ধূসর রঙে আকাশ পর্ব_৬০

0
1644

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৬০
লিখা: Sidratul Muntaz

নীলাভ্র হসপিটালের করিডোরে বসে আছে। ওর শরীর ঘামছে। তিলোত্তমা অটিতে ভর্তি। অপারেশন শুরু হয়েছে। আজকের মধ্যেই বাচ্চা ডেলিভারি হবে। মাত্র সাতমাস, এর মধ্যেই রিস্ক নিয়ে ডেলিভারি করাতে হচ্ছে। তিলোত্তমা জীবননাশক বড়ি অনেকগুলো একসাথে খেয়েছিল৷ সুইসাইড করতে চায় সে। তোহার বিয়ের অনুষ্ঠান চলাকালীন এই খবর পেয়ে নীলাভ্র আর মারুফা ইয়াসমিন হসপিটালে ছুটে আসলেন। ডাক্তার বলেছে যেকোনো একজনকে বাঁচানো সম্ভব। তিলোত্তমার মা-বাবা শুধু তাদের একমাত্র মেয়েকেই ফেরত চান। ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছেন দুজনেই। এদিকে মারুফা ইয়াসমিন হতাশ হয়ে আছেন মৃত সন্তানের অনাগত চিহ্নকে বাঁচাতে। উনি উনার নাতিকে যে কোনো অবস্থাতেই সুরক্ষিত দেখতে চান। তাই ডাক্তারকে অনুরোধ করেছেন যেনো বাচ্চাকে বাঁচানো হয়। সেজন্য আলাদা করে হসপিটালে টাকাও দিয়েছেন। এসব নিয়ে দুই-পক্ষের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। এখনও সেই ঝগড়া অব্যাহত আছে। নীলাভ্র এই মুহুর্তে জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। তার মনে হচ্ছে সে গভীর সমুদ্রে আছড়ে পড়েছে। যেদিকে তাকায় শুধু পানি আর পানি। কোনো কুল-কিনারা নেই। সে জানে না কি কারণে শুধু রিম্মির চেহারা তার চোখের পর্দায় ভাসছে। নীলাভ্রর চোখ ভিজে যাচ্ছে। ঘণ্টাখানেক পর ডাক্তাররা অটি থেকে বের হয়ে হাসিমুখে জানালেন, মা ও বাচ্চা দু’জনেই সুরক্ষিত আছে৷ একটা ফুটফুটে ছেলে বাচ্চা হয়েছে। মারুফা ইয়াসমিন দুইহাত মোনাজাতের মতো তুলে চিৎকার করে আনন্দিত গলায় বললেন,
” আলহামদুলিল্লাহ,আলহামদুলিল্লাহ! আমার নিবরাস ফিরে এসেছে!”

হাতে আছে মাত্র তিনমিনিট চুয়াল্লিশ সেকেন্ড সময়। তোহার ফরসা মুখে এখন রক্তিম আভা। পেট ফুলে যাচ্ছে। চোখ দুটো মনে হয় এখনি কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে৷ ভয়ংকর লাগছে দেখতে! প্রিয়জনের এতো কঠিন মৃত্যু সামনে থেকে দেখার সাধ্য এ পৃথিবীর কারো নেই। আমীর সহ্য করতে পারছে না। দুইহাতে শুধু কারাগারের লোহা ঝাকাচ্ছে। ওর দম আটকে আসছে। মনে হচ্ছে তোহার আগে ও নিজেই মরে যাবে। পানিতে দম আটকে থাকতে কতই না কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। আমীর কি পারে না ওকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে? কিন্তু কি করবে সে? তার হাত-পা সত্যিই বাধা। নিজেই কারাগারে বন্দী। আগে তো নিজেকে মুক্ত করতে হবে, তারপরেই না তোহাকে বাঁচানো সম্ভব। দুইপাশে পিলারের মতো রোবট দাঁড়ানো। হাসাদ চলে যাওয়ার সময় ওদের পাহারাদার হিসেবে রেখে গেছে। এখন ওদের কাজ হলো তোহা মরে যাওয়ার পর ওর লাশটা এক্যুরিয়াম থেকে বের করে যথাস্থানে সরিয়ে রাখা। তোহার পর ওদের