#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৪৯
রেস্টুরেন্টের একটা টেবিল দখল করে বসে আছে তমাল, ইলোরা আর ডালিয়া। পাশেই আরেকটা টেবিলে বসে আছে এরেন। দুই টেবিলেই খাবার সাজানো। কিন্তু কেউই কিছু মুখে তুলতে পারছে না। এসে হতে তমাল একাই কথা বলে চলেছে। ইলোরা আর ডালিয়া মাঝে মাঝে প্রয়োজনে দুই একটা কথা বলছে। এখনও সে আসল কথাটা তুলতেই পারছে না। মূলত তার সাহসে কুলাচ্ছে না। এরেন পাশের টেবিল থেকে বারবার ইশারা করছে আসল কথাটা তোলার জন্য। কিন্তু ইলোরা বলতে গেলেই গলায় আটকে যাচ্ছে। গতরাতের মায়ের বলা কথাগুলো মনে পড়ছে। তমাল বারকয়েক খাবার মুখে তুলতে বললেও ইলোরা বা ডালিয়া কেউই তোলেনি। তমাল হেসে বলল,“তোমরা কি কোনো কারণে আপসেট? মানে, এসে হতে তেমন কথাও বলছো না আর খাচ্ছও না।”
ডালিয়া বলল,“না ভাইয়া, তেমন কিছু না।”
তমাল ইলোরার দিকে তাকিয়ে বলল,“আমি তো অনেক কথাই বললাম। তোমার কিছু বলার নেই?”
ইলোরা ভাবল এটাই সুযোগ। এখনই কথাটা তোলার সময়। ডালিয়াও টেবিলের নিচ দিয়ে ইলোরাকে খোঁচা মারল। অর্থাৎ সেও কথাটা তুলতে বলছে। ইলোরা কিছুটা নড়েচড়ে বসে গলা ঝেড়ে বলল,“হ্যাঁ, আমার খুব জরুরী একটা কথা বলার আছে।”
তমাল বেশ খুশি হলো। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,“বলো। কোনো হেজিটেড কোরো না প্লিজ।”
ইলোরা একটা শুকনো ঢোক গিলে আড়চোখে পাশের টেবিলের দিকে তাকাল। এরেন খাবার নাড়াচাড়া করলেও দৃষ্টি তাদের দিকেই। সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন ইলোরা কথাটা বলবে। ইলোরা মিনিট খানেক চুপ থেকে নিজেকে সামলে মৃদু কন্ঠে বলল,“আমি আসলে….।”
কথাটা বলতে গিয়েও ইলোরার গলায় আটকে গেল। তমাল বলল,“তুমি কী? বলো।”
ইলোরা বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে বলেই ফেলল,“আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। তার সাথে আমার রিলেশন চলছে।”
তমালের মুখ দেখে মনে হলো না সে থমকেছে। তবে কিছুটা হলেও মন খারাপ হয়েছে। ইলোরা আড়চোখে তমালের দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব বুঝার চেষ্টা করল। তমাল মিনিট দুয়েক চুপ থেকে স্বাভাবিকভাবেই বলল,“বিয়ের আগে অন্য কারো সাথে রিলেশনে থাকাটা খুব একটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার না। তা আমারও ছিল। কিন্তু তাই বলে তো আর জীবন থেমে থাকে না। বিয়ের পর সবই ঠিক হয়ে যায়।”
ডালিয়া নিচু স্বরে বলল,“আপনি যেমনটা ভাবছেন তেমনটা না ভাইয়া। ও আসলে যাকে পছন্দ করে তাকে ছেড়ে আপনাকে বিয়ে করতে চাইছে না।”
তমাল ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বলল,“তাহলে বিয়েতে রাজি হলো কেন?”
“কেউ ওর মতামত জানতে চায়নি। ফুপা আর ভাইয়ের ওপরে ওর কথা বলার সাহসও হয়নি।”
“এটা কেমন কথা? তো এখন কেন জানাচ্ছে না?”
