সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্বঃ৫২

0
999

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৫১

কপালে কারো নরম হাতের স্পর্শে ঘুম ছুটে গেল এরেনের। পিটপিট করে চোখ খুলতে গিয়েও পারল না। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। চোখ-মুখ খিঁচে বন্ধ করে সে কপালে হাত রাখল। কিন্তু হাতটা কপাল না ছুঁয়ে কারো হাতের ওপর পড়ল। এরেন কপাল কুঁচকে তার হাতের নিচে অনুভব করা হাতটা মুঠোয় নিয়ে নিল। তারপর হাতটা চোখের সামনে নিয়ে এসে আস্তে আস্তে চোখ খুলল। নিজের হাতের মুঠোয় কাঁচের চুড়ি ভর্তি একটা ফর্সা হাত দেখে তার হৃদপিন্ডটা ধুক করে উঠল। এরেন আলতো করে মুঠোয় আবদ্ধ হাতটার আঙুল ছুঁয়ে দিলো। সেই হাত, সেই আঙুল। এরেন অস্পষ্ট দৃষ্টিতে সামনে তাকাল। অতিপরিচিত একটা মলিন চেহারায় তার চোখ আটকে গেল। শাড়ি পরিহিতা এক আবেদনময়ী রমণী। প্রেয়সীকে এই সাজে দেখার সাধ তার বহুদিনের। আজ যেন কত যুগ পর তার সাধ পূরণ হলো। সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল। এরেন পূর্ণ দৃষ্টিতে অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়ার দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইল। ঐ চোখের ভাষা তার বুঝতে অসুবিধা হলো না। ঐ চোখ জোড়া যে তাকে দেখেই তৃপ্তির স্বাদ নিচ্ছে। এরেন হঠাৎ করেই হাতটা ছেড়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ইলোরা ব্যস্ত হয়ে এরেনের কাছে সরে এসে তার ডান হাতটা নিজের মুঠোয় আবদ্ধ করল। ভেজা কন্ঠে বলল,“শুধু ঠান্ডা লেগেছে তোমার তাই না? একরাতে নিজের এই অবস্থা করে বসে আছো? সকালে বললে না কেন আমাকে?”

এরেন না ইলোরার দিকে ফিরে তাকাল আর না মুখ খুলল। ইলোরা ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বলল,“কথা বলছো না কেন? তাকাও আমার দিকে।”

এরেন তবু চুপ। ইলোরা এরেনের গালে হাত রেখে তার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,“কী গো? রাগ করেছ আমার সাথে? কিন্তু কেন?”

এরেন কপাল কুঁচকে তাকাল। তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে নিল। ইলোরা মুখ কালো করে কিছু বলতে যেতেই দরজায় টোকা পড়ল। দরজার বাইরে থেকে জারিন বলল,“ভাবি, আসব?”

ইলোরা এরেনের থেকে কিছুটা সরে বসে বলল,“আসো আপু।”

জারিন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। তার হাতে ট্রে ভর্তি খাবার। জারিন মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে বেড সাইড টেবিলে ট্রেটা রাখতে রাখতে ইলোরাকে বলল,“দুজনের জন্যই নিয়ে এলাম। তুমিও যে খাওনি তা খুব ভালো করেই জানি।”

জারিন এবার এরেনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,“হাই ব্রাদার। কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? বউ এনে একদম সাজিয়ে গুছিয়ে সামনে দাঁড় করিয়েছি। এমন একটা দারুণ সারপ্রাইজের জন্য তো আমি কিছু পাওনা তাই না?”

