জীবনের অন্যরঙ পর্ব-১০

0
495

#জীবনের অন্যরঙ [১০ম পর্ব]
#আজিজুর রহমান

জলময়, নদী তবু নহে জলাশয়,
কূলে কূলে বন্ধন তবু গাহে গান ;
বুকে তরণির বোঝা কিছু যেন নয়–
সিন্ধুর সন্ধানী চঞ্চল-প্রাণ।
দুই পাশে থাক তব বন্ধন-পাশ,
সমুখে জাগিয়া থাক সাগর-বিলাস॥

ঘুম থেকে উঠে ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে অনিমান বাথরুমে ঢুকে গেল। নীচে মিস্ত্রিরা আশপাশে চা খেতে গেছে।এসেই শব্দ করে কাজ শুরু করবে। অনিমানের পাশের খবর আঙ্কেল এখনো জানেনা। আজ গিয়ে বলবে। তাকে দুটো কাজ দিয়েছে একথা যেচে আঙ্কেল কে বলতে যাবেনা। অফিসের ক্যাণ্টিনে পয়সা দিয়ে খাওয়া যায়। অনিমান বাইরে থেকে খেয়ে যাবে।ক্যান্টিনে পাঁচ জনের সঙ্গে দেখা হোক চায় না। দুরত্ব রাখলে গুরুত্ব বাড়ে। অফিসে কি একটা গুঞ্জন শুনছিল শাকিলকে পুলিশ নাকি ধরেছে, প্রাইভেট কেস করছিল। তার এসব খবরে দরকার কি?এখানে যা পাচ্ছে তাই যথেষ্ট অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। পর মুহূর্তে মনটা বিষণ্ণ হয়,চিরকাল কি এইভাবে কাটিয়ে দেবে জীবন?ম্লান হাসি ফোটে ঠোঁটের কোলে। সবার সব ইচ্ছে পূরণ হয়না। রাজু ভাই বলছিল লেখাটা ছাড়িস নে। অনিমানের মুখটা শুকিয়ে যায়। তাকে নিয়ে সবার কত আশা। যদি কোনোদিন সবাই জানতে পারে? বুক কেঁপে ওঠে।

অনিমান উপন্যাস নিয়ে বসেছে। যত পড়ে বদলাতে ইচ্ছে হয়। অফিসে আগের মত ডাক পায়না। তাই হাতে অঢেল সময়।

চাকরি তার একটা দরকার। এই অফিসে থেকে সমাজে সম্মান প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। বেলা পড়ে এসেছে,তৈরী হয়ে ভাবল,একবার পাড়াটা চক্কর দিয়ে আসা যাক।

পাড়ায় পৌঁছে এক চমকপ্রদ খবর শুনল। করিম ভাইয়ের দোকানে রাজু ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। রাজু ভাইয়ের বিয়ে হবে খুশির খবর কিন্তু বিয়ে ঠিক হয়ে গেল অথচ অনি কিছুই জানতে পারে নি?অভিমান হয়। কিছুক্ষন পর রাজু ভাই এলো। অনি কোনো কথা বলেনা। রাজু ভাই গল্প শুরু করে। অনি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।

মুন্নী ভাবিকে নিয়ে বাপের বাড়ী গেছিল। রাজু ভাই বিন্দু বিসর্গ কিছু জানেনা। একটা ঘরে ভাবি ও ভাইয়া সঙ্গে গল্প করছিল। এমন সময় একটি মেয়ে প্লেটে করে খাবার দিয়ে গেল। কিছুক্ষন পর চা। মেয়েটি খুব লাজুক দেখতে সুশ্রী। আড়চোখে একবার দেখে মুচকি হেসে চলে গেল।
ফেরার পথে ট্রেনে ভাবি জিজ্ঞেস করল,উষা কে কেমন লাগল?
–কে উষা?অবাক হয় রাজু।
–ভুলে গেলে? তোমাদের খাবার দিল,চা দিল। উষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম এ করেছে। বিধবা মা, ভাই সামান্য চাকরি করে। বেশি দিতে থুতে পারবেনা।
–এসব আমাকে কেন বলছো?
–বাঃ তোমার বিয়ে তুমি বলবে না কি আমি বলব?
রাজু বুঝতে পারল কেন ভদ্রমেয়েটি মুচকি হেসেছিলেন।
–উফস ভাবি। আমি বললেই হবে?ঐ মেয়ের একটা মতামত আছে না? রাজু বলল।
–সেসব তোমাকে ভাবতে হবেনা।
–ঠিক আছে আমি কিছুই ভাবতে চাইনা। তুমি যা ভাল বুঝবে করবে।