“সবাই জেনে গেছে। কিন্তু তবু কেউ বিয়েটা ভাঙতে চাইছে না।”
তমালের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সে ইলোরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,“তাহলে আমাকে এখন এসব কথা বলছো কেন?”
ইলোরা আমতা-আমতা করে বলল,“আপনি যদি সবাইকে বলেন আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি, তাহলে হয়তো বিয়েটা আটকানো সম্ভব।”
তমাল মৃদু হেসে বলল,“জীবনে প্রথম দেখলাম হবু বউ এসে বরকে বিয়ে ভাঙার কথা বলছে। যাই হোক, তোমার কথাটা কোনো কাজে আসবে না। কারণ আমি অলরেডি জানিয়ে দিয়েছি তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।”
ইলোরার মুখটা চুপসে গেল। ডালিয়া বলল,“তখন তো আর আপনি ওর সাথে সরাসরি কথা বলেননি। আজ বলবেন যে ওর সাথে কথা বলার পর ওকে আপনার একদম ভালো লাগেনি। তাহলে হয়তো সবাই বিশ্বাস করবে। আপনার পরিবার থেকে না বলে দিলে ফুপা আর এগোতে পারবে না।”
তমাল বলল,“দেখো মিস, আঙ্কেল সবকিছু জেনেও যেহেতু বিয়েটা ভাঙতে চাইছে না তখন নিশ্চয়ই ঐ ছেলেকে তার পছন্দ নয়। কিংবা অন্য কোনো কারণ অবশ্যই আছে। আর ইতোমধ্যেই আমি আমার বোনকে মেসেজ করে দিয়েছি যে ইলোরার সাথে কথা বলে আমার ওকে ভালো লেগেছে। তাই তোমাদের এই প্ল্যানটাও ফ্লপ হলো।”
ডালিয়া হতাশ দৃষ্টিতে ইলোরার দিকে তাকাল। ইলোরা অনুরোধের সুরে বলল,“আপনি কিছু একটা বলে বিয়েটা আটকান প্লিজ। আমি আপনার সাথে ভালো থাকতে পারব না। শুধু শুধু তিন তিনটা জীবন নষ্ট হবে। আপনি কি চান না আপনার স্ত্রীকে নিয়ে ভালো থাকতে?”
তমাল হেসে বলল,“তোমার বয়ফ্রেন্ড কিছু করছে না কেন?”
ইলোরা মুখ ফুলিয়ে জবাব দিলো,“করেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। আপনার কাছে রিকোয়েস্ট করছি, প্লিজ এই বিয়েটা আটকান। আমার কাছে অন্য কোনো অপশন ছিল না তাই আপনার কাছে রিকোয়েস্ট করছি।”
“সরি টু সে, তোমাদের কাছে যেমন অন্য কোনো অপশন নেই, আমার কাছেও তেমন অন্য কোনো অপশন নেই।”
তমালের কথায় ইলোরা আর ডালিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ইলোরা মৃদু কন্ঠে বলল,“মানে?”
“মানে, আমার পুরো পরিবার চাইছে এই বিয়েটা হোক। ইভেন তারা অনেক খুশি এটা নিয়ে। বিয়েটা ভেঙে আমি তাদের খুশিটা কেড়ে নিতে পারব না। তাছাড়া আমি বাবাকে কথা দিয়েছি যে খুশিমনে বিয়েটা করব।”
ইলোরা আড়চোখে এরেনের দিকে তাকাল। এরেনও কপাল কুঁচকে তমালের দিকে তাকিয়ে আছে। ইলোরা বলল,“আর আমার খুশি? আমি তো খুশি না এই বিয়েটা নিয়ে।”
তমাল একইভাবে বলল,“এসব তেমন কোনো বিষয় না। তোমার মতো এমন কতশত মেয়ে বিয়েতে খুশি থাকে না। কিন্তু পরে সবই ঠিক হয়ে যায়।”
ডালিয়া খানিক শক্ত মুখে বলল,“আপনি তখন থেকে শুধু বলছেন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি এত শিওর হচ্ছেন কীভাবে? পরে তো আরও ঝামেলা হতে পারে। তখন?”
