#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৩৪
লিখা: Sidratul Muntaz
তোহা ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখলো শিউলি সোফা আর সেন্টার টেবিল পরিষ্কার করছে। হঠাৎ করেই মাথাটা গরম হয়ে গেল তোহার। শিউলির কাধ মুষ্টিতে ধরে হিংস্র বাঘিনীর মতো গর্জিত গলায় বললো,
” এই মেয়ে, সত্যি করে বলো। তুমি কি প্র্যাগনেন্ট?”
শিউলি হঠাৎ প্রশ্নে হকচকিয়ে উঠলো। সকাল থেকেই তোহার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। সে কেমন উল্টা-পাল্টা ব্যবহার করছে। কালরাতের ঘটনা নিয়ে তোহার সন্দেহ হয়েছে এই বিষয়টা শিউলির কাছে পরিষ্কার। শিউলি কি উত্তর দিবে ভেবে পেল না। একটা ঢোক গিলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তোহা অধৈর্য্য হয়ে ধমকে উঠলো,
“একদম চুপ করে থাকবে না। সত্যি কথা বলো। মিথ্যা বললে পূরবীকে দিয়ে হসপিটালে পাঠাবো তোমাকে চেকাপের জন্য। তখন যদি জানতে পারি মিথ্যা বলেছো তাহলে খবর আছে। একদম জানে মেরে ফেলবো। এখন বলো?”
শিউলি ভয়ে কেঁপে উঠলো। ওর হাতে নোংরা কাপড় ছিল যেটা দিয়ে ঘর পরিষ্কার করছিল। সেটা ইতোমধ্যে হাত থেকে পড়ে গেছে। শিউলি পেছনের দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। তোহা কাছে এসে বললো,
” তুমি প্র্যাগনেন্ট? ঠিক বলেছি আমি?”
শিউলি হঠাৎ মুখে ওরনা চেপে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে গেল। তোহা উত্তর নিজে থেকেই বুঝে নিয়েছে। তার ধারণাই সঠিক। নাহলে মেয়েটা কাঁদবে কেন? আর সে নিশ্চয়ই অপরাধী। তার চোখেমুখে অপরাধবোধ স্পষ্ট ধরা দিচ্ছে। তোহা শিউলির সাথে মেঝেতে বসলো। ওর দিকে ঝুঁকে উন্মাদের মতো হতবিহ্বল গলায় প্রশ্ন করলো,
” এই বাচ্চার বাবা কে? প্লিজ বলো, কে এই বাচ্চার বাবা?”
শিউলি কাঁদতে কাঁদতে বললো,” আমার কোনো দোষ নাই আপু। আপনি আমারে মাফ কইরা দেন। ভাইজান জোর কইরা আমার লগে…”
তোহা বাকি কথা সহ্য করতে পারলো না৷ তাই নিজের কান চেপে ধরে জোরে শব্দ করলো,” আহ!”
পূরবী ওইসময় রান্নাঘরে ছিল। তোহা অসুস্থ তাই ওকে দেখতে এসেছিল। চিৎকার শুনে ড্রয়িংরুমে উঁকি দেয় পূরবী। তোহা চোখ বড় করে পাগলের মতো শিউলির হাত চেপে ধরে প্রশ্ন করলো,
” ভাইজান কি করেছে? বলো কি করেছে?”
তোহার দম আটকে আসছিল। মনে হচ্ছে কথাটা শুনলেই সে মরে যাবে। না শুনলেও মরে যাবে। শিউলি তখনো ফুপিয়ে কাঁদছে। করুণ গলায় বললো,
” ভাইজানরে দেখলেই আমার ডর করে। আমি উনার কাছে যাইতে চাইতাম না। লুকায় লুকায় থাকতাম। উনি আমারে জোর কইরা প্রত্যেক রাইতে উঠায় নিয়া যাইতো। ”
” কোথায় উঠিয়ে নিয়ে যেতো?”
” উনার ঘরে।”
” তারপর? নিয়ে কি করতো?”
শিউলি মাথা নিচু করে বললো,” এইডাও আপনেরে খুইল্লা কওন লাগবো? মাইয়া মানুষ হইয়া বুঝেন না?”
