জীবনের অন্যরঙ পর্ব-১১

0
314

#জীবনের অন্যরঙ [১১তম পর্ব]
#আজিজুর রহমান

সময় মতো ঠিকানা খুঁজে অনিমান সওয়া-একটা নাগাদ গেস্ট হাউস খুজে বের করে, দরজায় কড়া নাড়ে। দরজা খুলে স্ব-প্রশ্ন দৃষ্টি মেলে তাকালো ফর্সা মহিলা। অনিমান পরিচয় দিতে মহিলা বলল,এ্যাম এমা। কাম অন অনি। ইউ টেইক সিট। সি ইজ বিনু রায়।

অনিমান বলতে লাগলো,”আমার হাতে সময় বেশি নেই। আপনাদের সমস্যা খুলে বলুন। কি কাজের জন্য হোয়াইট কান্ডার্সি প্রয়োজন?”

–আমি ও বিনু একটি সংস্থার অংশ হয়ে এখানে এসেছি। আর এখানে এসে যে কারেন্সি কালেক্ট করেছি তা ব্লাক। তোমাকে তা এখন যে করেই হোক হোয়াইটে কনভার্ট করে দিতে হবে। এমা বলল।

–সে আমি আপনার সাথে ফোনে কথা বলে বুঝতে পেরেছি। আমি করে দিব। তবে আমার ফিস এই কাজের জন্য ফোরটি লাখ। অনিমান বলে উঠলো।

— নো প্রবলেম অনি। আমরা তোমাকে তাই পেইড করব। আমাদের হাতেও সময় নেই। এই সুকেক্সে ৫০ লাখ রয়েছে। আমাদের কাজটি দ্রুত করে দাও। বিনু বলল।

–প্রথমে আপনাদের ল্যাপটপ দিন আমায়। অনিমান বলল।

অনিমান ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ে। প্রথমে অফিস ওয়েবে লগ ইন করে নিজের একাউন্ট একজিস্ট করে নিল। তারপর এমার দেওয়া লিগ্যাল একাউন্টে টাকা টান্সফার করে দিল। আর এমার ব্লাক টাকা অফিস একাউন্টে টান্সফার করে দিল। যা পরবর্তীতে হোয়াইটে কনভার্ট হয়ে কোম্পানির অন্য কাজে ব্যবহৃত হবে। আর কিছু কাজ বাকি রয়েছে যা কাগজ কলমের। এগুলো করতে শুরু করলো অনিমান।

এমন সময় মনে হল কেউ দরজা ধাক্কাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে এমা বলল,ডোণ্ট ডিস্টারব,কাম অন লেটার।ক্যারি অন অনি।

আবার কড়া নাড়ার শব্দ। এমা বিরক্ত হয়ে সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞেস করল,হু ইজ দিস?
–পুলিশ,দরজা খুলুন।

সকলে পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। অনিমানের মুখ শুকিয়ে যায়। এমা ওদের এক পলক দেখে দরজা খুলতে এগিয়ে গেল। বাইরে গাড়ীর হর্ণ বাজছে।সম্ভবত পিকাপ এসে গেছে। দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে পুলিশ ঢুকে দেখল মেঝেতে টাকার সুকেক্স পরে আছে। বিদেশিনী মহিলার চোখে মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই। একপাশে অনিমান মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অফিসার হুকুম করল,ওই বেটাকে ভ্যানে তোল। একজন সিপাই অনিমানের কলার চেপে টানতে টানতে নীচে দাঁড়ানো ভ্যানে তুলল।
এমা জিজ্ঞেস করে,হোয়াট হ্যাপেন অফিসার।
কিছুক্ষন দুজনের মধ্যে ইংরেজিতে কথাবার্তা হয়,আলাপ করতে করতে ব্যাগ খুলে বিভিন্ন কাগজ পত্র দেখাল। তারপর হাজার পাঁচেক টাকা দিতে পুলিশ অনিমানকে নিয়ে চলে গেল।

পুলিশের সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এমা এবং বিনু গাড়ীতে উঠে বিমান বন্দরের দিকে রওনা হল। চোখে মুখে বিরক্তি অতৃপ্তির ছাপ। মনে মনে গজরাতে লাগল,দে উইল নট বী এ্যাট পিস। স্কাউন্ড্রেল।