নেক্সট টার্গেট হয়তো আমীর। আমীর এখন নিজের পরিণতি নিয়ে ভাবছেও না। তোহাকে বাঁচানোর জন্য ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফট করছে তার হৃদয়টা। যেকোনো মূল্যে তোহাকে বাঁচাতে হবে। তোহার এই নির্মম মৃত্যু হাত গুটিয়ে দেখার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। আমীর সিদ্ধান্ত নিল তোহাকে যদি বাঁচাতে না পারে তাহলে সে নিজেও বাঁচবে না। আমীর গলায় বাধানো ব্লেডটা টেনে খুললো। তার উদ্দেশ্য ছিল নিজেকে আঘাত করা। কিন্তু সেটা করলো না। মস্তিষ্কে অন্য একটা চিন্তা চলে আসলো। মস্তিষ্ক গবেষক আমীর স্টিলের এই ব্লেডটি দিয়ে যেকোনো মানুষকে হিপনোটাইজ করার ক্ষমতা রাখে। মানুষের মতো একইভাবে রোবটদেরও কি হিপনোটাইজ করা সম্ভব? আমীর এর আগে কখনও চেষ্টা করেনি। কারণ প্রয়োজন পড়েনি। রোবটের মস্তিষ্ক আর মানুষের মস্তিষ্ক তো এক না। তাছাড়া এই রোবট ফোর্স আমীরের তৈরী না, হাসাদের তৈরী। তাই ওদের কন্ট্রোল করার পদ্ধতি আমীরের জানা নেই। হাসাদের জানা থাকবে হয়তো। হাসাদও একজন মানুষ। আমীর যদি হাসাদকে হিপনোটাইজ করতে পারে তাহলে রোবটদেরও পারবে। হাসাদ জেনে-শুনে আমীরের ফাঁদে কখনওই পা দিবে না। কিন্তু রোবটরা দিতে পারে কারণ ওদের তো চিন্তা করার ক্ষমতাই নেই। আমীর প্রথমে রোবটগুলোর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টায় জোরে লোহার গ্রিলে লাথি দিল। সবকয়টা রোবট মাথা ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায়। ডানে তিনজন, বামে তিনজন। মোট ছয়জন। প্রত্যেকের হাতে রাইফেল। আমীর শুরু করলো নিজের কাজ। সুতোযুক্ত ব্লেড সামনে ধরে ডানে-বামে স্প্রিং এর মতো নাড়াতে লাগলো। রোবটদের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। ওরা আমীরের দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকালো। আমীর হতাশ হয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। সে কি করছে এসব? রোবটগুলো তো চোখেই দেখতে পায়না। তাহলে ব্লেডের দোল খাওয়া দেখে ওরা কিভাবে হিপনোটাইজ হবে? আমীরের চিন্তা-শক্তি কি লোপ পাচ্ছে? পাওয়ারই কথা! আর মাত্র দুইমিনিট সাতসেকেন্ড। আমীর তোহার দিকে তাকালো। তোহার চোখ দু’টোয় যেন রাশি রাশি বিশ্বাস। আমীর তাকে বাঁচাবে, এই ভরসাতেই সে হাত-পা নাড়িয়ে চলেছে অবিরত। আমীর অসহায়চোখে চেয়ে দুইহাত ক্ষমা চাওয়ার মতো তোহার সামনে ধরলো। নিজের মনেই বললো,
” আমাকে ক্ষমা করো তোহা। তোমার জন্য আমি কিছুই করতে পারছি না৷ সারাজীবন তোমাকে শুধু কষ্ট দিয়ে গেলাম৷ আমার জন্যই তোমাকে এই কঠিন মৃত্যু ভোগ করতে হচ্ছে। নিজের কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ আমার নেই৷ তাও তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। আমি জানি, আমি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য না।”
