শব্দহীন_অনুভূতি পর্ব_২৪(শেষ)

শব্দহীন_অনুভূতি পর্ব_২৪(শেষ)
#পলি_আনান

ঝুম বৃষ্টিতে গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বের করে বৃষ্টি উপভোগ করছে মাইশা।গাড়ি দীর্ঘ যানজটে আটকে আছে।মেঘাবৃত আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে হাসেছে সে।সেদিনের পর জীবন থেকে কেটে গেলো আরো একটি মাস।বদলে গেছে অনেক কিছু।সময়ের পাল্লায় সবাই ব্যস্ত সময় পার করছে, তাকেও ফিরে যেতে হবে তার নীড়ে।আর কত দিন থাকবে এই দেশে।
নোমান আর প্রভার যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।হৃদিতা আর আরাফ তাদের মতো করে সংসার শুরু করেছে।বাড়ির সবাই স্বাভাবিক থাকলেও স্বাভাবিক নেই নোমানের বাবা মা।দুই ছেলেকে একসাথে হারিয়ে তারা পাথর বনে গেছে।মাইশা এখন আর এনায়েত মঞ্জিলে থাকে না।অবশ্য তাকে দেখলে যে হুমায়রা আর জাবেদের পুত্র হারানোর শোক জেগে উঠবে,সব দিক বিবেচনা করে মাইশা এখন তার বন্ধু রিকের বাড়িতেই থাকে।
এই সাপ্তাহ শেষে ফিরে যাবে নিজের দেশে আবারো ব্যস্ত হয়ে উঠবে দৈন্দিন কাজে।তাই আজ শেষ বারের মতো নোমান আর প্রভার সাথে দেখা করতে এসেছে সে।
গাড়ি কারাগারের সামনে দাড়াতেই দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে দ্রুত নেমে যায় মাইশা।সবার সাথে কথা বলে,সব ফর্মালিটি পূরণ করে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় সে।নোমানের সাথে এইসহ জেলখানায় ৩য় বার দেখা।

– কেমন আছো?মি.নোমান এনায়েত।
– তুই,তুই এখানে কেন এসেছিস?
– কেন আবার আসামীর সাথে দেখা করতে।
– একবার ,একবার শুধু আমি এখান থেকে বের হই তারপর তুই যেখানেই থাকিস, পাতালে থাকলে পাতালে তোকে খুঁজে বের করবোই।আর তিল তিল করে তোকে মারবো।তোর কারনে আমার রেপুটেশন শেষ হয়ে গেছে।

– আরে থাম থাম এই বন্ধী দশা থেকে তোমার মুক্তি হবে না।না মানে না।কোন দিন না।তোমাকে এই পর্যায়ে আনতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে
হয়েছে।আর কষ্টের ফল বুঝি এতটাই অতৃপ্তি হবে।
শত তালবাহানা করলেও মুক্তি পাবে না।একটা কথা কি যানো আমি না অনেক খুশি হয়েছি তোমার যাবজ্জীবন জেল হয়েছে।ফাঁসি হলে লাভ কী হতো বলো?গলায় দড়ি ঝুলবে আর টুকুস মরে যাবে। কিন্তু এখানে তুমি তিল তিল করে মরবে।

– আমি যদি তোকে সেদিন বাড়ি থেকে বের করে দিতাম তবে আমায় আজ এইদিন দেখতে হতো না।বাড়িতে রেখে একটা কালসাপ পুষেছি।
– সে যাই বলো আমার বোনের হত্যার প্রতিশোধ আমি নিতে পেরেছি এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।দেখলে তো নোমান এনায়েত ক্ষণিকের আনন্দ তোমায় আজ কোথায় নিয়ে এসেছে।ভালো থাকিবেন বিদায়।
মাইশা দ্রুত হেটে সরে আসে নোমানের কাছ থেকে।তীব্র ঘৃণায় নোমানের সামনে দাড়াতেও তার বিবেকে বাধঁছে।কিছুক্ষণ পর প্রভার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় মাইশা।