তমাল ডালিয়ার কথাটাকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে নড়েচড়ে বসে বলল,“তোমরা কিন্তু কিছুই খেলে না। খাবার সামনে রেখেই এতটা সময় পার করলে। এদিকে আমার ফেরার সময়ও হয়ে গেছে। ইম্পর্ট্যান্ট একটা কাজ আছে তাই আর দেরি করতে পারব না। তোমরা খাও প্লিজ। আমি তোমাদের পৌঁছে দিয়ে চলে যাব।”
ইলোরা আর ডালিয়া বিস্ময় নিয়ে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। পাশের টেবিল থেকে এরেনও সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইলোরা বলল,“আমাদের কথা তো এখনও শেষ হয়নি।”
তমাল বলল,“আমার শেষ হয়ে গেছে। তোমাদের পৌঁছে দিতে হবে, না-কি নিজেরাই চলে যাবে?”
ডালিয়া বলল,“আমরা নিজেরা এসেছি, নিজেরাই যেতেও পারব। আপনি প্লিজ কিছু বলুন। না বলবেন তো?”
তমাল টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল,“বিয়েটা যেদিন হওয়ার কথা ঐ দিনই হবে মিস। আসছি, আল্লাহ্ হাফেজ।”
তমাল আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াল না। লম্বা লম্বা পা ফেলে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। ইলোরা, ডালিয়া আর এরেন হা করে লোকটার চলে যাওয়া দেখল। সবার বিস্ময় আকাশচুম্বী। এত কথা বলার পরও লোকটা বিয়ে ভাঙবে না! এই লোকের জায়গায় অন্য কেউ হলে তো কথাগুলো শুনতে দেরি হলেও বিয়ে ভাঙতে দেরি হত না। এরেন নিজের টেবিল ছেড়ে উঠে এসে ইলোরাদের টেবিলে বসে পড়ল। ইলোরা অসহায় মুখে এরেনের দিকে তাকাল। এরেন বিরক্তি নিয়ে বলল,“এ তো দেখি উন্নতমানের ঘাড়ত্যাড়া। পুরো হাইব্রিড জাতের ঘাড়ত্যাড়া। বিয়ের পর যদি শোনে বউ পরকিয়া করছে, তাতেও বোধ হয় এর কিছু যাবে আসবে না। ইডিয়ট!”
ডালিয়া ফিক করে হেসে উঠে বলল,“মানুষ আবার হাইব্রিড জাতের ঘাড়ত্যাড়া হয় কীভাবে ভাইয়া?”
ইলোরা সজোরে এক থাপ্পড় বসাল ডালিয়ার বাহুতে। মুখ ফুলিয়ে বলল,“আমি চিন্তায় মরছি আর তুই হাসছিস?”
ডালিয়া এক আঙুল দিয়ে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল। এরেন মুখ দিয়ে ফুস করে একটা বিরক্তিকর শব্দ করে বলল,“এই ছেলেকে দিয়েও কিচ্ছু হবে না। ধুর! কেউ তো দেখছি কোনো ওয়ে-ই রাখছে না।”
ইলোরা মুখ কালো করে বলল,“কী করব আমরা এখন?”
এরেন কপালে এক আঙুল ঘঁষে বলল,“সাকিব ছাড়া আর কোনো অপশন দেখছি না।”
ইলোরা চিন্তিত কন্ঠে বলল,“কিন্তু ভাই তো তোমার সাথে দেখাও করছে না, ফোনও ধরছে না। ঐ দিনের পর থেকে আমার সাথেও কথা বলছে না। তাহলে?”
