#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৬২(শেষ)
লিখা: Sidratul Muntaz
আমীর হতাশ হয়ে বিছানায় বসে রইল কতক্ষণ। তোহা বারান্দায় গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করেছে। ওর কান্নার শব্দ আমীরের কানে প্রতিধ্বনির মতো বাজছে। ডিভোর্সের ব্যাপারেটায় হয়তো খুব বেশিই কষ্ট পেয়েছে সে। পাওয়ারই কথা!আমীরের নিজেরও খারাপ লাগছে। তোহার ভালোবাসা নিয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের অনাগত সন্তানকেও তোহা ভালোবাসে। এতোই ভালোবাসে যে তাকে বাঁচানোর জন্য আমীরকে ডিভোর্স দিতেও দ্বিধাবোধ করলো না। আমীরের ছোট বাচ্চাটার প্রতি ঈর্ষা হচ্ছে। পৃথিবীতে আসার আগেই ওর জন্য কত ভালোবাসা জমা হয়ে আছে। রাজকপাল নিয়ে আসছে ও৷ আমীর একটু পর বারান্দায় গেল। কান্নারত তোহাকে জোরপূর্বক বুকে জড়িয়ে ধরলো। তোহা কিছুতেই আমীরের কাছে আসতে চাইছিল না৷ আমীর ওকে শক্ত করে টেনে আনলো। তোহা এখনও কাঁদছে। আমীর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
” আই এম স্যরি তোহা৷ এক্সট্রিমলি স্যরি। প্লিজ মাফ করে দাও।”
তোহা নিয়মিত শব্দ করে কেঁদে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে হিচকিও তুলে ফেলেছে। ওর মনে যেনো ব্যথার পাহাড়। কান্না দিয়েই সেই পাহাড় টলাতে চায়। আমীর বুঝতে পারছিল না তোহার এই কান্না কিভাবে থামাবে। ওর কান্নারত মুখের দিকে ভালো করে তাকালো। তারপর হঠাৎই দুই ঠোঁট কামড়ে ধরলো। তোহা নির্বাক হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। ওর হিচকি, কান্না সবকিছু উধাও হয়ে গেল। আমীর দীর্ঘসময় নিল ঠোঁট চুম্বন শেষ করতে। তোহা এতোক্ষণে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমীর ওকে কোলে করে বিছানায় নিয়ে আসলো। ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিল। তারপর তোহার কাছে আসতে চাইলো কিন্তু তোহা হাত দিয়ে বাঁধ সেধে অভিমানী গলায় বললো,
” খবরদার, একদম কাছে আসবেন না।”
আমীর সম্পূর্ণ হকচকিয়ে গেল। কারণ এর আগে কখনও তোহা ওকে নিষেধ করেনি। মাঝে মাঝে করতো, যখন তোহা রেগে থাকতো। আমীর অবশ্য সেইসময় কোনো নিষেধ শুনতো না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোহা রেগে নেই৷ সে সিরিয়াস গলায় বললো,
” আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। আপনি আমার জন্য নিষিদ্ধ। তাই আমার কাছে আসার চেষ্টাও করবেন না।”
আমীর একথা শুনে হেসে ফেললো। সত্যি সত্যি তোহার কাছে এসে ওকে উপর থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” এ আমি বিশ্বাস করিনা। সামান্য একটা সাদা কাগজ আমার থেকে তোমাকে ছোঁয়ার অধিকার কেড়ে নিতে পারেনা। তুমি চিরকাল শুধু আমার তোহা৷ আমি যখন ইচ্ছা তোমার কাছে আসতে পারি৷ তুমি আমার আশ্রয়।”
আমীর তোহার গলায় মুখ গুজে কথা শেষ করলো। জোরে একটা শ্বাস নিয়ে তোহার শরীরের ঘ্রাণ নিল৷ এই সুগন্ধ ছাড়া আজ-কাল নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। কিভাবে থাকবে এই মেয়েটাকে ছেড়ে সে? কখনও পারবে না। প্রকৃতি কি এতো নিষ্ঠুর? আমীরের থেকে তার আহ্লাদীকে কেড়ে নিবে? তোহা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে কিঞ্চিৎ অভিমান মিশিয়ে বললো,
” তাহলে ডিভোর্স কেনো দিলেন আমায়?”
