জীবনের অন্যরঙ পর্ব-৪

0
387

#জীবনের অন্যরঙ [৪র্থ পর্ব]
#আজিজুর রহমান

চা-টা খেয়ে একটু বেলা করে বের হল অনিমান।সকালে করিম ভাইয়ের দোকানে সবাই আসেনা।কিছুটা যাবার পর মনে হল কে যেন তাকে ডাকছে।পিছন ফিরে দেখল মুন্নী ভাবি। কাছে এসে বলল,ভালই হয়েছে তোমার সঙ্গে দেখা হল।
–কোথায় গেছিলে?
–ছেলেকে বাসে তুলে দিয়ে এলাম। শোনো রাজু এই টাকাগুলো লক্ষী ভাই সুজয়কে দিয়ে দিও।
–কত টাকা?
–পাঁচ হাজার।এটিএম থেকে তুলে আনলাম।দ্যাখতো ঠিক আছে কিনা?
–তুমি গোনোনি? অনিমান টাকা গুনতে থাকে,চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
–রাস্তাঘাটে কে দেখবে তাড়াতাড়িতে আমি ভাল করে গুনিনি। কি হল কাঁদছো কেন?
অনিমান হেসে বলল,না কাঁদবো কেন?
মুন্নী গম্ভীর সুরে জিজ্ঞেস করে, ভাবিকে বলা যায় না?
অনিমান রুমালে চোখ মুছে বলল,ভাবি তুমি খুব ভাল।
অনিমান টাকা নিয়ে চলে যেতে মুন্নী অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটা বড় আবেগ প্রবণ। কে জানে যারা লেখালিখি করে তারা হয়তো এমন হয়।
সুজয়ের সঙ্গে দেখা করে টাকাটা দিতে সুজয় বলল,আমি জানতাম রাজু ভাই কিছু করবে।
–টাকাটা মুন্নী ভাবি দিয়েছে। অনি বলল।
–রাজু ভাই মুন্নী ভাবি আলাদা নয়। সুজয় বলল।
করিম ভাইয়ের দোকানে গেলনা,অনিমান বাড়ি ফিরে এল। ভাবি জিজ্ঞেস করলেন,কিরে এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি?
–তিনটের সময় বের হব। একটু বিশ্রাম করে নিই।
–তোর পরীক্ষা কিন্তু তোকে তো পড়তে দেখিনা।
অনিমান ভাবির দিকে তাকিয়ে হাসল। পরীক্ষায় বসতে হলে টাকার দরকার,সেকথা বললে ভাবির মন খারাপ হবে। নিজের ঘরে গিয়ে ডায়েরী নিয়ে বসল। মুন্নী ভাবি পাঁচ হাজার টাকা দিলেন সুজয়ের মায়ের জন্য। কি সম্পর্ক সুজয়দের সঙ্গে? সুজয়ের মায়ের যদি চিকিৎসা না হয় তা হলে মুন্নী ভাবিে কি আসে যায়?বাইরে থেকে যতটা জানা যায়,সেটাই সব নয়। জীবনের আরও অজানা রঙ আছে যার সবটাই লোক সমক্ষে আসেনা। কখনো কখনো ছিটকে এসে পড়ে চমৎকৃত করে। যত দেখছে যত জানছে ততই মনে হচ্ছে কিছুই জানা হলনা। জীবনের কত যে রঙ আছে কে সবটা জানে? একদিন হয়তো শুভ্রতার সঙ্গে ড.সাগরের বিয়ে হবে। শুভ্রতার সুখের সংসার হবে। সন্তানের মা হবে,মায়ের বুক ভরা মমতা হবে। সেই মমতার ফাঁকে একটুও কি অন্য রকম কিছু থাকবে না? অর্নি আপু ছিল চলে গেছে বন্ধুবান্ধব পরিবেশ বদলে গেছে অতীতের সব কি একেবারে মুছে গেছে?কিছুই কি নেই অবশেষ? ভাবি চা নিয়ে ঢুকলেন। অনিমান অবাক এতবেলা হয়ে গেছে খেয়ালই করেনি। ভাবি বললেন,তুই কোথায় যাবি বলছিলি?
–তুমি ঘুমাও নি?
–ঘুমিয়েছিলাম। দেখলাম তিনটে বেজে গেছে তুই বেরোবি–।
অনিমানের চোখ ভিজে যায়। ভাবি জিজ্ঞেস করেন,কি হোল তোর?
— ভাবি জানি না আমি জীবনে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো। কিন্তু তোমার মতো আদর ভালোবাসা কেউ দিতে পারবে না। মা মারা গেছে কিন্তু তোমার ভালোবাসা আমার মায়ের কথা ভুলিয়ে দেই। তোমার মাঝে আমি মায়ের ছায়া খুঁজে পাই।