– হেই মোস্ট বিউটিফুল লেডি!কেমন কাটছে তোমার দিন কাল?
মাইশা কন্ঠে চকিতে তাকায় প্রভা।নিস্তেজ মুখখানায় আগের মতো মলিনতা নেই।চোখের নিচে কালি পরে গেছে।
– এখানে কেন এসেছো?
– কেন আবার তোমায় দেখতে এসেছি।দেখলে তো অতি বাড়াবাড়ি করার ফল।পায়েল! পায়েলের কথা ভুলে যেওনা কিন্তু, যদি নিষ্পাপ মেয়েটাকে না মারতে তবে তোমায় এইদিন দেখতে হতো না।
এখানে ভালো থেকো। লন্ডান থেকে যত বার বিডিতে আসবো ততবার তোমাদের দেখে যাবো আমি চাই তোমরা তিলে তিলে মরো।গুড বায়।

প্রভাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মাইশা দ্রুত হেটে চলে যায়।তার মনে পড়ে যায় পায়েলের লাশের কথা।নোমানের কথা অনুযায়ী সেই জাঙ্গলেই পায়েলের কঙ্কাল পাওয়া যায়।রিকের সাহায্য নিয়েই মাইশা এত বড় চেলেঞ্জটার জয়ী হয়ে ফিরেছে।ঝুম বৃষ্টির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে দ্রুত গাড়িতে বসে সে।উদ্দেশ্য আরাফ আর হৃদিতার সাথে দেখা করতে যাওয়া।

– আরাফ বিয়ের সময় কবুল কয়বার বলতে হয়?
হৃদিতার প্রশ্নে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আরাফ।ঠোঁট বাকিয়ে চোখ উলটে সে বলে,
– কেন তিন বার।
– তুই আমাদের বিয়ের সময় পাচঁবার কবুল বলেছিস।
হৃদিতার আড় চোখে তাকানো কথা শুনে দাঁত কেলিয়ে হাসে আরাফ।হৃদিতার হাত টেনে তার পাশে বসিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দেয়।
– আসলে তোকে পাবো সেই জন্য একটু বেশি এক্সাইটেড হয়ে গেছিলাম।তাই পাচঁ বার বলে ফেলেছি।এতে আমার বিয়েটা আরো শক্ত পোক্ত মজবুত হলো তাই না।বাই দা ওয়ে তোর নাকি বিয়ের সময় হুশ ছিল না তাহলে জানলি কি করে আমি পাচঁবার কবুল বলেছি।

হৃদিতা আরাফের পাশ থেকে উঠে তার মুখোমুখি দাড়ায়।আরাফের গালে হাত দিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে,
– কে আবার নেহা আপু বলেছে।তোর কবুলের বিষয়টা নিয়ে হাসাহাসি চলছে ওই বাড়িতে।একটা গুড নিউজ আছে।
– কী?
– সুফিয়া বানু আমাদের যেতে বলেছে।মানে বুঝতে পারছিস দাদী আমাদের মেনে নিয়েছে।
হৃদিতার ঠাট্টা সুরে কথায় ভ্রু কুচকায় আরাফ।
– মানে কি তোর দাদী আমাদের বেড়াতে যেতে বলেছে। এই বুড়ির মাথায় শুভ বুদ্ধি এলো কি করে।
– দেখ মুরব্বিদের কথা একদম ফেলবি না। মনে আছে দাদী বলেছিল নোমান ভাই তোদের সম্পদ মেরে খাবে, আমরা বিশ্বাস করি নি। উলটো রাগ দেখিয়ে তোকে টেনে নিয়ে চলে এসেছিলাম।কিন্তু দেখ দাদীর কথাটাই সত্যি হলো।মা যদি প্রভার সাহায্য না চাইতো তবে কি হতো আমাদের।
– হুম তা ঠিক বলেছিস।মাইশা তো আজ আসার কথা ছিল কিন্তু এখনো আসে নি কেন।
– চল নিচে যাই।

