#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৩৮
লিখা: Sidratul Muntaz
তোহা সত্যিই সেদিনের পর থেকে আমীরের সামনে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তারা একই বাসা থাকে কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বলে না। আমীর দ্বিতীয় বেডরুমে সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে থাকে। তোহাও নিজের মতো তার ঘরে থাকে৷ দুজনের মাঝে আলাদা একটা দেয়াল উঠে গেছে৷ মনে হয় যেন দুজন দুই জগতের বাসিন্দা। তোহা এখন আর আমীরকে ব্রেকফাস্ট, ডিনার বা লাঞ্চের জন্য ডাকাডাকি করে না। শিউলি আমীরকে খাবার বেড়ে দেয়। তখন তোহা নিজের ঘরে দরজা আটকে বসে থাকে৷ আবার তোহা যখন ঘর থেকে বের হয়, আমীর দরজা আটকে দেয়। একজন আরেকজনের মুখ দেখাও বরাবরের মতো বন্ধ করে দিয়েছে। শিউলি এ বাসায় এসে প্রথম যে দৃশ্যটি দেখেছিল, তোহা আমীরকে যত্ন করে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে সেরকম মায়াবী দৃশ্য আর কখনো দেখা হয়না। আচ্ছা শিউলির জন্যই কি ওদের মাঝে দূরত্ব তৈরী হয়েছে? শিউলির একথা ভেবে কান্না পায়। তার জন্য দুটো ভালোবাসার মানুষ আলাদা হয়ে গেল। সে খুব স্বার্থপরের মতো কাজ করেছে। রিম্মির কথা শুনে আমীরের নামে মিথ্যে বলা উচিৎ হয়নি। তোহার কাছে অবশ্য কিছু সত্যি স্বীকার করেছিল শিউলি। কিন্তু এর আগে তোহা আমীরের সাথে যে দূর্ব্যবহার করেছে সেজন্য হয়তো আমীর তাকে এখনো ক্ষমা করেনি। এসব নিয়েই হয়তো ওদের মধ্যে ঝামেলা চলছে। ওদের মুখ দেখাও বন্ধ হয়ে গেছে। আমীরের বিষয় শিউলি জানেনা কিন্তু তোহা যে খুব কষ্ট পাচ্ছে সেটা শিউলি ভালোমতোই বুঝতে পারে। তোহার কষ্ট শিউলিরও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তোহা আপু ভাইজানকে কত ভালোবাসে সেটা তো সে নিজের চোখেই দেখেছে। আমীর ঝাল খেতে পারেনা তাই রান্নার সময় তোহা কড়াভাবে নিষেধ করে তরকারিতে ঝাল দিতে। মাছের গন্ধ আমীরের সহ্য হয়না। কিন্তু তোহার মাছ খুব পছন্দ। মাঝে মাঝে লাভলী তোহার জন্য মাছ রান্না পাঠায়। কখনো কাচা মাছও পাঠায়। সেই মাছ ধরার পর শিউলিকে কমপক্ষে পাঁচবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয়। যেন আমীরের খাবারে মাছের গন্ধ না করে। আমীরের খাওয়ার প্লেট একদম চকচকে ঝকঝকে পরিষ্কার রাখতে হয়। একফোঁটা হলদে দাগ থাকলেও ওই প্লেটে সে খেতে পারেনা৷ এজন্য তোহা সকাল বিকাল আমীরের প্লেট যত্ন করে ধোয়। অথচ লাভলীর কাছে শিউলি শুনেছিল বিয়ের আগে তোহা ভিমবারের গন্ধ শুনলেই বমি করে দিতো৷ সেই মেয়ে এখন সকাল-বিকাল ভিমবার দিয়ে প্লেট মাজে। আমীর ঠান্ডা পানি ছাড়া খেতে পারেনা৷ তোহা প্রতিদিন নিয়ম করে ফ্রীজে ঠান্ডা পানি রাখে। একদিন শুধু ভুলে গিয়েছিল। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় ফ্রীজে পানি রাখা হয়নি। আমীর নাকি সেজন্য সকালে পানিই খায়নি। একথা শুনে তোহা কেঁদে ফেলেছিল। সে অবশ্য প্রায়ই আড়ালে কেঁদে ভাসায়। ওর সেই কান্না, ব্যাকুলতা,আকুলতা সবই ভাইজানের জন্য। শিউলি জানে। আজকে দুপুরে শিউলি গোমরামুখে সোফায় বসেছিল৷ তোহা এসে বললো,
” শিউলি, তোর ভাইজানকে খেতে ডাক। আমি রুমে যাচ্ছি। তরকারিটা গরম করে নিবি। আর ফ্রীজে বরফ আছে। পানির সাথে মিশিয়ে দিবি।”
শিউলি ঘড়ির দিকে তাকালো। আমীর ঠিক দুপুর দুইটায় লাঞ্চ করে। দুইটা বাজতে দশমিনিট বাকি। তোহার কখনো ভুল হয়না। দুইটা বাজার দশ-বিশ মিনিট আগে থেকেই শিউলিকে তাড়া দিতে শুরু করে। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান কাজ এটি। একমিনিট দেরি করলেও অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। আজকে শিউলি ঠিক করেছে সে আমীরকে খাওয়ার জন্য ডাকতে যাবে না। তোহাকেই আমীরের ঘরে পাঠাবে। ওদের মধ্যে কথপোকথন শুরু হওয়া জরুরী। শিউলি হঠাৎ পেটে হাত রেখে ‘ উঁহু’ শব্দ করলো। তোহা বলে,
” তোর আবার কি হলো?”