তোহা দুইহাত দুইপাশে সরিয়ে শুধু কাতরাচ্ছে। একফোঁটা নিঃশ্বাসের জন্য হাসফাস করছে। তোহার এমন করুণ দশা সহ্য করার চেয়ে মৃত্যুই কি সহজ না?তোহার জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে আমীর নিজেকেই নিভিয়ে দিতে চায়। তোহাকে রক্ষা করতে না পারার অসীম অপরাধবোধ নিয়ে সারাজীবন বাঁচার ইচ্ছে তার নেই। পারবে না সে বাঁচতে! নিঃশ্বাস নিতে আবারও প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। হাতের ব্লেডটা একটু দূরে ছুড়ে ফেললো আমীর। আর কিছুই ভালো লাগছে না। লোহার রডের সাথে ব্লেড লেগে টুং করে শব্দ হলো। এই ঠুনকো শব্দেই সবকয়টি রোবট ঘুরে তাকায়। আশেপাশে শব্দের উৎস খুঁজছে তারা। এই ঘটনা দেখে আমীরের মাথায় দ্বিতীয় বুদ্ধি আসলো। রোবটরা চোখে দেখতে পায়না ঠিক, কিন্তু অতি সূক্ষ্মতর শব্দ ওরা শুনতে পায়। যদি কোনো নিয়মিত শব্দের সুর ওদের ব্রেইনে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তাহলে ওরা সহজেই হিপনোটাইজ হতে পারে। তখন হয়তো ওদের নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব। আমীর মেঝেতে পড়ে থাকা ব্লেডটা তুলে নিল। এই ব্লেড দিয়ে এখন সে লোহার রড ঘষবে। তার হাতের আঙুলগুলো কাঁপছে। ভীষণ হতাশ লাগছে। যদি এই কৌশলও কাজ না করে তাহলে তোহাকে বাঁচানোর আর কোনো পথ থাকবে না। আমীর ঠান্ডা মাথায় ধীরে-সুস্থে কাজ চালিয়ে যেতে লাগলো। ও একহাতে ব্লেড নিয়ে লোহা ঘষছে কিন্তু ওর দৃষ্টি তোহার এক্যুরিয়ামে রাখা স্টপওয়াচে। আস্তে আস্তে সময় কমছে। আমীরের হৃৎপিন্ড একটা করে বীট মিস করছে। মনে হচ্ছে শক্ত হাতে কেউ ওর ফুসফুসটা চেপে ধরে রেখেছে। এই বুঝি তোহাকে হারিয়ে ফেললো সে! এতো দ্রুত সময় কেনো চলে যাচ্ছে? এই সময় আটকানোর কি কোনো উপায় নেই? একটু পরেই আমীরের ঘোর কাটলো যখন সে দেখলো সবকয়টি রোবট মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। ওরা এলোমেলোভাবে একে-অপরের উপর হেলে পড়েছে। এখন ওরা যথেষ্ট সংবেশিত। আমীর শান্তগলায় নির্দেশ করলো,
” আনলক দ্যা প্রিজন।”
আমীরের ভোকাল কর্ড কাঁপছে। তার ইন্সট্রাকশন রোবটরা শুনবে তো? সত্যিই শুনলো একজন। একটা রোবট এগিয়ে এসে কারাগারের লক খুলছে। শুধু হালকা হাতে একবার স্লাইড করতেই লক খুলে গেল। আমীর দাঁড়িয়ে বললো,
” নাউ লেট মি ফ্রী।”
রোবটটি আমীরের হাতের বাধনও খুলে দিল। আমীর মুক্তি পেয়েই তোহার কাছে ছুটে আসলো। প্রথমে কাচের বাহিরে থেকে তোহাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করলো। এখান থেকে কিভাবে বের করবে তোহাকে? সম্পূর্ণ কাচ আবদ্ধ। কোথাও কোনো উৎস নেই যে উৎসের মাধ্যমে ভেতরে যোগাযোগ সম্ভব। তাহলে তোহাকে এর ভিতরে কিভাবে বন্দী করলো হাসাদ? রোবটদের জিজ্ঞেস করলেই হয়। এখন ওরা যে অবস্থায় আছে আমীরের প্রশ্নের সঠিক জবাব নিশ্চয়ই দিবে। তাই আমীর পেছনে ঘুরে রোবটগুলোর উদ্দেশ্যে বললো,
” হাউ টু ওপেন দিস স্টাফ?”
