#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_২৮
লিখা: Sidratul Muntaz
আমীর স্পষ্ট দেখলো রিম্মি শরীর ঝাঁকিয়ে কাঁপছে। আমীর ওকে সহজ করার উদ্দেশ্যে মৃদু হেসে বললো,
” ভয় পাচ্ছো নাকি?”
রিম্মির ঘর্মাক্ত নাক মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
” একদম না।”
আমীর কাছে এসে রিম্মির বাম বাহু স্পর্শ করলো। রিম্মি আঁতকে উঠল। আমীর ওকে শক্ত করে ধরে শীতল গলায় বললো,
” ভয়ের কিছু নেই। তোমার আর সাহিলের ব্যাপারটা আমি জানি। ওর সাথে গতকাল ফ্ল্যাটে কি করছিলে সেটাও জানি।”
রিম্মি উৎকণ্ঠিত স্বরে বললো,” কি জানেন? আপনি যেমন ভাবছেন তেমন না। বিশ্বাস করুন, ও আমার..”
আমীর রিম্মির মুখ চেপে ধরল। ওর মাথাটা কাঁচের দেয়ালে ঠেকিয়ে বললো,
” সব জানি। হি ওয়াজ ট্রায়িং টু রেইপ ইউ। আমি না এলে তো রেইপ হয়েই যেতো তোমার।”
রিম্মি ভয়ে ভয়ে হ্যাসূচক মাথা নাড়লো। আমীর আবারও হাসলো। এক-পা, দু-পা করে পিছিয়ে একদম বিছানার শেষ প্রান্তে এসে দাড়ালো। রিম্মির দিকে আঙুল উঠিয়ে চোখমুখ শক্ত করে বললো,
” তোমার কি মনে হয়না ওর মতো শয়তানের একটা কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিৎ? ”
রিম্মি কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে দ্রুত মাথা নাড়লো।সাহিলকে শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে তো সে ভুলেই গেছিল। আমীর মনে করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রিম্মির মতো ছোট্ট একটা মানুষ সাহিলকে আর কি শাস্তি দেবে? রিম্মির যদি বাবা বেঁচে থাকতো অথবা আপন মা থাকতো তাহলে রিম্মি তাদের কাছে সাহিলের কুকীর্তির কথা বলতে পারতো। ওরাই সাহিলের শাস্তির ব্যবস্থা করতো। কিন্তু রিম্মির বাবা নেই। তনিমাকে সাহিলের ব্যাপারটা বললে উনি রিম্মিকে জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলবেন। কোনো দোষ না করেও রিম্মিকেই শাস্তি পেতে হবে। সাহিল রিম্মির সাথে অনাচার করেছে, এখানে যেন রিম্মিরই সব দোষ। আমীর হঠাৎ দরজার দিকে তাকিয়ে তূরি বাজালো। স্লাইড করে দরজা খুলে গেল। লোহার শিকল দিয়ে সাহিলের হাত-পা বেধে একজন তুষ্টপুষ্ট ব্যাক্তি ভেতরে আসলো। সাহিল গোল গোল চোখে রিম্মিকে দেখছে। বোঝাই যাচ্ছে ও ভীষণ অবাক। ওকে দেখে মনে হচ্ছে, এই মুহুর্তে ওর যে অবস্থা সবকিছুর জন্য রিম্মি দায়ী। সব রিম্মির আদেশে হয়েছে। সেই বিস্ময়েই সাহিল ভয়ে আড়ষ্ট এবং হতভম্ব। কিন্তু রিম্মি তাকিয়ে আছে সাহিলের পেছনে দাঁড়ানো দীর্ঘদেহী তরতাজা মানুষটির দিকে। মানুষটিকে দেখলেই শরীরের লোম নিজস্ব শক্তিতে মাথা উঠিয়ে তাকায়। হাত-পা শিরশির করে। রিম্মি হৃৎপিন্ড জুরে বেধক চাপ অনুভব করছে। মানুষটির চোখের মণির রঙ হলুদ। যেন আগুনের ফুলকি। ভেতরে কালো দাগ। চোখের আকৃতি চতুর্ভূজের মতো। মুখ বড়। মাথা বিশাল। ভয়ংকরভাবে সে তাকিয়ে আছে রিম্মির দিকে। রিম্মির ভয়ে এমন অবস্থা হলো যে কারেন্টের শক লাগার মতো ওর সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। আমীর হৃষ্টচিত্তে আওয়ানকে আদেশ করলো,
” আওয়ান, কাজ শুরু করো।”
সাহিল প্রাণ বাচানোর চেষ্টায় ডানাকাটা পাখির মতো উথাল-পাথাল করতে লাগলো। আওয়ান তার গাবদা গাবদা হাত মুঠ করে সাহিলের মুখে ঢুকিয়ে গলা ভেদ করে বুকের ফুসফুস টিপে ধরলো। রিম্মি একদম কাচের দেয়ালের সাথে মিশে দাড়ালো। এমন দৃশ্য তার জন্য সহ্য করা কঠিন। সাহিল নিঃশ্বাস আটকে চোখমুখ উলটে দিয়েছে। ওর মুখ দিয়ে ঘন রক্ত জমাট বেধে বের হচ্ছে। রিম্মি এই অবস্থা দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। লুটিয়ে পড়লো আমীরের বিছানায়। আমীর হতবাক হয়ে উচ্চারণ করলো,
” আরে আরে, রিম্মি! ”