সন্ধ্যা থেকে ললিত রাগে সানাই বাজছে। বিকেল থেকে রাজুর দলবল হাজির। বাশার এখনো ছন্দার পিছনে ঘুর ঘুর করছে। শুভর খারাপ লাগে,এভাবে প্রেম হয়না। চোখ মুখ দেখে বুঝেছে ছন্দা মেয়েটা সেয়ানা টাইপ। বাশারকে খেলাচ্ছে,বলতে গেলে ভুল বুঝবে। মাঝে মাঝে রাস্তার দিকে চোখ যাচ্ছে কখন দ আণ্টি আসে। রুবিকে একা ছাড়বে না। ছাদে প্রথম ব্যাচ বসাবার তোড়জোড় চলছে। বেলা চৌধুরী নতুন বউয়ের পাশে বসে অভ্যাগতদের সামলাচ্ছে। মুন্নী ভাবি সারা বাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছে। আণ্টি সপরিবারে এলেও রুবির হাত ছাড়ছেন না। রুবি ঘুরে শুভকে দেখছে ইশারায় মাকে দেখিয়ে নিজের অসহায়তা বোঝাবার চেষ্টা করছে।

রাত বাড়তে থাকে,একটু রাত করে ডাক্তার কাকু এলেন। উষা কে দেখে বললেন,চমৎকার বউ। তারপর একটা শাড়ী এগিয়ে দিলেন। উষা সালাম করে শাড়ীটা নিয়ে পাশে বসা বেলা চৌধুরির হাতে দিল। বিয়ে বাড়ী রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝিমিয়ে আসে।

হাজতে ঢুকিয়ে নিলয় সরকার রুল দিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে। অনিমান দাঁতে দাঁত চেপে থাকে মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হয়না। মনে মনে কামনা করে এভাবে মারতে মারতে মেরে ফেলুক,এই কলঙ্কিত জীবন বয়ে বেড়াবার কোনো অর্থ হয়না। এই হাজতেই শেষ হোক ঘৃণিত এই জীবন। ঘর্মাক্ত ক্লান্ত হয়ে নিলয় হাজত থেকে বেরিয়ে গেল। হাজতে বসে ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত হাতের উলটো দিক দিয়ে মুছল অনিমান। অমানুষিক মার মেরেছে কিন্তু অনিমান মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। কামনা করেছে মারতে মারতে একেবারে মেরে ফেলুক। ডাকাতি কিম্বা খুনের জন্য ধরলে দুঃখ ছিলনা। কিন্তু যে জন্য তাকে ধরেছে সেকথা মনে করে লজ্জা গ্লানিতে সারা শরীর অবশ হয়ে আসে। শুধু এইটুকু বাকী ছিল,এবার ষোল কলা পুর্ণ হল। সারা জীবন তাকে জেল বন্দী করে রাখলেই ভাল। এই মুখ আর সে বাইরে দেখাতে চায়না।

ওসি নিলয় সরকার নিজের ঘরে বসে হাপাচ্ছে।এরকম আসামী সে আগে কখনো দেখেনি। আচ্ছা আচ্ছা গুণ্ডা মস্তান স্যারের পাল্লায় পড়লে প্যাণ্ট হলদে করে ফেলে। শালার মুখে রা নেই। এই শালাকে যা জিজ্ঞেস করে,নেই-নেই। বাড়ী কোথায়?নেই। বাড়ীতে কে কে আছে? কেউ নেই। সিপাইকে ডেকে বলল,জল খাওয়াও। টেবিলের উপর হাত ঘড়ি খুলে রেখেছে।একপাশে আসামীর মোবাইল আর টাকা পয়সা।সিপাই জল নিয়ে হাপাতে হাপাতে ঢুকে বলল,এসপি সাহেব।

কচু মেরেছে আবার এসপি কেন? নিলয় স্যার ঢক ঢক করে জল খেয়ে কোমরে বেল্ট আটকে টেবিল থেকে ঘড়ী তুলে কব্জিতে বাধতে বাধতে উঠে দাড়াতে না দাড়াতে এসপি প্রবেশ করেন। নিলয় স্যার স্যালুট করে নিজের চেয়ার দেখিয়ে বসতে অনুরোধ করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

নিলয় স্যার কপালে ভাজ,থানায় কেন?তাহলে ম্যাডামের কাছে কোনো খবর আছে?
এসপি সাহেব বসে ডায়েরী বুক ঘাটতে থাকেন।
শেষ ব্যাচ বসে গেছে।

মুন্নী ভাবি এসে রাজুকে জিজ্ঞেস করল, অনি আসেনি।
অনি না আসায় রাজুর মেজাজ আগেই খিচড়ে ছিল।কিছুটা উষ্মা নিয়ে বলল,আমি কি বসেছিলাম,কে আসছে না আসছে দেখার জন্য?