ভাবি বললেন, তোর চা তো ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

আয়েশ করে চায়ে চুমুক দেয়। বিটি রোড থেকে কিছুনা কিছু বাস পাওয়া যাবে। বাস স্টপেজে পৌঁছে দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল।ভীড়ে ঠাষা বাস,ঠেলেঠুলে ভিতরে ঢুকে বাসের রড ধরে দাড়ালো। পাশে মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক চোখাচুখি হতে মৃদু হাসলেন। ভদ্রলোক কেন হাসলেন জানি না। তবে মানুষের হাসি দেখতে আমার খুবই ভালোলাগে। টাউনে কখনো যেতে হয় নি। নতুন নতুন মানুষকে দেখে অনিমানের খুব ভালো লাগে। তাদেরকে জানতে ইচ্ছে হয়। ভদ্রলোক এখন কোনদিকে তাকিয়ে আছে বোঝার উপায় নেই। কিছুক্ষন পর লক্ষ্য করে পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের ঝুলন্ত হাত দিয়ে রড ধরে রেখেছে। কিছুটা বৃদ্ধদের মতো দেখাচ্ছে। তাই নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে তাকে বসতে দিলাম। তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। তার বিপরীতে আমি মুচকি হাসি দিলাম। অপরিচিতদের কে নিঃস্বার্থ ভাবে সাহায্য করার আলাদা এক প্রশান্তি আমে মনে। যে কখনো এমন সাহায্য করে নি সে কখনো এ কেমন ধরণের প্রশান্তি বুঝা যাবে না। বাসের মধ্যে সচরাচর কেউ সাহায্য করতে চাই না। আমি কেনই বা করলাম তা জানি না। তবে আমার মনে সাহায্য করে এক প্রশান্তি পাই।

বাস স্টপেজে এসে দাঁড়ালো। হুড়মুড়িয়ে বাস থেকে নেমে পড়ল অনিমান। বেলা পড়ে এসেছে।এবার কি করবে?পকেট থেকে রাজু ভাইয়ের দেওয়া কার্ডটা বের করে চোখ বোলায়।
–কোথায় যাবে?
চমকে তাকিয়ে দেখে বাসের সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক। সানগ্লাস চোখে পড়া,দীর্ঘাকার দেহ অবয়ব, দেখতে সুদর্শন । বৃদ্ধ হলে যে মানুষকে সুন্দর দেখায় অনিমান কখনো ভাবে নি। বৃদ্ধদের একটা সুন্দরতা রয়েছে যা এই বৃদ্ধ লোককে দেখে বুঝতে পেরেছে। অনিমান মনে করতো যৌবন হলো সকল সুন্দরের আলিঙ্গনতা। কিন্তু এই বৃদ্ধ লোককে দেখে সব পাল্টে গিয়েছে। সুন্দরের কোনো বয়স নেই। প্রত্যেক মানুষের আলাদা সৌন্দর্যরূপ রয়েছে। ভদ্রলোক অনিমানের সঙ্গে নেমেছেন? অনিমান হাতের কার্ড এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,এটা কোথায় বলতে পারবেন?
ভদ্র্লোক কার্ডটা উল্টেপাল্টে দেখেন আবার অনিমানের উপর চোখ বোলায়। উনাকে না দেখিয়ে কোন দোকানে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল ভাবে।
–ইয়ে তো রাশেদ আই মিন রাশেদুল ইসলামের ফ্লাট। আমি ওদিকেই যাচ্ছি।
–হ্যাঁ হ্যাঁঁ সেদিকেই যাব।
–আমি তোমাকে তুমি করে বলছি কিছু মনে করেছো।

–না কি মনে করবো। আপনি আমার বড় তুমি করেই বলতে পারেন।

— চলতে চলতে কথা বলা যাক। আমাকে তুমি করে বলবে। তোমার ব্যবহার আমার ভালো লেগেছে। কিসে পড়ো? কি জন্যে যাচ্ছো রাশেদের বাড়ি?
— এইতো বিএ পড়ছি। টিউশনি করে আমাকে চালাতে হয়। রাশেদ সাহেবের বাড়িতে যাচ্ছি টিউশনির জন্য।
–খুব ভালো। এই তো রাশেদ সাহেবের বাড়ি। আর কার্ডটা রাখো। এটা আমার অফিস কার্ড। তোমার ব্যবহার ভালো লেগেছে। বিশ্বাসযোগ্য কেউ থাকলে নিশ্চিন্তে কিছু করা যাই। কখনো চাকরির প্রয়োজন হলে আমার সাথে যোগাযোগ করো।
–ধন্যবাদ!