মাইশা বাড়িতে এসে সবার কাছ থেকে বিদায় জানায়।হুমায়রা তার ভুল বুঝতে পেরে মাইশার কাছে লজ্জায় পরে যান তবুও মাইশা সবার সাথে হাসি খুশি নির্ভেজাল সম্পর্ক বজায় রাখে।এত হাসি খুশির মাঝেও হুমায়রার মনে মনে মাইশাকে নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকেই যায়।

– মাইশা কি বলছো তুমি এত তাড়াতাড়ি ফিরে যাবে তুমি।চলে যাবে আমাদের ছেড়ে।

হৃদিতার কথা নিশব্দে হাসলো মাইশা।

– দেখো বিডিতে থেকে আমার আর কাজ নেই আমি আর কি করবো বলো।বাবা বলেছে ফিরে যাওয়ার জন্য আমি বরং চলেই যাবো।
– কিন্তু তা তো হবে না আমার কাজিন নেহার বিয়ের অনুষ্ঠান সামনের সাপ্তাহে তোমাকেও আমাদের সাথে থাকতে হবে।

হৃদিতার কথায় তাল মিলিয়ে এগিয়ে আসে আরাফ।
– আরে নেহার বিয়েতে তো খুব মজা হবে।মাইশা মনে আছে আমার নেহা ফ্রেন্ডের কথা তোমায় বলেছিলাম।সে হৃদিতার কাজিন হয়।তোমায় তো দাওয়াত করা হয়েছে তবুও তুমি চলে যাবে বলছো।তাছাড়া নাফিসা আর শাকীল তো হুট করেই বিয়েটা করে নিলো তোমায় দাওয়াত দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিলনা এবার অন্তত থাকো প্লিজ বিয়েতে অনেক মজা হবে।

সবার জোরাজোরিতে মাইশা অবশেষে নেহার বিয়ে পর্যন্ত থাকার সিধান্ত নেয়।

বাড়িতে সল্প পরিসরে বেশ আয়োজনের মধ্যে দিয়েই নেহার বিয়ের অনুষ্ঠান করা হয়েছে।বিয়েতে আজ যুগল বন্ধী হয়ে এসেছে শাকীল আর নাফিসা।এই সহ দ্বিতীয়বার নাফিসাকে শাড়ি পরিধানে দেখে সব বন্ধুরা মুগ্ধ নয়কে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
– আল্লাহ এটা কে রে। টপ’স, জিন্স পড়ে লাফালাফি করা মেয়েটা বুঝি এখন শাড়ি পরে স্বামীর হাতে হাত রেখে হাটছে।

আরাফের কথায় লাজুক ভঙ্গিতে হাসে নাফিসা।
– দোস্ত দেখ,বিয়ে মানুষ কেন করে।নির্ঘাত ফকির হওয়ার জন্য করে।শাড়ি পরতে পারেনা অথচ বিয়ের পর একের পর এক শাড়ি কিনে আমারে ফকির বানাইছে।কিন্তু আজকে বললো সে নাকি শাড়ি পরবে না।দিসি ধমক। কিন্তু কথা হইলো সে তো মাইয়া মানুষ তারে তো আবার ধমক দেওয়া যায় না দিলেও বিগড়ে যাবে ত্যাড়ামি করবে,এবার নাকি বিয়েতেই আসবে না। আমি আর কি করমু হাতে পায়ে ধরে শাড়ি পরতে বলে রাজি করিয়ে,পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তারপর আসলাম। উফফফ জানটা বাইর হই যাচ্ছে রে দোস্ত।

শাকীলের কথায় সবাই অট্ট হাসিতে মেতে উঠে।নাফিসা চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকে শাকীলের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে কাচুমাচু হয়ে যায় শাকীল।