এরেন ভাঙা গলায় বলল,“সরি সিস্টার, আমার কাছে দুই টাকার কয়েন নেই। তাই ভিক্ষাটা দেয়া হলো না।”

ইলোরা বাঁকা চোখে এরেনের দিকে তাকাল। তার সাথে কথা বলল না, অথচ এখন তো ঠিকই জারিনের সাথে কথা বলছে। জারিন গাল ফুলিয়ে ইলোরাকে টেনে বিছানা থেকে নামাতে নামাতে বলল,“চলো তো ভাবি। ওর সারপ্রাইজের দরকার নেই। তোমাকে বরং বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে আসি। ও বুঝুক আমাকে ঠকানোর মজা।”

এরেন চাদরটা টেনে নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলে বলল,“আমি এত সহজে গলে যাওয়ার পাত্র নই।”

জারিন হতাশ হয়ে ইলোরার দিকে তাকাল। ইলোরা গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জারিন এগিয়ে গিয়ে এরেনের চাদরটা টেনে সরিয়ে দিয়ে বলল,“এই ওঠ তাড়াতাড়ি। ফ্রেশ হয়ে আয়। বউ এনে সামনে রেখে গেছি আর সে ঢং দেখাচ্ছে। ওঠ বলছি।”

এরেন ধমকের সুরে বলল,“বিরক্ত করছিস কেন? যা ভাগ এখান থেকে।”

জারিন এরেনের হাত ধরে টেনে উঠিয়ে বসিয়ে দিয়ে বলল,“গায়ে এক বালতি পানি ঢেলে ঢং ছুটিয়ে দিব। যা ফ্রেশ হয়ে আয়।”

জারিনের ঠেলেঠেলিতে এরেন বিরক্ত মুখে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল। সাথে সাথে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। সে মাথা চেপে ধরতেই ইলোরা দ্রুত এগিয়ে এসে তার হাত চেপে ধরে বলল,“চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

এরেন কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। জারিন ঠোঁট টিপে হেসে বলল,“আমার কাজ আছে, আমি যাই। ভাবি, কিছু দরকার পড়লে আমাকে ডেকো। আর নিশ্চিন্ত থাক, তোমাদের কেউ ডিস্টার্ব করবে না।”

ইলোরা লাজুক হেসে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। জারিন হাসিমুখে দরজা বন্ধ করে চলে গেল। ইলোরা এরেনকে ধরে ধরে ওয়াশরুম পর্যন্ত নিয়ে গেল। এরেন ওয়াশরুমে ঢুকে ইলোরার দিকে না তাকিয়েই দরজা বন্ধ করে দিলো। ইলোরা চুপচাপ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর এরেন দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই ইলোরা দ্রুত তার হাত ধরল। এরেন এবারও নিশ্চুপ। ইলোরা এরেনকে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে খাবারের ট্রে নিয়ে নিজেও বিছানায় উঠে বসল। এরেন ততক্ষণে বালিশে হেলান দিয়ে বসেছে। ইলোরা তার মুখোমুখি বসে খাবার তুলে মুখের কাছে ধরল। এরেন মুখ খুলল না। ইলোরা মুখ গোমড়া করে বলল,“খাবারের ওপরও রাগ করবে?”

এরেন চোখ দুটো সরু করে বলল,“নিজে না খেয়ে অন্যের প্রতি দরদ দেখাতে হবে না।”

এতক্ষণে এরেন মুখ খোলায় ইলোরা খুশি হলেও বিস্ময় নিয়ে বলল,“এভাবে কথা বলছো কেন?”

এরেন আবার নিশ্চুপ। ইলোরা বেশ বুঝতে পারল সে না খেলে এরেন খাবার মুখেও তুলবে না। সে ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মুখে খাবার তুলল। তারপর আবার এরেনের মুখের কাছে ধরল। এবার এরেন বিনা বাক্যে খাবারটুকু মুখে পুরে নিল। ইলোরা মৃদু হাসল। এরেনকে খাওয়াতে খাওয়াতে সে নিজেও খেয়ে নিল। পুরোটা সময় ইলোরা এরেনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও এরেন একদম নিশ্চুপভাবে খাওয়া শেষ করল। ইলোরা এরেনকে ঔষধও খাইয়ে দিলো। খাবারের ট্রেটা বেড সাইড টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসতেই দেখল এরেন গায়ে চাদর টেনে সটান শুয়ে পড়েছে। ইলোরা ভ্রুকুটি করে বলল,“শুয়ে পড়ছো যে?”