মুন্নী দেওরের ক্ষোভের কারণ অনুমান করতে পারে।ইতিমধ্যে অন্যান্যরাও এসে পড়েছে। শুভ বলল, ভাবি অনি অনেক বদলে গেছে।
–তোমরা একবার ফোন করে খবর নিতে পারতে?মুন্নী বলল।

কথাটা রাজুর খারাপ লাগেনা বাশারকে বলল,ফোন করতো। বড় লেখক হয়ে গেছে।

নিয়ল স্যার একজন সিপাইকে চা আনতে ইঙ্গিত করল। এসপি সাহেব ডায়েরীর একজায়গা দেখিয়ে চোখ তুলে স্যারের দিকে তাকালেন।
স্যার বললেন,ম্যাম-।
–স্যার বলুন।
–স্যরি স্যার,একটা ব্লাক র‍্যাকেট রেইড করা হয়েছে।
–কোথায়?একজন সাপ্লাই করছিল নাকি?
–ভি আই পি রোডের একটা গেস্ট হাউসে। দুজন মহিলা একজন পুরুষ। মহিলা দুজনের মন্ত্রী লেবেলে কনট্যাক্ট আছে ,আজই দিল্লী চলে গেল।
–সো হোয়াট?
–না মানে স্যার ওদের কনফারেন্স আছে মিনিস্টার উপস্থিত থাকবেন। আরেক জন অনি।
–ওর বাড়ীর লোককে খবর দিয়েছেন?
–স্যার ছেলেটা পেশাদার ভীষণ টেটিয়া টাইপ, বলছে বাড়ী নেই নিজের কেউ নেই কিছুই বলছে না।
–তাহলে নাম জানলেন কি করে?
–সোর্স মারফৎ জেনেছি স্যার।
একজন সিপাই টেবিলে চা খাবার রেখে দিল।এসপি সেদিকে ফিরেও দেখলেন না।

এস পি সাহেব উঠে দাড়াতে টেবিলের উপর রাখা মোবাইল ফোন বেজে উঠল। এস পি জিজ্ঞেস করলেন,কার ফোন?
–আসামীর স্যার।
–ধরুন।

ওসি ফোন ধরে বললেন,হ্যালো?..কিরে অনি তুই কোথায়?…কে অনি?…মানে অনি অনিমান চৌধুরী …চ্যাংড়ামো হচ্ছে?… ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিল।
–কে ফোন করল?
–চ্যাংড়া ছেলের ব্যাপার। অনিমান চৌধুরী কে চাইছে।

অনিমান চৌধুরী ?এসপি জিজ্ঞেস করল, আসামীর নাম কি বললেন?
–আজ্ঞে স্যার অনি।
–কল ব্যাক করুন–কে ফোন করেছে?

ওসি নম্বর টিপে ফোন করল,হ্যালো একটু আগে আপনি ফোন করেছিলেন …আমি এয়ারপোর্ট থানা থেকে বলছি…।
–স্যার ফোন কেটে দিল।
এস পির কপালে চিন্তার ভাজ, জিজ্ঞেস করেন,আসামী কোথায়?
–চলুন স্যার। ভীষণ জিদ্দি।
এস পি সাহেব দূর থেকে হাজতে বসা ছেলেটিকে দেখলেন। মুখ নীচু করে বসে থাকলেও চিনতে ভুল হয়না। মুখে মেঘ জমে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেন,ওসির দিকে চোখ তুলে তাকাতে নিলয় স্যার জিজ্ঞেস করে,কিছু বলবেন স্যার?
–খুব মেরেছেন?
–না মানে এদের কাছে এসব কিছুই না–গন্ডারের চামড়া।
–মেয়ে দুটোকে ছেড়ে দিলেন?
–কি করব স্যার,একজন আবার ফরেনার। দুত্রাবাসে খবর গেলে হৈ-চৈ শুরু হবে।
–ব্লাক র‍্যাকেট প্রমাণ করবেন কিভাবে?
–রাইট স্যার।
–একে আটকে কি করবেন,ছেড়ে দিন।
–না মানে স্যার–।
–কেয়া বোলা সমঝা নেহী?এসপির চোয়াল শক্ত।
এসপির গলা শুনে ওসির শিরদাড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। মুহূর্ত বিলম্ব না করে সামনে দাঁড়ানো সিপাইকে ধমক দিল,স্যার কি বলল শুনা নেহী?
এস পি গট গট করে বেরিয়ে জিপে স্টিয়ারিং ধরে বসলেন। পিছনে বডি গার্ড উদয়।