– তোদের ঝগড়া বিয়ের পরেও চলছে বাহ বাহ।

আরাফ কথাটি বলে আবার হাসতে থাকে।সবাই সবার মতো করে বিয়ে বাড়ি উপভোগ করছে। মাইশার বাবা কল করায় সে একটু আড়ালে গিয়ে কথা বলে হঠাৎ করেই পিছনে ঘুরতে কারো সাথে ধাক্কা খায়।মাথা তুলে তাকাতেই লিবানকে দেখে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়।
– সরি সরি আমি বুঝতে পারি নি।
লিবানের অনুনয় স্বরের কথায় সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মাইশা।
– ইট’স ওকে।
– আরাফের কাছে আপনার সম্পর্কে অনেক কথাই শুনেছি।আপনি তো মাস্টার মাইন্ড। বাই দা ওয়ে আমরা কি পরিচিত হতে পারি?
-আমার পেছনে ঘুরে লাভ নেই আমি বিবাহিত।
মাইশার কথা শুনে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে লিবান।মাইশার দিকে ঝুকে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
– হৃদিতা আমায় আগেই বলেছে যার সাথে লাইন করার চেষ্টা করবেন তার বিষয়ে একটু অবগত হয়ে নিবেন।তাই তো আপনার সম্পর্কে আগেই জানলাম।আপনি বিবাহিত না পিউর সিঙ্গেল।

লিবানের কথায় চমকে যায় মাইশা।এই ছেলেতো হাবলুর মতো থাকলেও আড়ালে শয়তানি নিয়ে ঘুরে।
– তো আমি সিঙ্গেল দেখেই কি প্রেম করতে হবে না কি?
– আমি আমার মনের কথাটাই বললাম আর বাকিটা আপনার ইচ্ছা।
লিবান হাসতে হাসতে সেখান থেকে প্রস্থান করে।এদিকে মাইশা দ্বিধা দ্বন্দে পরে যায়।হঠাৎ এই ছেলেটা তার আশেপাশে থাকায় এমন অস্থিরতা লাগলো কেন?তার মন যে অন্য কথা বলছে।
লেখনীতে পলি আনান।
বিয়ে শেষে কনে বিদায় পর্ব চলে এলো।আরাফ হৃদিতা কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেছে।নাফিসা,মাইশা হৃদিতার হাতে হাত রেখে সাহায্য করছে।লিবান আর শাকীল টুকটাক সাহায্য করে এক কোনায় দাঁড়ায়।

– কিরে লিবান তুই কি এখানে থাকবি না কি আড়ালে যাবি?
– কেন আমি আড়াল হবো কেন?
– না মানে তোর তো আবার মেয়েদের কান্না দেখলে নিজের ও কান্না পায় তাই বললাম।
শাকীল ঠোঁট টিপে হাসছে আর তা দেখে রেগে যায় লিবান।
– সবসময় ফাজলামো ভালোলাগে না শাকীল।
– ওকে যা আর মজা করবো না।অল দা বেস্ট চোখের পানি কন্ট্রোল করিস।

কিছুক্ষণ পরেই কনে বিদায় পর্ব শুরু হয়ে যায়। নেহাকে বিদায় দিতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ওয়ালীদ,হামিদা এবং সুফিয়া।হৃদিতা ফুঁপিয়ে কাঁদছে।শাকীল, আরাফ,মাইশা নাফিসা,লিবান সবাই একপাশে দাঁড়িয়ে আছে।

হঠাৎ করেই নাফিসার কানে ফ্যাচ ফ্যাচ কারো কান্নার আওয়াজ আসে।সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই লিবানের কান্নারত মুখটা দেখেই বিস্মিত হয়ে যায় সবাই।মাইশা আহাম্মক বনে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লিবানের দিকে।সবার দৃষ্টি দেখে দ্রুত লিবান চোখ মুখ মুছে নেয়।