এরেন ততক্ষণে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। ইলোরা এরেনের গায়ে হাত রেখে বলল,“শরীর খারাপ লাগছে?”

এরেনের নীরবতা ইলোরার মনে আঘাত হেনে গেল। সে এরেনের গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ঠোঁট উলটে বলল,“শুনছো? কথা বলবে না তুমি? কতক্ষণ এমন করে থাকবে?”

এবারও ইলোরা হতাশ হলো। বারকয়েক ধাক্কাধাক্কি করার পরও যখন এরেনের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখল না তখন ইলোরা হুট করেই অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ করে বসল। এরেনকে অবাক করে দিয়ে সেও এরেনের চাদরের নিচে ঢুকে তার পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। ইলোরার এমন কান্ডে এরেন চোখ খুলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ইলোরা গাল ফুলিয়ে বলল,“আমার হাসবেন্ডের পাশে শোয়ার অধিকার আছে আমার। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে না থেকে মুখ খোলো।”

এরেন আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। ইলোরা এক আঙুল দিয়ে এরেনকে গুঁতো মেরে বলল,“এই, শুনছো? শোনো না।”

এরেন নড়চড় না করায় ইলোরা ভাবতে লাগল কী করা যায়। মিনিট খানেক চুপ থেকে সে হঠাৎ এরেনের বুকে মাথা রেখে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। এরেন এবার একটু বেশিই অবাক হলো। মেয়েটা আজ একটুও লজ্জা পাচ্ছে না? না-কি রাগ ভাঙানোর জন্য লাজুক স্বভাবটা দূরে সরিয়ে রেখেছে? এরেন চোখ খুলে তাকাল। সে একটু নড়েচড়ে উঠতেই ইলোরা মাথা তুলে এরেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,“আমার হাসবেন্ডের বুকে মাথা রেখে শোয়ার অধিকার আছে আমার।”

এরেন ভ্রুকুটি করল। ইলোরা ঠোঁট উলটে বলল,“কথা বলো না প্লিজ। ভালো লাগছে না তো আমার। আচ্ছা, এটা অন্তত বলো যে কী করেছি আমি? এমন শাস্তি কেন দিচ্ছ আমাকে?”

এরেনের চোখ-মুখ হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল। সে ইলোরাকে নিজের বুকের ওপর থেকে সরিয়ে বিছানার সাথে চেপে ধরল। হঠাৎ এরেনের এহেন কান্ডে ইলোরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এরেনের রাগত চেহারার দিকে তাকিয়ে সে একটা শুকনো ঢোক গিলল। এরেন ইলোরার মুখের ওপর ঝুঁকে এসে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,“তোমার তো এতক্ষণে মরে যাওয়ার কথা ছিল তাই না? তো তুমি এখানে কী করছো? না-কি মরার আগে শেষ দেখা দেখতে এসেছ?”

এতক্ষণে ইলোরা বুঝতে পারল এরেনের রাগের কারণ। সকালের রাগ সে এখনও মনে পুষে রেখেছে। ইলোরা মৃদু হেসে বলল,“উঁহু। তুমি বলেছিলে না তোমার সামনে এসে মরতে? সেজন্যই তো এসেছি। ভাবলাম বলেছ যখন, তখন হয়তো তুমি হেল্প করতে পারবে।”

এরেন একইভাবে বলল,“আচ্ছা? হেল্প লাগবে? তার চেয়ে বরং আমিই মেরে ফেলি। কী বলো?”