বাশার ফোন কেটে দিতে হিমেশ বলল,কিরে কেটে দিলি?
–অনি না কে একটা অন্যলোক ধরেছিল।

রাজু বলল আমার মনে হয় কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। না হলে অনি তো ওরকম ছেলে নয়। বলেছিল ঝড় বাদল হলেও আমি আসব রাজু ভাই।

অনিমান আশপাশে চেয়ে দেখল দুটো ছেলে গারদের এককোনে ঘুমিয়ে পড়েছে। দূর্গন্ধে নাক জ্বালা করছে। এরমধ্যে কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে দেখে অবাক হয়। হাজতে কি খেতেটেতে দেয়না?তালা খোলার শব্দ পেয়ে অনিমান দেখল খালিহাত একজন সিপাই। প্রথমে মনে হয়েছিল বুঝি খাবার নিয়ে এসেছে।
–এই নিকালো।
অনিমান এদিক-ওদিক দেখে। সিপাই আবার ধমক দিল,সমঝা নেহি?নিকালো।

অনিমান বুঝতে পারে তাকেই বলছে। ধীরে ধীরে উঠে দাড়াতে গিয়ে বুঝতে সারা গা-হাত-পা বেশ ব্যথা।ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে হাজত থেকে বেরোতে ওসি ডাকল,এই এদিকে আয়।

অনিমানের কান্না পেয়ে যায় আবার মারবে নাকি?ওসির কাছে যেতে টেবিলে রাখা জিনিস পত্তর দেখিয়ে বলল,এগুলো নিয়ে যা।

স্বস্তির শ্বাস ফেলে অনিমান। টাকা পয়সা মোবাইল তুলে পকেটে ভরে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। নিলয় সরকার সেদিকে তাকিয়ে ভাবে তার অবস্থা শাখের করাতের মত। এই এস পি শুনেছে হেভি হারামী।আরেক দিকে কি মুখ নিয়ে রাকিব স্যারের কাছে দাড়াবে?যা সত্যি তাই বলবে তাছাড়া উপায় কি?কপালে যা আছে তাই হবে।

রাস্তায় এসে দাড়াল অনিমান। মাথার উপর নক্ষত্র খচিত বিশাল আকাশ। নিজেকে দীনাতিদিন অতি নগণ্য মনে হয়। কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে তাকে চিনতে পারেনা। এতরাতে যাবে কোথায়?গাড়ী ঘোড়ার দেখা নেই, দোকানপাটও বন্ধ। কাছাকাছি কোনো পার্ক থাকলে সেখানে শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া যেত। রাস্তার ধার ঘেষে ধীর পায়ে এগোতে লাগল।হাজতবাস বাকী ছিল সেটাও হয়ে গেল।
সারাদিনের ঘটনা মনে মনে ভাবার চেষ্টা করে।এতক্ষনে নিমন্ত্রিত-রা যে যার বাড়ী ফিরে গেছে। রাজু ভাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি বউয়ের সঙ্গে গল্প করছে রাত জেগে। সামনে গিয়ে দাড়াবার মুখ নেই।
পিছনে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের জীপ। উদয় রাজপাল চুপচাপ লক্ষ্য করছে স্যারকে। কোন গড়বড় হল,স্যারকে কখনো এভাবে দেখেনি। শালে ওসি কুছু বলেছে? নানা প্রশ্ন মনে উকিঝুকি দিলেও জিজ্ঞেস করার সাহস হয়না। এসপি সাহেব রুমাল বের করে চোখ মুছলেন।
–উদয়?
–জ্বি সাব?
–আপনার দেশ কোথায়?
–বিহারে সাব জি।
–কে আছে সেখানে?
উদয় রাজপাল ইতস্তত করে,এত বড় অফিসার তার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিচ্ছেন।
–কেউ নেই?
–জি স্যার আমার আউরত আছে একটা বেটা আছে।
–আপনার চিন্তা হয়না?
–জি চিন্তা হয়। কিন্তু জমিন জায়দাদ না থাকলে কলকাত্তা করে এখানে নিয়ে আসতাম।