ভদ্রলোক কি যেন ভাবেন। অনিমানের মনে হল এতকথা ওনাকে বলতে গেল কেন?সহানুভূতি পাবার জন্য কি?নিজের উপর বিরক্ত হয়।
কিছুক্ষন পর ভদ্রলোক বলল,এতে কত টাকা পাবে?ইয়ং ম্যান হ্যাণ্ডসাম আছো, ভালো পড়ালেখা আছে। এই কার্ডটায় সব আছে–ইফ ইউ লাইক ইউ ক্যান কন্ট্যাক্ট।
–এটা কি?
–সামান্য নিজের চেষ্টায় বিজনেস করছি। গেলেই বুঝতে পারবে। দিস ইজ রাশেদ ফ্লাট। পাশে একটা ফ্লাট দেখিয়ে ভদ্রলোক বাদিকে মোড় ঘুরলেন।
কি ধরণের বিজনেস করে কিছুই বলল না। কার্ডটা না দেখেই পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। ভদ্রলোককে রহস্যময়ী মনে হল। কথা শুনে অবাঙালী মনে হলেও বিহারি না পাঞ্জাবি বোঝা গেলনা। অর্নি আপুর কথা শুনলে কেউ বুঝতেই পারবে না অর্নি আপু পাঞ্জাবি। ঠিকানা মিলিয়ে দেখল ভদ্রলোক ঠিকই বলেছেন। রাস্তায় আলো জ্বলে গেছে। প্রায় পৌনে চারটেয় বাসে উঠেছিল। এর মধ্যে সন্ধ্যে হয়-হয়। ইতিউতি তাকিয়ে সিঁড়িঁ বেয়ে তিনতলায় উঠে এল। দরজায় পেতলের ফলকে নাম লেখা–রাশেদুল ইসলাম,ডব্লিউ বি সি এস। ডানদিকে কলিং বেল। চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল।এলোচুল সালোয়ার কামিজ পরা,চোখ জোড়া ফোলা ফোলা মহিলা তার আপাদ মস্তক দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি?
অনিমান কার্ডটা এগিয়ে দিতে মহিলা ভিতরে আসুন বলে সরে গিয়ে পাস দিলেন। একটা সোফা দেখিয়ে বসতে বলে চলে গেলেন। মহিলা কার্ডটা ফেরৎ দেয়নি। সামনের টেবিল থেকে একটা ইংরেজি জার্ণাল তুলে চোখ বোলাতে থাকে।পায়জামা পরে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন হাতে কার্ড।অনিমান উঠে দাঁড়াতে যাবে ভদ্রলোক হাত নাড়িয়ে বসতে বললেন।
–আহমেদ আপনাকে পাঠিয়েছে?
–হ্যা রাজু আহদেদ।
–মেয়ের কথা বলেছে আপনাকে?
–মোটামুটি।
–বাংলা কিছুটা বলতে পারলেও লিখতে পারেনা।আফটার অল মাদার টং–হে-হে-হে। অমায়িক হাসলেন ভদ্রলোক।
একজন মহিলা সঙ্গে হাফ প্যাণ্ট টি-শার্ট গায়ে একটি মেয়েকে নিয়ে ঢুকলেন। মহিলা ভদ্রলোকের পাশে বসলেন,ভদ্রলোক বললেন,মাই ওয়াইফ অঞ্জনা ইসলাম।
অঞ্জনা ইসলাম জিজ্ঞেস করলেন,তোমার নাম কি?তুমি বললাম কিছু মনে করোনি তো?
–না না আপনি আমাকে তুমিই বলবেন। আমার নাম অনিমান চৌধুরী ।
অনিমান অপেক্ষা করে কখন আসল কথায় আসবে। ভদ্রলোক মেয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,চৈতি কিছু জিজ্ঞেস করবে?
মেয়েটি কাঁধ ঝাকিয়ে বলল,আই হ্যাভ নো চয়েস,ডু হোয়াট ইউ ফিল গুড।
–একী কথা চৈতি?তোমার টিচার–। অঞ্জনা ইসলাম মেয়েকে বকলেন।
–ওহ মম,হ্যাজ হি দা হ্যাবিত অফ স্নাফ?আই কান্ট টলারেট ইট।
–না না আমার কোনো নেশা নেই,শুধু চা। অনিমান আশ্বস্থ করে।
–ওকে থ্যাঙ্ক ইউ। চৈতি বলল।
–আচ্ছা চৈতি তোমার কোন ক্লাস?
–দ্যাতস নো ম্যাটার ।মী চৈতি ইসলাম উ ক্যান সে চিত্রা।
–বন্ধুরা ওকে ঐনামে ডাকে। অঞ্জনা ইসলাম বললেন।
–আচ্ছা এবার আপনার ডিম্যাণ্ড বলুন। মি.ইসলাম জিজ্ঞেস করেন।
–অনেক দূর থেকে আসতে হবে–মানে–।
–টু-ডেজ টু-হাণ্ড্রেড?
–ওহ বাপি ওনলি সানদে প্লিজ। আদুরে গলায় বলল চিত্রা।
–ঠিক আছে। অন্য ছুটির দিন কথা বলে মাঝে মাঝে–।
–থ্যাঙ্ক উয়ু বাপি।
–সামনের রবিবার চলে আসুন।
–রবিবার?যদি তিনটে নাগাদ আসি?
মি.ইসলাম মেয়ের দিকে তাকাতে চিত্রা বলল,ওকে নো প্রবলেম।
দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে অনিমান বলল,আজ আসি?
অনিমান কিছুটা আশার আলো দেখতে পেয়েছে
চিত্রা কি নাম,অনিমান নীচে নেমে এল। সপ্তায় একদিন দু-শো টাকা আশাতীত, মনে মনে খুব খুশি। এখন মেয়েটাকে ম্যানেজ করতে পারলে হয়।আপন মনে হাঁটতে থাকে।

