#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৩৫
লিখা: Sidratul Muntaz
আমীর তোহার মাথার কাছে বসে আনমনে চুলে বিলি কাটছে। তার খুব ইচ্ছে করছে একবার তোহার সাথে কথা বলতে। তোহা যখন আমীরের সাথে পাগলামী করে, আমীরের খুব মজা লাগে। এতো মজা সে পৃথিবীর কোনোকিছুতে পায়না। তার যতটা মজা লাগে ততটা বিরক্তও লাগে। বিরক্তিটা নিজের প্রতি। কেনো তোহার প্রতি ক্রমশ দূর্বল হয়ে যাচ্ছে সে? কেনো নিজেকে সামলাতে পারছে না? রিম্মির সামনে দাঁড়াতে লজ্জা লাগে আমীরের। কারণ রিম্মি আমীরের অনুভূতি জানে। রিম্মি তো সবার অনুভূতিই জানে৷ আমীরের মনে হয়, কারো মায়ায় জড়িয়ে যাওয়া চরম দূর্বলতার পরিচয়। কাউকে ভালোবাসা বোকামী। দয়া,মায়া,ভালোবাসা সবকিছু দূর্বলতার উদাহরণ। আমীর দূর্বল হতে চায়না। কেউ তাকে দূর্বল ভেবে হাসি-ঠাট্টা করুক সেটাও আমীরের সহ্য হয়না। তোহার থেকে দূরত্ব সৃষ্টির জন্য আমীর দুজনের বিছানা আলাদা করে দিয়েছে। তোহার কাছাকাছি থাকলে বিপদ বাড়বে। একদিন না একদিন এই রূপবতী মেয়েটির মায়া কাটিয়ে আমীরকে চলে যেতে হবে। বাচ্চা মেয়েটার মিষ্টি মিষ্টি পাগলামী আর দেখা হবে না। কেউ মিষ্টি করে বলবে না, শুনুন, টেবিলে আপনার খাবার দিয়েছি। খেতে আসুন। হুটহাট কেউ জড়িয়েও ধরবে না। ভেজা শাড়ি পড়ে সামনে এসে বলবে না, দেখুন কত রূপবতী মেয়ে আমি। আমাকে আদর করতে ইচ্ছে করে না আপনার? আমীর হেসে ফেললো। তোহার এসব ছেলেমানুষী আমীরের জন্য কতবড় অত্যাচার সেটা কি তোহা জানে? সেদিনরাতে আমীরের একফোঁটা ঘুমও হয়নি। কোনো কাজে কনসেন্ট্রেট করতে পারেনি। শুধু বেগুনি শাড়ি গায়ে জড়ানো ভেজা চুলের মেয়েটিকে ভেবে ভেবে সময় পার করেছে। এভাবে চলতে থাকলে তো সর্বনাশ হবে। তার গবেষণা রসাতলে যাবে। এতোদিনের সাধনায় জলে ভেসে যাবে। জীবনে প্রথম আমীর কাউকে মিস করতে শুরু করেছে। তোহাকে ছাড়া সে কিভাবে থাকবে? এই একটা প্রশ্ন আমীরকে প্রতিনিয়ত জ্বালাচ্ছে। এই যে বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা, এটা একটা অসুখ। এই অসুখের নিরাময় কি?
তোহা চোখ পিটপিট করে তাকালো। ওর জ্ঞান ফিরেছে। আমীর তোহার দিকে তাকিয়ে একটা মৃদু হাসি দিল। তোহার মাথার শিরা তিরতির করে কাঁপতে লাগলো। শিউলির কথাগুলো মনে করে আবার বমি আসছে। শিউলি আর আমীরের অন্তরঙ্গ মুহুর্ত কল্পনায় আসছে৷ তোহা শোয়া থেকে উঠেই ঠাস করে আমীরকে চড় মারলো। আমীর হতভম্ব হয়ে গেলো। তোহার দিকে হা করে কতক্ষণ চেয়ে থেকে ভ্রু কুচকে ফেললো। মেজাজ খারাপ করে তৎক্ষণাৎ উঠে চলে গেল৷ তোহা রাগে টেবিলে ভাঙা ল্যাম্পটা দেখে সেটাই ছুড়ে মারলো মেঝেতে। বিছানার চাদর মুষ্টিতে নিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।
পূরবী শিউলিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। ডাক্তার ওকে দেখে বলেছে মেয়েটার তিনমাস চলে। অথচ মেয়েটা এখানে এসেছে দুইমাসও হয়নি। তার মানে আগেই কোনো কাহিনি ঘটিয়ে এসেছে। আর এখন দোষ আমীরের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। কি শেয়ানা মেয়ে! ব্যাপারটা তোহাকে গিয়ে বললো পূরবী। তোহা এসব শুনে বললো,
” তুই এখন যা পূরবী।”
পূরবী বললো,” মাথা ঠান্ডা কর তোহা। আর সিন ক্রিয়েট করিস না। ভাইয়ার এখানে কোনো দোষ নেই সেটা বোঝাই যাচ্ছে। এখন এই মেয়েটার কি করবি?”