“কাল ভার্সিটিতে গেলে তো দেখা হবেই। তখন কথা বলব। দেখি কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে।”
ডালিয়া বলল,“ভাইয়ের তো এখন আর কিছুই করার নেই। ফুপার ওপরে সে আর কী বলবে? আমার মনে হয় এতেও লাভ হবে না।”
এরেন বলল,“বুঝতে পারছি ডালিয়া। কিন্তু তবু শেষ চেষ্টাটা করতে হবে। আমি জানি সাকিব চায় ওর বোন ভালো থাকুক। অভিমান করে আছে বলে চুপ আছে।”
ইলোরা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,“যা-ই হোক, আমি কিন্তু বিয়ে করব না।”
এরেন বলল,“এখানেও ইমোশনাল হয়ে পড়ো না প্লিজ। বলছি তো আমি সামলে নেব।”
তিনজন বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এল। কারোরই কিছু খাওয়া হলো না। এরেন একটা টেক্সি ডেকে ইলোরা আর ডালিয়াকে নিয়ে উঠে বসল। ইলোরাদের বাড়ির থেকে কিছুদূর টেক্সি থামিয়ে ইলোরা আর ডালিয়া নেমে পড়ল। এরেনের থেকে বিদায় নিয়ে শুকনো মুখে তারা বাড়ির দিকে রওনা দিলো। এরেনও দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেক্সি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
•
সন্ধ্যা আটটার মধ্যেই খবর এল বিয়ের তারিখ এগিয়ে দুদিন পরে দেয়া হয়েছে। তমালের বাবা না-কি সাজিদ হোসেনের সাথে কথা বলে এই সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। ডালিয়ার মুখে খবরটা শুনে ইলোরা চোখে অন্ধকার দেখল। সঙ্গে সঙ্গে কিছু না ভেবেই সে ছুটে গেল সাকিবের রুমে। সাকিব তখন বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল। অনন্যা তার পাশেই দাঁড়ানো ছিল। ইলোরা রুমের দরজায় এসে দাঁড়াতেই অনন্যার চোখে পড়ে গেল। অনন্যা হাসিমুখে বলল,“ইলো, কিছু বলবি? ভেতরে আয়।”
ইলোরা একবার সাকিবের দিকে তাকাল। সাকিব তার উপস্থিতি টের পেয়েও একবার ফিরে তাকাল না। ইলোরা এক’পা দু’পা করে ভেতরে ঢুকল। সাকিবের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ঢোক গিলে ডাকল,“ভাই।”
সাকিব সঙ্গে সঙ্গে তাড়া দেখিয়ে বলল,“অনু, আমার ওয়ালেট কোথায়?”
অনন্যা এগিয়ে গিয়ে সাকিবের ওয়ালেট বের করে হাতে দিলো। সাকিব ওয়ালেটটা হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল। ইলোরা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে সাকিবের পথ রোধ করে দাঁড়াল। ধরা গলায় বলল,“ভাই প্লিজ, এভাবে মুখ ঘুরিয়ে থেকো না আর। তোমার সাথে আমার কথা….।”
এটুকু বলতেই ইলোরার হাতের মুঠোয় ফোনটা স্বশব্দে বেজে উঠল। ইলোরা সাকিবের থেকে চোখ সরিয়ে ফোনটার দিকে তাকাল। সাকিবও ফোনের দিকে তাকাতেই স্ক্রিনে এরেনের নামটা স্পষ্ট চোখে পড়ল। ইলোরা দ্রুত ফোনটা কেটে দিয়ে পুনরায় সাকিবের দিকে তাকাতেই সাকিব অনন্যার দিকে তাকিয়ে বলল,“অনু, আম্মুকে বলো তার মেয়ের ফোনটা বিয়ে অবধি নিজের কাছে আমানত রাখতে।”
কথাটা বলেই সাকিব দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল। ইলোরা কয়েকবার পিছু ডাকলেও সে পিছু ফিরে তাকাল না। ইলোরার বুকটা ভার হয়ে এল। ছোটো বেলা থেকে যে ভাইয়ের ছায়ায় সে বড়ো হয়েছে, আজ তার মুখ ফিরিয়ে নেয়াটা সে সহ্য করতে পারছে না। তার ভাইটা তাকে ঠিক কতটা ভালবাসে সে ব্যাপারে সে অবগত। এটুকুতেই যে এতটা কষ্ট পেয়েছে, বিয়ের কথা শুনলে তার কী অবস্থা হবে ভেবেই ইলোরা ভয়ে বিয়ের কথা তুলতে পারছে না। তার ভয়ের কাছে হার মেনে এরেনও মুখ খুলতে