করিম ভাইয়ের দোকানে আড্ডা জমে গেছে। অনিকে দেখে রাজু ভাই জিজ্ঞেস করল, গেছিলি?
–ওখান থেকে আসছি।
–কি কথা হল?
–সপ্তায় একদিন,আর দু-একদিন ছুটি থাকলে কথা বলে যেতে হবে।
–টাকার কথা?
–দু-শো দেবে।
–দু-শো?তাহলে খারাপ কি?
–খারাপ নয় তবে মেয়েটা ডেপো টাইপ।
–তাতে তোর কি?তোর মাল্লু নিয়ে কথা।
–মেয়েটার নাম চৈত্রি,বলে কিনা চিত্রা বলতে–।
–চিত্রা কে বস?ভিতর থেকে শুভ ফুট কাটে।
–যাক অনির একটা গতি হল এবার বঙ্কার কিছু একটা করতে হয়। হিমু বলল।
–আমার জন্য তোদের ভাবতে হবেনা। হিমু নিজের ব্যবস্থা নিজেই করতে পারবে।
–রাজু ভাই হিমু ক্ষেপেছে। হা-হা-হা। শুভ বলল।
–আমাকে মুখ খোলাস না,সব মিঞার কুষ্ঠী আমার জানা আছে।
–তোরা কি আরম্ভ করলি? অনি যাকে পড়াবে তার নাম চৈত্রি।
–পড়ানো পটানো একই ব্যাপার। শুভ বলল।
অনিমান বলল,তুমি কাদের বলছো রাজু ভাই?এদের কাছে মেয়ে মানে মেয়ে,মানুষ নয়।
–এরা সব হাভাতের দল মেয়ের নাম শুনলেই কিছু আছে বলে মনে করে। হিমু বলল।

বাসের ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে গেল। চাকরি আমার খুব প্রয়োজন আছে। বাড়িটাও থাকবে না মনে হচ্ছে। রবি কাকু উঠে পরে লেগেছে আমাকে তাড়ানোর জন্য। কিছুদিন যাক তারপরে চিন্তা করা যাবে কি করব। এখন টিউশনি করে লেখাপড়া চালিয়ে যায়। সুযোগ পেলে পাড়াটা ছেঁড়ে দিব।

রাজু ভাই চিন্তিতভাবে বলল,তুই রবিবার যাবি কি করে?
–খাওয়া-দাওয়া তো সন্ধ্যেবেলা,আমি পাঁচটার মধ্যে ফিরে আসব। বলে এসেছি।

অনিমান রাতে শোবার আগে ডায়েরী নিয়ে বসল।বাসের লোকটার কথা ভেবে এখন কিছুটা হাসি পেল। ভদ্রলোক আমাকে কি বুঝে চাকরির অফার করেছিল বুঝতে পারলাম না। চৈত্রি মেয়েটি অদ্ভুত।তাকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখছিল। অবশ্য তার মধ্যে এমন কি আছে যে সমীহ করবে? চিত্রা বলে ডাকতে বলল। চৈত্রি কি সুন্দর নাম। মানে পূর্ণিমা বা আলোকিত করা। চিত্রার কি কোন মানে আছে?চিত্রা মানে সক্রিয়। নিজের নাম বিকৃত করে কি আনন্দ পায় মানুষ? সবাই চৈত্রিকে নিয়ে ঠাট্টা করছিল। চৈত্রি তার চাইতে আট-নয় বছরের ছোট হবে। বয়স অনুযায়ী কিছুটা বেশি বড় হয়ে গেছে বলে মনে হয়। টিউশনিটা এসময় খুব দরকার ছিল। ছাত্রীর হালচাল যা দেখছে তাতে কদিন টিকবে সন্দেহ আছে। পরশু থেকে পড়ানো শুরু। সকাল সকাল বেরিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। বর্ণপরিচয় দ্বিতীয়ভাগ একটা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। আবার মনে হল ওকে প্রথমে কবিতা পড়ে শোনাবে। ভাষার প্রতি প্রেম জন্মালে শেখার আগ্রহ হবে।

একটা ঘটনা দিয়ে মানুষকে বিচার করা ঠিক নয়।মানুষের জীবনে অনেক ঘাতঘোত ওঠা নামা আলো আধার সব আছে। তাই মানুষকে এক পলকে কখনো চিনতে পারা যায় না।

শরীরটা কেমন করছে, অনিমান স্থির হয়ে কিছুক্ষন বসে থাকে। ধীরে ধীরে শান্ত হয় মন। কাল যাবে বলেছে। দু-শো টাকার ট্যুইশনি পেয়ে মনটা খুশি? ঘুমিয়ে পড়লো বেশি রাত জাগলো না।

অনিমান চা খেয়ে বাজারের দিকে যায়। বাজার বলতে তরী তরকারী। অনিমান সাদাসিধে কিন্তু অত্যন্ত জেদী।
অনিমান দেখল মিতা কোচিং চলেছে। ইচ্ছে করেই অনিমান চলার গতি কমিয়ে দিল। মিতা দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকাতে চোখাচুখি হল। আর এড়াতে পারেনা, অনিমান এগিয়ে যেতে মিতা বলল,কাকুর ব্যবহারের জন্য আমার উপর রাগ করেছো?
–রাগের কি আছে?উনি বললেন,চাবকাবেন।পারবেন উনি আমার সঙ্গে?
–তুমি কাকুকে মারবে?হাসি চেপে জিজ্ঞেস করে মিতা।
–অতটা অভদ্র নই। এটাই আমার দূর্বলতা।
–আচ্ছা আমি ক্ষমা চাইছি।
–কেউ অন্যায় করলে ক্ষমা চায়,তুমি তো কোনো অন্যায় করোনি।
কিছু একটা দেখে মিতা চকিতে একগোছা কাগজ অনির হাতে গুজে দিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। অনিমান অবাক হয়ে এপাশ ওপাশ দেখতে থাকে,নজরে পড়ল হনহন করে মিতার কাকা আসছেন। অনিমান গোজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।কাকা কটমটিয়ে এক পলক দেখে তাকে অতিক্রম করে চলে যায়। অনিমান কাগজে চোখ রেখে বুঝতে পারে সাজেশন,চোখ তুলে মিতার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। কোচিং হতে সাজেশন দিলে দেবে বলেছিল,মিতা ভোলেনি সেকথা। অনিমান বাজারের পথ ধরল।
বাড়ি ফিরে বাজারের থলি নামিয়ে রেখে ঘরে বসে সাজেশনের উপর চোখ বোলায়। মিতা সত্যিই ভাল,কাকুর ব্যবহারের জন্য ওকে দায়ী করা ঠিক হবেনা। অনিমান বাজার থেকে এসে সোজা বাথরুমে ঢুকে পড়ল।
–এখনই স্নান করছিস?কোথাও বেরোবি নাকি?
–পরশু কলেজ খুলবে,যাই একটু আড্ডা দিয়ে আসি।
–একবারে খেয়ে বেরোস।