উদয় স্যারকে আজ অন্য রকম মনে হয়।
এস পি সাহেব গাড়ীতে স্টার্ট দিয়ে বললেন,ঐ যে লেড়কাটা যাচ্ছে ওকে জীপে তুলে নেবেন।
–স্যার ওহি আদমী থানায় ছিল। উদয়ের কথা শেষ হতে না হতেই জীপ অনিমানের গা ঘেষে ব্রেক করে।উদয় রাজপাল লাফিয়ে নেমে অনিমানকে জীপে তুলে নিল। হা-করে সিপাইজিকে দেখে অনিমান।ভয়ডর কিছুই বোধ করেনা। অনিমানের মনের অবস্থা সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কিবা ভয়।

এস পি বাংলোর কাছে জীপ থামতে স্যার নেমে ভিতরে ঢুকে গেল। অনিমানের একটা ঘরে আশ্রয় জুটলো সেটা জিম, ব্যায়ামের সরঞ্জাম ভর্তি। এখানে তাকে কেন আনা হল,তার অপরাধ কি তার সদুত্তর না পেলেও রাতে মাথার উপর একটা ছাদ জুটেছে ভেবে ভাল লাগল। মেঝেতে এক জায়গায় শোবার আয়োজন করছিল এমন সময় এক মহিলা এসে একটা প্লেটে রুটী তরকা দিয়ে গেল। ক্ষিধেতে নাড়ি ছিড়ে যাবার জোগাড় তাহলেও তার পক্ষে নির্বিকার থাকা আর সম্ভব হচ্ছেনা। সেই মহিলা আবার যখন শতরঞ্চি বালিশ দিতে এল অনিমান জিজ্ঞেস করল,আপু এইসব আমাকে কেন দিচ্ছেন?

–জানিনা স্যার বললেন তাই দিলাম। খেয়ে শুয়ে পড়েন। মহিলা চলে গেল।

উদয় রাজপাল গেস্টরুমে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানেই ঘুমায় বরাবর। ক্ষিধের মুখে তরকা রুটি আচার বেশ ভালই লাগল। কপালে যা আছে তাই হবে তা নিয়ে অনিমানের চিন্তা নেই। যা হয়েছে তার চেয়ে বেশি আর কিইবা হতে পারে। রাজু ভাইয়ের বউভাতে যেতে পারল না তার কি জবাব দেবে ভেবে পায়না।

ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গতে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। কাল রাতের কথা মনে পড়ল। নজরে পড়ল একটু দূরে ট্রেডমিলে পিছন ফিরে হাঁটছে একজন। পরনে শর্টস গায়ে কালো টি-শার্ট কাধে সাদা তোয়ালে। ঘাড় অবধি ছাটা চুল,পিছন থেকে দেখেও বোঝা যায় মহিলা।একসময় মহিলা ট্রেডমিল হতে নেমে তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছে তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,ঘুম হয়েছে?

অনিমান মহিলাকে দেখতে দেখতে অতীত হাতড়ায়।একসময় চিনতে পেরে লজ্জায় মাথা ঝুকে পড়ে।
–সারারাত বাইরে কাটালি আণ্টি চিন্তা করবেন না?
অনিমান মাথা তোলেনা চুপ করে থাকে। মহিলা কাছে এসে বলল,উত্তর দিচ্ছিস না।দেবো থার্ড ডিগ্রি?
–মা নেই,মারা গেছে। গোজ হয়ে বলল অনিমান।
–আণ্টি মারা গেছে?আমার বাপুও নেই। অর্নিতা কি যেন ভাবেন তারপর বললেন,এই জন্য তোর এই অধঃপতন। এতদিন পর তোকে এভাবে দেখব ভাবিনি।
–তোমার ভাবনা মত দুনিয়া চলবে এরকম ভাবলে কি করে?অর্নি আপু আমি এখন যাচ্ছি?
–যাবি। এখন বাথরুমে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে আমার ঘরে আয়। তোর ঠোঁটে কি হয়েছে দেখি-দেখি?অর্নিতা হাত বাড়িয়ে দেখতে গেল।
–আমি নোংরা,আমার গায়ে হাত দেবেনা। অনিমান এক ঝটকায় হাত ঠেলে সরিয়ে দিল।
অর্নিতা ঠাস করে এক চড় মেরে বলল,অন্যায় করে আবার তেজ দেখানো হচ্ছে?
অনিমান গাল চেপে ধরে কেঁদে ফেলে বলল,তুমি আমাকে মারলে?