“বেশ তো, মেরে ফেলো। আস্ত একটা ঝামেলা বাঁচিয়ে রেখে লাভ কী? আমি তো……………।”

ইলোরার কথার মাঝ পথেই এরেন হঠাৎ ইলোরার গলায় মুখ গুঁজল। ইলোরা থমকে গেল। কয়েকদিন আগেও এরেন এভাবেই তাকে ছুঁয়েছিল। কিন্তু সেদিন তার পাগলামীর কারণেই এরেন বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আজ? অসুস্থতার কারণে মাথাটাই এলোমেলো হয়ে গেছে মানুষটার। এরেনের হাত দুটো ইলোরার হাত ছেড়ে কোমরে নেমে এল। কোমরে এরেনের শক্ত হাত আর গলায় ঠোঁটের ছোঁয়া পেতেই ইলোরার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। এরেনের শরীরের উত্তাপে সে কেঁপে উঠল। তবু সে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিশ্চুপ রইল। কয়েক মিনিটের মধ্যেও যখন তার গলায়, ঘাড়ে এরেনের ঠোঁটের অবাধ বিচরণ থামল না তখন ইলোরা এরেনের টি-শার্ট খামচে ধরল। কাঁপা কাঁপা মৃদু কন্ঠে বলল,“কী করছো তুমি এটা? পাগলামি কোরো না প্লিজ। তুমি অসুস্থ।”

এরেন এবার মুখ তুলে ইলোরার চোখে চোখ রাখল। ইলোরা আবার ঢোক গিলল। ঐ চোখ জোড়া আজ তার বড্ড অপরিচিত লাগছে। এরেন ইলোরার মুখের কাছে ঝুঁকে আসতেই তার গরম নিঃশ্বাস ইলোরার মুখে পড়ল। এরেন নিচু স্বরে বলল,“ইলোনি, তুমি জানো আমার ভয়ানক অসুখ হয়েছে?”

ইলোরা আঁতকে উঠে কাঁপা গলায় আওড়ালো,“ম..মানে?”

“হুম। এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই।”

ইলোরা এরেনের টি-শার্টের কলার চেপে ধরে ভীতু কন্ঠে বলল,“কী হয়েছে তোমার?”

এরেন ঠোঁট এলিয়ে হেসে ফিসফিস করে বলল,“প্রেমাসুখ। আমার অসুখের নাম প্রেমাসুখ। এই অসুখটা দেখা যায় না। সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এর কোনো ডক্টরি চিকিৎসা না থাকলেও একটা সিক্রেট ঔষধ আছে। কী নাম জানো?”

ইলোরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,“কী?”

“ইলোনি। আমার প্রেমাসুখের এক এবং একমাত্র ঔষধ শুধুই ইলোনি। জগতের আর কোনো ঔষধ এই অসুখ নিরাময়ে সক্ষম নয়।”

ইলোরা ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এরেন এবার ইলোরার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,“বলেছিলাম না ইলোনি? বাসরের আগে তুমি এমন আবেদনময়ী রূপে আমার সামনে আসবে না? শুনলে না তো?”

ইলোরা ঢোক গিলে আমতা-আমতা করে বলল,“আমি তো ইচ্ছে করে এসব পরিনি। আপু বলল তুমি এসব আমার জন্য কিনে রেখেছিলে। পরলে না-কি তুমি খুশি হবে তাই।”

এরেন ডান হাতটা ইলোরার কোমর থেকে সরিয়ে তার কপালে পড়া অবাধ্য চুলগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে ফিসফিসিয়ে বলল,“ইলোনি, আজ যদি আমি সত্যি সত্যিই অসভ্য হয়ে পড়ি, তবে কি সেটা খুব বড়ো অপরাধ হয়ে যাবে?”

ইলোরার বুকটা ধক করে উঠল। সে কাঁপা গলায় বলল,“কী বলছো?”