মুন্নী আড়চোখে দেওরকে দেখে বলল,পছন্দ হয়েছে এটাও মুখ ফুটে বলতে পারোনা। তোমাদের ছেলেদের এই এক দোষ।
–ভাল করে দেখলে না বিয়ে ঠিক হয়ে গেল?শুভ জিজ্ঞেস করল।
রাজু বলল,একী কুমারটুলির প্রতিমা? ভাবি দেখেছে আবার কি–। একটাই খারাপ ব্যাপার লেখাপড়ায় আমার উপরে।

অনি না তাকালেও কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল। একী কুমোরটুলির প্রতিমা–কথাটা ভাল লাগে। রাজু ভাই লক্ষ্য করেছে অনি কিছু বলছে না, জিজ্ঞেস করল,কিরে অনি তুই একেবারে চুপচাপ?
–কি বলব?বিয়ের দিন দেখব কেমন দেখতে হল ভাবি?

রাজু পকেট থেকে একটা ছবি বের করে অনিকে দিল। সবাই হামলে পড়ল। অনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছবিটা দেখল। তারপর অন্যরা ছবিটা নিয়ে নিল।
রাজু ভাই হেসে জিজ্ঞেস করল,কেমন লাগল?
–রঙ চঙা মলাট দেখে বইটা কেমন মন্তব্য করা ঠিক হবেনা।
–একেই বলে লেখক। বাশার ফুট কাটে।
–কচুর লেখক। বিরক্তি নিয়ে অনিমানের মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেল।

সবাই হো-হো করে হেসে উঠল। কিন্তু অনিমান হাসেনা,কতটা যন্ত্রণা থেকে কথাটা অনিমান বলেছে সেটা কেউ বোঝেনি। বাসায় ফেরার সময় রাজু ভাই একান্তে জিজ্ঞেস করে,তুই আর লিখছিস না?
—রাজু ভাই তোমাদের সেই অনি আর নেই। অনিমান কেঁদে ফেলল।

অন্যদের আসতে দেখে রাজু বলল,ঠিক আছে পরে শুনবো। চোখ মুছে ফেল।

হোটেলে খেয়ে অটোতে চেপে বসল। রাজু ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। ভালই লাগে, বিয়ের পরও কি চ্যারিটির জন্য সময় দিতে পারবে?সবই নির্ভর করে বউ কেমন হবে তার উপর। রাজু ভাইকে ঐসব কথা না বললেই পারতো। সমস্যা তার ব্যক্তিগত এখানে রাজু ভাই কি করতে পারে। এখন লজ্জা করছে।আসলে বাশার যখন তাকে লেখক বলল মনে হল যেন নরম জায়গায় কথাটা বিদ্ধ হল। মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। রাজু ভাই বউ নিয়ে সিনেমা যাচ্ছে ছবিটা কল্পনা করে হাসি পেল। সবার সঙ্গে বউ মানায় না। রাজু ভাই মানে কার কি হল কোথায় কি হল দৌঁড়ঝাপ ইত্যাদি বউ নিয়ে সুখের সংসার রাজু ভাইয়ের সঙ্গে খাপ খায়না। অটো থেকে নেমে দেখল তিনজন মিস্ত্রি বসে বিড়ি টানছে। অনিমান কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,তাস খেলছেন না?
–পার্টনার নাই,আপনি খেলবেন?
–আমি খেলতে জানিনা। পার্টনার কোথায় গেল?
–দেশে গেছে,ওর বউ অসুস্থ।

অনিমান উপরে উঠে এল। বউ অসুস্থ তাই দেশে গেছে। ওর কেউ নেই,ভাই থেকেও নেই। সংসারে আজ তার কেউ নেই,সে বড় একা। সবাই কারো না কারো জন্য বেঁচে আছে, মা যখন বেঁচে ছিল প্রায়ই বলত তোর যে কি হবে তোর জন্য শান্তিতে মরতেও পারছিনা। সে কার জন্য বেচে আছে?অনিমানের চোখ ঝাপসা হয়ে এল।