আমীর প্রথমে তোহার গলায়, নাকে, কপালে, গালে আলতো আলতো চুমু দিল৷ তারপর বললো,
” ডিভোর্স দেইনি। তোমাকে ভয় দেখানোর জন্য নকল পেপার সাজিয়ে এনেছি। যেনো অ্যাবর্শনের জন্য তোমাকে রাজি করাতে পারি। কিন্তু তুমি তো রাজি হলেনা। নকল ডিভোর্স পেপারেই সাইন করে দিলে।”
” ছি, আপনি এতো নীচ? আমি আর থাকবো না আপনার সাথে।”
” কোথায় যাবে?”
” জাহান্নামে যাবো। তাও আপনার কাছে থাকবো না।”
” আমি তো তোমাকে জান্নাতে পাঠাতে চাই।”
” আমি যেতে চাইনা।”
” রাগ করলে? আমিও করতে পারি। আমার থেকে এখনি এই বাচ্চার প্রতি এতো বেশি ভালোবাসা তোমার। তাহলে এই বেটা পৃথিবীতে আসলে তো মনে হয় আমার দামই থাকবে না।”
” আর আপনি যে ব্ল্যাকমেইল করে আমার হাতে আমার বাচ্চাকে খুন করাতে যাচ্ছিলেন? সেটা কি? ও শুধু একবার পৃথিবীতে আসুক, আমি সব বলবো ওকে। তারপর ও কখনও আপনাকে ক্ষমা করবে না।”
আমীর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,” আমিও চাই সে আমাকে ক্ষমা না করুক। আমি খুব খারাপ বাবা। সেলফিশ বাবা।”
” না, আপনি সেলফিশ না। আপনি খুব ভালো। শুধু আমাকে আর আমার বাচ্চাকে ভালোবাসবেন। ওকে অবহেলা করবেন না। ও তো আমারই অংশ।”
তোহা আমীরের ডানহাতটা নিয়ে নিজের পেটে রাখলো। আমীর তোহার কপালে চুমু দিয়ে বললো,
” ঠিকাছে তোহা, ও এই পৃথিবীতে আসবে। নিশ্চয়ই আসবে। আমি ওকে তোমার মতোই ভালোবাসবো।”
তোহা উচ্ছলিত কণ্ঠে বললো,” সত্যি তো?”
” একদম সত্যি।”
তোহার খুশিতে কান্না আসছে। সে আমীরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। আমীর তোহার গলায় মুখ গুজেই বললো,
” কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”
তোহা একটু ভয় নিয়ে বললো,” কি শর্ত?”
” আমাদের ছেলের নাম হবে তিরান।”
” তিরান? ওয়াও, খুব ভালো হবে। কিন্তু যদি মেয়ে হয়?”
” মেয়ে হবে না।”
” তাই? আপনি এতো নিশ্চিত কিভাবে?”