একটা আবেশিত রোবট উত্তর দিল,” দেয়ার ইজ কারেন্টলি নো ওয়ে টু ওপেন ইট। হোয়েন দ্যা গার্ল ডাইস, শী উইল বি ফ্রী।”
কথাটা শুনে আমীরের চোখ দিয়ে অচিরেই ঝরঝর করে জল গড়াতে লাগলো। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললো। দূর্বল হয়ে কিছুটা নুইয়ে গেল। চরম হতাশাগ্রস্ত দৃষ্টি নিয়ে তোহার দিকে চাইলো একবার। তোহার মৃত্যুর মাধ্যনেই কেবল এই এক্যুরিয়ামের দরজা খুলবে। তাছাড়া সম্ভব না। অর্থাৎ তোহার মৃত্যু অনিবার্য। এতোক্ষণে তোহা হাত-পা ছেড়ে একদম নেতিয়ে পড়েছে। একটুও নড়াচড়া করছে না। আমীর বুকের ভিতর তীক্ষ্ণ একটা শব্দ অনুভব করলো। মনে হচ্ছে পৃথিবীটা সমস্ত ভার নিয়ে তার বুকের উপর ধ্বসে পড়েছে। তোহা কি তাহলে মরে গেছে?
হাসাদ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে। সে হঠাৎ আবিষ্কার করে রোবট ফোর্সগুলোকে আমীর-তোহার কাছে ছেড়ে আসা একদম উচিৎ হয়নি। হাসাদ ভুলেই গিয়েছিল আমীর মানুষকে যেকোনো অবস্থায় হিপনোটাইজ করতে পারে। তার পক্ষে রোবটদের হিপনোটাইজ করা কোনো ব্যাপারই না। আমীর যদি কোনোভাবে এই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে যায়? হাসাদ এসে দেখলো আমীর ক্ষুদার্থ বাঘের মতো গর্জন করতে করতে কাচের এক্যুরিয়ামটা নাড়াচ্ছে, খোলার চেষ্টা করছে। রোবটগুলো মেঝেতে দূর্বল হয়ে লুটিয়ে আছে। ভয়ে হাসাদের চোখমুখ শুকিয়ে গেল। আত্মার দৈর্ঘ্য কমে এতোটুকু হয়ে আসলো। সে যেটা ভয় পেয়েছে সেটাই হয়েছে। আমীর এখন মুক্ত, ওকে পুনরায় বন্দী করা সহজ হবে না। তার উপর তোহা যদি মরে যায় তাহলে আমীরকে নিয়ন্ত্রণে আনা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আমীরের হাতের সাথে বাধা স্টিলের ব্লেডটা ঝুলছে। ওই ঝুলন্ত ব্লেডের দিকে তাকাতেই হাসাদের শিরা-উপশিরা কাঁপতে লাগলো। তোহার মৃত্যু হলে আমীর হাসাদের সমস্ত শিরা কেটে ফেলবে নিশ্চিত। হাসাদ কি করবে এবার? ওর মুখ ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে। একহাতে ঘাম মুছতে মুছতে কয়েক পা এগিয়ে আসলো সে। হাসাদের উপস্থিতি টের পেয়ে আমীর ঘুরে তাকালো। হাসাদ মনে মনে প্রস্তুতি নিল ছুটে পালানোর। তার আগেই আমীর ওর উপর ঝাপিয়ে পড়লো। হাসাদ ভেবেছিল এই মুহুর্তই তার জীবনের শেষ মুহুর্ত। এখনই আমীর ধারালো ব্লেডের আঘাতে হাসাদের গলার শিরা কাটবে, কিন্তু একি! হাসাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে আমীর ওর সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়লো। ব্লেডটা এগিয়ে দিয়ে উন্মত্ত কণ্ঠে এক নিঃশ্বাসে বললো,
“নে, আমাকে মেরে ফেল। তাও তোহাকে বাঁচতে দে প্লিজ। তোর শত্রুতা তো আমার সাথে। তোহা কি দোষ করেছে বল? ও তো তোর কোনো ক্ষতি করেনি। আমার শাস্তি ওকে কেনো দিচ্ছিস? তুই যা বলবি আমি তাই মেনে নিবো। কিন্তু ওকে মারিস না প্লিজ। ও খুব কষ্ট পাচ্ছে। ওকে বাঁচতে দে। ও নিষ্পাপ!”
