#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৪০
লিখা: Sidratul Muntaz
শিউলি নতুন জামাটা বারবার পড়ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করছে৷ তোহার এসব দেখে খুব হাসি পায়। আনন্দের হাসি৷ এই মেয়েটা ছোট্ট একটা উপহার পেয়েই কত খুশি৷ যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটি সে। শিউলির কথা ভেবে ভালো লাগছে। কিন্তু আমীরের কথা ভেবে চিন্তা হচ্ছে। সে কি পাঞ্জাবীটা পড়বে? যদি না পড়ে তাহলে খুব কষ্ট লাগবে তোহার। আমীর এই মুহুর্তে বাসায় নেই। কখন আসবে সেটা তোহা জানেনা। যখন সে বাসায় আসবে তোহা শিউলিকে দিয়ে পাঞ্জাবীটা আমীরের ঘরে পাঠাবে৷ তার নিজের নাম বলবে না। বলবে বাবা দিয়েছে। মানে জাবিদ সাহেব। উনি বলেছেন শুক্রবারে পাঞ্জাবীটা পড়ে উনার সাথে নামায যেতে। তখন নিশ্চয়ই আমীর আর নিষেধ করতে পারবে না। কিন্তু পাঞ্জাবী পড়া আমীরকে দেখতে হলে শুক্রবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এটা ভেবেই তোহার মনখারাপ হয়ে গেল।
সন্ধ্যায় তোহা চা খাওয়ার জন্য শিউলিকে ডাকে। মেয়েটার কোনো সাড়া নেই। ঘুমিয়ে পড়লো নাকি? শিউলির আবার যেখানে সেখানে হুটহাট ঘুমিয়ে যাওয়ার অভ্যাস। তোহা ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখলো ঠিকই শিউলি কুশন জড়িয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। নতুন জামাটা তার মাথার কাছে ভাজ করা। তোহা জামাটা উঠিয়ে রাখলো। তারপর নিজেই গেল চা বানাতে। চা খেতে খেতে তোহা মোবাইল নিয়ে বসলো। মোবাইলে পুরনো দিনের একটা টিভিশো দেখতে লাগলো। শো এর নাম ‘কোন বানেগা কারোরপতি।’ অনুষ্ঠানের হোস্ট অমিতাভ বচ্চন। সেখানকার একটি প্রশ্ন হলো, Dr. Rib Secant এর পুরো নাম কি? চারটি অপশন দেওয়া আছে। অপশনগুলি এমন, আমীর হোসাইন চোধুরী, খান আমীর হোসাইন, আমীর ইকবাল খান, শাহভীর আমীর হোসাইন খান। গেস্ট লাস্ট অপশন সিলেক্ট করলেন এবং সেটাই সঠিক হলো। তোহা চমকে গেল। চমকানোর কারণ দুইটা। প্রথমত সে রিব সিকেন্টকে চেনেনা। আর দ্বিতীয়ত, শাহভীর আমীর হোসাইন খান তার স্বামীর নাম। এই রিব সিকেন্টের সাথে আমীরের কি কোনো সম্পর্ক আছে? নাকি শুধু নামেই মিল? উত্তর জানতে গুগল সার্চ করলো তোহা। রিব সিকেন্ট , এটুকু লিখতেই ভেসে উঠলো দ্যা গ্রেট সাইন্টিস্ট। তোহার জানামতে আমীর একজন ডাক্তার। কিন্তু এমন ডাক্তারও না যে ওর নাম গুগলে থাকবে। তোহা তবুও নামটিতে ক্লিক করলো। একসাথে অনেকগুলো ছবি আসলো। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো তোহা একটা ছবিও দেখতে পারছে না। অদ্ভুত! সবকয়টা ছবি সাদা। তোহা উইকিপিডিয়াতে গেলো। রিব সিকেন্টের বায়োডাটা পড়লো। উনার জন্ম অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে৷ বাবার নাম, ড.সানাফ সাইফান খান। মায়ের নাম, লায়ভান্টিকা গোমেজ। উনি খ্রিস্টান। রিব সিকেন্টের বয়স ছাব্বিশ। জন্মদিনের তারিখও আমীরের সাথে মেলে। পুরো নামে তো মিল আছেই। তোহার মাথায় সব চিন্তা কুন্ডলী পাকাতে লাগলো। এতো মিল একজনের সাথে আরেকজনের হয় নাকি? রিব সিকেন্টের ছবি দেখতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সে কোনো ছবি দেখতে পারছে না। উত্তেজনায় পায়চারী করতে লাগলো তোহা। কি করবে সে? আমীরকে জিজ্ঞেস করবে? না, দরকার নেই। এই রহস্য সে