তোহার মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। অকস্মাৎ
শিউলির গলা চেপে ধরে উদ্ভট স্বরে চিৎকার শুরু করলো,
” তোর এত্তোবড় সাহস কিভাবে হলো? তুই কোন সাহসে ওর ঘরে গেলি? চিৎকার করতে পারলি না? আমাকে ডাকতে পারলি না? সব তোর নিজের ইচ্ছায় হয়েছে। এখন ন্যাকা সাজার ভান করবি না। তোকে খুন করে ফেলবো আমি। রাক্ষসী,পিশাচিনী, ডাইনি।”
দুইহাতে শিউলির গলা ধরে সমানতালে ওর মাথাটা দেয়ালে ঠুকাতে লাগলো তোহা। পূরবী ছুটে আসলো তোহাকে থামানোর উদ্দেশ্যে। মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে। এইভাবে শিউলিকে মারতে থাকলে তো ও মরেই যাবে। পূরবী তোহাকে টেনে হিঁচড়েও সরাতে পারছিল না। অবশেষে তোহা নিজে থেকেই ছাড়লো। ওর মাথা থেকে গলা পর্যন্ত ঘেমে গেছে। শিউলির কপাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে। এই অবস্থাতেও মেয়েটা কাশছে, গলায় চাপ লাগার কারণে। তোহা কিছুক্ষণ থেমে থাকল। তারপর হঠাৎ শিউলির মুখে খামচানো শুরু করলো। পূরবী চেচিয়ে উঠলো,
” তোহা! কি শুরু করলি এসব?”
শিউলি চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। তোহা জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে সেন্টার টেবিলে একটা লাথি মারলো। সোফার সবকয়টা কুশন উল্টে পাল্টে মেঝেতে ফেলতে লাগলো। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মতো আচরণ শুরু করেছে সে। শিউলি ভয়ে অস্থির। পূরবীর পিছে গিয়ে আশ্রয় নিল। পূরবী নিজেও বুঝতে পারছে না কিভাবে তোহাকে সামলাবে। তোহা ড্রয়িংরুম তছনছ করে এবার বেডরুমে চলে গেল। মাথার চুল খামচে ধরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে চিৎকার করতে লাগলো। ড্রেসিং টেবিলের আয়না ভেঙে ফেললো। বিছানার চাদর উল্টে দিল। এতো কষ্ট জীবনে কখনো লাগেনি। এই কষ্টের ভারী পাহাড় টলানোর জন্য দুনিয়া ধ্বংস করতেও সে দু’বার ভাববে না। আমীর বাহিরে থেকে মাত্রই বাসায় ঢুকেছে। তখনি দেখলো তোহার মহাপ্রলয়ংকিনি রূপ। প্রথম কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে বিমূঢ় হয়ে গেল। তারপর যেই না তোহাকে থামাতে ঘরে প্রবেশ করতে যাবে, তোহা সহসা ল্যাম্প লাইট ছুড়ে মারলো আমীরের মুখে। উচ্চ কণ্ঠে বললো,
” প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক,জানোয়ার,নরপিশাচ!”
আমীর কয়েক কদম পিছিয়ে পড়ল। তার চশমাটা চোখ থেকে খুলে পড়ে গেছে। হয়তো ভেঙেও গেছে। আমীর চোখে কিছু দেখতে পারছে না। ল্যাম্প লাইটের শক্ত কোণাটা কপালের ঠিক ডান সাইডে লেগেছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আরেকটু হলেই চোখে কাচ ঢুকে যেতো। আমীর অন্ধ হয়ে যেতো। পূরবী দৌড়ে আসলো আমীরকে ধরতে,
” ভাইয়া আপনার লাগেনি তো?”
তোহা পূরবীর গালে শক্ত চটকনা বসালো। পূরবী বিস্ময়ের সীমান্তে পৌছে বললো,
” আমি তোর দুইমাসের বড়। তুই আমাকেও মারলি? ভাইয়াকেও মারলি? তোর মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে তোহা?”
তোহা জবাব দিল না। তার দৃষ্টি এলোমেলো। ক্ষুদার্থ বাঘিনীর চেয়েও হিংস্র হয়ে উঠেছে সে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। সামনে কেউ এলেই খুন করে দিবে, সেই যে-ই হোক। আমীর কপালে হাত রেখে উঠে চলে গেল। পূরবী তোহার কাছে যাওয়ার সাহস পেল না। ড্রয়িংরুমে শিউলির কাছে গেল। শিউলি আহত অবস্থায় মেঝেতে বসে আছে। ব্যথায় কোঁকাচ্ছে। আমীর ফ্ল্যাট থেকে বের হতেই দেখলো রিম্মি ওর সামনে দাড়িয়ে হাসছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে আজ মহাখুশি। আমীরের মেজাজ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেল। দাঁত খিচড়ে বললো,
” এসব তোমার কাজ তাইনা?”