হাসাদ বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। তোহা কি আদৌ বেঁচে আছে? ওর তো এতোক্ষণে মরে যাওয়ার কথা। হয়তো মরেও গেছে। আর আমীর তোহার মৃত্যু নিজচোখে দেখে পাগল হয়ে গেছে হয়তো। তাই পাগলের প্রলাপ বকছে। হাসাদ চাইলেই এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। আমীরকে মেরে দিতে পারে। হাসাদ যখন হাত বাড়িয়ে ব্লেডটা নিতে গেল আমীর সঙ্গে সঙ্গে হাত গুটিয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বললো,
” আগে তোহাকে মুক্ত করতে হবে। আমি ওকে জীবিত অবস্থায় দেখতে চাই। তারপর তুই যা চাইবি তাই হবে। আমাকে মেরে ফেললেও আমি কিছু বলবো না। শুধু তোহার জীবন ফিরিয়ে দে।”
আমীর বিনীত ভঙ্গিতে হাতজোড় করলো। হাসাদের পৈশাচিক আনন্দ হওয়ার কথা। এই দিনটির স্বপ্ন কতদিন ধরে দেখে আসছে সে। আমীর ওর সামনে মাথা নত করবে। এখন সত্যিই তাই হচ্ছে কিন্তু হাসাদ খুশি হতে পারছে না। মৃত্যু ভয় ওকে গ্রাস করে রেখেছে। তোহার মৃত্যু মানে হাসাদের নিজেরও মৃত্যু। আমীর মেরে ফেলবে ওকে। অবশ্যই মেরে ফেলবে।হাসাদ আর কিছু না বলে এক্যুরিয়ামের কাছে গেল। আস্তে করে উপর থেকে কাচের দরজাটা খুলে দিল। তোহার দেহটা ভেসে উঠেছে। দুইচোখ বন্ধ। হাসাদ বার কয়েক ওর নাকের কাছে আঙুল ছুইয়ে চুপসানো গলায় বললো,
” শী ইজ ডেড।”
আমীর ধপ করে বসে পড়লো মেঝেতে। যেন একদম অসাড় হয়ে গেছে। হাসাদ তোহার দেহটা তুলে আমীরের সামনে রাখলো। আমীর একটু এগিয়ে এসে তুমুল তৃষ্ণা নিয়ে তোহার হাত-পা স্পর্শ করতে লাগলো। অশ্রুসজল চোখে তোহার ডানহাতটা নিয়ে চুমু দিল। তারপর সযত্নে নামিয়ে রাখলো। এবার তোহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে। হাসাদ দাঁড়িয়ে দেখছে আমীরের অস্বাভাবিক কর্মকান্ড। এসব ওর ভয়ংকর লাগছে। তোহা মরে গেছে ব্যাপারটা হয়তো এখনও আমীর বুঝতে পারেনি। যখন বুঝতে পারবে তখন এমন ঠান্ডা থাকবে না সে। দুনিয়া তোলপাড় করে ফেলবে হয়তো। এর আগে প্রাণটা হাতে নিয়ে পালানোই বুদ্ধিমানের কাজ। হাসাদ পালিয়ে গেল। আমীর তোহার একহাত নিজের গালে ছুইয়ে ভারী কণ্ঠে বললো,
” এভাবে কেনো হারিয়ে গেলে তোহা? এতোকিছু করেও আমি তোমাকে পেলাম না? আমার জীবনটা যে ব্যর্থই রয়ে গেল! এই ব্যর্থ, গ্লানিভরা জীবন নিয়ে আমি তো বাঁচতে চাইনা। নিয়তি কেনো এমন করলো আমার সাথে? আমার জীবন দিয়েও যদি তোমাকে বাঁচানোর কোনো উপায় থাকতো, আমি তোমাকে বাঁচাতাম!”
তোহা আমীরের মুখ চেপে ধরে বললো,
” এমন কথা আর কখনও বলবেন না। আপনার জীবন নিয়ে আমি বাঁচতে চাইনা। সারাজীবন আপনাকে সাথে রেখে একসঙ্গে বাঁচতে চাই। বুঝেছেন?”
