#রৌদ্রমাখা বর্ষা
আলহীনা ইনাম [ছদ্মনাম]
০৫,,
‘আমি তোমাদের আর টাকা দিতে পারবোনা মা।’
আফাফ শান্ত কন্ঠে বললো।
আঞ্জুমের কান্না থেমে গিয়েছে। ওনি অবাক কন্ঠে বললেন, ‘কেন? তোমার তো সম্পদের অভাব নেই। তোমার ভাইকে এতোটুকু দিতে তোমার এতো কিপ্টামি! তুমি ভালো থাকো। তোমার হিংসা হয়, ওরা একটু ভালো থাকলে!’
আফাফ অহেতুক একবার নাক টেনে বললো,
‘তোমাকে আগেও বলেছি মা, তুমি যাকে সুখ মনে করো, সেটা সুখ নয়। পয়সা থাকলেই মানুষ সুখী হতে পারে না। তোমাকে বলেছি, নিদ্রের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না। তোমার প্রতিবারই মনে হয়েছে, সাধারণ স্বামী স্ত্রীদের নিত্যকার মান অভিমান। বিষয়টা কখনোই তা নয়, আমি তোমাকে বোঝাতে পারিনি। তুমি একবার ভেবে দেখো, এই পর্যন্ত যতো টাকা দিয়েছে, তা দিয়ে ওরা কি নিজেদের জন্য ভালো কিছু করে নিতে পারতোনা? করেনি। আর তুমিও প্রশ্রয় দিয়েছো। আমার পক্ষে আর দেওয়া সম্ভব নয়।’
আঞ্জুম একটু দমে গেলেন। এরপর আবার বললেন,
‘করবে তো। আফতাব তো বলেছে এবার ভালো কিছু করে দেখাবে। সোনা মা আমার, এবারের মতো দিয়ে দে ওকে।’
‘মা, নিদ্রের সাথে আমার সম্পর্কটা আর নেই। কয়েকমাস পর আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে।’
আঞ্জুম চমকে উঠলেন আফাফের কথাটা শুনে। জোরে বলে উঠলেন, ‘কেন?’
‘ওনি আনাবিয়াকে বিয়ে করতে চান। আনাবিয়া ওনার সন্তানের মা হতে চলেছে।’
আঞ্জুম এবার হয়তো ওদের ভিতরকার দূরত্বটা পরিমাপ করতে পারছেন। ওনি হঠাৎই সুর পাল্টে বললেন,
‘বাহ! জামাই আরেকটার পেট বাঁধায় দিলো আর তুমি বসে কি করো! এতোদিনেও আমার একটা নাতি নাতনি হলোনা! চরিত্রহীন একটা লোক! তোমাকে ছাড়লে তার ক্ষতিপূরণ কি দেবে নাকি মামলা করতে হবে? আর তোমাকেও বলছি, একটা বাচ্চা থাকলে আর এইদিন দেখতে হতোনা। শ্বশুরবাড়ি কি মুখে কুলুপ এঁটে থাকো নাকি। জামাই যায় কেন ওইসমস্ত নষ্ট মেয়েগুলোর কাছে?’
আফাফ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
‘কেন চুপ করে থাকি, তুমি জানো। অন্যায়টা আমিও করেছি।’
‘ও কোনো অন্যায় না। বিয়ের আগে ওসব আজকাল সবার থাকে। বিয়ের পর ফারহানই তোমাকে বিরক্ত করতো, তুমি তো আর করোনি। তোমাদের সম্পর্ক দশটা সাধারণ প্রেমের মতোই ছিলো। আর জামাই কি করলো!’