তোহা কঠিনগলায় বললো,” তোকে আমি চলে যেতে বলেছি।”
পূরবী চলে গেল। তোহা বেডরুমের দরজা আটকালো। শিউলি ভয়ে গুটিশুটি মেরে বিছানার কোণে বসে আছে। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়াচ্ছে। তোহা শান্ত গলায় বললো,
” সবকিছুর ঠিকঠাক উত্তর দাও। কোনো ধানাই-পানাই না। আর কোনো মিথ্যে না। যদি আবার মিথ্যে বলো জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো।”
তোহার হুমকিতে কেঁপে উঠলো শিউলি। মার খাওয়ার পর থেকে তোহাকে আযরাঈলের মতো ভয় লাগছে তার। কোনো উত্তর না পেয়ে তোহা প্রশ্ন করলো,
” এই বাচ্চা কি আমীরের? সত্যি কথা বলো।”
পূরবী মাথা ডানে-বামে নাড়লো। অর্থাৎ বাচ্চা আমীরের না। তোহা বুকে শীতল প্রশান্তি অনুভব করলো। কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে শিউলির দিকে ঝুঁকে বললো,
” আমীর কি তোমাকে ছুঁয়েছে? যা সত্যি তাই বলো। ভয় পেয়ে মিথ্যা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি আর তোমাকে মারবো না। তাও সত্যি বলো প্লিজ। ও ছুঁয়েছে তোমাকে?”
শিউলি আবারও শুরু করলো মুখে আঁচল চেপে কান্না। তোহা চোয়াল শক্ত করে উচ্চকণ্ঠে বললো,
” এই মেয়ে একদম কাঁদবি না। কথার উত্তর দে। নাহলে মেরে ফেলবো তোকে।”
শিউলি দ্রুত মাথা নেড়ে না বললো। মানে আমীর তাকে ছোঁয়নি। তোহা কপাল কুচকে বললো,
” তাহলে কালরাতে এসব আমি কি দেখলাম? তুমি আমার পাশে ঘুমাতে চাইতে না কেন? মাঝরাতে গোসল করেছিলে কেন?”
শিউলি আবারও কেঁদে ভাসায়। কান্নারত অবস্থাতেই সব সত্যি প্রকাশ করলো। মাঝরাত হলেই শিউলির শরীর খারাপ হয়ে যায়। বমি বমি পায়। মাথা ঝিম ঝিম করে। আর প্রচুর ক্ষুধা লাগে। তোহার পাশে ঘুমালে ও এসব টের পেয়ে যাবে। তাই শিউলি তোহার সাথে ঘুমাতে চাইতো না। শিউলির ধারণা তোহা যদি জানতে পারে সে প্র্যাগনেন্ট তাহলে বাজে মেয়ে ভেবে ঘর থেকে বের করে দিবে। শিউলির যাওয়ার জায়গা নেই। তাই সে কাউকে ব্যাপারটা বুঝতে দিতে চায়নি। প্রতিদিন রাতে তোহা ঘুমানোর পর শিউলি বিছানা থেকে উঠে যেতো৷ ফ্রীজ থেকে খাবার বের করে লুকিয়ে লুকিয়ে খেতো। আমীর অবশ্য তখন জেগেই থাকতো। সে শিউলিকে খেতে দেখলেও কিছু বলতো না। শিউলি মাঝে মাঝে ভদ্রতার খাতিরে আমীরকে বলতো,
” ভাইজান, চা খাইবেন? কফি বানায় দেই?”
আমীর সবসময় নিষেধ করতো। আর বিরক্ত হয়ে বলতো শিউলি যেন ওর ঘরে না আসে। একদিন আমীর সন্দেহবশত শিউলিকে প্রশ্ন করেই ফেললো,
” তুমি কি প্র্যাগনেন্ট?”