–বেশ করেছি আবার মারব। যা ফ্রেশ হয়ে আমার ঘরে আয়,কথা আছে।

অর্নি নিজের ঘরে এসে নিজেকে আয়নায় দেখল।অতবড় ছেলেকে মারা ঠিক হয়নি। কিন্তু এমন রাগ হয়ে গেল। ঘামে ভেজা টি-শার্ট খুলে জামা গায় দেয়।
ওসি নিলয় রাতে খুব মেরেছে তবু নাকি টু-শব্দটি করেনি,চুপচাপ সহ্য করেছে। আর এখন একচড়ে কেঁদে ফেলল? আঘাত সম্ভবত গালে নয় লেগেছে আরও গভীরে। অর্নিতা রুমালে চোখ মোছে।
অনিমান এল,মুখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। অর্নি তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে বলল,মুছে ফেল।
–তোকে কেন মারলাম বলতো?

অনিমান মুখ থেকে তোয়ালে সরিয়ে তাকালো। অর্নিতা বলল,মনে আছে তুই একদিন বলেছিলি তুমি টাচ করলে সব মালিন্য ধুয়ে মুছে যায়?
কতদিন আগের কথা অর্নি আপু ঠিক মনে রেখেছে। টাচ করার কি ছিরি,ফিক করে হাসল অনিমান।
–হাসলি যে?
কাজের মহিলা একটা ট্রেতে ডিমটোস্ট আর চা দিয়ে গেল। অনিমান তুলে খেতে থাকে।
–কিরে বললি নাতো হাসলি কেন?
–তুমি কি ভাববে।
–ভাববো না তুই বল।
অনিমান গম্ভীর হয়ে যায়। তারপর দ্বিধা জড়িত স্বরে বলল,অর্নি আপু তুমি যদি পাড়ায় থাকতে তাহলে এমন হতনা।

অর্নিতা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চায়ে চুমুক দিল।বুকের মধ্যে হু-হু করে উঠল। একসময় অর্নিতা বলল,পাড়ার খবর বল।
–রাজু ভাইকে মনে আছে?
–রাজু?সবাইকে মনে আছে। কেমন আছে রাজু?
–কাল রাজু ভাইয়ের বউভাত ছিল।
–আর তুই সারারাত হাজতে ছিলি?ঠিক আছে স্নান করে বিশ্রাম কর। আমি একটূ ঘুরে আসি,একসঙ্গে খাবো। পরে শুনবো সব কথা।
দ্রুত পোশাক পরে তৈরী হয়ে নিল। দরজায় হেলান দিয়ে উঁচু গলায় ডাকল,জানকি।
সেই মহিলা আসতে অর্নিতা বলল,একে দেখা শোনা কোরো। স্নান করার সময় ওকে একটা লুঙ্গি দিও।
–অর্নি আপু বাসায় যাব, দেরী হয়ে যাচ্ছে।

অর্নিতা চোখ পাকাতে অনিমান বিমর্ষ হয়ে চুপ করে গেল। অর্নিতা বলল,একদম বাইরে বেরোবি না।

পুলিশি পোশাকে দারুন দেখতে লাগছে অর্নি আপুকে। প্রায় তার সমান লম্বা ছিপছিপে শরীরের গড়ন। পিছনে দাঁড়িয়ে উদয় রাজপাল হাতে রাইফেল।অর্নি আপু এখানে ফিরে এসেছে। অর্নিতা আপুর বাবা মারা গেছেন। অর্নিতা আপুর মা ভাল আছেন?এখানে তো একাই থাকে।

অফিসেতে গোছগাছ শুরু হয়ে গেছে। রাকিব নিজের অফিসে বসে এখানে ওখানে ফোন করছেন। নিলয় সরকার এসেছে শুনে ভিতরে আসতে বললেন। নিলয় দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে বলল,সালাম স্যার।
–বসুন। কি গল্প শোনাবেন শুরু করুন।
নিলয় সরকার মাথা নীচু করে বসে থাকে।
–কে আসামীর জামীন করিয়েছে?
–এস পি সাহেব বলল একা একা কিভাবে ব্লাক এক্সিকিউট করল?
–অন্য কেস দিতে পারতেন। কি নাম এস পির?
–আপনাকে আগেও বলেছি,অর্নিতা মির্জা।
–বিয়ে করেনি?ঠিক আছে যান। অনি কোথায় গেছে জানেন?
–মনে হয় বাড়ী চলে গেছে।
–রাবিশ। মনে হয় কি?কনফার্ম খবর চাই। যেখানে থাকে লোক পাঠান।