আমীর এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। তোহা আমীরের চোখে ঘোর খুঁজে পেল। সাথে সাথেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল। আমীর তোহার গলায়, বুকে, পেটে ঠোঁটের জাদুময়ী উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। তোহার মনে হলো ও সত্যিই জান্নাতে পৌছে গেছে।
নিজের মৃত্যু মনে হয় তিন-চারমাস আগে থেকেই টের পেয়েছিল তোহা। তাই অনাগত সন্তান তিরানের জন্য অনেক অনেক চিঠি বাক্সবন্দী করে রেখে যায় সে। তিরান মাঝে মাঝেই মৃত মায়ের রেখে যাওয়া চিঠিগুলো পড়ে ডুঁকরে কাঁদে। যখন কাঁদে তখন সে একদম একা থাকে। আশেপাশে কেউ থাকলে তিরান কখনও কাঁদে না। কারণ কান্না হলো দূর্বলতা। এই দূর্বলতা সে মানুষের সামনে প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক। উপরে উপরে নিজেকে খুব সাহসী প্রমাণ করতে চায় তিরান। অথচ তার ভেতরটা বড্ড নড়বড়ে৷ বাবার ঘরে গেলেই তিরানের চোখ ভিজে যায়। যদিও বাবার ঘরে বেশি একটা যাওয়া হয়না তার। বাবা তাকে খুব বেশি পছন্দ করেনা। সবসময় ধমকের উপর রাখে। অযথা মেজাজ দেখায়। বাবার এই উগ্র মেজাজের রহস্য কি শুধুই মায়ের মৃত্যু? নাকি আগে থেকেই বাবা এমন? শিউলি আন্টির কাছে তিরান শুনেছে বাবা মায়ের সাথে কখনও মেজাজ দেখাতো না। একসময় খুব ভালো ছিল তার বাবা। মায়ের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে কেমন যেন হয়ে গেছে। যেদিন হসপিটালে তোহা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, আমীর তোহার মাথাটা কোলে নিয়ে বসেছিল। তোহা জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বললো,
” আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবেন?”
আমীর পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিল। তোহা বললো,” স্বামীর কোলে মাথা রেখে মৃত্যুবরণের সৌভাগ্য কয়জনের হয়? আমি খুব সৌভাগ্যবতী। আজ নিজের সৌভাগ্য দেখে নিজেরই হিংসা হচ্ছে।”
তারপর খুব বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
” লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ)।”
তোহার শেষবাক্য এটাই ছিল। আমীর তখন ভারী কণ্ঠে বলেছিল,
” আমিও খুব সৌভাগ্যবান। জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তোমার পাশে থাকতে পেরেছি। কিন্তু আমার জীবনের শেষদিন কি তুমি আমার পাশে থাকবে না? বিধাতা কেনো আমার বেলাতেই এতো নিষ্ঠুর হলেন তোহা?”
আমীর তোহার কপালে চুমু দিল, হাতে চুমু দিল। তোহার গাল আলতো স্পর্শে আদর করে দিল। শেষবার তোহাকে কবরে নেওয়ার সময় খুব কেঁদেছিল আমীর। ওর কান্নার দমকে প্রকৃতিও যেনো স্থির হয়ে গেছিল। তারপর সে নিজেই স্থির হয়ে যায়। আর কোনোদিন কাঁদেনি। এই বাস্তব গল্পগুলো যখন শিউলি তিরানকে শোনায়, তখন সে মুখে আঁচল চেপে ফুপিয়ে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে বাথরুমে চলে যায়। তিরানের ভীষণ বিরক্ত লাগে। শিউলি আন্টি কেনো এতো কাঁদে? যারা কাঁদে তারা দূর্বল হয়। বাবা তো কখনও কাঁদে না! তিরানের কাছে তার বাবা সুপারহিরো। বাবা যেমন কখনও কাঁদে না তেমনি কখনও হাসেও না। তিরান বাবাকে জীবনেও