এই মরেছে,যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়।মুন্নী ভাবি ছেলেকে নিয়ে ফিরছে। কি ব্যাপার এত বেলা হল? মুন্নী ভাবি বলল,আর বোলনা। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। তোমার ভাই অফিসে,রাজু অফিসে। এই একটু আগে বাস এল,রাস্তায় নাকি খারাপ হয়ে গেছিল। তুমি কোথায় চললে?
–সোমবার কলেজ খুলে যাচ্ছে। তার আগে একটু ঘুরে দেখি।
–লেখকদের দেখা আর অন্যদের দেখা আলাদা।লোকে চোখ দিয়ে দেখে,লেখকরা দেখে মন প্রাণ দিয়ে।

ভাবির কথায় লজ্জা পেলেও অনিমানের কথাটা ভাল লাগে। সত্যিই কি সে মনপ্রাণ দিয়ে দেখে?এই তো কত লোক তার আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। কখনো কি তাদের মনপ্রাণ দিয়ে দেখেছি?
–রাজুর কাছে শুনলাম,তুমি নাকি একটা মেয়েকে বাংলা শেখাবে?
–হ্যা মেয়েটা ফট ফট ইংরেজি বলে,নিজেকে ভাবে খুব স্মার্ট।
ভাবি হেসে ফেলে। হাসি থামিয়ে বলল,ভাষার প্রতি যদি প্রেম না থাকে তাহলে যতই শেখাও কিচ্ছু হবেনা। প্রেম থাকলেই জানতে ইচ্ছে হয়। আসি অনেক বেলা হল। তুমি ঘুরে দেখো।
ভাবির কথাগুলো মনে মনে নাড়াচাড়া করে অনিমান। প্রেম থাকলেই জানার ইচ্ছে?সে কি সবাইকে জানতে চায় বুঝতে চায়?সবার মনকে তন্ন করে দেখতে চায়?কবি বলেছেন,কভু ভাবি পল্লীগ্রামে যাই/নামধাম সকলই লুকাই/চাষীদের মাঝে রয়ে/চাষিদের মত হয়ে/ চাষীদের সঙ্গেতে বেড়াই। ঠিকই চাষীদের জানতে হলে তাদের জীবনের শরিক নাহলে বিশ্বাস করে নিজেদের অকপটে মেলে ধরবে না।

বেলা একটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ে অনিমান। ভাগ্য ভাল বাসে উঠতে একজন সিট ছেড়ে ওঠার উদ্যোগ করছে। অনিমান ঠেলে এগিয়ে গিয়ে বসে পড়ে। যাক বাবা আজ আর কেউ টানাটানি করবে না। বাস যত এগিয়ে চলেছে চিত্রার কথা মনে পড়ছে আর বুকের ধুকপুকানি বাড়ছে। তিন তলায় উঠে কলিং বেল টিপতে সেই মহিলা দরজা খুলে একটা ঘর দেখিয়ে দিল। অনিমান দেখে বুঝতে পারে এটাই চিত্রার পড়ার ঘর। দরজায় শব্দ হতে দেখল একমুখ হাসি নিয়ে চিত্রা দাড়িয়ে,চোখাচুখি হতে বলল,ইউ আর টুউ ইয়াং,আই কান্ট টেল ইউ স্যার মি.অনিমান।
–এ্যাজ ইউ লাইক।

একটা টেবিলে দুজনে মুখোমুখি বসল। অনিমান ব্যাগ থেকে দ্বিতীয়ভাগ বের করে বলল, তুমি পড়ার চেষ্টা করো। অসুবিধে হলে বলবে।
চিত্রা মনোযোগ দিয়ে চোখ বোলাতে লাগল। দ্বিতীয় ভাগে চোখ বোলাতে বোলাতে একটা শব্দ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,হোয়াট ইজ দিস?
অনিমান শব্দটা উচ্চারণ করতে চিত্রা জিজ্ঞেস করে,মিনিং?
–আকাঙ্ক্ষা মানে ইচ্ছে।
–ওহ গড! বেঙ্গলি ইজ ভেরি টাফ। নাক কুচকে বলল চিত্রা।
মুন্নী ভাবিে কথা মনে পড়ল,প্রেম থাকলেই আগ্রহ জাগে। অনিমান বলল,একটা কবিতা শুনবে?
–পোয়েম?ওকে ফাইন।
অনিমান আবেগ দিয়ে আবৃত্তি করে,