রিম্মি হাসতে হাসতে বার্তা দিল,” আপনার অনুভূতি এখন কেমন মিস্টার সাইন্টিস্ট? যদিও আমি জানি, তবুও আপনার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে করছে।”
আমীরের ভীষণ রাগ হলো। একবার ইচ্ছে হলো রিম্মিকে ধাক্কা মেরে সিড়ি থেকে ফেলে দিতে। কিন্তু রিম্মির কোনো ক্ষতি হলে লস তো তার নিজেরই হবে। তাই আমীর কিছু বললো না। সিড়ি ভেঙে নিচে চলে গেল।
তোহা ভাঙচুর করতে করতে ক্লান্তপ্রায়। বিছানায় বসতেই অজ্ঞান হয়ে যায়। আমীর বাসায় ফিরলো সন্ধ্যায়। ওর মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ। পূরবী বা শিউলি কেউই বাসায় নেই। তোহা একা এলোমেলো বিছানায় শুয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে ও ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু আসলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আমীর তোহার মাথার কাছে গিয়ে বসলো। প্রায় তিনমাসের মতো আমীরের ল্যাবরুমে তোহা এমন অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে থেকেছে। আমীর তখন প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে তোহাকে দেখতো। এই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমীরের কিভাবে যেন সময় কেটে যেতো। সে টেরই পেতো না। যখন ও খুব ক্লান্তবোধ করতো বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতো, তখন তোহার নির্মল মুখটা দেখলে ওর অদ্ভুত শান্তি লাগতো। কি অসম্ভব সুন্দর মায়াবী মুখ। নিষ্পাপ আভা। চেহারায় কতো মাধূর্য্যতা! এই মুখের দিকে চেয়ে দুনিয়া ভুলে থাকা যায়। সারাজীবন তোহাকে দেখে জীবন কাটিয়ে দেওয়া আমীরের জন্য কোনো ব্যাপারই না। আচ্ছা, সে কি এই সাধারণ মেয়েটির মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে? আমীর তীব্র প্রতিবাদ করলো, অসম্ভব। এ কিছুতেই হতে পারেনা। সামান্য এক নারীর রূপের মোহে অন্ধ হওয়ার মানুষ সে না। ছি, এতো সস্তা চিন্তা-ভাবনা তাকে মানায় না। তার জন্মই হয়েছে পৃথিবীতে বিস্ময় সৃষ্টি করতে। ভালোবাসা এক ভয়াবক তুচ্ছ ব্যাধি। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কামনার আকর্ষণ এর চেয়েও তুচ্ছ। এসব অর্থহীন কাজে নিজেকে জলাঞ্জলি দেওয়া চরম বোকামী। আমীর সেই বোকামীটা করতে চায়না। তার জীবনের ছাব্বিশ বছর কেটে গেছে কিন্তু সে কখনো কোনো নারীদেহের সংস্পর্শে আসেনি। সেই প্রয়োজনবোধ কঠোরভাবে দমিয়ে রেখেছে।। কিন্তু তোহা নামের অতি সাধারণ এই মেয়েটি যেন ওকে চুম্বকের মতো টানছে। এমন কেন হচ্ছে? তোহাই তার দেখা সর্বোত্তম রূপসী মেয়ে, এমনো তো না৷ এর চেয়েও হাজারগুণ সুন্দরী আমীরের পায়ের কাছে লুটিয়ে থাকতে প্রস্তুত। অথচ তার ভালোবাসার তৃষ্ণা শুধু তোহার জন্য জাগে? কি আছে এই মেয়ের মধ্যে? এক ভয়ংকর নেশা আছে। তোহাময় এই নেশার জাল কেটে আমীরকে অতি শীঘ্রই মুক্ত হতে হবে। নাহলে ধ্বংস নিশ্চিত।
চলবে
( ভেবেছিলাম এই পর্বেই কাহিনি ক্লিয়ার করবো। পরে ভাবলাম থাক, আপনারা বরং আমীরকে আরও কিছুক্ষণ গালমন্দ করেন। আমি দেখি।😝)