হাসতে দেখেনি। বাবার ঘরে মায়ের অনেক ছবি। বাবা সেই ছবিগুলোর সাথে মাঝে মাঝে কথা বলে। মাঝে মাঝে না, সবসময়ই বলে। কিন্তু তিরান মাঝে মাঝে শুনে। তার লুকিয়ে বাবার প্রলাপ শুনতে ভালো লাগে। একা কথা বলার অভ্যাসের কারণে আমীরকে কয়েকবার সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ওর সমস্যা ঠিক হয়নি। তিরান প্রতিদিন মায়ের চিঠিগুলো পড়ে। মোট একত্রিশটা চিঠি মায়ের। বেশিরভাগ চিঠির সম্বোধন অনেকটা এরকম,
“আমার তীরু, তোকে বাস্তবে দেখার সৌভাগ্য আমার হবে কিনা জানিনা। যদি হয়, তাহলে এই চিঠি তোর কাছে কখনও পৌঁছাবে না। আর যদি না হয়, তাহলে এই চিঠিগুলোই হবে তোর মায়ের শেষ স্মৃতি। ”
তোহা বেশিরভাগ চিঠিতেই তিরানকে বলেছে সাহসী হতে, তার বাবাকে সামলে রাখতে। বাবা তাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু তিরানের এই কথা বিশ্বাস হয়না। তার ধারণা বাবা শুধু মাকেই ভালোবাসে। তাইতো সারাখন মায়ের ছবি নিয়ে পড়ে থাকে। কখনও তিরানকে আদর করে না। হাসিমুখে কথা বলেনা তিরানের সাথে। তিরানকে কাঁধে করে ঘুরতে নিয়ে যায়না। বাবার প্রতি তিরানের অনেক অভিমান। কিন্তু মায়ের চিঠিগুলো পড়লে সেই অভিমান আর থাকেনা। পানির মতো গলে যায়। যতবার তিরান চিঠি পড়ে, ওর কান্না আসে। অথচ মা তাকে বারবার কাঁদতে নিষেধ করে গেছে। বাবাকে সামলে রাখতে বলেছে। তিরান পারেনা তার বাবাকে সামলাতে। তিরানের বয়স এখন চৌদ্দ। আমীরদের রিসার্চ সেন্টারের জুনিয়র গ্রুপের সদস্য সে। প্রফেসর ট্রুডোর মৃত্যুর পর আমীরই এখন সেই রিসার্চ সেন্টারের একমাত্র প্রফেসর। প্রফেসর শাহ। তিরান বাবাকে বাঘের মতো ভয় পায়। তার প্রিয় সাবজেক্ট অ্যাস্ট্রোনোমি। তার স্বপ্ন অ্যাস্ট্রোনাট হওয়া। টাইম ট্রাভেলের অ্যাস্ট্রোনাট। তিরান জানে তার বাবাও একজন টাইম ট্রাভেলার। পুরো পৃথিবীর প্রথম টাইম ট্রাভেলার। সে দ্বিতীয় হতে চায়। ঠিক তার বাবার মতো। কিন্তু আমীরের কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে, এসব নিয়ে যেনো তিরান কখনও চিন্তা না করে। সৌরজগতের ভিতরে যেকোনো গ্রহ ভ্রমণের অনুমতি সকল সাধারণ নভোচারীর আছে। কিন্তু টাইম ট্রাভেলে যাওয়ার জন্য সৌরজগৎএর গন্ডি পেরোতে হয়। সেই অনুমতি এখনও কাউকে দেওয়া হয়নি। লাইফ রিস্ক নিয়ে এই কাজ করতে চায় এমন কোনো সাহসী নভোচারীও নেই। তবে তিরানের সেই সাহস আছে। যদিও আমীরের মতে সাহসটা নিতান্তই দুঃসাহস। অথচ এই দুঃসাহস একসময় আমীর নিজেও দেখিয়েছিল, মায়ের জীবন ফিরে পেতে। তিরানও তার মাকে ফিরে পেতে চায়। তিরান যদি একবার মায়ের দেখা পেতো, বাবার নামে অনেক অভিযোগ করতো মায়ের কাছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, ‘ মা, বাবা আমায় একটুও ভালোবাসে না!’
একদিন তিরান লুকিয়ে লুকিয়ে মায়ের ছবির সাথে বাবার কথোপকথন শুনছিল। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল বলে আমীর যখন রুম থেকে বের হয় তিরান টের পায়নি। আমীর ওকে দেখে ফেলে। ভয়ে তিরানের কলিজা শুকিয়ে যায়। এই বুঝি বাবা চেচিয়ে উঠবে। তিরান দৌড়ে পালাতে নিল। কিন্তু এর আগেই আমীর নরমগলায় বললো,
” তির, আমার সাথে যাবি?”
” কোথায়?”