ছেলের উপর রাকিবের কোনো রাগ নেই কেউ এর পিছনে আছে। যেভাবেই হোক ছেলেকে তার চাই চাই-ই। নিজেকে দোষারোপ করেন তার উচিত ছিল ছেলেকে এখানে এনে রাখা।

একটা নাগাদ অর্নিতা ফিরে এল। ঘরে ঢুকে দেখল স্নান করে লুঙ্গি পরে ঘুমে অচেতন। সারা মুখে নির্মল প্রশান্তি জড়ানো। এমন ছেলে কিভাবে এরকম একটা অনৈতিক ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ল ভেবে অবাক হয়। অর্নিতার মুখে হাসি ফোটে, বিপদে কখনো নিরাশ হতে কখনো দেখে নি। সবকিছু সহজ করে সামলে নিতে পারে। এই জন্যই ওর এত চাহিদা। অর্নিতা ডাকল,অনি?

অনিমান চোখ মেলে তাকিয়ে অর্নিতাকে দেখে লাজুক হেসে বলল,ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
–আমি স্নান করে আসছি। অর্নিতা বাথরুমে ঢুকে গেল।

অনিমান বুঝতে পারেনা কেন অর্নি আপু তাকে আটকে রেখেছে?এমনি নাকি কোন কারণ আছে?মোবাইল বেজে উঠল। অফিস থেকে ফোন এসেছে।ছুটে বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে বলল,অর্নি আপু রিলিফ অফিস থেকে ফোন করেছে।
–ধরবি না বাজুক। বাথরুম থেকে অর্নিতা বলল।

অনিমানের মনে পড়ল শাকিলের কথা। তাকে একেবারে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর খোঁজ নেই। অর্নিতা বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখল জানকি টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখেছে। দুজনে একসঙ্গে খেতে বসল। খাওয়া দাওয়ার পর বিছানায় দুজনে মুখোমুখি বসল। অনিকে অনেকদিন চেনে,সব কিছুর গভীরে যাবার প্রবণতা বরাবর। মেয়েদের প্রতি ছিল নিবিড় শ্রদ্ধাবোধ। সেই অনিকে এভাবে দেখবে কল্পনাও করতে পারেনি। হাজতে যখন মুখ গুজে বসেছিল তার চোখে জল এসে গেছিল। অর্নিতা জিজ্ঞেস করে, এবার সত্যি করে বলতো কিভাবে তুই এই চক্রে পড়লি?
–তোমাকে মিথ্যে বলবো ভাবতে পারলে?
–কেন আমি কে?

কি বলবে ভেবে পায়না অনিমান। অর্নি আপু তার প্রিয় মানুষের একজন কি করে বোঝাবে। অর্নিতা বলল,আচ্ছা ঠিক আছে এবার বল কিভাবে জড়ালি?
অনিমান আদ্যোপ্যান্ত সমস্ত ঘটনা একের পর এক বলে গেল। মা মারা গেল বাড়ী থেকে উৎখাত করা খাওয়া জুটতো না থেকে সব।
–তোকে কোনো প্রশ্ন করল না চাকরি দিয়ে দিল। তখন কোনো সন্দেহ হল না?
–অর্নি আপু তুমি আঙ্কেলকে দেখোনি,অদ্ভুত ক্ষমতা আমার সম্পর্কে সবজানে–।
–সে তো আমিও বলতে পারি।
–আহা তুমি আমাকে জানো তাই।
–তোর আঙ্কেল লোক দিয়ে খবর নিয়ে জানতে পারেনা?