” আপু, আমার খুব পেটে ব্যথা করতাসে। মাথাটায় কেমন জানি লাগতাসে। অনেকক্ষণ ধইরা মনে হইতাসে বমি আইবো। কিন্তু আইতাসে না। নাড়িভুঁড়িতে খালি মোচড় দিতাসে।”
” বলিস কি? তোর ভাইজানকে খাবার দিতে গিয়ে আবার বমি করে ভাসাবি না তো?”
” কইতে পারিনা আপু। মনে হইতাসে দশমিনিটের মধ্যে বমি আইবো।”
” আচ্ছা বুঝেছি৷ তুই আমার রুমে গিয়ে শুয়ে থাক। একটা পলিব্যাগ হাতে নিয়ে রাখবি। আর বাথরুমের দরজা খোলা রাখবি৷ বমি আসলেই চলে যাবি বাথরুমে৷ ঘর নোংরা করবি না।”
” আইচ্ছা আপু, কিন্তু ভাইজানরে এখন খাইতে দিবো কে?”
” সেটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না৷ তুই যা।”
শিউলি মনে মনে হাসলো৷ কিন্তু উপরে অসুস্থতার ভং ধরে বললো,
” আইচ্ছা আপু, যাইতাসি।”
তোহা আমীরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে লাগলো। দরজায় টোকা দিবে কি দিবে না দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগছে। চোখ বন্ধ করে হৃৎপিন্ডের অদম্য কম্পন উপেক্ষা করে টোকা দিয়েই ফেললো। আমীর বললো,
” কে? শিউলি?”
তোহা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
” শিউলি না। আমি তোহা।”
আমীর ওর দিকে তাকালোও না। কিবোর্ডের বাটন চাপতে চাপতে বললো,
” কি চাই?”
তোহা লক্ষ্য করেছে ইদানীং আমীর সারাক্ষণ কিবোর্ডে টাইপিং করতে থাকে। লেখালেখি শুরু করলো নাকি? তোহা বললো,
” আপনার লাঞ্চ রেডি৷ খেতে আসুন।”
” ক্ষিদে পেলে আমি এমনিই বের হবো। ডাকতে আসার প্রয়োজন নেই। আর শিউলিকে পাঠালেও হতো। তুমি আসলে কেন? আর কখনো আসবে না। সবসময় তোমার এই চেহারা দেখতে ইচ্ছে করেনা।”
আমীর রুম থেকে বের হয়ে গেল। তোহার গাল বেয়ে দুই-তিন ফোটা পানি গড়িয়ে মেঝেতে পড়লো। তার মনে হচ্ছে কেউ গলা চেপে ধরে বুক চিড়ে আত্মাটা বের করে আনতে চাইছে। অথবা তার চেয়েও দ্বিগুণ কষ্ট লাগছে। আমীরের পেছন পেছন ডাইনিং টেবিলে গেল তোহা। আমীর রান্না দেখেই বুঝে ফেললো আজকের রান্না তোহা করেছে। আমীর চেয়ারের মাথা মুষ্টিতে ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তোহা বললো,
” বসছেন না কেন?”