– হোয়াট দা ফাও!তুই আবার কান্দস লিবান? এইসব কি দেখায় আল্লাহ আমারে।
শাকীলের কথায় তার পীঠ চাপড়ে হাসতে থাকে আরাফ।
– থাক থাক জ্বালাইস না তোরা। সে একটু দুঃখ প্রকাশ করুক।
– লিবান তুই নাকি আমার বিয়েতে কেঁদে ছিলি কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি।আজ আমার বিশ্বাস হয়েছে তুই সত্যি কেঁদেছিস।
নাফিসার কথায় মুখ ঘুরিয়ে নেয় লিবান।
– তোরা ইমোশনাল জিনিসেও ফাজলামি করস ভাল্লাগে না।সর সামনে থেকে।
লিবান রাগ দেখিয়ে দ্রুত চলে যায়।কিন্তু তার দিকে এখনো দুটো চোখ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।

সবার আড়াল হয়ে মাইশা তার বাবাকে ফোন করে। গিয়াস মেয়ের আর্তনাদ কন্ঠ শুনেই থম মেরে যান।
– বাবা আই ওয়েন্ট লিবান!আই নিড ইট বাবা, আই নিড ইট!
– হোয়াট? কি বলছো তুমি?তোমার মাথায় আবার কোন ভূত চাপলো।
– বাবা তুমি বলেছিলেনা আমাকে কোন আহাম্মক বিয়ে করবে।
– আমি সেই আহাম্মকটাকে পেয়ে গেছি।
– কিন্তু কে সে?
– লিবান। প্লিজ বাবা তুমি আজকের ফ্লাইটে বিডিতে আসবে।আর আমি শীঘ্রই বিয়ে করবো ছেলেটাকে এটাই ফাইনাল ডিসিশন।
– ছেলে কি করে বংশ পরিচয় না জেনেই আমি তোমার বিয়ে দিয়ে দেবো আজব!
– বাবা ছেলে একটা আহাম্মক!তবে যাই হোক তোমার মেয়েকে কোন দিন কষ্ট দেবেনা সিওর থাকো।আমি যা বলি তাই করি বাবা।তাই আমাকে অবাধ্য করবে না।তুমি দ্রুত বিডিতে আসো।

মাইশা ফোন রাখতেই গিয়াস নির্বোধ হয়ে যান, হচ্ছে টা কি?

সময়ের তার আপন গতিতে পেরিয়ে যায়।কিন্তু বন্ধন গুলো অটুট থাকে সারাজীবন। কেটে গেছে আরো সাতটি মাস।মাইশা আর লিবানের বেশ ধুমধাম করেই বিয়ে হয়েছে।বর্তমানে তারা লন্ডনেই আছে।শাকীল আর নাফিসা দুজনে মিলে তাদের বাবার ব্যবসার কাজে মন দিয়েছে তার পাশাপাশি পড়াশোনাটাও চলছে।

হৃদিতা বর্তমান সময়ে এনায়েত বাড়ির সবচেয়ে প্রিয় সদস্য।শশুড়-শাশুড়ীর সাথে পারিবারিক ব্যবসার কাজে হাত লাগিয়েছে সে নিজেও।তার সাথে আরাফ টুকটাক সাহায্য করছে।

ভার্সিটির উদ্দেশ্য বেরিয়ে আরাফ হঠাৎ করেই উলটো রাস্তায় বাইক ঘুরিয়ে নেয়।
– আরে আরাফ কোথায় যাচ্ছিস? ভার্সিটি যাবি না? আমার ইনপটেন্ট ক্লাস আছে।
– হিসসস স্বামীর থেকে ইমপটেন্ট ক্লাস আর থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না। চুপ যা এবার।
– দেখ ফাজলামি করবি না একদম, দ্রুত গাড়ি ঘুরা আমি ভার্সিটি যাবো।
– চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে যা।আমি ভার্সিটিতে যাবো না।