“তোমাকে খুব করে কাছে পাবার লোভ আজ আমাকে তৃষ্ণার্ত করে তুলেছে ইলোনি। তোমার এই মাদকীয় রূপ আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। আমি তোমাতে আসক্ত হতে চাই। কিন্তু সেটা তোমার অনিচ্ছায় কখনও না। ইলোনি, উইল ডু?”

ইলোরা কিছুটা থমকে গেলেও তার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। মুহূর্তে তার কান্না পেয়ে গেল। এটা যে ভালোবাসার মানুষটাকে শুধুই নিজের করে পাওয়ার আনন্দের কান্না। ইলোরার চোখের কোণের টলমলে পানিটুকু কান্নায় পরিণত হলো তখনই যখন এরেন তার কানের কাছে ফিসফিস করে উচ্চারণ করল,“ভালোবাসি ইলোনি।”

ব্যস, দুটো শব্দই ইলোরাকে কাঁদানোর জন্য যথেষ্ট। কই? এতদিন তো মানুষটা একবারও ‘ভালোবাসি’ শব্দটা উচ্চারণ করল না। তবে আজই কেন? তাকে দুর্বল করার জন্য? ইলোরা বুঝল, সে আজ পারবে না এই মানুষটার আবদার উপেক্ষা করে তাকে দূরে সরিয়ে দিতে। কেন জানি আজ তার মনও চাইছে এই আবদারটুকু পূরণ হোক। ভালোবাসাটা পূর্ণতা পাক। সম্পর্কে পবিত্রতা আসুক। হোক না আজ রাত বিহীন সোহাগ। ইলোরার চোখের পানি মুছে দিয়ে এরেন মৃদু হেসে তার অধরে আলতো করে অধর ছোঁয়াল। ইলোরার ঠোঁট জোড়ায় কম্পন ধরে গেল।

“ভয় নেই ইলোনি। অধিকার আদায় করে নেয়ার মতো মানুষ না তোমার ভালোবাসার মানুষটা।” হাসিমুখে কথাটা বলে এরেন সরে আসতে নিতেই ইলোরা দুহাতে এরেনের গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। ভেজা কন্ঠে বলল,“দাও না কিছু পূর্ণতা।”

এরেনের ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসির রেখা ফুটে উঠল। প্রিয় মানুষটার হাত যখন শাড়ির আঁচল ছুঁলো ইলোরা বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিল। তারপর যখন পূর্ণ অঙ্গে মানুষটার ভালোবাসার উষ্ণ স্পর্শ ছড়িয়ে পড়ল, মুহূর্তে তার আবেগী মন সিদ্ধান্ত নিল এই মানুষটাকে সে কোনো মূল্যেই ছাড়বে না। ধরুক সমস্ত সম্পর্কে ফাটল, তবু না।


এরেনের উন্মুক্ত লোমশ বুকে মুখ গুঁজে জড়োসড়ো হয় শুয়ে আছে ইলোরা। এই নিয়ে এরেন তাকে বারকয়েক বলেছে ফ্রেশ হয়ে আসতে। কিন্তু ইলোরা লজ্জায় মুখই তুলছে না। এরেন ইলোরার মুখ তোলার চেষ্টা করে হেসে বলল,“এই মেয়ে, কিছুক্ষণ আগে যখন নিজেই আমার চাদরের নিচে ঢুকে বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিলে, তখন এই লাজুক স্বভাব কোথায় ছিল? তারপর যখন আমি…..।”

এরেনের কথার মাঝে ইলোরা তার বুকে চিমটি কেটে বিড়বিড় করে বলল,“চুপ, অসভ্য।”

এরেন ঠোঁট টিপে হেসে বলল,“এখন থেকে এই অসভ্যের অসভ্যতামিই সহ্য করতে হবে মিসেস জামান।”

ইলোরা মিনিট খানেক চুপ থেকে বলে উঠল,“বাসার সবাই খোঁজ করলে তো ডালিয়া সত্যি কথা বলতে বাধ্য হবে। তারপর যদি এসে আমাকে নিয়ে যায়?”