আমীর হাটু গেড়ে বসে কোমলগলায় বললো,
” তোকে নিয়ে বাংলাদেশে যাবো।”
বাংলাদেশের কথা শুনেই তিরানের মনে পড়ে কাল মায়ের জন্মদিন। বছরের এই দিনটি তিরানের সবচেয়ে পছন্দের। কারণ এই দিনে বাবা পুরোটা সময় তিরানের সাথে থাকে। আর খুব ভালো ব্যবহার করে। তিরান যা বলে আমীর তাই শোনে। তিরান মনে মনে ঠিক করে রেখেছে কাল সে বাবার কাছে অনেক বড় কিছু আবদার করবে।
নীলাভ্র-তিলোত্তমার ছেলে নেহালের বয়স এখন পনেরো বছর। ওদের সুখের সংসার বেশ আনন্দেই কাটছে। নেহাল নামটা মৃত্যুর আগে নিবরাস ঠিক করে রেখেছিল, ছেলে হলে নাম হবে নেহাল। আর মেয়ে হলে নেহা। তিলোত্তমা নিবরাসের স্মৃতি নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে আছে। নীলাভ্রর মনেও রিম্মির স্মৃতি জীবন্ত। তিলোত্তমা বা নীলাভ্র কখনও একে-অপরের ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনা। নীলাভ্র যেমন রিম্মির স্মৃতি নিয়ে স্বাধীনভাবে সুখে আছে, তিলোত্তমাও তেমনি মৃত স্বামীর স্মৃতি নিয়ে যথেষ্ট সুখে আছে। ওদের দুজনের যদি বিয়েটা না হতো তাহলে এই স্বাধীনতাটুকু ওরা পেতো না। এখন নীলাভ্রর মনে হয়, তিলোত্তমাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে সে ধন্য। কারণ তিলুর জায়গায় অন্যকোনো মেয়ে তার স্বামীর পুরনো ভালোবাসার স্মৃতি বয়ে বেড়ানো কখনও সহ্য করতো না। একই ব্যাপার তিলোত্তমার ক্ষেত্রেও।
আমীর তিরানকে নিয়ে যমুনা শপিংমলের পেছনে এসেছে৷ চৌদ্দ বছরে জায়গাটা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন হয়নি শুধু স্মৃতি আর মনের সুপ্ত অনুভূতিগুলোর। এ জায়গায় আসলে আমীরের মেজাজ সচরাচর খুব ভালো থাকে। তিরান ভাবলো এখনি সঠিক সময় বাবাকে কথাটা জানানোর। তিরান খুব সাহস নিয়ে কোনো ভণিতা ছাড়াই বলে ফেললো,
” বাবা আমি টাইম ট্রাভেলের অ্যাস্ট্রোনাট হতে চাই। ”
আমীর আড়চোখে তাকিয়ে বললো,
” আমি এই বিষয়ে আগেই নিষেধ করেছি। দ্বিতীয়বার কেনো একই কথা বলছিস?”
” স্যরি বাবা, কিন্তু আমি তোমার অনুমতি ছাড়া সৌরজগতের বাহিরে একটা রিসার্চ কমপ্লিট করে ফেলেছি। একটা বিশেষ গ্রহের সন্ধানও পেয়েছি। আমি সেখানে যেতে চাই।”
” গ্রহটা কি টাইম ট্রাভেল রিলেটেড?”
তিরান মাথা নিচু করে বললো,” হুম।”
আমীর অকপটে বললো,” যাওয়া হবে না। ক্যান্সেলড।”
তিরান উত্তেজিত গলায় বললো,” বাবা এই রিসার্চ শেষ করতে আমার নয়মাস সময় লেগেছে। সবকিছু বিফলে যাবে।”
” নয়বছর লাগলেও কোনো লাভ নেই। আমি একবার ‘না’ বলেছি মানে ‘না’। এ বিষয়ে আর কিচ্ছু শুনতে চাইনা।”
তিরানের মনটা একদম খারাপ হয়ে যায়। মাকে ফিরে পাওয়ার এই একটাই সুযোগ ছিল। আমীর যদি রাজি না হয় তিরান কখনও নভোচারী হতে পারবে না। তিরানকে মবখারাপ করে থাকতে দেখে আমীর জিজ্ঞেস করলো,
” কি এমন আছে ওই গ্রহে? কেনো যেতে চাস?”