একাই উন্মোচন করবে। তোহা দ্বিতীয় বেডরুমে মানে আমীরের লঙ্গরখানায় গেল। একটা স্ট্যান্ডারে আমীরের জামা-কাপড় ঝুলছে। টেবিলে কম্পিউটার। বেশ কিছুদিন আগে আমীর কম্পিউটারটা এনেছিল। আমীর বলেছে এটা নাকি তার ফ্রেন্ডের। দুই দিনের জন্য ধার এনেছে। কিন্তু তোহার ধারণা আমীর মিথ্যে বলেছে। এই কম্পিউটার আমীরের নিজের। কিন্তু এটা সে তোহাকে জানাতে চাইছে না। কেন? কিসের এতো লুকোচুরি? আমীর ওর কাছে অনেক কিছুই লুকায়। তোহা সেটা বোঝে, কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে আমীরকে ধরতে পারেনা। আজকে ধরবে। তোহা কম্পিউটারের ডেস্ক, আমীরের শার্টপকেট, ড্রয়ার, ওয়ালেট, এসব সার্চ করতে গিয়ে একটা মূল্যবান জিনিস পেল। আমীরের আইডি কার্ড। বাবা আর মায়ের নামের জায়গায় স্পষ্ট লিখা, ড.সানাফ সাইফান খান আর লায়ভান্টিকা গোমেজ। তোহার হাত-পা শিরশির করে কাঁপছে। মেরুদণ্ড বরাবর হিমশীতল বাতাস প্রবাহিত হয়। এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে আমীরই রিব সিকেন্ট। কারণ দুইজন মানুষের বাবা-মা’র নাম এতো নিখুঁতভাবে মিলতে পারেনা। এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। তোহা বুঝতে পারছে আজ অনেক বড় সত্যি তার সামনে এসেছে। তার এখন কি করা উচিৎ?
রাতে আমীর যখন বাসায় ফিরলো, তোহা দরজা খুলে রোবটের মতো ওর সামনে দাড়িয়ে রইলো। আমীর ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করলো,
” কিছু বলবে?”
তোহা চোখমুখ শক্ত করে তাকালো। আমীর বললো,
” না বললে সামনে থেকে সরো। আই নিড সাম স্পেস।”
আমীর রিলেক্সের একটা নিঃশ্বাস ফেলে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে সামনে এগিয়ে গেল। তোহার শরীর মৃদু কাপছে। সে তীক্ষ্ণ গলায় হঠাৎ বলে উঠলো,
” মিস্টার রিব সিকেন্ট!”
আমীর থমকালো। তোহার দিকে অবাক হয়ে তাকালো। তোহা হাত ভাজ করে বললো,
” দ্যা গ্রেট সাইন্টিস্ট। আমি ঠিক বললাম না?”
আমীর হেসে ফেললো। তোহা হাসি দেখে চমকে গেল। সে কি কৌতুক বলেছে? আমীর হাসছে কেন? তার তো ভয় পাওয়া উচিৎ। কারণ সে ধরা পড়ে গেছে। আমীর খুব বিকট শব্দে হাসছে৷ তোহার কানে সেই শব্দ ধারালো লাগে। মানুষটার হাসি খুব ছন্দহীন। এতো বিছরী কারো হাসির আওয়াজ হতে পারে? তোহা কান চেপে ধরে চিৎকার করে বললো,
” প্লিজ চুপ করুন।”
আমীর সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল। তোহাও কিছুক্ষণ চুপ। হঠাৎ করেই শব্দ করে চেয়ার টেনে আমীরের সামনে বসলো। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বললো,
” অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে আজ আপনাকে। আমি জানি, আমার স্মৃতিশক্তি আমি আপনার জন্যই হারিয়েছি। এখন আমার যে অবস্থা সবকিছুর জন্য আপনি দায়ী। আপনি কি করতে চাইছেন আমাকে নিয়ে? কেনো আমার জীবন তছনছ করে দিচ্ছেন? কি আপনার পরিচয়? আচ্ছা আমি কি আপনার বড় কোনো ক্ষতি করেছিলাম? যার শাস্তি এখন এইভাবে দিচ্ছেন? প্লিজ দয়া করে, দয়া করে এই যন্ত্রণা থেকে আমাকে রেহাই দিন। সবকিছু জানতে দিন প্লিজ। লেট মি ক্লিয়ার এভ্রিথিং। ”
আমীর ধীরপায়ে তোহার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। ধীরে সুস্থেই বললো,
” কি জানতে চাও বলো? সব উত্তর পেয়ে যাবে।”
” আজকে শপিংমলে সামি’র সাথে যেটা হয়েছে সেটা আপনি করেছেন তাইনা?”