এরেন ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইলোরার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,“চিন্তা কোরো না। এমনিতেও আমি সবাইকে সত্যিটা জানিয়ে দিব। কেউ না মানলেও আমি তোমাকে ছাড়ছি না। এমনকি তুমি নিজে ছাড়তে চাইলেও না।”

“আমি আর না ফিরলে সবাই খুব কষ্ট পাবে তাই না?”

“হয়তো। কিন্তু তারা বেশিদিন তোমার ওপর রেগে থাকতে পারবে না।”

“আমি কি ঠিক করছি না ভুল?”

এরেন ইলোরার এই প্রশ্নের উত্তর দিলো না। কারণ স্বামীকে না ছাড়ার সিদ্ধান্ত যেমন ভুল নয়, পরিবারকে ছাড়ার সিদ্ধান্তও তেমন সঠিক নয়। অথচ একটার জন্য আরেকটা করতেই হত ইলোরাকে। এরেন এবার দুজনের শরীরে জড়ানো চাদরটা ইলোরার শরীরে ভালোভাবে জড়িয়ে দিলো। তারপর ইলোরার কপালে চুম্বন রেখা এঁকে দিয়ে বলল,“কাবার্ডের ডানপাশে দেখো কয়েকটা শাড়ি রাখা আছে। ফ্রেশ হয়ে ওখান থেকে একটা পরে নাও। ব্লাউজ, পেটিকোট সবই আছে।”

ইলোরা অবাক হয়ে এরেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,“এসব তোমার কাবার্ডে কেন?”

“আমার এক এবং একমাত্র বউয়ের জন্য কিনে রেখেছিলাম। মার্কেটে গেলে যখন যেটা চোখে পড়েছে কিনে নিয়েছি। জারিনের কাছে যেগুলো ছিল ওগুলো গ্রাম থেকে এসেই তোমাকে দেবো ভেবেছিলাম। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। যাই হোক, ফ্রেশ হয়ে আসো। না-কি তাতেও আমাকে লাগবে।”

“অসভ্য।”

বিড়বিড় করে শব্দটা উচ্চারণ করে ইলোরা লাজুক হেসে বিছানা ছাড়ল। কাবার্ড খুলে ডানপাশ থেকে একটা শাড়ি বের করল। তার পাশ থেকেই ব্লাউজ আর পেটিকোট বের করার সময় হঠাৎ এরেনের জামা-কাপড়ের কোণে কিছু একটা চোখে পড়ল। ভ্রুকুটি করে সেটা হাতে নিয়ে ইলোরা পেছন ফিরে এরেনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,“শুকনো গোলাপ তোমার জামা-কাপড়ের মধ্যে এল কী করে?”

এরেন হেসে বলল,“ওটা আমার একমাত্র বউয়ের থেকে যেচে নিয়ে আসা গোলাপ।”

ইলোরা কিছুটা ভেবে মৃদু হেসে বলল,“ওওও, সেই ফুলের মার্কেট থেকে কেনা গোলাপ। রেস্টুরেন্ট থেকে ফেরার সময় তুমি আমার থেকে নিয়ে এসেছিলে। যত্ন করে রেখে দিয়েছিলে বুঝি?”

এরেন শোয়া থেকে উঠে বসে টি-শার্টটা পরতে পরতে বলল,“জি ম্যাম। সদ্য প্রেমে পড়লে যা হয় আরকি।”

ইলোরা হাসিমুখে গোলাপটা পুনরায় জায়গামতো রেখে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে কোনোমতে শাড়ি পরে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল। এরেন তখন বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে ফোন স্ক্রলিং করছিল। ইলোরা দরজার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,“দরজা খোলা কেন?”