রাজুর কাছে অনির কথা শুনে মুন্নীর মন খারাপ হয়।সেই অনি আর নেই। কথাটার মানে কি?মা নেই,খোঁজ খবর নেবার মত কেউ নেই সংসারে। ছেলেটার যে কি হবে,ভেবে দুশ্চিন্তা হয়। কোনো খারাপ সঙ্গে পড়লনা তো?প্রথমদিকে পাড়ায় আসতো না এখন নাকি প্রায়ই আসে রাজুর কাছে শুনেছে। চ্যারিটিতে টাকা দিয়েছে।নিজের মনে বলে যারা এভাবে কাঁদে তাদের মন খুব পরিস্কার।

–আচ্ছা রাজু,তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে অত টাকা কোথায় পেল?
–ভেবেছিলাম করব কিন্তু যদি ভাবে সন্দেহ করছি তাই করিনি।
–তুমি ঠিক করোনি। তুমি ওকে ভালবাসো,ও তোমাকে বিশ্বাস করে,সন্দেহ করলে করত তোমার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। জোর দিয়ে বলল মুন্নী।
–ভাবি এখন মনে হচ্ছে তুমি ঠিক,আমার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল।
— মুন্নী ওকে খুব ভালোবাসে।
–ওকে সবাই ভালবাসে। রাজু বলল।

মুন্নী মনে মনে হাসে রাজু বুঝতে পারেনি তার কথা।মুন্নী বলল, বিয়েটা মিটুক। তারপর একদিন তুমি ওকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি কথা বলব,সে অনি নেই দেখি কি অনি হয়েছে।

ভাবির কথা শুনে হাসল রাজু। অনির জন্য ভাবির চিন্তা ভাল লাগে।

উপন্যাসটা নিয়ে বসল অনিমান। পড়তে পড়তে আবার রাজু ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। অনিমান ভাবে মুন্নী ভাবি বিয়েটা ঠিক করে দিয়েছে। কেউ না কেউ ঠিক করে দেয়। তার তো কেউ নেই। বিয়ের জন্য উপার্জনের সংস্থান থাকতে হয়। তার উপার্জনের সংস্থান কি?নিজে কি করে ভেবে অনিমানের শরীর গুলিয়ে উঠল।

অনিমান আবার উপন্যাসে মনটা ফিরিয়ে আনে। তার উপন্যাসে নায়ক-নায়িকার প্রেমকে বাড়ীর লোকেরা মেনে নিতে পারছেনা। নায়ককে প্ররোচিত করছে নায়িকাকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার জন্য কিন্তু এভাবে বিয়েতে নায়কের উৎসাহ নেই। অনিমানের সঙ্গে অনেক মেয়ের আলাপ হলেও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। মিতা ছাড়া প্রায় সকলেরই কারো না কারো সঙ্গে সম্পর্ক আছে। বয়সে কয়েক বছরের বড় হলেও অর্নিতা আপুকে ভাল লাগত,বেশ হাসি খুশি।ওর সঙ্গে প্রেম করার কথা কেউ ভাবতে পারত না।হঠাৎ পাড়া ছেড়ে কোথায় না কোথায় চলে গেল। যাবার আগে তার খোঁজে বাড়ীতে এসেছিল,দেখা হয়নি। এখন তার দলে শুধু বাশার,বেচারা চেষ্টা করেও সাফল্য পায়নি।

বই খাতা সরিয়ে রেখে শুয়ে পড়ল। বাশারের কথা ভাবতে ভাবতে হাসি পেল। কি যেন নাম মেয়েটার?দেখতে আহামরি কিছু নয় কিন্তু পড়াশুনায় ছিল চৌখস। হ্যা মনে পড়েছে মেয়েটির নাম দেব্রতি। তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী। বাশার তাকে খুব পছন্দ,স্কুল ছুটির আগে রোজ স্কুলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকত।একদিন কি ভুত চেপেছিল কে জানে,চিঠি লিখে মেয়েটির হাতে গুজে দিল।পরেরদিন অনেক আশা নিয়ে বাশার দাঁড়িয়ে থাকে কখন দেব্রতি স্কুলে আসে,হয়তো তার হাতে চিঠির উত্তর গুজে দেবে। এক সময় নজরে পড়ল দেব্রতি আসছে। বাশার দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে। কেননা দেব্রতি একা নয় সঙ্গে ষণ্ডা চেহারার ভাইটাও ছিল। বাশার আর সেমুখো হয়নি। দেব্রতিকে এখন আর দেখা যায়না।অন্য কোথাও চলে গিয়ে থাকবে।