আমীর চোখের পলক ঝাকিয়ে, হালকা মাথা দুলিয়ে বললো,” হুম।”
যেন খুব সাধারণ একটা কাজ করেছে সে। ছোট্ট বাচ্চাকে টফি কিনে দেওয়ার মতো সাধারণ। তোহা ফুসতে ফুসতে বললো,
” রগ কাটা শাহয়ের সাথে আপনার কোনো যোগসূত্র আছে?”
” বাংলায় রগ কাটা, ইংরেজিতে রিব সিকেন্ট। একই ব্যাপার।”
তোহা স্তব্ধ হয়ে যায়। ধাক্কা সামলে আবার প্রশ্ন করলো,
” আমি মিতুদের বাসায় যাওয়ার পর কিছু মনে করতে পারছিলাম না। কিন্তু বাসায় আসার পর আমার সব মনে পড়েছে। এখানেও কি আপনার কোনো কারসাজি আছে?”
” তোমার ব্রেইনের কন্ট্রোল আমার হাতে। তুমি কখন কি মনে করতে পারবে আর কি পারবে না, কি ভাবতে পারবে কতটুকু ভাবতে পারবে, সব আমি ডিসাইড করবো। তোমার মর্জিমতো তুমি চলতে পারছো না। সেই ক্ষমতা তোমার হারিয়ে গেছে। এখন তুমি চলছো আমার মর্জিমতো।”
তোহা ভ্রু কুচকায়। বিস্ময়ে নিঃশ্বাস ভারী হতে থাকে। আমীর এসব কি বলছে তাকে? আমীর এতোক্ষণে তোহার অনেক কাছে চলে এসেছে। এবার সে তোহার চেয়ারের পেছনে হাত ঠেকিয়ে তোহার মুখে দিকে ঝুঁকলো। গলা থেকে একটানে সুতোয় বাধা ব্লেড খুলে আনলো। তোহার চোখ দুটো ভয়ে বড় হয়ে যায়। আমীর একাধারে ব্লেডটা তোহার চোখের সামনে ধরে নাড়াতে শুরু করে। একটু পড়েই তোহা জ্ঞান হারালো। আমীর কোলে নিয়ে বিছানায় রেখে দেয়। তোহার নিষ্পাপ মুখশ্রীতে একবার স্পর্শ করে। আজকের পর থেকে এই মুখ আর কখনো দেখা হবে না তার। আমীরের চোখে অশ্রু চলে আসে। সেই অশ্রু গড়িয়ে গড়িয়ে তোহার নাকের ডগায় পরে যেতে নেয়, আমীর আটকায়। তার অশ্রু এতো সস্তা হতে পারেনা।
সকালে তোহার ঘুম ভাঙে সূর্যের মৃদু আলোয়। ঘড়িতে আটটা বাজে। হঠাৎ করেই যেন ঘুমটা ভেঙে গেল। কেউ ডাকেনি, কোনো শব্দ হয়নি তাও। মাঝে মাঝে এভাবে ঘুম ভেঙে গেল ভালো লাগে। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নামার সময় ল্যাম্পটেবিলে হাত লাগতেই একটা খাম খুঁজে পেল তোহা৷ খামটা বেশ সুন্দর। তোহা হাতে নিল, খুললো। ভিতরে একটা চিঠি। কারো লেখা চিঠি না, টাইপ করা চিঠি। প্রথম অক্ষর পড়েই আত্মা কেঁপে উঠলো,
তোহা, তুমি কি জানো তুমি যে খুব আহ্লাদী? শুধু আহ্লাদী না, বড় আদুরে। তাইতো আমার একফোঁটা অবহেলাও সহ্য করতে পারো না। কঠিন হয়ে একটু কিছু বললেই কেঁদে-কেটে নাকের পানি,চোখের পানি সব এক করে ফেলো। এতো আহ্লাদ কেনো তোমার? এতো কেনো কাঁদতে হয়? কাঁদো তুমি, কিন্তু কষ্ট হয় আমার। অদ্ভুত না? আসলেই অদ্ভুত। তুমি আমার জীবনে আসার পর থেকে এমন বহু অদ্ভুত অদ্ভুত অনুভূতির সাথে আমি পরিচিত হয়েছি। যেগুলো আগে কখনো হয়নি। মাঝে মাঝে তোমার কান্ড দেখে হাসি পেতো। কত কষ্ট করে যে হাসি আটকাতাম সেই গোপন যুদ্ধের কথা শুধু আমিই জানি। মনে মনে তোমার একটা নাম দিয়ে