আরাফের ঘাড় ত্যারামো কথায় তার ঘাড়ে জোরে ঘুষি দেয় হৃদিতা।তার কাদো কাদো মুখ খানা বাইকের আয়নায় দেখে মুচকি হাসে আরাফ।

কিছুক্ষণ পরেই তারা পৌছে যায় সেই কফি শপে। তা দেখে হৃদিতা অবাক না হয়ে পারলোনা।
– এখানে কেন আরাফ?
– আগে নাম তারপর বলছি।

হৃদিতা গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে যায়। মূল ফটোকে আসতেই সে থেমে যায়।সম্পূর্ন মেঝে শিউলি ফুলের গালিচা। হৃদিতা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়েই আরাফ তাকে এগিয়ে যেতে বলে হৃদিতা জুতা খুলে এগিয়ে যায়।আগের কফি শপের চেহারাটা বর্তমানে সম্পূর্ণ পালটে গেছে।মাঝ খানে এসে দাড়াতেই হৃদিতার সামনে একটি পর্দা চোখে পড়ে আর সেই পর্দায় স্লো ভয়েজে মিউজিক চালছে। তার সাথে সাথে হৃদিতার একের পর এক ছবি আসতে থাকে। প্রত্যাকটা ছবি গোপনে তোলা।কিছু ছবি কফি শপের,আবার কিছু ছবি চিরচেনা সেই পুকুর পাড়ের, লাইব্রেরি, ক্লাস,মাঠ সব জায়গায় আড়ালে হৃদিতার ছবি তুলে সংগ্রহ করেছিল আরাফ।হৃদিতা স্তব্দ, স্তম্ভিত হয়ে থ বনে গেছে।
হৃদিতা মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই আরাফ তাকে সামনে পর্দায় তাকাতে ইশারা করে। তখনি আরেকটি ভিডিও অন হয়।যেখানে আরাফ এক গুচ্ছ সাদা-লাল গোলাপ হাতে কফি শপের চিরচেনা সিটে বসে আছে।আরাফ মুচকি হেসে বলতে শুরু করে,

” ‘হৃদিতা’ আমার কাছে আস্ত একটা ভালোবাসার নাম।যাকে প্রথম দেখায় আমি প্রণয় আগুনে জ্বলেছি, তাকে পাওয়ার তৃষ্ণা আমায় আকুল করলেও নিজেকে অটুট রেখেছি।দৈর্য্য ধরেছি মাসের পর মাস।তাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু না তাকে তো ভুলার নয়; সে তো আমার রাতের ঘুমে হানা দেবে।বৃষ্টির দিনে তার কথা ভাবতেই শিহরণ বয়ে যাবে।ধাপে ধাপে আমার স্পন্দন বাড়িয়ে তুলবে। এবার এই মেয়েকে আমি ভুলবো কি করে?তাকে কাছে পাওয়ার আকুলতা যখন আমায় সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে তখনি আমি নানান ছল বাহানায় তাকে কাছে আনি।

আমি জানি তোমার মনে আছে এই কফি শপের কাটানো প্রতিটি দিনের কথা।যে অবাধ্য ছেলেটা পড়াশোনা নামক মরিচিকার পেছনে ছুটেনা, সে ছেলেটা এই মরিচিকার মাধ্যেমেই তোমায় কাছে এনেছে।তোমার হৃদয়ে গড়ে তুলতে চেয়েছিল মৃদ্যু স্পন্দন!
তোমায় নিয়ে বললে আমার শেষ কখনোই হবেনা।
তুমি তো সেই মেয়ে,
পরিবারের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করতে সব কিছু করতে পারে। দায়িত্ব, দয়া, নিঃস্বার্থতা, সহানুভূতি এবং আনুগত্য তোমার দুর্দান্ত গুণ।যার হৃদয়ে আছে অফুরন্ত ভালোবাসা। হৃদিতা নিখুঁততার সাথে সবকিছু পরিচালনা করতে পারে এবং খুব বিশ্বাসযোগ্য।সবাইকে আগলে রাখে সে যে পরম যত্নে।