মানুষ যায় আর আসে,সবকিছু এক জায়গায় থেমে থাকেনা। আবার কেউ কেউ গিয়েও ফিরে আসে। কাকা চলে গেছিল ফ্লাট হয়ে গেলে আবার ফিরে আসবে পুরানো পাড়ায়। সেও একদিন সরদার পাড়ার পাট চুকিয়ে আবার নিজের এলাকায় চলে যাবে।

মুহূর্তে কিভাবে মানুষ বদলাতে পাঁরে দেখে অবাক হয় অনিমান। মাণিক তলা থেকে বাসে উঠল। মায়ামতি সিনেমার কাছে আসতে মনে পড়ল সন্ধ্যা আপুর কথা।সেও কি আস্তে আস্তে সন্ধ্যা আপুর মত হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা আপু একটা কথা বলেছিল এ লাইনে ভাই মামা কাকা কোনো সম্পর্ক নেই। মিতা শুভ্রতার থেকে সামাজিক অবস্থানে অনেক ফ্যারাক ছিল। ক্রমশ সেই ব্যবধান আরো বাড়ছে। পাঁচ রাস্তার মোড়ে দীপ্তভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর মুর্তির দিকে তাকিয়ে নিজেকে অশুচি মনে হয়। চোখ ছলছল করে ওঠে। সভ্য সমাজ থেকে কি দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ?
পাড়ার কাছে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে এল। বাস থেকে নেমে পকেটে হাত দিয়ে অনুভব করে কড়কড়ে বাইশশো টাকা। পাড়ার পথ ধরে আপন মনে হাঁটছে।দেখতে দেখতে পুঁজো এসে গেল। অফিসে শুনেছে পুঁজোর সময় কাজের চাপ বাড়ে। এখন একবার স্নান করতে পারলে ভাল হত। মনে হচ্ছে আবর্জনার পাহাড় ডিঙিয়ে এসেছে। মা নেই ভালই হয়েছে নিজের চোখে ছেলের এই অধঃপতন দেখতে হলনা। অনিকে অবলম্বন করে স্বপ্ন দেখতো। মনে মনে মাকে বলে,মাগো আমি তোমার কোনো আশাই পুরণ করতে পারলাম না। ভেবেছিলাম ভীড়ের মধ্যে সহজে চেনা যায় এমন একজন হব। হয়ে গেলাম শেষে অন্ধকার গলীর মুখোশধারী। করিম ভাইয়ের দোকানের কাছে আসতেই অনিমানের চোখের জল মুছে ফেলে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে।

–এই তো অনি শালা অনেকদিন বাঁচবি। তোর কথাই হচ্ছিল। বাশার উৎসাহের সঙ্গে বলল।

তাকে নিয়ে কি কথা?ব্রেঞ্চের একপাশে পল্টু ঝুকে কাগজ পড়ছে,তার পাশে বসতে শুভ বলল,শোন অনি আমাদের বাড়ীর সবাইকে বলেছে। কিন্তু আমরা ঠিক করেছি রাজু ভাইকে আলাদা করে কিছু দেবো। পঞ্চাশ টাকা ধরেছি। তুই কি বলিস?
–ঠিক আছে আমার তো বাড়ী নেই। ভেবেছিলাম আমি আলাদা করে কিছু দেব। আচ্ছা আমিও তোদের সঙ্গে দেবো।
–বাড়ী নেই কিরে? ভাবিকে দেখলাম রাজু ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছে। রাজু ভাই কি ভাবিকে বাদ দেবে ভেবেছিস?হিমেশ বলল।
–হ্যারে অনি তোর কি শরীর খারাপ?সুবীর জিজ্ঞেস করল।