ফেলেছিলাম। কি জানো? কোমলমতী আহ্লাদী। কিন্তু এই নামে তোমাকে ডাকার সৌভাগ্য কখনো হয়নি। আমি চাইনি তুমি আমার মায়ায় পড়ে যাও। মনে মনে কিন্তু তোমাকে আহ্লাদী বলেই ডাকতাম। আমার কোমলমতি আহ্লাদী। আমি মানুষ হিসেবে খুবই খারাপ। শুধু ধোঁকা দিয়ে তোমার বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি বিশ্বাসের সাথে সাথে অমূল্য এতো ভালোবাসা কেন দিতে গেলে? এতো ভালোবাসার যোগ্য তো আমি না। শুধু চেয়েছিলাম কৃত্রিম স্বামী সেজে অল্প কিছুদিনের জন্য তোমাকে ব্যবহার করতে। শুনতে খুব খারাপ লাগে তাইনা? অথচ তুমি আমাকে নিজের মনের মালিকানা দিয়ে বসলে। খুব বোকা তুমি। এতো বোকা হতে নেই মেয়ে! এতো অবুঝ হতে নেই। বিশ্বাস করো তোমাকে কখনো নিজের মায়ায় জড়াতে চাইনি। অথচ দেখো, আমি নিজেই তোমার সরলতার মায়ায় আটকে গেছি। ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছি তোমার সাথে। তোমার দুষ্টমী, হাসি, কান্না, আহ্লাদ করে কথা বলা, সবকিছুতে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে। এখন যে তোমাকে চিঠিটা লিখছে, সে শুধুই তোমার স্বামী। আহ্লাদী তোহার স্বামী। যদিও আমাদের বিয়েটা মিথ্যে ছিল। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাও মিথ্যে। কিন্তু মনের আত্মিক সম্পর্ক? সেটাও কি মিথ্যে? বিয়ে ছাড়া কি হৃদয়ের বন্ধন তৈরী হতে পারেনা? এটা আমি অন্তত মানিনা। যদি আমাদের মনের বন্ধনই না থাকে তাহলে তোমার জন্য আমার বুক পাজরের এতো অদ্ভুত টান কেন? বুকের এই অবাধ্য ঝড়ের উৎস কি? কেন এতো চিনচিনে যন্ত্রণা বুকের বামপাশে? বলতে পারো? শুধু এই ভয়েই তোমাকে বিয়ে করিনি। তবুও ভয়টা সত্যি হয়ে গেল। তুমি এতোই জাদুময়ী যে তোমাকে ভালো না বেসে থাকাই যায়না। আমি আমার সবটুকু হারিয়ে ভালোবেসে ফেললাম তোমাকে। তবুও কেন আমাদের মিলনে এতো বাধা? জানতে চাও? আমি যে শুধুই তোমার স্বামী না তোহা। খুব ভালো হতো যদি শুধুই তোমার স্বামী হয়ে থাকতে পারতাম। কিন্তু এর বাহিরে আমার অন্য একটা পরিচয় আছে। একটা আলাদা সাজানো জগৎ আছে। যে জগতে মন বলে কিছু নেই। সেখানে আছে শুধু স্বার্থের খেলা। উপযুক্ত কারণ ছাড়া সে জগতের একটা বিন্দুও এদিক-সেদিক হয়না। তোমাকে আমার ভালোবাসার কথা ছিল না। তবুও আমি ভালোবেসেছি। কোনো স্বার্থ ছাড়াই ভালোবেসেছি। এই ভালোবাসার দাম নেই সে জগতে। আমি ওই জগতের স্থায়ী বাসিন্দা। তাই তোমার স্বামী হয়ে সারাজীবন তোমাকে ভালোবাসার ক্ষমতা আমার নেই। আমি তো স্বার্থবাজ স্বামী। আমার স্বার্থের খেলা শেষ। তাই এই ভালোবাসা তোমাকে ভুলতে হবে। মনের দুই গোপন সত্তার সাথে যুদ্ধ করে এতোদিন বেঁচে ছিলাম আমি। সেই যুদ্ধে যেকোনো একসত্তাকে তো হারতেই হতো। তোমার স্বামী নামক