তোমাকে কি করে দূরে সরাই আমি বলো?তোমার ভালোর জন্য হলেও আমি তোমায় কখনো ছাড়বো না।কারন আমি জানি আমার চেয়েও কেউ কোন দিন তোমায় ভালোবাসতে পারবে না।সুখী করতে পারবেনা।তোমার বাধ্যে হয়ে চলবে না।তাই এই হৃদিতার জন্য গন্ডমূর্খ, হাঁদারাম,আহাম্মক আরাফটাই প্রয়োজন।

যদি আমি নির্বোধ হয়ে, আমাকে গুছিয়ে দেওয়ার জন্য এমন একজন পার্ফেক্ট জীবন সঙ্গী থাকে তবে আমি নির্বোধ থাকতে চাই সারা জীবন।
তুমি বলনা ‘ভালোবাসি’ নামক শব্দটা তোমায় আমি কোনদিন বলিনি।কেন বলবো আমি?ভালোবাসি বললেই কি ভালোবাসা হয়ে যায়।তোমার প্রতি আমার যে যত্ন,আগলে রাখা, অবাধ্য ছেলে বাধ্য হওয়া।এইসবে কি ভালোবাসা খুঁজে পাওনা।যদি বলি আমার ভালোবাসা শব্দহীন, অর্থহীন,খুঁজে নাও তুমি তোমার মতো।আমার অনুভূতি গুলো অনুভব করো, খুঁজে নাও ভালোবাসা। আমার শব্দহীন অনুভূতির কাছে তোমার ‘ভালোবাসা’ নামক একটা শব্দ কিছুই না।আমার মুখে ভালোবাসি নামক শব্দটা তোমার যতটা তেষ্টা মেটাবে তার থেকেও বেশি প্রফুল্লিত হবে আমার অনুভূতি গুলো অনুভব করলে।এবার বলো থাকবে তো দি আহাম্মকটার পাশে, সারাজীবন! আগলে রাখবে তো তাকে?

পর্দায় আরাফের করুণ মুখখানা দেখে নিজেকে সামলাতে পারলোনা হৃদিতা। এতক্ষণ তার চোখ দিয়ে নিশব্দে গড়িয়ে পড়ছিল নোনাজল। হুট করেই ঢুকরে কেঁদে উঠে সে।আরাফ বিচলিত হয়ে তার সামনে গেলেই আরাফকে জাপটে ধরে হৃদিতা।

– থাকবো তো সারাজীবন পাশে হাতে হাত রেখে!তুই শুধু আগলে রাখিস তোর বাহুডোরে।
আরাফ ঠোঁট কামড়ে হাসে।তার চোখে চিকচিক করছে নোনা জল।

কেটে গেছে আরো নয় বছর।সময়ের সাথে সাথে পালটে গেছে সব কিছু।আইদা আদীব এখন অনেকটাই বড় হয়ে গেছে।পরিবার থেকে হারিয়ে গেছে “হৃদি”।হৃদির মৃত্যুতে বাড়ির সবার অন্তর আত্না কাপিঁয়ে তুলেছে।নোমান,প্রভা এখনো জেল খানায়। সারাজীবনের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে তারা।লিবান আর মাইশা এখন এক বাচ্চার বাবা মা।শাকীল, নাফিসার ফুটফুটে একটি কন্য সন্তান হয়েছে।আরাফের ঘরেও আলোকিত করে এসেছে মেয়ে আরিহা।তার বর্তমান বয়স আট বছর।মেয়েটা আরাফের মতো দুরন্ত হলেও চালচলন সম্পূর্ণ হৃদিতা