বাঁকা চাঁদ জেগে রবে–নদীটির জল
বাঙালী মেয়ের মত বিশালাক্ষী মন্দিরের ধুষর কপাটে
আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে ভয়ে….।

মুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতে চিত্রা বলল,ভেরি নাইস।উড ইউ মাইণ্ড ইফ আই টেল ইউ তুমি?
–নো প্রব্লেম। তোমাকে একটা অনুরোধ করি?
–ওহ সিয়োর।
–বাংলা শেখার সময় আমরা শুধু বাংলা বলব,রাজি?
–তোমার আকাঙ্ক্ষায় সম্মত।

মনে মনে হাসে অনিমান। একটু আগে শেখা ‘আকাঙ্ক্ষা’ শব্দটা প্রয়োগ করেছে।
–ভুল বলেছি?
–ঠিক বলেছো। তবে তোমার ইচ্ছে মেনে নিলাম বললে আরও ভাল হত। আকাঙ্খা ইন ইংলিশ ডিজায়ার।
–ডিজায়ার? গ্রাজুয়ালি আই মিন ধীরে ধীরে হবে।পোয়েমটা বলো। বুঝতে না পারলেও একটা মিউজিক আছে মনকে নাড়া দেয়।

দেখিবে কখন কারা এসে আমকাঠে সাজায়েছে চিতা
বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ
চেয়ে রবে…..।

–অনি তুমি সুন্দর করে বলতে পারো।
–এটা জীবনানন্দের কবিতার লাইন।
–সব কথা বুঝতে পারি নি কিন্তু মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। বাংলাটা ভাল করে শেখা হলে কবির একটা বই আমাকে দেবে?

চিত্রা মন দিয়ে পড়ছে। ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে আছে অনি। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। এক সময় বই থেকে মুখ তুলে চিত্রা বলল, অনি আরেকটা কবিতা বলবে?
অনিমান শুরু করে,

সন্ধ্যা হয়–চারদিকে শান্ত নীরবতা
খড় মুখে নিয়ে এক শালিক যেতেছে উড়ে চুপে
গোরুর গাড়িটি যায় মেঠোপথ বেয়ে ধীরে ধীরে
আঙ্গিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তুপে।

পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে
পৃথিবীর সর রূপ লেগে আছে ঘাসে
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনার মনে
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে-আকাশে।

চিত্রা অবাক হয়ে অনিমানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অস্বস্তি বোধ করে অনিমান। চিত্রা হেসে বলল,অনি ফ্রাঙ্কলি স্পিকিং তোমাকে খুব ভাল লেগেছে। একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
–কেন করবে না? বলো।
–প্রেম সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?

অনিমান দেখল চিত্রা বেশ চিন্তিত। হাতে সময় কম,কি বলবে বুঝতে পারেনা। বাংলা আলোচনা করতে করতে বাংলা শিখবে। অনিমান বলল,প্রেম ব্যাপারটা আমার কাছেও খুব স্পষ্ট নয়। আজ অনেক সময় হল। পরে আরেকদিন আলোচনা করব আমরা?
–স্যরি আমি খেয়াল করিনি।

চিত্রা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলল,ইউ আর ডিফারেণ্ট নট অ্যা টিপিক্যাল টিচার।
আরেকটু আগে বেরনো উচিত ছিল। রাজু ভাই বিরক্ত হবে হয়তো।

প্রচণ্ড ভীড় বাসে। এখন ওসব ভাবলে হবেনা।পাদানিতে পা রাখতে কণ্ডাকটর কোমরে হাত দিয়ে তুলে নিল। ভীড় ঠেলতে ঠেলতে ভেতরে ঢুকে কোন মতে অনিমান একটু জায়গা করে নিল। চিত্রার মধ্যে তাচ্ছিল্যের ভাব,এখন মনে হচ্ছে সেটা দেখার ভুল। মেয়েটি চমৎকার,বুদ্ধিমতী এবং শার্প মেমরি। হয়তো ওর মুখে ইংরেজি শুনে নিজের হীনমন্যতা বশত ওকে মনে হয়েছে ডেপো।বাইরে থেকে বুঝতে গিয়ে অনিমান আবার ধাক্কা খেলো।