শিউলি তখন কাঁদতে কাঁদতে আমীরের পায়ে পড়ে গেল। আমীর হতভম্ব এবং একইসাথে বিরক্ত হলো। বললো,
” আরে কি করছো? পা ছাড়ো।”
শিউলি মিনতি করে বললো,” আপুরে এই কথা বলবেন না ভাইজান। আপু জানতে পারলে আমারে বাইর কইরা দিবো। ”
” তোহা তোমাকে বের করে দিবে কেন? এটা তো কোনো অপরাধ না।”
” অপরাধ না আমিও জানি। তাও কইবেন না। আমি এতিম মাইয়া। আমারে তাড়ায় দিলে যামু কই? কসম লাগে ভাইজান, আপনি এই কথা আপুরে কইবেন না।”
” উফফ, আচ্ছা বলবো না। তুমি কান্নাকাটি বন্ধ করো।”
আমীর এরপরেও ভেবেছিল তোহাকে ঘটনা বলবে। শিউলির কাছ থেকে সে শুনেছে, মেয়েটাকে রেপ করা হয়েছিল। তখন সে রেপ কি সেটাই বুঝতো না। তাও একবার না, ওকে প্রতিদিন রেপ করা হতো। বাচ্চাটা সেখান থেকেই এসেছে। বাচ্চার বাবা কে শিউলি জানেনা। খুবই দুঃখজনক সেই ইতিহাস। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই আরেকটা ঘটনা ঘটলো। আমীর কৃত্রিম নিউরন নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিল। তার ঘরের ড্রিম লাইট সবসময় জ্বালানো থাকে। শিউলি তখন আমীরের ঘরের আশেপাশে পায়চারী করছিল। আমীরের রুমের ফ্যান ফিউজ হয়ে যায়। আমীর ফ্যানটা সিলিং থেকে খুলে পরিষ্কার করতে লাগলো। শিউলি এ অবস্থা দেখে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে এসে বললো,
” ভাইজান পাংখা করি? আপনি ঘাইমা যাইতাসেন।”
আমীর ভীষণ বিরক্ত হলো। হালকা ধমক দিয়ে বললো,
” আমি বলেছি তোমাকে? লাগবে না যাও।”
” চা খাইবেন ভাইজান? বানাই?”
” না।”
” ঠান্ডা কিছু খাইবেন? শরবত? ”
আমীরের এতো রাগ উঠলো… এমনি অসহ্য গরম তার উপর মেয়েটা শুরু করেছে ঘ্যানঘ্যান। আমীর ময়লা পানির মগটা শিউলির দিকে ছুড়ে বললো,
” কথা কানে যায়না? সামনে থেকে যাও।”
শিউলি চমকে উঠলো। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমীর একটু পর দেখলো শিউলি জামা-কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকছে। তার কিছুক্ষণ পরই তোহার চিৎকার, কান্নাকাটির আওয়াজ। আমীর তাড়াহুড়ো করে ছুটে গেল। তোহা শিউলিকে খুঁজতে বাহিরে যেতে চাইছিল। রাগে ওর হাত-পা কাঁপছে। আমীর ভাবলো এই অবস্থায় তোহা চিৎকার চেচামেচী করলে ওর অবস্থা আরও খারাপ হবে। তার উপর শিউলি এখন গোসলে ঢুকেছে৷ তোহা যদি জিজ্ঞেস করে ও এইসময় কেন গোসল করছে শিউলি নিশ্চয়ই বলবে আমীর ওর উপর ময়লা পানি ফেলেছিল। তোহা এমনিই সন্দেহ করছে। রিম্মি ওর কানে বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। দরকার কি এতো ঝামেলার? আমীর তোহাকে বের হতে দিচ্ছিল না। তখনই হঠাৎ শিউলি মাথায় তোয়ালে পেচিয়ে রুমে আসলো। আমীরের খুব জিদ উঠলো শিউলির উপর। ইচ্ছে করলো থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ভেঙে ফেলতে মেয়েটার। তোহা দুজনের দিকেই সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো। শিউলি খুব স্বাভাবিকভাবে বললো,
” ডাকসিলেন নাকি আপু?”
তোহা ক্ষীণ গলায় বললো,
” কিছু না যাও।”
” আইচ্ছা।”
শিউলি চলে গেল। আমীর কিছু বলতে যাবে তোহা ওকে থামিয়ে বললো,” প্লিজ চলে যান এখান থেকে। আমার কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে না।”
আমীর বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই তোহা হুড়মুড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে এলোপাথাড়ি বমি শুরু করলো।
শিউলি এখনো কাঁদছে। তোহা শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ তার কি করা উচিৎ? শিউলির জন্য অর্ধেক মায়া লাগছে অর্ধেক ঘৃণা লাগছে। মিশ্র এক অনুভূতি। মেয়েটা তখন এতোবড় মিথ্যে কেন বলতে গেল? রেপের কাহিনি তোহাকে বলতে নাকি ওর ভয় লাগছিল। এজন্য আমীরকে নিয়ে এত জঘন্য মিথ্যে বলবে? আমীরের সাথে কি দূর্ব্যবহারটাই না করেছে তোহা। এখন ওর কাছে কিভাবে ক্ষমা চাইবে? ওকে মুখ দেখানোর সাহসটাও তোহার নেই!
চলবে