তিরান তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল,” মা আছে।”
” মায়ের সাথে আরেকটা বাবাও আছে৷ তাহলে ওদের কাছেই চলে যা। আমার কাছে কেনো পড়ে আছিস?”
” বাবা নেই। শুধু মা আছে। বাবার অপেক্ষায় আছে।”
আমীর ভ্রু কুচকে কিছুটা নিচু হয়ে বললো,” মানে?”
” মানে সেই গ্রহে মা চৌদ্দ বছর ধরে তোমার অপেক্ষায় আছে। তোমার মনে আছে বাবা, তুমিই বলেছিলে তোমার মতো দেখতে একটা মানুষকে খুন করেছিলে তুমি। সেও কিন্তু টাইম ট্রাভেলার ছিল। মৃত্যুর পর সে তার নির্দিষ্ট টাইমলাইনে আর ফিরে যেতে পারেনি। তুমি যখন এই গল্প বলছিলে তখনি আমার মাথায় এসেছিল কোনো না কোনো জায়গায় মা এখনও তোমার অপেক্ষায় আছে। যেই গ্রহে বাবা এখনও ফিরে যায়নি। আমরা যদি ওই গ্রহে পৌঁছাতে পারি তাহলে মাকে ফিরে পাওয়া সম্ভব।”
আমীর বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়। একটু ভেবে বললো,
” এতো লক্ষ-কোটি গ্রহের মাঝে তুই সেই নির্দিষ্ট গ্রহটি কিভাবে বের করলি? এই কাজ তো শুধু একজনই পারতো।”
” জানি, রিম্মি আন্টি পারতো তাইনা? রিম্মি আন্টির জন্য এই হিসাব একটা চুটকি বাজানোর মতো। কিন্তু আমার নয়মাস সময় লেগেছে। আমি একটা সূত্র বের করেছি বাবা, এই সূত্র দ্বারা আমরা যেকোনো টাইমলাইনের গ্রহ সহজে বের করে ফেলতে পারবো।”
আমীর অবাক হয়ে ছেলেকে দেখছে। মাত্র চৌদ্দবছর বয়সী ছেলেটা এসব কি বলছে? তিরান বললো,
” তুমি যদি অনুমতি দাও, আমি তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যেতে পারি বাবা। আমরা আবার মায়ের সঙ্গে থাকতে পারবো।”
” সম্ভব না। সেই গ্রহে পৌছাতে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর সময় লাগবে। ততদিনে কি তোর মা পৃথিবীতে থাকবে?”
” উফফ বাবা, আমি এতো বোকা নাকি? জার্নিটাইম যোগ করেই আমি গ্রহের হিসাব বের করেছি। তাই আমরা যেই সময় ওই গ্রহে পৌছাবো সেইসময় আর বর্তমান সময়ের মধ্যে কোনো ব্যবধান থাকবে না। ”
আমীর চুপ করে রইল। কিছু একটা ভাবছে। তিরান জিজ্ঞেস করলো,
” আমরা কি যাবো বাবা?”
আমীর তখন আর কোনো উত্তরই দেয়না। তিরানকে নিয়ে বাসায় চলে আসে৷ পরদিন তারা অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। তিরান বাবার উত্তরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। আমীর সারাদিন বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করে। সত্যিই কি তোহাকে পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব? যদি সম্ভব হতো, তাহলে আমীরের চেয়ে বেশি খুশি আর কে হতো? আমীর চট করেই সিদ্ধান্ত নিল, কপালে যা আছে হবে কিন্তু তোহাকে ফিরে পাওয়ার শেষ চেষ্টা আমীর নিশ্চয়ই করবে৷ আমীর রাতে হঠাৎ তিরানের ঘরে ঢুকলো। তিরান টেবিলে বসে পড়ছিল। আমীরকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললো,
” বাবা?”
