ধূসর রঙে আকাশ পর্ব- ৩২

0
917

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৩২
লিখা: Sidratul Muntaz

রিম্মি নিভৃতে নীলাভ্রর মস্তিষ্কে বার্তা পাঠালো,
” তোহার কোনো বিপদ নেই। ও আমীরের কাছে সুরক্ষিত। ”
নীলাভ্র কনফিউজড হয়ে বললো,” কিভাবে সুরক্ষিত?”
” তোহার প্রতি ওর দূর্বলতা আছে। ওর ক্ষতি আমীর জীবনেও করবে না।”
” কেমন দূর্বলতা?”
” ঠিক কেমন দূর্বলতা সেটা আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না। দয়া-মায়া জিনিসগুলো আমীরের মধ্যে একদমই নেই। সে পাষাণতম মানুষ। কিন্তু ইদানীং তোহার জন্য আমীরের মায়া কাজ করছে। ও তোহার বিষয়ে খুব সচেতন। তোহার গায়ে মশা বসলেও ও পাগল হয়ে যায়।”
” ওদের বিয়েটা কি সত্যি লভ ম্যারেজ?”
” ওদের বিয়েই হয়নি।”
নীলাভ্র আৎকে উঠলো,” বিয়েই হয়নি!”
” ওদের সম্পর্কটা বাহিরে থেকে যেমন দেখা যায়, ভিতরে ঠিক তার বিপরীত। আমি যেমন একসময় আমীরের হাতের পুতুল ছিলাম, তোহাও এখন আমীরের হাতের পুতুল। পার্থক্য হলো, তোহা খুব যত্নের। আমার বেলা কোনো যত্ন ছিল না।”
” আমীর কি তোহাকে ভালোবাসে?”
রিম্মি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বললো,” ওর মানুষকে ভালোবাসার ক্ষমতাই নেই। ও একটা শয়তান।”
” তাহলে? ও তোহাকে দিয়ে কি করতে চায়?”
” কিছুই করতে চায়না। ও শুধু তোহাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে আমার কাছাকাছি থাকার জন্য। এই ফ্ল্যাটে মনে হয় ব্যাচেলর ভাড়া হয়না। তাছাড়া আমীর জানে, তোহা আমার মতো সস্তা না। ওকে ইচ্ছে করলেই টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া যায়না। তাই বিয়ের নাটক সাজিয়ে ওকে এখানে নিয়ে এসেছে। যতদিন আমি আমীরের প্রস্তাবে রাজি না হবো ও এখানেই থাকবে। তোহার মাধ্যমে থাকবে।”
” রাজি হয়ে গেলে?”
” তোহাকে ফেলে আমাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে।”
” তাহলে তোহার কি হবে?”
” কিছুই হবে না। ও সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে যাবে। হয়তো সব মনেও পড়বে। এখন যেসব মনে নেই।”
” তোহার কিছু মনে নেই?”
” অনেককিছুই মনে নেই। তোহাকে দেখে মনে হয়, ও আমীরকে প্রচন্ড ভালোবাসে। হঠাৎ যখন শুনবে আমীরের সবকিছুই সাজানো নাটক ছিল, স্বার্থ উদ্ধারের নিকৃষ্ট কৌশল ছিল, অনেক বড় একটা ধাক্কা খাবে মেয়েটা। মানসিকভাবে অসুস্থও হয়ে যেতে পারে।”
” ব্যাচেলর ভাড়ার বিষয়ে কি বললে?”
” এই ফ্ল্যাটে ব্যাচেলর ভাড়া হয়না তাই বলেছি। ভাড়া পাওয়ার জন্য আমীরের একটা বিয়ে দরকার ছিল। একটা নকল বউ। তোহা নিজের অজান্তেই সেই নকল বউয়ের ভূমিকা পালন করছে। আমীর এমনভাবে এ বাসায় প্রবেশ করেছে যে কেউ কখনো ওকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করবে না। আর ও এখানে খুব সহজভাবে আমাকে পাহাড়া দিতে পারছে। এটাই ওর উদ্দেশ্য। ”
” তাহলে তোহাকে মেডিসিন খাওয়ানো, তারপর রূপার পায়েল, এসব কি?”