মুখ ঘুরিয়ে সুবীরকে দেখে অবাক,হেসে বলল,নানা শরীর ঠীক আছে। তোর খবর কি বল?
সুবীর বুঝতে পারে কি জানতে চায় অনি,বলল,খবর আর কি?বিসিএ-তে ভর্তি হয়েছি।
–আর বিএ?
–সময় হলে দেখা যাবে। আজকাল জেনারেল এডুকেশনের কোনো দাম নেই।
অনিমান তর্ক করল না। কি বলবে সুবীরকে? বিএ অনার্স করে কি করছে সে?রাজু আসতে আলোচনা থেমে গেল।
–নেমন্তন্ন শেষ?শুভ জিজ্ঞেস করে।
–ওটা ওখানে কি করছে?পল্টুকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে রাজু।
–এ্যাই পল্টু তখন থেকে কি পড়ছিস বলতো?এখন তো কোনো খেলা নেই।

পল্টূ ক্রিকেট প্রেমী কাগজ থেকে চোখ তুলে বলল, এই পড়ছি আর কি।
–অনি তুই আমার সঙ্গে একটু যাবি। দু-একটা বাকী আছে সেরে ফেলি।
–আমিও যাব। বাষার সঙ্গে সঙ্গে ঊঠে দাড়াল।
রাজুর সঙ্গে অনি আর বাশার চলে গেল। কয়েকটা বাড়ীর পর একটা ফ্লাটের নীচে এসে বাশার হাক পাড়ে, মঞ্জিত–এই মঞ্জিত।
দোতলা থেকে মঞ্জিত উকি দিয়ে বলল,রাজু ভাই?আমি আসছি।

একটু পরেই মঞ্জিত নীচে নেমে এসে বলল,কার্ড না দিলেও আমি যেতাম। তোমার বিয়ে বলে কথা।ভাবীজীর সঙ্গে আলাপ করব না?
–শোন বিয়েতে আমার বাড়ীর লোক আর ভাবির কিছু জানাশোনা মহিলা ছাড়া আর সব আমার বন্ধু-বান্ধব–তুইও যাবি। বউভাতের দিন পাড়ার লোকজন। দুটো তারিখ মনে রাখিস।
–ঠিক আছে। আবার তো দেখা হবে।
–আমার সঙ্গে দেখা নাও হতে পারে। অবশ্যই যাবি।

অনি বুঝতে পারে তাকেও দুদিন বলবে?বাশার বলল,বউভাতের দিন মঞ্জিতকে ভাংড়া নাচাবো। অর্নিতা আপু থাকলে হেভি জমতো।
–অর্নির কথা আমিও ভেবেছি। কোথায় আছে জানলে গিয়ে নেমন্তন্ন করে আসতাম।
–অনিকে খুব ভালবাসতো। বাশার বলল।
–অর্নির পাড়ার জন্য একটা ফিলিংস ছিল। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ছিল। আমাকে বলেছিল বাংলা পড়তে শেখাতে। অনি হেসে বলল।

আরো কয়েক বাড়ী নেমন্তন্ন সেরে রাজু একটা কার্ডে অনির নাম লিখে এগিয়ে দিয়ে বলল,ব্যাস দায়িত্ব শেষ।
–আমাকে কার্ড দেবার কি দরকার? অনিমান মৃদু আপত্তি করল।
–কার্ড কম পড়েলে তোকে দিতাম না। ভুলে যাস না আবার?
–তুমি কিযে বলোনা?তোমার বিয়ে আমি ভুলে যাবো?
–আমি জানি তবে ইদানীং তোর মতিগতি অন্য রকম লাগছে।
–তুই শালা খুব বদলে গেছিস মাইরি। রাজু ভাই ঠীকই বলেছে। বাশার তাল দিল।