” রান্নার চেহারা দেখেই খাওয়ার ইচ্ছে চলে গেছে।”
আমীর চেয়ারটা ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। তোহা জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। মুখে হাত দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমীর বদ্ধ দরজার ওইপাশে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তোহার কান্নার আওয়াজ শুনছে। অচিরেই কখন যেন চোখে পানি চলে আসলো। এতো মায়া লাগে কেন এই মেয়ের জন্য? এর আগে কখনো কারো প্রতি একবিন্দু দয়া-মায়া আসেনি তার। নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট হতে কার্পণ্য করেনি। সবার ক্ষেত্রেই সে নিষ্ঠুর, পাষাণ, কঠিনতম। অথচ তোহা নামের এক সাধারণ মেয়ে কত সহজেই তার পাথরের মতো হৃদয় ভিজিয়ে দিতে পারে। আমীর তোহার সামনে খাওয়ার ইচ্ছে নেই বলেছে ঠিকই, তোহা হয়তো ভাবছে ও খুব বাজে রান্না করে বলে আমীর খায়নি। কিন্তু তোহা জানেনা, যত্ন করে সে যদি আমীরের জন্য বিষও রাধে, আমীর সেটা অমৃত ভেবে অনায়াসে খেয়ে নিতে পারে।
তোহার কান্নার শব্দ আর চেয়ার মেঝেতে পড়ার শব্দ শুনে শিউলি ছুটে আসলো। তোহাকে উঠিয়ে বিছানায় এনে বসালো। তোহা মাথায় হাত রেখে কাঁদতে কাঁদতে প্রশ্ন করলো,
” আচ্ছা শিউলি, সত্যি করে বলতো। আমার চেহারা কি খুব বাজে? যে আমার দিকে তাকানো যায়না? আমি কি খুব খারাপ রান্না করি? যে মুখে তোলা যায়না?”
” ও আল্লাহ! এডি আপনেরে কেডা কইসে আপু? যে কইসে সে পাগল। মাথায় ডিষ্টাপ।”
তোহা চোখ গরম করে তাকালো। শিউলি ভয়ে মুখে হাত দিয়ে বললো,
” সুরি। আমার মনে হয় ভাইজানের মেজাজ সারাখন গরম থাকে তো, তাই ভুলভাল কইয়া ফালাইসে। আপনেরে দেখতে তো আসমানের পরীর মতো। আমার তো মন চায় সারাদিন চায়া থাকি। যখন আপনি গোসল কইরা আসেন আর খাটে বইসা ভিজা চুল শুকান, তখন যে আপনারে কি সুন্দর লাগে আপু। মনে হয় আস্তা একখান তাজা গোলাপ ফুল বিছানায় ফুইট্টা রইসে।”
শিউলি খিকখিক করে হেসে উঠলো। পুনরায় বললো,” আমার তো চোখের পলকও ফালাইতে মন চায়না। খালি মন চায় আপনারে দেখি।”
তোহা চোখ মুছতে মুছতে বললো,” তুই বেশি বেশি বলছিস।”
” কসম লাগে। এক্কেরে সত্যি কইতাসি। আর রান্নার কথা কি কমু? আগে আপনের রান্না আমারও তেমন একটা পছন্দ ছিল না। এইডা সত্যি। কিন্তু এখন আপনের রান্না যেই আপডেট হইসে কেউ একবার খাইলে বার বার চাইবো। বিশ্বাস করেন আপু, আমি সত্যি কইতাসি।”
তোহা হাসার চেষ্টা করে বললো,” ভালো লাগছে না শিউলি। চল কোথাও বের হই। শপিং এ যাবি?”
” শপিং এ? আইচ্ছা।”
যমুনা ফিউচার পার্কের লারিভ শো-রুমের সামনে একটা থ্রিডি পিকচার। সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে শিউলি। ছবিতে মেয়েটার পরনে জামার দিকেই তার নজর। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে সে চিন্তা করছে এতো সুন্দর জামা হয় কিভাবে? তোহা মুচকি হেসে বললো,
” জামাটা পছন্দ হয়েছে শিউলি?”
শিউলি লাজুকমুখে মাথা নাড়লো। তোহা বললো,
” এটা পড়লে আমাকে কেমন লাগবে?”