আমীর কতক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে রইল। প্রথমে ভেবেছিল সে কল্পনা দেখছে৷ পরে বুঝলো কল্পনা নয়, সত্যি! তোহা সত্যিই বেঁচে আছে! তাহলে একটু আগে হাসাদ কি বললো এটা? আমীর আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো হাসাদ কোথাও নেই। তোহা একহাতে আমীরের মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
” হাসাদের সামনে ইচ্ছে করেই নিঃশ্বাস আটকে রাখার নাটক করেছি। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য স্যরি। আসলে ভয় হচ্ছিল, আমি বেঁচে আছি জানলে যদি আবার পানিতে ডুবিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে?”
আমীর কপট রাগ নিয়ে বললো,” আমি থাকতে ও তোমাকে মারবে? ওকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবো না আমি?”
তোহা ফিক করে হেসে আমীরের গলা জড়িয়ে ধরলো।

হাসাদের বিশ্বাসঘাতকতা জানাজানি হওয়ার পর সংস্থা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শাস্তি হিসেবে ওকে ফাঁসি দেওয়া হয়। হাসাদকে সহযোগিতা করার জন্য ইউজান আর হিরোশকে সংস্থা থেকে বিতাড়িত করেন প্রফেসর ট্রুডো। আমীর এখন গ্রুপের একমাত্র অবশিষ্ট সাইন্টিস্ট। রিম্মি, সানভী আর রিডের সম্মানার্থে ওদের ছবি বাধাই করে রিসার্চ সেন্টারের দেয়ালে টানিয়ে রাখা হয়েছে। ওরা পৃথিবীর স্বার্থে জীবন উৎসর্গ করেছিল। মানুষ যতদিন বাঁচবে ওদের এই ত্যাগকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। শহীদদের স্মরণে যেমন একুশে ফেব্রুয়ারী পালিত হয় তেমনি ওদের স্মরণেও একটি আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হবে। মহাকাশে টাইম ট্রাভেল রিসার্চের ঘটনা এখন সারা বিশ্ব জানে। সাইন্টিস্ট হিসেবে আমীরের পরিচিত খুব একটা প্রসারিত ছিল না। কিন্তু এখন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ আমীরের নাম জানে। সারা বিশ্বের একমাত্র সফল ও সাহসী বিজ্ঞানী যে মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসতে পেরেছে। এসবকিছুর মধ্যে তিরান নামটি আড়ালেই থেকে গেল। কেউ জানতেও পারলো না আমীরের বেঁচে থাকার পেছনে তিরান নামের চৌদ্দ বছরের কিশোর ছেলেটির অবদান কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এরপর অবশ্য আমীরের সাথে আর কোনোদিন তিরানের দেখা হয়নি। জীবনের সেরা বন্ধুগুলোকে আমীর হারিয়ে ফেলেছে। রিম্মি, সানভী,রিডের ছবি আমীর নিজ ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখলেও তিরানের ছবি রাখতে পারেনি। কারণ তিরানের কোনো ছবি আমীরের কাছে ছিল না।
নীলাভ্র আর তিলোত্তমার নতুন সংসার শুরু হয়েছে। ওদের একমাত্র ছেলের নাম রাখা হয়েছে নেহাল পাটোয়ারী। নীলাভ্র বেশ ভালোই আছে। শুধু মাঝে মাঝে রিম্মির স্মৃতিগুলো মনে পড়লে একটু অগোছালো হয়ে যায়। তিলোত্তমা ওকে মানসিকভাবে যথেষ্ট সাপোর্ট দেয়। ওদের সংসার জীবন সুখেই কাটছে।