রাত হয়েছে,ওদের কাছে বিদায় নিয়ে অনিমান রাতের খাবার খেতে হোটেলে ঢুকল। ভাতের থালা নিয়ে বসে ভাবে বাইরে থেকে তাকে দেখে কি সত্যিই অন্যরকম লাগে?পল্টূ যখন কাগজের সংবাদ শোনাচ্ছিল তার অস্বস্তি হচ্ছিল। পুলিশ যদি তাকেও ওরকম ধরে তাহলে লোকের সামনে মুখ দেখাবে কি করে?নিজেকে বলল,অনিমান ঢের হয়েছে আর নয়।আঙ্কেল কে স্পষ্ট জানিয়ে দেবে দরকার হলে মিথ্যে বলবে, চাকরি পেয়েছে তার পক্ষে সময় দেওয়া সম্ভব নয়। অন্য মনষ্কভাবে খেতে গিয়ে একটা লঙ্কা চিবিয়ে ফেলেছে। অসম্ভব ঝাল কান দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে।ঢোকঢোক করে জল খায়। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এসেছে। বেয়ারাটা বুঝতে পেরে এক্টূ চিনি এনে দিল।
হোটেলের বিল মিটিয়ে বেয়ারাকে একশ টাকা বখশিস দিল। বাসায় ফিরে দেখল তাস খেলা চলছে।উপরে উঠে চেঞ্জ করে বাথরুমে ঢূকে স্নান করল।কলঙ্কিত জীবনের ভার ক্রমশ ভারী হচ্ছে। সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হবে। মনকে শক্ত করতে হবে।বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিজেকে বেশ ফ্রেশ মনে হল।আজ আর লেখালিখি করবেনা,ঘুমোবে।

পুবের আকাশ আলো করে সকাল হল। মিস্ত্রিদের কাজের খুটখাট শব্দ কানে আসছে। চোখে মুখে জল দিয়ে বের হল অনিমান। একটা রাস্তা চলে গেছে গ্রামের দিকে। এতকাল এখানে এসেছে আশপাশ অঞ্চল ঘুরে দেখা হয়নি। মনটা বেশ চনমনে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের দিকে পা বাড়ালো। বাবুয়া এখানে ফ্লাট করছে কি ভেবে?কার দায় পড়েছে এই পাণ্ডব বর্জিত অঞ্চলে আসবে। কিছুটা এগিয়ে বাক নিতে ডানহাতি বিশাল জায়গা পাচিল দিয়ে ঘেরা। ভিতরে ঝোপ জঙ্গল হয়ে আছে। পাচিলের সীমানায় একটা ঝুপড়ি চায়ের দোকান,জনা কয়েক লোক বসে চা পান করছে। এত কাছে চায়ের দোকান সে জানতোই না। অনিমান দোকানের বেঞ্চে বসে বলল, একটা চা হবে?
কিছুক্ষন আলাপ করে বুঝতে পারে ডানদিকের রাস্তা দিয়ে মিনিট তিনেক পর বাস রাস্তা। সরদারপাড়া অঞ্চলের পিছনদিক। এখানকার মানুষ সরদার পাড়ার দিকে খুব প্রয়োজন না হলে যায়না। চোর ডাকাতের বসবাস ছিল একসময়। এই চায়ের দোকানের একসময় রমরমা ব্যবসা ছিল। কয়েক হাজার শ্রমিক ছিল খদ্দের,কারখানা বন্ধ হয়ে যাবার পর অনেক দোকান বন্ধ হয়ে যায়। প্রতি শনিবার এই রাস্তায় হাট বসত। ভীড়ে গিজগিজ করত চলাচল মুস্কিল হয়ে যেত। জিজ্ঞেস করে জানতে পারল,হাটে বিক্রী হত গেরস্থালীর জিনিসপত্র। বাহাদুর হাট বললে সবাই চিনতো। আসলে এই রাস্তার নাম বি বি রোড–বাহাদুর বদ্রীনাথ রোড।
একজন বয়স্ক মানুষ জিজ্ঞেস করল,আপনি কোথায় থাকেন?

অনিমান ফ্লাটের কথা বলতে আরেকজন বয়স্ক ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বলল,ধনা মস্তানের ছেলে,প্রোমোটার হয়েছে।
ওদের কাছে জানা গেল ধনেশ এক সময় কারখানা মালিকের পোষা গুণ্ডা ছিল। বাপের নাম ভাঙ্গিয়ে বাবুয়াও কিছুকাল মস্তানি করে এখন প্রোমোটারি ব্যবসায় নেমেছে।

চা খেয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে মনে হল কি একটা বিরাট আবিস্কার করেছে। এদিক দিয়ে গেলে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাস রাস্তা। অটোয় ওঠার ঝামেলা করতে হয়না। দুটো স্টপেজের পর তাদের পাড়ার স্টপেজ। এতকাল কি হাঙ্গামা করে যাতায়াত করতে হয়েছে।