সত্তাটি যুদ্ধে হেরে গেছে তোহা। সত্যিই আমি হেরে গেছি। কারণ আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছি। যতদিন পর্যন্ত মন থেকে আমার মৃত্যু মানতে না পারবে ততদিন তুমি ভালো থাকবে না। তাই তোমাকে অবশ্যই মানতে হবে। আমি চাই তুমি ভালো থাকো এবং সেটা অবশ্যই আমাকে ছাড়া। আমি চাইলেই পারতাম আমাদের সংসার জীবনের চমৎকার সুন্দর মুহুর্তগুলোর সমস্ত স্মৃতি তোমার ব্রেইন থেকে মুছে দিতে। কিন্তু সেটা হয়তো আমি নিজেই মানতে পারতাম না। আমাকে সম্পূর্ণ ভুলে তুমি সুখে থাকবে আর আমি সারাজীবন অসহ্য সন্তাপের আগুনে দগ্ধ হবো? এটা কিছুতেই হয়না। আমি খুব হিংসুটে তোহা। খুব লোভীও। তাই মৃত্যুকে বরণ করে সারাজীবন তোমার ভালোবাসা পাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি তোমার মনের কোনো এক ছোট্ট কোণ জুড়ে আজীবন বেঁচে থাকতে চাই। বড়ই অর্থহীন চাওয়া। তাও আমি চাই। তুমি ভালো থেকো তোহা। নতুনভাবে সবকিছু শুরু করো। আর আমাকে কখনো ক্ষমা করোনা। তোমার নরম হৃদয় যে ধারালো খঞ্জরের আঘাতে জঘন্যভাবে রক্তাক্ত করেছে তাকে এতো সহজে ক্ষমা করা কি উচিৎ? একদম উচিৎ না। এই অনুচিত কাজটি তুমি কক্ষনো করবে না। তোমার বদভ্যাসের অভাব নেই। এই বদভ্যাসগুলো শুধরে নিও। রাতে ঘুমানোর সময় প্রায়ই উল্টো হয়ে যাও তুমি। উল্টো হয়ে ঘুমানো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কতবার যে তোমাকে টেনে সোজা করেছি। তোমার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করেছি। তোমাকে ভেবেই রাত কেটে যেতো। ভোর হতো, কিন্তু আমার মনের তৃষ্ণা মিটতো না। ঘুমের মাঝে ভুল-ভাল বকে যাও। তোমার সেই বকা আমার কাছে স্বর্গীয় সুখের মতো সুন্দর। বাচ্চা একটা মেয়ে তুমি, এখনো শাড়িটাও সামলাতে শেখোনি। ঘুমন্ত অবস্থায় তোমার এলোমেলো শাড়ি কয়বার যে ঠিক করে দিয়েছি তার হিসেব নেই। কিন্তু বিশ্বাস করো, কখনো কুনজর দেইনি তোমার পবিত্রতায়। যে পবিত্র অঙ্গে আমি কখনো স্পর্শ দেওয়ার সাহস করিনি সেখানে অন্যকারো কলুষিত হাতের ছোয়া মেনে নেই কি করে? এটা অত্যন্ত কঠিন ধৈর্য্যের পরীক্ষা আমার জন্য। সেই ধৈর্য্যের পরীক্ষায় আমি হেরে গেছি বলেই নিয়াজ আর সামির পরিণতি এতো ভয়ানক। তুমি কি ওদের জন্য কষ্ট পাও? তাহলে তো আমার জন্যও কষ্ট পাওয়া উচিৎ। ওদের চেয়ে বেশি যন্ত্রণা তো আমি ভোগ করেছি। ওদের শারীরিক কষ্টগুলো তুমি নিজচোখে দেখেছো। কিন্তু আমার ক্ষত-বিক্ষত মনের বিষাক্ত যন্ত্রণাগুলো কি দেখেছো? যদি দেখাতে পারতাম, তাহলে বুঝতে কত তিক্ত যাতনা নিয়ে তোমার জন্য এই বিদায় চিঠি লিখছি। ভাগ্যিস আমাদের বিয়েটা মিথ্যে ছিল। যদি সত্যিই তোমাকে বিয়ে করতাম তাহলে অধিকারের তাগিদে হলেও কখনো না কখনো হয়তো ছুঁয়ে ফেলতাম। আমার ছোঁয়ায় তুমি কলঙ্কিনি হতে। ভালোই হয়েছে, আমাদের সত্যিকারের বিয়ে হয়নি। কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসাটা কেনো হলো? কেন তুমি আমায় ভালোবাসলে?