আমীর হাটু গেড়ে তিরানের সামনে বসে ওর হাত দুটো ধরে বললো,” আজ থেকে তুই আমার ছেলে না, তুই আমার বাবা।”
আমীর দ্বিতীয়বারের মতো টাইম ট্রাভেলের জন্য প্রস্তুত হয়। আগেরবার রিম্মি, সানভী, রিডদের হারিয়ে ফেলার পর আমীরের পাশে শুধুই তিরান ছিল। আজও আমীরের পাশে তিরানই আছে। ওরা একই উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে। পার্থক্য হলো গতবার আমীর নিজের মাকে ফিরে পাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। এবার তিরান তার মাকে ফিরে পাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে। এই যাত্রা অনন্তকালের এক অনিশ্চিত যাত্রা!
নতুন গ্রহ নিয়ে আমীরের মনে ছিল হাজারো শঙ্কা। সেই গ্রহের তোহা কি আজও আমীরের জন্য অপেক্ষা করে আছে? সে যে অন্যকাউকে বিয়ে করে সুখের সংসার করছে না তার কি নিশ্চয়তা আছে? তাছাড়া হাসাদের সাথে তো তোহার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। আমীর ফিরে না আসলে সেই বিয়ে হয়ে যেতো। এখন যদি আমীর গিয়ে দেখে তোহার হাসাদের সাথে বিয়ে হয়ে গেছে! ওরা দিব্যি সুখের সংসার করছে! সেই কঠিন বাস্তব মেনে নেওয়া আমীরের জন্য মোটেও সহজ হবে না। নতুন গ্রহের মাটিতে পা রাখার পর আমীর পরিচিতদের মধ্যে সর্বপ্রথম দেখলো রিম্মি আর নীলাভ্রকে। ওরা হাত ধরাধরি করে একটা পার্কের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দেখেই বোঝা যায় ওরা আজ সুখী দম্পতি। তিরান বললো,
” বাবা তুমি কি জানো? এই রিম্মিআন্টিই সেই রিম্মিআন্টি। যে চৌদ্দবছর আগে ব্ল্যাকহোলে হারিয়ে গেছিল। সত্যি বলতে সে হারিয়ে যায়নি। আসল ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিল। এটাই তার আসল ঠিকানা। এখানে নীল আঙ্কেলের সাথে রিম্মিআন্টির বিয়ে হয়েছে। বাবা তুমি কি আসল প্যারাডক্স বুঝতে পারছো? যে গ্রহে তুমি ফিরে গেছিলে সেই গ্রহে রিম্মিআন্টি ফিরতে পারেনি। কিন্তু যে গ্রহে তুমি ফিরতে পারোনি সেই গ্রহে রিম্মি আন্টি ফিরেছে। তোমাদের নিয়তি অনেকটাই বিপরীত। ”
আমীর হঠাৎ উপলব্ধি করলো, প্রকৃতি কাউকে কখনও ঠকায় না। যে প্রকৃতিকে ভালোবাসে, প্রকৃতি তাকে দ্বিগুণ ভালোবাসা ফিরিয়ে দেয়। আর যে প্রকৃতির সাথে বেঈমানী করে, প্রকৃতি তাকে ধ্বংস করে দেয়। তিরান বললো,
” বাবা, মা কিন্তু এখানেই আছে। চৌদ্দ বছর ধরে তোমার অপেক্ষা করছে। খুঁজে নাও মাকে।”
তিরান আমীরকে একা ছেড়ে চলে গেল। বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ ধরে সে দৌড়াচ্ছে। আজ তার খুশির দিন। হঠাৎ খেয়াল করলো একটা ছেলে আর মেয়ে হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। ছেলেটাকে তিরান চেনে, তার খুব পরিচিত। তিলোত্তমা আন্টির ছেলে নেহাল। কিন্তু ওর পাশের মেয়েটা কে? খুব সুন্দরী। চোখের মণি নীল, চুলগুলো লাল। আর গায়ের রঙ বরফের মতো সাদা। এতো সুন্দরী মেয়ে তিরান তার ইহজীবনে কখনও দেখেনি। তিরান ওদের পিছু নিল। নেহাল তিরানকে দেখে হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” তুমি কি আমাদের অনুসরণ করছো? কে তুমি?”