” রূপা বিদ্যুৎ সুপরিবাহী। আমীর প্রত্যেকটা ঘরের দরজায় রেস্ট্রিকশন দিয়ে রাখে। যেন তোহা কখন কই যাচ্ছে সব ও আগে থেকেই বুঝে শতর্ক হয়ে যেতে পারে। আর মেডিসিন বলতে শুধু ঘুমের ঔষধ। যেন তোহা সারারাত মরার মতো ঘুমায় আর আমীর তার কাজ নির্দ্বিধায় করতে পারে।”
” কি কাজ?”
” ওর একটাই কাজ। আমাকে যন্ত্রণা দেওয়া।”
নীলাভ্র দাঁতে দাঁত পিষে বললো,” ওকে আমি খুন করে ফেলবো। ”
রিম্মি নীলাভ্রর হাতের উপর হাত রেখে চোখমুখ শক্ত করলো। বার্তা দিলো,” ভুলেও এই ভুল করতে যেও না। পরিণাম সর্বনাশ হবে। আমি আজকে তোমাকে কথাগুলো বলেছি শুধু মন হালকা করতে। তুমি সবকিছু এখনি ভুলে যাবে। আমি না বললে কখনো এই প্রসঙ্গ তুলবে না।”
” তুমি কি ওর সাথে অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাবে রিম্মি?”
” এই বোঝাপড়া আমার আর আমীরের। তুমি শুধু এটুকু জেনে রাখো, আমি তোমাকে কখনো ধোকা দিবো না। আর তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।”

রিম্মি বাসায় ফিরে দেখলো তোহা তাদের ফ্ল্যাটের দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। ওর সাথে আরও একজন আছে। একটা বাচ্চামতো শ্যামলা মেয়ে। মেয়েটার গায়ে খুব সাদামাটা নীল সেলোয়ার কামিজ। সে বিষণ্ণ মুখে সিড়ির এক কোণায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে। রিম্মিকে দেখে আড়চোখে তাকালো মেয়েটা। তোহার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল। রিম্মিকে দেখে সে চোখের জল আড়াল করলো। রিম্মি তোহাকে একবারও জিজ্ঞেস করেনি কি হয়েছে। এইটাও বলেনি যে সে বাসার বাহিরে দাড়িয়ে কেন কাঁদছে। রিম্মি তোহার কাছে গিয়ে ওর কাধে হাত রেখে কোমল গলায় বার্তা দিল,
” আমার সাথে এসো।”
তোহা প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে তাকায়। মেয়েটা রিম্মির বার্তা পেলনা। তাই সে চুপচাপ তাকিয়ে আছে। হয়তো অপেক্ষা করছে, রিম্মি কি বলে শুনার জন্য। তোহা বললো,
” ছাড়ুন আমাকে। আমি কোথাও যাবো না।”
রিম্মি আবার বললো,” প্লিজ আসো তোহা। আই ইনসিস্ট।”
মেয়েটা বড় বড় চোখ করে চেয়ে রইল। সে শুধু দেখছে তোহা একা একা কথা বলছে। রিম্মি কিছুই বলছে না। কিন্তু ওর মুখের অঙ্গভঙ্গি বদলাচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার! তোহা রিম্মির কথা মেনে নিল।মেয়েটার দিকে চেয়ে বললো,
” শিউলি এসো।”
শিউলি চুপ করে উঠে তোহার পেছন পেছন গেল। রিম্মি তোহাকে নিয়ে ওর বাসায় ঢুকলো। পুরো ঘটনা রিম্মি জানে। তোহা আজ সন্ধ্যায় আমীরের অনুমতি ছাড়াই নিয়াজের সাথে দেখা করতে হসপিটালে গিয়েছিল। আমীর তখন ঘুমিয়ে ছিল৷ ঘুম থেকে উঠে সে যখন তোহাকে খুঁজে পায়নি, তখন লাভলী আন্টিদের বাসায় যায়। সেখানে গিয়ে জানতে পারে পূরবী আর তোহা বাংলাদেশ মেডিকেলে গেছে। আমীরের মাথাগরম হয়ে গেল কথাটা শুনে। চোখেমুখে আগুন জ্বলে উঠলো। সে নিষেধ করা সত্ত্বেও তোহা ওখানে ঠিকই গেল? তোহা বাড়ি ফেরার সময় শিউলি মেয়েটাকে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছে। মেয়েটার বয়স তেরো। রাস্তাঘাটে ফুল বিক্রি করে। তার মাও ফুল বিক্রি করতো। আজ মেয়েটার মা মারা গেছে। বাবাও নেই। তোহার খুব মায়া লাগে অসহায় মেয়েটার জন্য। তাই শিউলিকে কাজের মেয়ে হিসেবে সে বাসায় নিয়ে এসেছে। মেয়েটা ভালোই। তবে একটা সমস্যা আছে। রিম্মি ইতোমধ্যে অনুমান করতে পারছে না সমস্যাটা। আর কিছুসময় গেলেই বুঝতে পারবে। তোহা বাসায় আসার পর আমীর যখন ওকে জিজ্ঞেস করলো,” কোথায় ছিলে?”