পারছে না। কারণ সে চায় না ইলোরাকে তার পরিবার ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিক, বা তার পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হোক। ইলোরা দুচোখের পানি ছেড়ে দিলো। অনন্যা এগিয়ে এসে ইলোরার কাঁধে হাত রেখে বলল,“মানুষটা খুব কষ্ট পেয়েছে রে ইলো। ও নিজেও চাইছে না তোর অমতে অন্য কারো সাথে তোর বিয়ে হোক। কিন্তু ফুপার ওপরে কথাও বলতে পারছে না। আর বলবেই বা কী? তুই আর এরেন ভাইয়া সত্যিই কাজটা ঠিক করিসনি। এভাবে লুকিয়ে-চুরিয়ে রিলেশনের কোনো প্রয়োজন ছিল না। বরং সবাই ব্যপারটা জানলে আজ এই সিচুয়েশন তৈরি হত না। যাই হোক, বিয়েটা যখন ঠিক হয়েই গেছে তখন আর কান্নাকাটি করিস না বোন। জানি কষ্ট হবে তবু বলছি, এরেন ভাইয়াকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর। যার সাথে নতুন জীবন শুরু করতে চলেছিস তাকে নিয়ে ভাব।”
ইলোরা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে এক ছুটে সেখান থেকে নিজের রুমে চলে এল। বিছানায় পড়ে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ডালিয়া আর মিথিলা পড়ার টেবিলে বসে ছিল। ইলোরার কান্ড দেখে তারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ডালিয়া এগিয়ে গিয়ে ইলোরাকে বুঝানোর চেষ্টা করল। আর মিথিলা ছুটে গিয়ে মায়ের কাছে বলল যে ইলোরা খুব কাঁদছে। ইতোমধ্যে অনন্যা এসে আলিয়া বেগমকে বলেও গেছে সাকিব ইলোরার ফোন সরিয়ে নিতে বলেছে। আলিয়া বেগম মিথিলাকে নিয়ে ইলোরার রুমে এলেন। মিথিলা ভেবেছিল তার মা হয়তো বোনের কান্না থামাতে পারবে। কিন্তু পরবর্তীতে মায়ের কান্ড দেখে বেচারি নিজেকেই নিজে বকতে লাগল। কারণ আলিয়া বেগম রুমে ঢুকেই ইলোরার ফোনটা নিজের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছেন। ইলোরা মাকে দেখে উঠে বসে গতরাতের মতো আবার সেই একই অনুরোধ করতে লাগল। বিয়েটা সে করতে পারবে না বলার সাথে সাথে এবার মালিহা বেগম সজোরে এক থাপ্পড় বসালেন ইলোরার গালে। সঙ্গে সঙ্গে ইলোরা থম মেরে গেল। কারণ জ্ঞান হওয়ার পর এই প্রথম তার মা তার গায়ে হাত তুলছেন। মিথিলা আর ডালিয়াও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মালিহা বেগম ছলছল চোখে ধরা গলায় বললেন,“বাপের নাম ডুবাবি নির্লজ্জ মেয়ে? খুব পেকে গেছিস তাই না? প্রেমিক জুটিয়ে তার জন্য আবার পাগলামিও শুরু করে দিয়েছিস? খবরদার বলছি, আমার সংসারে কোনো অশান্তি সৃষ্টি করবি না। প্রেমিকের জন্য পাগল হলে এই বাড়ি ছেড়ে এক কাপড়ে চলে যাবি। কোনোদিন এই বাড়ির বা এই পরিবারের কারো ছায়াও মাড়াবি না। আর যদি তা না পারিস তাহলে নিজের বাপের সম্মান বাঁচিয়ে রাখবি। আমি চাই না তোর এইসব পাগলামির খবর তোর বাপের কানে যাক।”
ইলোরা চাপা স্বরে কাঁদছে। মিথিলা আর ডালিয়ার চোখের কোণেও পানি জমে গেছে। মালিহা বেগম আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে প্রস্থান করলেন। ডালিয়া বা মিথিলা ইলোরাকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না। তারা করুণ চোখে তাকিয়ে বসে বসে ইলোরার কান্না দেখে গেল। মালিহা বেগম ইলোরার ফোনটা নিয়েই সুইচ অফ করে দিয়েছেন তাই এরেন বারবার ফোন করেও ব্যর্থ হলো। শেষে সে ডালিয়ার ফোনে কল করল। ডালিয়া ফোন রিসিভ করতেই এরেন প্রশ্ন করল,“ইলোরা কোথায়? ওর ফোন বন্ধ কেন এতক্ষণ ধরে?”