” আপনেরে তো নরমাল জামাতেই পরীর মতো লাগে। এইডা পড়লে ফুলপরী লাগবো।”
” ইশশ, তেল মারা তো ভালোই শিখেছিস। চল।”
শিউলি হাটতে হাটতে বললো,” তেল মারি নাই আপু, সত্যি।”
তোহা শিউলিকে নিয়ে লারিভের শো রুমে ঢুকলো। একটা সেলস গার্লকে বাহিরের থ্রিডি পিকচারটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” ইজ দিস এভেইলেবল?”
মেয়েটা মিষ্টি হেসে বললো,” ইয়েস ম্যাম। প্লিজ কাম।”
মেয়েটা ওদের আসল ড্রেসের কাছে নিয়ে গেল। তোহা প্রাইজ ট্যাগ খুঁজে দেখলো, দাম বারো হাজার পাঁচশো। মাথায় বাজ পড়লো তোহার। জামাটার এতো দাম হবে সে ভাবেনি। ভেবেছিল হয়তো পাঁচ বা ছয়হাজার হবে। এতো টাকা আপাতত তোহার কাছে নেই। কিন্তু বাবাকে ফোন দিয়ে বললেই পাঠিয়ে দিবেন। তোহা শিউলিকে বললো,
” শিউলি, ড্রেসটা নিয়ে ট্রায়ালরুমে যা। তোর ঠিকমতো ফিট হয় কিনা দ্যাখ।”
শিউলি চোখ দুটো রসগোল্লা সাইজ করে বললো,” এই জামা আমার জন্য আপু?”
” তো কি আমার জন্য? মগা! নে ধর।”
তোহা হ্যাঙ্গার থেকে কামিজ সেটটা খুলে দিল। শিউলি হাতে নিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল৷ সে ভেবেছিল জামাটা তোহা নিজের জন্য দেখছে। কিন্তু আসলে ওর জন্য? তাও এতো দামী জামা! কয়েক মুহুর্তের জন্য যেন শিউলি থমকে গেছে। তোহা বললো,
” তুই গেলি? দ্যাখ আমার মুড চেঞ্জ হয়ে গেলে কিন্তু আর পাবি না। পাঁচসেকেন্ডের মধ্যে না গেলে ড্রেসটা তোর হাত থেকে নিয়ে জায়গামতো রেখে দিবো। তাই সময় থাকতে দৌড় দে!”
শিউলি সত্যি দৌড় দিল। তোহার হাসি পেয়ে গেল। ট্রায়াল রুমে ঢুকে ড্রেস চেঞ্জ করার কথা ভুলে ফ্লোরে বসে কাঁদতে লাগলো শিউলি। এতো ভালো মানুষটাকে সে কিভাবে পারলো ঠকাতে? শিউলির জন্যই তোহার সংসারে এতো অশান্তি। অথচ সে কিনা শিউলিকে শাস্তি দেওয়ার বদলে উপহার দিচ্ছে? খুব বড় মনের মানুষ না হলে এমন কাজ করা যায় না। রিম্মির সব কথা তোহার কাছে স্বীকার করবে শিউলি। জীবনে আর কখনো অন্তত তোহার সাথে মিথ্যে বলবে না সে। তাকে কখনো ঠকাবে না। মরে গেলেও না। এখন থেকে তোহার বিপদে জীবন দিতেও সে প্রস্তুত থাকবে। তোহা দরজায় টোকা দিল,
” এই শিউলি, একটা ড্রেস চেঞ্জ করতে এতোক্ষণ লাগে? তাড়াতাড়ি বের হো না। তোকে কেমন লাগছে একটু দেখি!”
শিউলি চোখমুখ ভালো করে মুছে নিয়ে জামাটা পড়লো। তারপর বেরিয়ে এলো। তোহা অবাক হয়ে বললো,
” ওয়াও, তোকে দারুণ মানিয়েছে শিউলি। তুই যে এতো সুন্দরী সেটা তো আগে বুঝিনি।”
শিউলি আচমকা জাপটে ধরলো তোহাকে। এরপর ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। তোহা চমকে গিয়ে বললো,
” আরে পাগলী, কি হয়েছে?”
চলবে
( বাস্তবে তোহার মতো গৃহকর্ত্রী হয়না। শিউলির মতো গৃহকর্মীও হয়না। শুধু গল্পেই এসব ছাতার মাথা সম্ভব।🙄)