বেলা হল স্নান করতে হবে,বাসার দিকে হাঁটা শুরু করল। নেশা বা অভ্যাসের পক্ষে কোনো যুক্তি হয়না।তার বেড়াজাল হতে ইচ্ছে করলেই বেরিয়ে আসা নেহাৎ সহজ কাজ নয় অনিমান এই সত্য মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে।

শরীর খারাপ বন্ধুর বিয়ে কতবার বলা যায়। অফিস থেকে বারবার ফোন আসছে। কথায় বলে লোভে পাপ পাপ হতে পতন। সব থেকে দুঃখ জনক রাজু ভাইয়ের বিয়েতে যেতে যেতে পারেনি। আজ বউভাত–যেতেই হবে। স্যুটকেশ খুলে টাকার গোছা গুছিয়ে তার উপর জামা কাপড় চাপা দিয়ে রাখল। এক প্রস্থ ভাল জামা কাপড় গুছিয়ে রাখে বিয়ে বাড়ীর জন্য। দেখা হলে বিয়েতে না যাওয়ার কারণ রাজু ভাইকে কি বলবে মনে মনে একটা সন্তোষজনক যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করে। অনিমানের মনে পড়ল আঙ্কেল সব খবর রাখে শাকিল কে পুলিশে ধরেছিল। তার খবর কি জানে?

সকাল থেকে উষাকে নিয়ে গপ্পে মেতে আছে রাজুর বন্ধুরা। রাজু চা দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু ভিতরে ঢুকছে না।উষা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে রাজুকে চেনার চেষ্টা করে। এখনো পর্যন্ত একসঙ্গে কোনো কথা হয়নি। বাশার ছন্দার একেবারে গা ঘেষে বসেছে। উষার কেমন সম্পর্কিত বোন ছন্দা। কাল রাত থেকে এখানে আছে। হিমেশ ফিস ফিস করে পল্টুকে বলল,দেখ বলদটা কেমন সেটে বসে আছে। বাশার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে সুবীর মৃদু স্বরে গান গাইল,কোথায় পেরেক ঠূকছ পাচু ও মাটি বড় শক্ত। ছন্দা কি বুঝল কে জানে মুখ ঘুরিয়ে মুচকি হাসল। বাশার কট মটিয়ে সুবীরকে দেখে বিরক্তি নিয়ে বলল,সব জায়গায় ছ্যাবলামি।
–আপনার এখানে খুব বোর লাগছে তাই না? বাশার জিজ্ঞেস করল।
–না তা নয়,আসলে কাউকে চিনিনা জানিনা–। ছন্দা আমতা আমতা করে বলে।
–বাইরে বেরিয়ে একটু ঘুরলে ভাল লাগবে।
–তা ঠিক। ছন্দা বলল।

উষা সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে ছন্দাকে চিমটি দিল। ছন্দা হাত দিয়ে উষার হাত সরিয়ে দিল। এই ছেলেটা কাল রাত থেকে তার সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করছে,ছন্দার মজা লাগে।
–যান বাশার সঙ্গে পাড়াটা ঘুরে আসুন। শুভ ফুট কাটল।

সারা ঘর হো-হো করে হেসে উঠল। উষা মুখ চাপা দিয়ে হাসি দমন করে। বাশার গম্ভীর কোনো কথা বলেনা। উষা জিজ্ঞেস করল,আপনাদের মধ্যে অনি কে?

সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। উষা বলল,কাল থেকে নামটা শুনছি তাই–।
–লেখক। বাশার বলল। ও এখনো আসেনি।সন্ধ্যেবেলা আলাপ করিয়ে দেবো।
–আমার সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দেবেন তো। অনেক লেখকের নাম শুনেছি কিন্তু কারো সঙ্গে সামনা সামনি কথা বলিনি। ছন্দা বলল।

মোবাইল বাজতে কানে লাগিয়ে অনিমান বলল,সন্ধ্যেবেলা দেখা হবে…বিশ্বাস করো. ..সব তোমাকে বলব….ঠিকই, বিশ্বাস আমিই আমাকে করিনা….রাজু ভাই রাগ হওয়া স্বাভাবিক অস্বীকার করছিনা..সব কথা শুনলে আর রাগ করতে পারবেনা ….ভাবিকে বোলো ঝড় বাদল কিছুই আমাকে আটকাতে পারবে না….আচ্ছা।