আরিহাকে অনেক্ষণ থেকে পড়াচ্ছে হৃদিতা কিন্তু দুরন্ত মেয়ে কিছুতেই পড়তে চাইছেনা।ঘরের এদিক থেকে সেদিক ছুটাছুটিতে ব্যস্ত সে।হৃদিতা বিরক্ত হয়ে মেয়েকে ডাকতে থাকে,
– আরিহা আম্মু দ্রুত আসো।মিস কিন্তু কাল মারবে তোমায় নামতা গুলো পড়ে যাও আর একবার পড়ে নাও আমার লক্ষি মেয়েটা।
– আহ! তোর খালি সারাদিন পড়া আর পড়া। একটা সময় আমাকে জ্বালিয়েছিস এখন আমার মেয়েটাকে। কিসের এত পড়ালেখা বলতো?
আরাফের কথা শুনে চোখ গরম করে তাকায় হৃদিয়া।সঙ্গে সঙ্গে আরাফ তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
– আরিহা আম্মু এদিকে আসো। আজ আমরা একটা খেলা খেলবো,
– কি খেলা আম্মু?
– তোমার বাবা আজ আমাদের নয়ের নামতা শুনাবে।আরাফ বলতো নয়ের নামতা!
হৃদিতার কথাত আরাফের পেটের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠে। সে তো পড়ালেখা নামক বিরক্তিকর জিনিস আগেই ছেড়ে দিয়েছে এবার মুখস্থ বলবে কি করে।
– আব..এইসব কি হৃদিতা মেয়েকে পড়াচ্ছিস পড়া। আমাকে টানছিস কেন?
– নো বাবা নো!আমি তোমার কাছ থেকেই নামতা শুনবো।
আরিহার কথা শুনে হৃদিতা মিটিমিটি হাসছে। আরাফ পড়েছে ভীষণ ফ্যাসাদে।

– নয় একে নয়… নয় দু গুনে আঠারো…..তিন নয়?তিন নয়,,তিন নয়,,
আরাফ আর পারছেনা ঠোক গিলে আরিহার দিকে তাকালে আরিহা তার বাবার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।
– বাবা ইউ আর সো বেড। নামতা কেন পারো না তুমি? আম্মু তো আমায় সম্পূর্ণ নামতা শিখেছে আমি পারি।কিন্তু তুমি,

আরিহা আর কোন কথা বলতে পারলো না তার আগেই তার দাদুমনি ডাক পরায় ছুটে চলে যায় সে।হৃদিতা আরাফের শুকিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে হাসতে হাসতে বলে,
– তোকে একদিন অভিশাপ দিয়েছিলাম, তুই আদুভাই হবি তোর বাচ্চার সাথে তুই পড়বি কিন্তু অভিশাপ টা যে এইভাবে লেগে যাবে ভাবতে পারিনি।এখন মেয়ের সাথে মিলে নয়ের নামতা শিখবি হা হা হা।
আরাফ রাগ দেখিয়ে উঠে যেতে নিলেই হঠাৎ করেই হৃদিতা মুখে হাত দিয়ে ওয়াশরুমে দৌড় দেয়।আরাফের বুঝতে বাকি নেই হৃদিতার কি হয়েছে।ক্লান্ত মুখ নিয়ে হৃদিতা ওয়াশরুম থেকে ফিরে এলে আরাফ মিটি মিটি হেসে বলে,
– যাক মেয়ে তো তোমার মতো হয়েছে ইনশাআল্লাহ পরের টা আমার মতো হবে। আমি অপেক্ষায় আমার সুইটি বউ কখব আবার নতুন মুখে বাবা ডাক শুনবো।
আরাফের কথা ক্লান্ত মুখে হৃদিতা মুচকি হাসে।আরাফ তাকে জড়িয়ে নেয় তার বাহুডোরে।

_______সমাপ্ত_________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here