তারপর দ্রুত গিয়ে রিম্মিকে ধরলো। সাহিল মেঝেতে শুয়ে গলাকাটা মুরগীর মতো কাতরাচ্ছে। একটু পরেই ওর দম চলে যাবে৷ তার আগে ওর শিরায় বিষ প্রবেশ করানো হবে। বিষ যন্ত্রণায় ও অদ্ভুতভাবে চিৎকার করবে। রিম্মিকে এসব নৃশংসতা উপভোগ করাতে চেয়েছিল আমীর। সে ভেবেছিল রিম্মি হয়তো এগুলো দেখে মজা পাবে। উপভোগ করবে। খুশিতে হাত তালি দিবে। অথচ মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেল? মেয়েমানুষ এতো অদ্ভুত কেন? ওদের মধ্যে রসকষ নেই? এতো ভয় পেলে চলে না। পাখির আত্মা নিয়ে মানুষ হয়েছে নাকি? এমন কোনো মেয়ে কি পৃথিবীতে নেই, যে কোনোকিছুর পরোয়া করেনা। যার মধ্যে ভয় নামক বালাই নেই। ভয় পাওয়া কোনো অন্যায় না। কিন্তু সেই ভয় অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত হওয়া উচিৎ। এমন অকারণে ভয় পেয়ে জ্ঞান হারানোর কি আদৌ কোনো মানে হয়? মানুষের মস্তিষ্কের একটি অপ্রয়োজনীয় অনুভূতি হলো অতিরিক্ত ভয়। আমীর তীক্ষ্ণ গলায় আওয়ানকে নির্দেশ দিল দেহটা প্রাইমারী মর্গে নিয়ে যেতে। আওয়ান সাহিলকে কাধে উঠিয়ে চলে গেল।
রিম্মি জ্ঞান ফিরে আবিষ্কার করলো সে বাসায় চলে এসেছে। তার মাথার কাছে তনিমা চিন্তিত মুখে বসে আছেন। রিম্মি তাকাতেই উনি দুধের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললেন,
” নে মা, এইটা খা। তোর শরীর দূর্বল। খেলে বল পাবি।”
রিম্মি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। মায়ের এতো যত্ন তার সুবিধার ঠেকছে না। অন্তরা হাসিমুখে রিম্মির কাছে এগিয়ে এসে বললো,
” এই রিম্মি, আজরাতে বিরিয়ানি খাবি? তোর প্রিয় দম বিরিয়ানিটা রান্না করেছি। একদম তুই যেভাবে পছন্দ করিস সেইভাবে। বাসমতি চাল আর মুরগীর মাংস। জলদি খেতে আয়।”
রিম্মি এতো অবাক হলো যে ওর খোলা মুখের আকৃতি বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেল। সবাই ওকে এতো গুরুত্ব দিচ্ছে কেন? আগে তো জন্ডিস হয়ে বিছানার এক কোণায় পড়ে থাকলেও কেউ পাত্তা দিতো না। তনিমা কখনো একবারের জন্যে এসে রিম্মিকে জিজ্ঞেস করেনি,” মা, তুই কেমন আছিস?” জীবনে কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেননি। অথচ এখন তনিমা ক্রমাগত রিম্মির মাথায় হাত বুলাচ্ছে। এসব তার সঙ্গে কি হচ্ছে? রিম্মি ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলো,
” আমি বাসায় কখন এসেছি?”
তনিমা হাসিমুখে মিষ্টি করে জবাব দিলেন,” আধঘণ্টা আগে। তোর তো সেন্স ছিলনা। ছেলেটা তোকে বিছানায় দিয়ে গেছে। আমার যে কি ভয় লাগছিল মা। এখন তুই চোখ মেলে তাকিয়েছিস, তাই শান্তি লাগছে।”
রিম্মি আশ্চর্য হয়ে গেল। আমীর কি তাকে কোলে করে বিছানা পর্যন্ত নিয়ে এসেছে? তবুও তনিমা কিছু বলেন নি? দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে দশটা বাজে। তার মানে রিম্মি বাড়ি ফিরেছে দশটায়। তাও অজ্ঞান অবস্থায়। শুধু তাই নয়, অপরিচিত একটা ছেলের কোলে চড়ে। তাও মা কিছু বললেন না? সাহিলের সাথে কথা বলার জন্যও আগে রিম্মিকে কত বিছরি বিছরি গালি শুনতে হতো। আর এখন এতোবড় একটা ঘটনা হয়ে গেল তাও মা কিছু বললেন না? আশেপাশের মানুষগুলোর এমন পরিবর্তন নিঃসন্দেহে ভালো তবে অস্বাভাবিক। সাহিলের কথা মনে হতেই রিম্মির আবার বুকে ব্যথা উঠে গেল। চোখ পানিতে টইটম্বুর হয়। বেচারার কত ভয়ানকভাবে মৃত্যু হলো। এমন মৃত্যু শত্রুকেও কেউ দিতে চাইবে না। আর সাহিল তো রিম্মির বেস্টফ্রেন্ড ছিল।
রিম্মি এরপর থেকে আমীরের সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। কেন দেয় সেই উত্তর সে নিজেও জানেনা। বাসা থেকেও প্রয়োজন ছাড়া বের হতো না। রিম্মির কোনো মোবাইল নেই। ওদের বাড়ির ল্যান্ড লাইনে আমীর মাঝে মধ্যে ফোন দেয়। রিম্মি ধরেনা। যথাসাধ্য এড়িয়ে যায়। একদিন রিম্মি স্কুল থেকে বের হতেই দেখলো, আমীর গাড়ি নিয়ে স্কুল গেইটের সামনে দাড়িয়ে আছে। রিম্মির বুক ধ্বক করে উঠলো। সে উল্টো রাস্তা দিয়ে পালাতে চাইলো। কিন্তু ততক্ষণে আমীর ওকে দেখে ফেলেছে।
চলবে