সন্ধ্যেবেলা লুচি তরকারি চা দিয়ে চলে গেছে মুন্নী।দরজা বন্ধ করে টিভি দেখছে রাজন। পাশের ঘরে চলছে ভূতের নেত্য। রাজনের মুখে যতই বিরক্তি প্রকাশ করুক মুন্নীর মত বউ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। অফিস যাওয়া ছাড়া কিছুই করেনা,মু্ন্নী আর তার দেওর রাজু সবদিক সামলায়। রাজুটা চাকরি পাওয়ায় ধকল আরও বেড়েছে অথচ ব্যবহারে সামান্য বিরক্তি নেই।অবাক লাগে তার ভাইটাকে কেড়ে নিয়ে কেমন নিজের ভাই করে নিয়েছে।
সবাই লুচি তরকারী নিয়ে বসে গেছে। পাশে ক্যারামবোর্ড হয়তো খেলা চলছিল। গান বাজছে।অনি ঢুকতেই বরুণ বলল,এইতো অনি,ঠিক সময়ে এসে গেছে। ভাবি তোর খোঁজ করছিল।
অনিমান রান্না ঘরে উকি দিয়ে দেখল রাজু ভাইও সেখানে। জিজ্ঞেস করল,ভাবি তুমি খুঁজছিলে?
–হ্যা আয় তুই আমাকে সাহায্য করবি। রাজু তোমার ছুটি।
–ভাবি অনি একেবারে আনাড়ী,ও পারবে না। রাজু ভাই বলল।
–কে নাড়ি আর কে আনাড়ি আমি জানি। তুমি যাও।
রাজু বেরিয়ে যেতে অনিমান বলল, ভাবি রাজু ভাই ভুল বলেনি।
–আমি তোমার ভুল ভেঙ্গে দিচ্ছি। আগে খেয়ে নেও। মুন্নী লুচির প্লেট এগিয়ে দিল।
খুব ক্ষিধে পেয়েছে,প্লেট হাতে পেয়ে অনিমান খেতে লাগল।
–ছাত্রী কেমন মনে হল? মু্ন্নী জিজ্ঞেস করে।
–ভাবি আমি আবার ঠকলাম। এক পলক দেখেই ওকে বলেছিলাম ডেপো।
মুন্নী মুখ টিপে হাসে। ভাল লাগে অনির সঙ্গে কথা বলতে,জিজ্ঞেস করে,এখন কেমন মনে হচ্ছে?
–এখনই বলবো?
–সমস্যা কি?
–যদি আবার পরে মত বদলাতে হয়?
–বদলাবে। সব কিছু বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত,মত এক জায়গায় স্থির থাকবে ভাবলে কি করে?
–মেয়েটি খুব ইন্টেলিজেণ্ট। বেশ সংবেদনশীল, আজকালকার মেয়েদের মত নয়।
–তুমি আবার ভুল করলে। এক-আধজনকে দেখে সবাইকে দাগা মেরে দেওয়া কি ঠিক?
–স্যরি ভাবি,মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। আসলে আসার পথে তনিমার সঙ্গে দেখা হল। মেয়েটাকে আমার খুব হালকা প্রকৃতি মনে হয়।
–খাওয়া হয়েছে?এবার এই চিংড়ি মাছগুলোর মাথা ছাড়িয়ে দেও। মুন্নী একবাটি মাছ এগিয়ে দিল।
অনিমান অসহায় বোধ করে। দ্বিধা জড়িত গলায় বলল,ভাবি আগে আমি কখনো মাছ ছাড়াইনি।
মুন্নী হেসে ফেলে। অনি বলল,আসলে কি জানো আমার মা এই অবস্থা করেছে। কোনদিন একটা কাজ করতে দেবে না। খালি বলে পারবি না,তুই হাত দিলে আর খেতে হবেনা। এখনতো সব পাশের বাড়ি ভাবি করে দেই।
–ঠিক আছে আমি তোমাকে শিখিয়ে দেবো।মুন্নী দেখিয়ে দেয় কিভাবে চিংড়ি মাছের খোলা ছাড়াতে হয়।
মাটিতে থেবড়ে বসে অনিমান সযত্নে খোলা ছাড়াতে লাগল। মুন্নী লক্ষ্য করে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটার পর একটা খোসা ছাড়াচ্ছে অনি। রাজু সব কিছু করে হড়বড়িয়ে অনি ধীরে সুস্থে।মুন্নী বলল,তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
–এ আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে?
–তুমি তো অনেক মেয়ে দেখেছো?মেয়েদের সম্পর্কে তোমার কি মনে হয়?
অনিমান হেসে বলল,তোমার সামনে বলবো?
–ভুলে যাও আমি একজন মেয়ে,একজন কৌতুহলী শ্রোতা মাত্র।
–ভাল বলেছো। আমরা একজন মহিলার মধ্যে কেবল মহিলাকেই সনাক্ত করি মানুষটা আড়ালে থেকে যায়। এটাই বড় বিভ্রম।
মুন্নী ইচ্ছে করেই অনিকে রান্না ঘরে ডেকেছে,ওর সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে। এটাই ওর বড় গুণ,বলা যায় সম্মোহন।
–ভাবি আমরা যা জানি বই পড়ে অন্যের কাছে শুনে আর স্বচক্ষে দেখে তারপর উপলব্ধির টেবিলে ফেলে বিশ্লেষণ করে আয়ত্ত করি। তুমি বিরক্ত হচ্ছো নাতো?
মুন্নী হাসল। তারপর বলল,সারারাত ধরে আমি শুনতে পারি কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে ও ঘরে একদল বসে আছে তাদের কথা ভুলে গেলে চলবে না।
–আচ্ছা সংক্ষেপে বলছি। এক জায়গায় তিনটে সাধু পথের কথা পড়েছিলাম। জ্ঞান কর্ম আর প্রেমের পথ। জ্ঞান কর্মের পথ ধীরে ধীরে,সেটা পুরুষের পথ। বিচার বিশ্লেষণ হিসেব করে তারা গ্রহণ করে। নারীর পথ প্রেমের পথ সেখানে ভাবাভাবির অবকাশ নেই। অনায়াসে ঝাপিয়ে পড়ে।