ডালিয়া একবার বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ইলোরার দিকে তাকাল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এরেনকে সবটা খুলে বলল। বিয়ের তারিখ দুদিন পর দেয়া হয়েছে শুনেই এরেন চমকে উঠল। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে সে ডালিয়াকে বলল ইলোরার হাতে ফোনটা দিতে। ডালিয়া এগিয়ে গিয়ে ইলোরার গায়ে হাত দিয়ে ডেকে বলল,“ইলো, ভাইয়া ফোন করেছে। তোর সাথে কথা বলতে চাইছে।”
কথাটা কান অবধি পৌঁছুতেই ইলোরা হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসল। ডালিয়া ইলোরার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে মিথিলাকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মিথিলা এর আগে বোনের কান্না দেখলেও এমন পাগলামি আজই প্রথম দেখল। সে বেশ অবাকই হয়েছে তবু ডালিয়ার কথায় চুপ রইল। ইলোরা ফোন কানে ধরলেও কান্নার তোড়ে কিছুই বলতে পারছে না। প্রেয়সীর বাঁধ ভাঙা কান্নার শব্দে এরেনের বুকটা বারবার কেঁপে উঠছে। তবু সে ইলোরাকে থামানোর চেষ্টা করল। নানান সান্ত্বনার বাণী শুনিয়েও যখন ব্যর্থ হলো তখন আর কিছু না ভেবেই রিক্সা নিয়ে ছুটে এল ইলোরাদের বাড়ির পেছনের রাস্তায়। আকাশে তখন মেঘের আনাগোনা। বৃষ্টি হবে নিশ্চিত। তবু সে তা তোয়াক্কা করল না। খবর পেয়েই ইলোরাও ছুটে গেল বেলকনিতে। প্রিয় মানুষটার মুখ দেখে কান্নার গতিটা আরও একগুণ বেড়ে গেল। চোখের সামনে প্রেয়সীর কান্নাভেজা মুখটা দেখে এরেনের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। বুকের বাঁ পাশটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল। দুজনেই ফোন কানে ধরে রেখেছে, কিন্তু কেউই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। তখনই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টিও না, একেবারে মুষলধারে বৃষ্টি! এরেন তবু ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে ইলোরার হুঁশ ফিরল। সে নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে এরেনের মুখের দিকে তাকিয়ে কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,“এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছো কেন? ঠান্ডা লেগে জ্বর এসে যাবে। বাসায় ফিরে যাও।”
এরেন বলল,“তোমার চকলেট নিবে না?”
ইলোরা চুপ করে রইল। এরেন প্যান্টের পকেট থেকে দুইটা ক্যাডবেরি চকলেট বের করে কয়েক পা এগিয়ে এসে ওপরের দিকে ছুঁড়ে মারল। ক্যাডবেরি দুটো এসে পড়ল ইলোরার বাঁ পাশে। সে নিচু হয়ে সেগুলো হাতে তুলে নিল। এরেন হঠাৎ মৃদু স্বরে ডেকে উঠল,“ইলোনি?”
ইলোরা কেঁপে উঠল। এই ডাকটাই তাকে সম্পূর্ণ দুর্বল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। ইলোরার সাড়া না পেয়ে এরেন আবার বলল,“মনে আছে আমরা যেদিন অনন্যা ভাবির বিয়েতে গিয়েছিলাম, সেদিন বাসে তুমি আমাকে প্রথমবার ‘ভালোবাসি’ বলেছিলে?”