তোহা থতমত খেয়ে জবাব দিয়েছিল,” পূরবীর সাথে শপিং এ গিয়েছিলাম।”
মিথ্যে কথা শুনে আমীরের মেজাজ আরও বিগড়ে যায়। শিউলিসহ তোহাকে ঘর থেকে বের করে দেয় আমীর। বলে, নিয়াজের কাছেই চলে যেতে। তার সামনে যেন আর না আসে। তোহা অভিমানে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়েই কাঁদতে শুরু করলো। তারপর রিম্মি তোহাকে আর শিউলিকে নিয়ে বৈঠকঘরে এসেছে। শিউলি মেয়েটা খুব ক্ষুধার্ত। রিম্মি দুজনকেই খেতে দিল। তনিমা ভূনা খিচুরি আর গরুর মাংস করেছেন। সুস্বাদু খাবার দেখে শিউলির মুখ ঝলমল করে উঠলো। সে গরুর মাংস শেষবার খেয়েছিল গত কুরবানী ঈদে। তারপর আর খাওয়া হয়নি। এই খাবার তার খুবই প্রিয়। রিম্মি মুচকি হেসে শিউলিকে ইশারায় বললো,
” হাত ধুয়ে খেতে বসো।”
শিউলি খুশি মুখে হাত ধুতে চলে গেল। রিম্মি তোহার সামনে বসে শান্ত ভঙ্গিতে জানতে চাইলো,
” তোমার কি হয়েছে তোহা?”
রিম্মি সবই জানে। তবুও তোহাকে জিজ্ঞেস করলো। যেন কথাগুলো বলে ও মন হালকা করতে পারে। তোহা আস্তে-ধীরে রিম্মিকে সবকিছু বললো। রিম্মি বললো,
” টেনশন কোরো না। রাগ কমলে ও এমনিই দরজা খুলবে। এখন তুমি খেয়ে নাও৷ তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তোমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে।”
তোহা মাথা নিচু করে বিরক্ত গলায় বললো,” খেতে ইচ্ছে করছে না।”
রিম্মি মৃদু হাসলো,” কেন ইচ্ছে করছে না সেটা আমি জানি। আমীর এখনো খায়নি। ঘরে রান্নাও নেই। ওকে ফেলে তুমি কিভাবে খাবে তাইতো?”
” হুম। আমি বাসায় গিয়ে রান্না করবো। তখন দুজন একসাথে খাবো।”
” আমি তোমাদের দুজনের খাবার দিয়ে দিচ্ছি। রাত এগারোটা বাজে তোমাকে রান্না করতে হবে না।”
” কোনো দরকার নেই আপু।”
” অবশ্যই দরকার আছে। বসো তো চুপচাপ।”
রিম্মি একটা হটপটে খাবার ভরে আনলো। শিউলি তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। আর অবাক হয়ে রিম্মিকে দেখছে। রিম্মির কান্ডকারখানায় সে বিস্মিত হওয়া শুরু করেছে মাত্র।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here