মুন্নী জিজ্ঞেস করে,যেমন?
–যেমন বিয়ের পর একটা পরিবেশ ছেড়ে অন্য পরিবেশে এসে শ্বশুর শাশুড়ি ভাসুর দেওর জা ননদ–নানা চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কেবল মেয়েরাই পারে। এখানেই তাদের মহত্ব। ভাবি শিক্ষার উদ্দেশ্য কি?বইতে পড়েছিলাম,adjustment অর্থাৎ সঙ্গতি সাধন।মেয়েরা এই শিক্ষায় দক্ষতা নিয়েই জন্মায়। পুরুষ যা করে স্বার্থ প্রণোদিত হয়ে করে, নারী নিঃস্বার্থভাবে করে। আমার চোখে নারী অনেক অনেক বড়,পুরুষ কোনো দিন তার ধারে কাছে পৌঁছাতে পারবে না।
মুন্নী চিংড়ী মাছের বাটিটা তুলে নিয়ে দেখল সুন্দর করে ছাড়িয়েছে,ভাতের মধ্যে মিশিয়ে দিল।ভিনিগারে ভেজানো মাংস দেখিয়ে বলল,দেখো তো টিপে নরম হয়েছে কিনা?
অনিমান পরীক্ষা করে। মুন্নী জিজ্ঞেস করল,আচ্ছা পলাশের বিধবা বোন বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে গেল।শুনেছি এখন নাকি খারাপ পথে চলে গেছে। তুমি কি বলবে?
অনিমানের চোখ ছলছল করে উঠল। সন্ধ্যা আপুকে চেনে অনিমান। বিয়েতেও গেছিল। বিয়ের বছর খানেক পর স্বামী বাইক দুর্ঘটনায় মারা যায়।শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা বলল, অলক্ষুণে বউ।টিকতে না পেরে বাপের বাড়ী ফিরে আসে। পলাশ ভাই নাইম ভাই তখন বিয়ে হয়ে গেছে। আন্টিও বেঁচে নেই। চাচা নিজে সংসারে গলগ্রহ। দু-তিনমাস পরেই সন্ধ্যা আপু কোথায় যে হারিয়ে গেল,কেউ খোঁজ করনি।
–ভাবি তুমি বললে বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে গেল।তুমি হয়তো ভেবে বলোনি কিন্তু তুমি কি নিশ্চিত পালিয়ে গেল না পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল সন্ধ্যা আপু?আমরা যাদের খারাপ মেয়ে ভাবি সেটা তার বাইরের পরিচয় ভাল করে খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেই মেয়ে সব কিছু স্বাভাবিক মেনে নিয়ে প্রতিনিয়ত কত ত্যাগ স্বীকার করে চলেছে।আমার মাকে দেখে বুঝতে পেরেছি,দারিদ্র্য অভাব নয় মাকে কষ্ট দেয় একমাত্র চিন্তা কবে তার বোকা ছেলেটা নিজের পায়ে দাড়াবে,যখন থাকবে না কে তাকে দেখবে। কিন্তু আজ আর মা নেই–। ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে অনিমান। মুন্নী বলল,ছি বোকা ছেলে কাঁদেনা। কেউ দেখলে কি বলবে।
–ভাবি পেটে ছুচো দৌড় শুরু করেছে। অন্য ঘর থেকে আওয়াজ এল।
মুন্নী চোখের জল মুছে বলল,আর দশ মিনিট।
অনিমান লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। মুন্নী বলল,এবার যাও বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করো।
অনিমান এঘরে এসে দেখল সিরাজ নেই। বরুণ জিজ্ঞেস করে,তোর হাত পড়েছে ভাবছি আজ না অভুক্ত থাকতে হয়।
–সিরাজকে দেখছিনা–।
–আমি কিছু বলব না। বরুণ বলল।
এতরাত অবধি তনিমাকে আটকে রেখেছে। এদের কোনো মাত্রাজ্ঞান নেই। রাজু ভাই বিরক্তি প্রকাশ করে।
–ঠিক সময় এসে গেছি?সিরাজ ঢুকেই জিজ্ঞেস করল।
বরুণ বলল,আর দশ মিনিট।
রাজু ভাই শুয়ে শুয়ে গান শুনছিল কাছে যেতে জিজ্ঞেস করল,সল্ট লেকের কি খবর?
–মোটামুটী।
–টিকবে মনে হয়?
–আমি চেষ্টার কসুর করছিনা।
মুন্নী বলল,জায়গা করে বসে যাও সবাই।
প্লেটে সাঁজিয়ে খাবার নিয়ে গেল রাজনের ঘরে।ইতিমধ্যে মেঝেতে শতরঞ্চি পেতে জায়গা তৈরী।বরুণ বলল,দারুণ গন্ধ ছেড়েছে মাইরি।
–তুই যে বললি অনি হাত দিয়েছে আজ সবাইকে উপোস করতে হবে?
মুন্নী পরিবেশন করতে লাগল। অনিমান বলল,ভাবি হেল্প করবো?
–দরকার নেই মোটে তো দশজন। তুমি বসে যাও।
–রাজু ভাই দারুণ করেছো। সিরাজ বলল।
কথা বলতে বলতে খাওয়া চলতে থাকে।খাওয়া শেষ হতে পরস্পর বিদায় জানিয়ে সবাই বাড়ীর পথ ধরে। বাড়ী ফেরার সময় মন খারাপ,কাল থেকে কলেজ খুলে যাবে।
.
.
.
চলবে…….!

[আজকের পর্বটি কেমন হয়েছে কমেন্ট করে জানান।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here