কেনো আমি তোমার মোহে অন্ধ হলাম? কেনো? এই কেনো’র উত্তর নেই। আর নেই বলেই আজ এতো সমস্যা। তুমি ভালো থেকো তোহা। এখন থেকে আর কাঁদবে না। কারণ তোমাকে কাঁদানোর জন্য আমি থাকবো না৷ সবসময় হাসবে। তোমার হাসি খুব সুন্দর। যদিও সেই কমনীয় হাসি দেখার জন্য আমি আর নেই। ভালো থেকো আমার কোমলমতী আহ্লাদী। অনেক ঠকিয়েছি তোমায়, সেজন্য এই অধমকে কখনো ক্ষমা করো না।
তোমার স্বার্থবাজ মিথ্যাবাদী স্বামী।
চিঠি শেষ হওয়ার পর তোহা তিনবার জোরে জোরে চিৎকার দিল। সে জানেনা তার কেমন লাগছে। এই অনুভূতি অজানা, অবাধ্য, অস্থির। তোহা ঘরের একোণ থেকে ওইকোণ ছটফট করে দৌড়াতে লাগলো। আমীরের মৃত্যু। উফফ, আর ভাবা যাচ্ছে না। সারামাথা ফাঁকা হয়ে গেছে। সব অনুভূতি মরে যাচ্ছে। হৃদয়টাকে লোহা মনে হচ্ছে। প্রত্যেকটা লোমকূপে যেন উত্যক্ত শিখা জ্বলজল করছে। ভীষণ যন্ত্রণা লাগছে, ভীষণ! তোহা গা চুলকাতে থাকে। হঠাৎ করেই শিউলির আগমন। পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা আর্তনাদ করতে লাগলো,
” আপু, আপু গো। ভাইজান আর নাই। ভাইজান আত্মহত্যা করসে…”
তোহা ঠাস করে শিউলির ডানগালে চড় দিল। তারপর বামগালে আবার একটা চড় দিল। তারপর আচমকা পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে মেঝেতে বসে গেল। একবার হাটু জড়িয়ে ধরলো। আরেকবার মেঝেতে হাটু বিছিয়ে দিল। আরেকবার নিজের চুল খামচে ধরল। শিউলি দুইগালে চড় নিয়ে মেঝেতে বসে ফুপিয়ে কাঁদছে। আর অসহায় চোখে তোহার অবস্থা দেখছে। এমন ভয়ানকভাবে ছটফট করছে কেন তোহা আপা? ছটফট করতে করতে তার দমটা চলে যাবে না তো? ভাইজানকে বড্ড বেশি ভালোবাসে সে। এতোবড় শক সে কিভাবে নিবে? হঠাৎ করে আমীরের মৃত্যুর খবর তোহাকে দেওয়া ঠিক হয়নি। কিন্তু এছাড়া আর কি উপায় ছিল শিউলির? ওই রুমে আমীরের রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে আছে। গলা দিয়ে রক্ত বের হতে হতে সব জমাট বেধে গেছে। নিজের গলার ঝুলন্ত ব্লেড দিয়ে নিজের গলার শিড়া কেটে কেউ আত্মহত্যা করতে পারে? এতো ভয়ংকর আত্মহত্যার নিদর্শন শিউলি এর আগে কখনো দেখেনি। প্রথম দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। তারপর জ্ঞান ফিরতেই তোহার রুমে এসে কাঁদতে কাঁদতে কথাটা বলে ফেলে। আর তোহা এখন কি করছে? নিজের মুখের চামড়া খামচাতে খামচাতে নিজেকেই রক্তাক্ত করে ফেলছে! আর বিকটভাবে চিৎকার দিচ্ছে। শিউলির হঠাৎ মনে হলো তোহাকে এখনি আটকানো উচিৎ। সে দৌড়ে যায় তোহার কাছে।
( এটা কোনো দুঃস্বপ্ন না।)
চলবে