রাজু ভাই ছাড়া অন্য কেউ হলে এত খারাপ লাগত না।বিপদে আপদে রাজু ভাই সব সময়ে তার পাশে থেকেছে। গতকাল এক ফাঁকে গিয়ে দেখা করে আসলে ভাল হত। আবার কে ফোন করল?
–হ্যালো?
–অনি?
–বলছি,আপনি?
–মী এমা । ক্যান ইউ প্লিজ কাম টুডে?
–অলরেডি প্রি অকুপায়েড। চারটের সময় জরুরী এ্যাপয়নমেণ্ট।
–প্লিজ অনি,তিনটের আগেই আমার কাজ করে দিতে পারবে। টু-থার্টি পিএম আমার ফ্লাইট, বেঙ্গল লিভ করতে হবে। দোন্ত ডিজ হার্টেন মী । অফিসে তোমার অনেক সুনাম শুনেছি। আমার কাজটা করে দিতে পারলে অনেক উপকার হতো।

অনিমান মনে মনে হিসেব করে,সাড়ে-তিনটের ফ্লাইট ধরতে অন্তত একঘণ্টা আগে রিপোর্ট করতে হবে? অনিমান জিজ্ঞেস করল,তুমি একা?
–আমার ফ্রেণ্ড বরখা আর আমি।
–আপনি কি ফরেনার?
–ইন্ডিয়াতে একটা এন জি ও-তে আছি। প্লিজ অনি–।
–আপনি কি আমার ব্যাপারে জানেন?
–এভ্রিথিং হি-হি-হি, ইউর জিনিয়াস মাইন্ড এন্ড মেনুপুলেট করার ক্ষমতাও।
–কিন্তু কাল হলে ভাল হত মানে–।
–জরুরী কাজে আজই বেঙ্গল লিভ করতে হচ্ছে।তোমার সঙ্গে কথা বলছি আই এ্যাম ফিলিং এক্সসাইটেড। তুমি আমার কাজটা করে দিকে পারলে মোটা অংকের টাকা পাবে।
–আচ্ছা দেখছি–।
–নো দেখছি ,তুমি ঠিক একটায় রিচ করছো।ঠিকানাটা লিখে নেও।

অনিমান ঠিকানা লিখে নিয়ে বলল,আমার ক্লায়েন্ট রেট বেশি কিন্তু বেশী। অসফল আমি কখনোই হয় না। তাই ভেবে বলুন আমাকে দিয়ে ক্লায়েন্ট এক্সিকিউট করবেন কিনা?
–ও কে দ্যাট ইজ নট প্রব্লেম।
–ঠিক আছে।
ওপাশ থেকে এমা বলল,থ্যাঙ্কিউ ।
থ্যাঙ্ক ইউ ?এখানে থাকতে থাকতে কথা বলার ঢং বদলে গেছে। বিদেশিনীরা অনেক বেশি সক্রিয়। বিদেশ থেকে এখানে এসে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় আছে।তিনটের আগে রিলিজ করে দেবে চারটে হলেও অসুবিধে হত না। ইচ্ছে করেই হাতে সময় রেখেছে।পাঁচটার মধ্যে রাজু ভাইয়ের বাসায় গেলেই যথেষ্ট।দরকার হয় রাতে থেকে যাবে। পরক্ষনে খেয়াল হল আজ তো বাসররাত। রাতে থাকা উচিত হবেনা। ছবিতে দেখেছে আজ স্বচক্ষে দেখবে রাজু ভাইয়ের বউকে।

গেস্ট হাউস ভি আই পিতে,দরকার হলে ট্যাক্সি নিয়ে নেবে। এবার একটা ব্যাঙ্ক এ্যাকাউণ্ট খুলতে হবে।এতগুলো টাকা আলগা ফেলে রাখা রিস্ক হয়ে যাচ্ছে।টাকা হাতে এলেই ব্যাঙ্কে ফেলে দাও,ব্যাস নিশ্চিন্ত।
.
.
.
চলবে….!

[গল্পটি কেমন লাগছে আপনাদের কমেন্ট বক্সে মতামত জানান।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here