বিয়ের পর তোহা আমীরের সাথে অস্ট্রেলিয়ায় চলে এসেছে। ওর সাথে পূরবী আর শিউলিও এসেছে। পূরবী কিছুদিন পরই চলে যাবে। শিউলি স্থায়ীভাবে তোহার কাছে থাকবে। এই মুহুর্তে পূরবী আর শিউলি বসে আছে আমীর-তোহার বাসরঘরে। আমীর এখনও বাসরঘরে ঢোকেনি৷ তোহা একটা নরমাল শাড়ি পড়ে এদিক-ওদিক হাটাহাটি করছে। ঘর গুছানোর কাজ করছে। পূরবী পুরো ঘরটা ঘুরে দেখছে। এতো অদ্ভুত বাসরঘর আগে কখনও দেখেনি সে। ঘরে ফুলের ছোঁয়া পর্যন্ত নেই। কিন্তু একটা জিনিস ভালো, এই ঘরে বিশাল একটা বারান্দা আছে। বারান্দাটাই একটা গোটা রুমের সমান। সেখানে অনেক অনেক ফুল গাছ। রজনীগন্ধা আর হাসনাহেনার ঘ্রাণে বাড়ি মোমো করছে। সেখান থেকে ফুল এনে পূরবী আর শিউলি ঘর সাজাতে চেয়েছিল। কিন্তু তোহা দেয়নি। তার মতে এখন ফুল দিয়ে ঘর সাজানো বিরাট ঝামেলার কাজ। এসব সে কাল করবে, আজকে শুধু ঘর গুছাবে। পূরবী তখন বলেছিল, বিয়ের প্রথম রাত একবার শেষ হলে আর পাওয়া যায় না। এই একটা রাতই সবচেয়ে স্পেশাল। পরে হাজারটা রাতও এই একরাতের সমান হয়না। কিন্তু কে শোনে কার কথা? আমীরও ফুল দিয়ে ঘর সাজাতে বারণ করলো এমনকি তোহাও। যেমন জামাই তেমন বউ, রসকষহীন অদ্ভুত! তোহার বাসরঘরে দাঁড়িয়ে পূরবী নিজের বাসরঘরের স্বপ্ন দেখছে। তার যখন বিয়ে হবে সে খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে ঘর সাজাবে৷ মেঝেতে ছড়ানো থাকবে গোলাপের পাপড়ি। বিছানার চারপাশে থাকবে অর্কিডের আস্তরণ। আর মশারীর মতো ছড়ানো-ছিটানো রজনীগন্ধার মালা। কি রোমান্টিক! ভাগ্যিস নীলাভ্রর সাথে তার বিয়ে হয়নি। তাহলে বাসর ঘরে শুধু পদ্মফুলের ছড়াছড়ি থাকতো। পূরবী এই কথা ভেবে নিজের মনেই হাসলো। এইটা আসলে তার মনের সান্ত্বনা। নীলাভ্রকে না পাওয়ার আক্ষেপ যে তার কোনোদিন মিটবে না!
আমীর ঘরে প্রবেশ করতেই শিউলি আর পূরবী বের হয়ে গেল। তোহা হাই তুলে বললো,
” ভালোই হয়েছে আপনি তাড়াতাড়ি এসেছেন। আরেকটু দেরি করে আসলেই দেখতেন আমি ঘুমিয়ে গেছি। ঘুমে আমার চোখ নিভে আসছে।”
আমীর তীক্ষ্ণ গলায় বললো,” কি? আজকেও তোমার ঘুম আসছে?”
” কেনো? আজকে কি ঘুম আসা নিষেধ? ”
” অবশ্যই নিষেধ। একশোবার নিষেধ। আজকেরাতের জন্য তোমার ঘুম হারাম। নিষিদ্ধ করা হলো।”
তোহা চোখ বড় করে বললো,” এর মানে আমি এখন ঘুমাবো না?”
” না।”
” তাহলে ঘুমাবো কখন?”
” দিনে ঘুমাবে। ওহ, শুধু আজরাতে না। এখন থেকে প্রতিরাতেই তোমার ঘুম নিষিদ্ধ। ”
তোহা ফ্যাকাশে মুখে বললো,” প্রতিদিন রাত জাগতে থাকলে তো আমার ইনসোমিয়া হয়ে যাবে।”
আমীর মুচকি হেসে বললো,” ইনসোমিয়া না, রোম্যানসোমিয়া হবে!”

চলবে

( পাঠকগণ বিশ্বাস করেন, নেক্সট পার্টে শেষ করবোই করবো ইনশাল্লাহ।😌)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here