে উঠে বলল,“আম্মু, কিছু একটা করো আম্মু। আমি এই বিয়ে করতে পারব না। আব্বুকে একটু বুঝাও না। আমি কোনোদিনও ভালো থাকতে পারব না আম্মু। আব্বুকে একবার বুঝাও, প্লিজ।”

মেয়ের এহেন কান্ডে মালিহা বেগম থমকে গেলেন। শেষে কি না প্রেমিকের জন্য তার মেয়ে পায়ে পড়তেও দ্বিধা বোধ করল না! মালিহা বেগম ইলোরাকে টেনে দাঁড় করিয়ে ধমকে উঠে বললেন,“লজ্জা করে না তোর? সবার আড়ালে ভাইয়ের বন্ধুর সাথে প্রেম করে বেড়িয়েছিস। এখন আবার তার জন্য পায়েও পড়ছিস! এইজন্য তোকে ভার্সিটিতে ভর্তি করেছিলাম? পড়াশোনা বাদ দিয়ে প্রেম করে বেড়িয়েছিস? শোন, বিয়ের পর ওসব ঠুনকো প্রেমের কথা মনে করারও সময় পাবি না দেখিস। ওসব ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নতুন জীবন নিয়ে ভাব। নতুন সংসার নিয়ে ভাব। মেয়েদের জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ভেবে নে এটাও তোর জন্য ত্যাগ। কান্নাকাটি বন্ধ কর। তোর জন্য আমার ছেলেটা মনে কত কষ্ট পেয়েছে জানিস? ছেলেটাকে এমন শুকনো মুখে দেখতে পারছি না আমি। শেষবারের মতো বলছি, চুপচাপ থাক আর বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নে। উলটা-পালটা কিছু মাথায়ও আনিস না। তোর বাপ-ভাইয়ের মান সম্মান ডুবালে তুই জীবনে আর কোনদিনও আমার মুখ দেখতে পারবি না।”

ইলোরার দুচোখ দিয়ে শ্রাবণের ঢল নামছে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করল সে। মালিহা বেগম কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,“তোর বাপ তোদের জন্য কম করেছে? মানুষটা সারাজীবন নিজে খেটে তোদের ভালো রাখার চেষ্টা করেছে। সে কি জেনেশুনে তোকে অতল সাগরে ফেলবে? তোকে ভালো রাখার জন্যই তো তমালের সাথে বিয়ে ঠিক করল। দুদিনের প্রেমিকের জন্য সেই বাপের মান সম্মান খাবি? আর তোর ভাই? ছেলেটা কী না করেছে তোদের জন্য? সেই ছোট্ট থেকে মাথায় করে রেখেছে। আপনজনদের কথা যদি তুই না ভাবতে চাস তাহলে তুই সারাজীবনের জন্য এদের সবার মন থেকে উঠে যাবি। নিজেই ঠিক কর কী করবি।”

মালিহা বেগম চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু মুছে গটগট করে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। মা চলে যাওয়ার পর ইলোরা ধপ করে মেঝেতে বসে পরল। দুহাতে মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। এই মুহূর্তে তার মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। শুধু এইটুকুই বুঝতে পারছে যে, তাকে এখন কাঁদতে হবে। খুব করে কাঁদতে হবে। এই কান্নার সাথে যদি তার সব মনোকষ্টগুলো ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যেত তাহলে কতই না ভালো হত। জীবনটা কত অদ্ভুত! এই তো সেদিন রাতেও সে এরেনের সাথে কথা বলতে গিয়ে নিজের সংসার নিয়ে কতশত স্বপ্ন বুনেছে। এরেনের মুখে কত রোমাঞ্চকর কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কত কিছু ভেবে রেখেছে দুজন। অথচ আজ? আজ সেসব কথা শুধুই কল্পনা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে স্বপ্নগুলো সব এক নিমিষেই ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। মন বলছে, ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে সরে যাচ্ছে সে। এতটাই দূরত্ব যে ফেরার কোনো পথই খোলা নেই। সব পথে একেকটা উঁচু প্রাচীর গড়ে তোলা হয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে সে দাঁড়িয়ে আছে যে না পারছে নিজের পরিবারকে ছাড়তে, আর না পারছে ভালোবাসার মানুষটাকে। আজ তার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কেঁদে বলতে ইচ্ছে করছে,“সে আমার দুদিনের প্রেমিক নয়। সে আমার স্বামী। শুনেছো তোমরা? আমি তার অর্ধাঙ্গিনী। স্বামী থাকতে আমি কী করে অন্য একজনকে গ্রহণ করব? পাপ হবে, পাপ।”

কিন্তু কথাগুলো গলাতেই আটকে রইল। কেউ যেন তার কন্ঠনালিটা চেপে ধরে রেখেছে। কান্না ছাড়া একটা শব্দও বের করার ক্ষমতা পাচ্ছে না। তার ফাঁকা মস্তিষ্কটা হঠাৎ জানান দিলো,“পৃথিবীর মানুষগুলো খুব স্বার্থপর। আপন হোক বা পর। জীবনের কোনো না কোনো মুহূর্তে এসে সবাই নিজের স্বার্থপর স্বভাবটা দেখাবেই দেখাবে।”

চলবে…………………..🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here