ইলোরা এবারও কোনো উত্তর দিলো না। এরেন নিজেই আবার বলল,“সেদিন তো আমার বুকে মুখ লুকিয়ে বলেছিলে। আজ একবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলবে?”
ইলোরার বুকটা ধক করে উঠল। বুক ফেটে কান্না এল আবার। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। শরীরটা কাঁপুনি দিয়ে উঠল। এরেন ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল,“বলবে না? আমি কিন্তু ভেবে রেখেছিলাম আমাদের বাসরের দিন আমি তোমাকে এই কথাটা বলে তোমার ইচ্ছে পূরণ করব। আজ না বললে কিন্তু তোমার ইচ্ছে আর পূরণ হবে না।”
ইলোরা আবার পূর্বের ন্যায় ফুঁপিয়ে উঠে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,“খুব ভালোবাসি। আমাকে নিয়ে যাও না তোমার কাছে। আমি এভাবে কষ্ট পেতে পারছি না আর। সবাই বলছে পরশু গায়ে হলুদ আর তার পরদিনই বিয়ে। মাঝখানে শুধু কালকের দিনটাই বাকি। কালকের মধ্যে তুমি আমাকে নিয়ে না গেলে আমি সবাইকে বলে দেবো আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আর তাতে যদি আমাকে সবাই ভুল বুঝে বুঝুক। সবাই কষ্ট পেলে পাক। তোমার থেকে ছাড়াতে চাইলেও আমি তা পারব না। আমার বাবার বাড়ি বা স্বামীর বাড়িতেও যদি আমার জায়গা না হয়, তাহলে সবাইকে মুক্তি দিয়ে পৃথিবী ছাড়ব।”
সঙ্গে সঙ্গে এরেন ধমকের সুরে বলল,“কষিয়ে এক থাপ্পড় মারব গাধা মেয়ে। আমি কি মরে গেছি? কালকের মধ্যেই আমি যা করার করব। প্রমিস। অনেক কান্নাকাটি হয়েছে। এবার থামো।”
ইলোরা নাক টেনে বলল,“আজ আম্মু আমাকে মেরেছে।”
এরেন এই কথাটা ডালিয়ার মুখেই শুনেছে। কিন্তু এবার ইলোরার মুখে শুনে কেন জানি তার প্রচন্ড রাগ উঠে গেল। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে সে আদুরে গলায় বলল,“ইলোনি, আর কাঁদবে না। ওকে? এখন চুপচাপ গিয়ে ডিনার করে শুয়ে পড়বে। ডিনার না করলে কিন্তু কাল পানিশমেন্ট পেতে হবে।”
ইলোরা বলল,“অনেক ভিজে গেছ তুমি। এখন বাসায় যাও প্লিজ।”
এরেন মৃদু হেসে বলল,“একটু হাসবে না?”
ইলোরা কান্নার মাঝেই জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল। এরেন হাসিমুখেই বলল,“আল্লাহ্ হাফেজ।”
ইলোরা মাথা দোলালো। এরেন কান থেকে ফোন নামিয়ে কেটে দিলো। তারপর আরেক পলক প্রেয়সীর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উল্টো পথে হাঁটা দিলো। যতক্ষণ পর্যন্ত এরেনকে দেখা গেল ততক্ষণ ইলোরা একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল। এরেন দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতেই তার বুক চিরে বেরিয়ে এল এক তপ্ত দীর্ঘশ্বাস। এই মুহূর্তে তার ইচ্ছে করছে এই ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে। বৃষ্টির পানির সাথে নিজের সব কষ্টগুলো ধুয়ে-মুছে ফেলতে। বৃষ্টির শব্দগুলো যেন তার কানের কাছে বিচ্ছেদের গান গাইছে। একেকটা বজ্রপাত জানান দিচ্ছে, বিচ্ছেদ অতি নিকটে। সত্যিই কি তবে তাই হবে?
চলবে…………………..🌸
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আর যারা গল্প পড়বেন, তারা অবশ্যই রেসপন্স করবেন প্লিজ।)