“জারিন এসেছিল।” কথাটা বলে এরেন ইলোরার দিকে তাকাতেই এক ঝটকা খেল। বারকয়েক চোখ ঝাপটা দিয়ে ফোনটা রেখে ইলোরার দিকে এগিয়ে গেল। এরেনকে এগিয়ে আসতে দেখে ইলোরা চুল মোছা থামিয়ে এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করতে লাগল। এরেন গিয়ে ইলোরার হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে ইলোরাকে বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করাল। তারপর নিজেই সযত্নে ইলোরার ভেজা চুলগুলো মুছে দিলো। ইলোরা চুপ মেরে দাঁড়িয়ে রইল। ব্যাপারটা তার কাছে নতুন হলেও বেশ ভালো লাগল। নিজেকে নববধূ মনে হচ্ছে তার। তাই তো। আজই তাদের সম্পর্কের আসল সূচনা। কারণ আজ থেকেই তারা অন্যসব স্বামী-স্ত্রীদের মতো একসাথে থাকবে। আর কোনো দূরত্ব থাকবে না দুজনের মাঝে। এরেন চুল মোছা শেষ করে তোয়ালেটা পাশের চেয়ারে রেখে ইলোরাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ভেজা চুলে মুখ গুঁজে দিয়ে নিচু স্বরে বলল,“এই লজ্জাবতী, তুমি কি আজ আমাকে হার্ট অ্যাটাকে মারতে চাও?”

ইলোরা লাজুক হেসে এরেনের হাত সরানোর চেষ্টা করে বলল,“ছাড়ো। দরজা খুলে রেখেছ সেই খেয়াল আছে? কেউ এসে পড়বে।”

“উঁহু। এখন আর কেউ আসবে না। লাফালাফি কোরো না তো।”

এরেনের থেকে ছাড়া পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা বন্ধ করে ইলোরা প্রশ্ন করল,“আজ নিশ্চিত অনেক ঝামেলা বাঁধবে। আমার ফ্যামিলি আর তোমার বাবা। সবাইকে কীভাবে সামলাবে বলো তো? আমার খুব ভয় করছে।”

এরেন হাতের বাঁধনটা আরেকটু শক্ত করল। ইলোরার চুল থেকে মুখ উঠিয়ে কাঁধে থুতনি রেখে বলল,“আমি সব পরিস্থিতির জন্য তৈরি। মনে সাহস আর আমার ওপর একটু বিশ্বাস রাখো।”

ইলোরা ঘাড় ঘুরিয়ে এরেনের কপালে, গলায় হাত ছুঁইয়ে চিন্তিত মুখে বলল,“জ্বরটা তো কমছেই না তোমার। আমিই না-কি আবেগী? তাহলে তুমি কেন খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে অসুখটা আরও বাড়িয়ে বসে আছ?”

এরেন হেসে বলল,“বললাম না এটা প্রেমাসুখ? এর সিক্রেট ঔষধ ইলোনি যখন স্বয়ং আমার কাছে আছে তখন আর অসুখের ভয় নেই। তাছাড়া আমার এই প্রেমাসুখটা আজীবন সুপ্ত থেকে যাবে। আর তা সারানোর জন্য ইলোনিও থাকবে।”

ইলোরা হেসে ফেলল। পরক্ষণেই সে বাইরে কারো পদধ্বনি শুনতে পেয়ে ছুটোছুটি শুরু করে হন্তদন্ত হয়ে বলল,“ছাড়ো ছাড়ো, মনে হয় আপু আসছে। দরজা………।”

ইলোরার কথা শেষ না হতেই দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে স্বয়ং সাকিব। তার দিকে চোখ পড়তেই ইলোরা থমকে গেল। কিন্তু এরেন এমন কোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিল। সে চুপচাপ ইলোরাকে ছেড়ে দিয়ে তার থেকে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়াল। সাকিবের চোখে-মুখে রাগ স্পষ্ট। ইলোরা ভয়ে জমে গেল। তার মুখ দিয়ে আপনা-আপনি কাঁপা কাঁপা অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এল,“ভাই!”

চলবে……………………🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here