তিরান নেহালের প্রশ্নের জবাব দিলনা। মেয়েটির দিকে চেয়ে বললো,
” হাই, আমি তিরান। তোমার নাম?”
মেয়েটি নেহালের দিকে তাকায়। মনে হয় ভাইয়ের কাছে অনুমতি চাইছে নাম বলা যাবে কিনা। নেহাল কিছু একটা বলতে নিচ্ছিল তার আগেই রিম্মি ডাকলো,
” নেহাল, টুই, জলদি এদিকে এসো।”
টুই হেসে বললো,” আসছি আম্মু।”
তিরানের চোখ আটকে গেল টুইয়ের বামপাশের নজরকাঁড়া গজদাঁতে। একটা মেয়ের এতো গুণ! নীলনয়না, লাল চুলের রূপসী, শুভ্রতায় অপরূপা সাথে গজদন্তিনী। এ কোনো মেয়ে নয়, স্বর্গের হুরপরী। এগারো বছর বয়সী টুই বড়ভাইয়ের হাত ধরে দৌড়ে মায়ের কাছে ছুটে যায়। নীলাভ্র বললো,
” আমার সুইটহার্ট কি করছিলো? ”
টুই তিরানের দিকে ইশারা করে নীলাভ্রর কানে কানে কিছু একটা বললো। তারপর বাপ-মেয়ে দুজনেই একসাথে হেসে উঠলো। তিরান তখনো হতবিহ্বলের মতো টুইয়ের হাসি দেখছিল। রিম্মি ভ্রু কুচকে তিরানের দিকে তাকায়। তারপর টুইকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। তিরানের মেজাজ খারাপ হয়। রিম্মিআন্টি এতো স্টুপিড তিরান আগে জানতো না। এতো হ্যান্ডসাম ছেলে দেখেও কেউ ইগনোর করতে পারে?
তোহার গায়ে সোনালী চাদর। চুলগুলো ছাড়া। এলোমেলোভাবে উড়ছে। ওকে দেখতে এখন পূর্ণবতী নারী মনে হয়। আমীর তোহার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। অবাক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে বত্রিশ বছর বয়সী তোহাকে। সে এখনও অবিবাহিত। পরিবার,সমাজ,পৃথিবী সবকিছুর সাথে একপ্রকার যুদ্ধ-বিগ্রহ করে টিকে আছে। আমীরের ফিরে আসার অপেক্ষা সে আজও করে। যদি কোনোদিনও আমীর ফিরে না আসে, তোহা তবুও জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। স্বপ্ন দেখবে। কারণ স্বপ্ন দেখতে দোষ নেই, অনিশ্চিত অপেক্ষাতেও এক অন্যরকম তৃপ্তি আছে। আমীর ভাবতেও পারছে না তোহা যখন পেছন ফিরে আমীরকে দেখবে, তার কেমন রিয়েকশন হবে। তোহা যদি বলে সে এখন বিবাহিত, তার সংসার আছে! আমীর সেটা মানতে পারবে না। প্রয়োজনে তোহার স্বামীকে খুন করে তোহাকে নিয়ে মহাশূন্যে পালিয়ে যাবে। ধূর, আমীর কি চিন্তা করছে এসব? আগে তো এটা জানতে হবে, তোহা এখনও তাকে ভালোবাসে কিনা? আমীর মৃদু কণ্ঠে ডাকলো,
” তোহা!”
তোহার বক্ষপিঞ্জরে শিরশির অনুভব হয়। চিরচেনা কণ্ঠস্বর হৃৎপিন্ডের গতি থামিয়ে দেয়। একরাশ বিস্ময় নিয়ে পেছন ফিরে তাকায় তোহা…
সমাপ্ত
( আমীরকে দেখার পর তোহার কেমন অনুভূতি হয়েছিল পাঠকরা নিজ দায়িত্বে কল্পনা করে নিবেন। যদি আবার কখনও সায়েন্স ফিকশন লিখি, তিরান আর টুইকে নিয়েই লিখবো ইনশাল্লাহ। গল্পটা শেষ করতে পেরে স্বস্তি লাগছে। সবাই মন্তব্য জানাবেন।)