অর্নিতা অনির দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। অনিমানের অবাক লাগে জিজ্ঞেস করে,তুমি ভাবছো বানিয়ে বলছি?
–শোন অনি তোর একটা দোষ সহজেই সবাইকে বিশ্বাস করিস।
–বিশ্বাস করা দোষের হলে অবিশ্বাস করাও দোষ।
–শোন অনি আমি একটা সাধুকে দেখেছিলাম,এক গ্লাস দুধ খেয়ে হাতের আঙুল দিয়ে বের করেছি।
–তুমি বলছো বুজ্রুকি?
–সত্যি না মিথ্যে জানিনা?তোকে দিয়ে কাজ হাসিল করে নিল এটাই আসল সত্যি। তুই গ্রাজুয়েশন করেছিস?
–হ্যা।
–আর লেখালিখি?
–একটা উপন্যাস লিখেছি।
–কোথায় দেখি।
–আমি সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি নাকি? সরদার পাড়ায় আছে যেখানে থাকি।

অর্নিতার মন অতীতে হারিয়ে যায়। আসার দিন অনির সঙ্গে দেখা করতে গেছিল। ইচ্ছে ছিল অনিকে নিজের ঠিকানা দিয়ে যোগাযোগ রাখতে বলবে কিন্তু দেখা হয়নি। অনি বিশাল এক চক্রে জড়িয়ে পড়েছে সহজে ওরা ওকে ছেড়ে দেবেনা। ওর উপর দিয়ে বিরাট ঝড় বয়ে গেছে।
–তোকে একটা কথা বলব,রাখবি?
–তোমার কথা আমি শুনিনা বলো?
–ঠিক আছে। তুই তোর মালপত্তর সব এখানে নিয়ে আয়।

প্রস্তাবটা অনিমানের মনোপুত হয়না সে ঘুরিয়ে বলল,অর্নি আপু আমি মাঝে মাঝে এসে তোমার সঙ্গে দেখা করবো?

অর্নিতা বুঝতে পারে ওর আত্মসম্মানে লাগছে। কিন্তু একা ছাড়লে আবার ওদের খপ্পরে গিয়ে পড়বে। অর্নিতা খাট থেকে নেমে দরজা বন্ধ করে দিল। অনিমান ঘাবড়ে যায়। অর্নিতা বলল, বল তোকে কত টাকা দিলে আমার সব কথা শুনে চলবি। আমার সব পার্সোনাল কাজ তুই করবি।

অনিমানের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে থাকে। অর্নিতা বলল,কিরে আয়। এগ্রিমেন্ট সাইন করে নে অফিসের নিয়ম অনুযায়ী।
অনিমান মাথা নীচু করে গাট হয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকে।
–আমি কি তোর আঙ্কেল থেকে খারাপ?

অনিমান আড়চোখে তাকাতে চোখের দৃষ্টি যেন ঝলসে গেল।
অর্নিতা বলল,ঠিক আছে আমি তাহলে রিলিফ অফিসে গিয়ে নাহয়–।

কথা শেষ হতে না-হতেই অনিমান খাট থেকে নেমে অর্নিতার পা জড়িয়ে ধরে বলল,না না তুমি ওখানে যাবেনা,অর্নি আপু অফিসের নোংরা আর অনৈতিক কাজের জায়গা তুমি যাবেনা।
–পা ছাড়–পা ছাড়।
–না তুমি বলো তুমি ওখানে যাবে না।
–কেন গেলে কি হবে?
–ওখানে ভাল জায়গা নয়।
–বুঝিস তাহলে তুই কেন গেছিলি?
–আর যাব না। তুমি ওখানে যেওনা।
–তোর কথা কেন শুনব তুই আমার কথা শুনিস?
–শুনব সব কথা শুনব। বলো তুমি ওখানে যাবেনা?
–তাহলে তুই মালপত্তর নিয়ে চলে আয়। তোর ভালোর জন্য বলছি।
–ঠিক আছে।
–তুই কিন্তু কথা দিয়েছিস। খেলাপ করলে বুঝেছিস পুলিশকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়।
দেখি তোর মোবাইলটা আমাকে দে। আসলে ফেরৎ দেবো।

অর্নিতা তোয়ালে দিয়ে অনির চোখ মুছে দিল। অনিমান মনে মনে হাসে, অর্নি আপু ভেবেছে মোবাইল রাখলে আমি ফিরে আসবো। জানে না ঐ রকম আরেকটা মোবাইল সে আবার কিনতে পারে। কি সুন্দর লাগছিল অর্নি আপুকে। কামিজে আপুকে যেন আরো সুন্দর করে তুলেছে। অনিমান কল্পনায় শাড়ী তে অর্নি আপু কেমন হবে ভেবে আরো লাজুক হেসে দিল মনে মনে।

.
.
চলবে….!

[পর্বটি কেমন হয়েছে মতামত জানান। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here