‘আমিও তাকে সাড়া দিয়েছি মা। নিদ্রের অভাব পূরণ করতে চেয়েছি। পাপ করেছি। সে যাই হোক, আমি চলে আসবো এখানে। আর দয়া করে আমাকে আর টাকার জন্য চাপ দিও না।’
বলেই আফাফ আঞ্জুমকে কিছু বলতে না দিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। আঞ্জুম এখন ভাবছেন, কয়েকমাস পর কেন ওদের ডিভোর্স হবে। এটা তো এখনও হতে পারে।
আফাফ দ্রুতই আনাবিয়ার অ্যাপার্টমেন্টে চলে এসেছে। ও ফিরতে চায় ওর শ্বশুর বাড়িতে রাতে। ওই বাড়িতে এখন থাকা সম্ভব না। আঞ্জুম মাথা খারাপ করে দেবে কথা বলে। রাত ন’টা বাজে সবে। বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছিলো। আফাফ অনেকটা ভিজে গিয়েছে।
আফাফ তিনতলার দক্ষিণের অ্যাপার্টমেন্টটার কলিং বেলটা বাজাতেও সংকোচ বোধ করছে। কোনোমতে সংকোচ কাটিয়ে বাজালো। কিছু সময়ের মাঝেই আনাবিয়া দরজা খুলে দিলো। ঠোঁটের কোণায় সবসময়ের মৃদু হাসিটা লেগে আছে। যেন আফাফকে দেখে ও খুশিই হয়েছে।
‘বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে এসো।’
আনাবিয়া দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললো।
আফাফ ভিতরে ঢুকে ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটটার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিদ্রকে কোথাও দেখতে পেলো না। আফাফ আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ওনি কোথায়?’
আনাবিয়া দরজা বন্ধ করে বললো,
‘ও একটু বাইরে গিয়েছে আমার জন্য কিসব যেন বললো, ওগুলো কিনতে। পাগল একটা। প্রেগন্যান্সির সময় কি খেতে হবে, কিভাবে চলতে হবে, সবকিছু আমার আগে ও খোঁজ করে আমার খেয়াল রাখছে। ওরকমই কিছু কিনতে গিয়েছে।’
আফাফ ওর কথা শুনে মৃদুস্বরে ‘হু’ বললো।
‘তুমি তো অনেকটা ভিজে গিয়েছো। একটু অপেক্ষা করো, আমি টাওয়েল এনে দিচ্ছি।’
আনাবিয়া আফাফের দিকে তাকিয়ে বলে সামনে হেঁটে গেলো।
‘তার কোনো প্রয়োজন নেই।’
আফাফ বললো।
‘তা বললে হয়? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।’
আনাবিয়া বলতে বলতে টাওয়েল খুঁজছে। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না। ও ওপর তলায় গেলো টাওয়েল আনতে।
আনাবিয়া একটা মিষ্টি গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজ পরে আছে। ওড়নাটা ঝুলছে নিচে সামনেরদিকে। ও যে সালোয়ার কামিজে অভ্যস্ত না, সেটা মাঝে মাঝে ওকে বিরক্ত হতে দেখে বোঝা যাচ্ছে। আফাফ ওর যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে গভীর একটা শ্বাস নিয়ে আশেপাশে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। মেয়েটা বেশ পরিপাটি। অ্যাপার্টমেন্টে আর কাউকে দেখলো না ও।
হঠাৎই কারো তীক্ষ্ণ চিৎকার আর ভূপতনের শব্দে আফাফের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো। আফাফ অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটার সাক্ষী হয়ে কিছু সময়ের জন্য যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। ওর বোধগম্য হচ্ছে না এখন ওর কি করা উচিত। ছুটে গেলো আনাবিয়ার কাছে। আনাবিয়া সিঁড়ি থেকে পরে গিয়েছে। ও গড়িয়ে পড়েছে। শেষ ধাপে পৌঁছানোর পূর্বেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তার কপাল কেটে রক্ত পড়ছে। আরো কিছু ঘটেছে, যা আফাফকে ভীত করে তুলেছে। আফাফ হাঁটু গেড়ে বসে ওকে কয়েকবার ডাকলো ওর শরীরে হাত দিয়ে। ওর কোনো সাড়া পেলো না।
আফাফ উঠে দাঁড়িয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে পানির একটা মগে পানি ঢেলে এনে ওর মুখে ছিটিয়ে দেওয়ার আগেই ওকে প্রচন্ড জোরে কেউ ধাক্কা দিলো। আফাফ ছিটকে গিয়ে সিঁড়ির রেলিঙে কপালে বারি খেলো। মৃদু চিৎকার করে উঠলো ও। কপালে হাত দিয়ে সামনে তাকাতেই নিদ্রকে দেখে আঁতকে উঠলো আফাফ। নিদ্রের চোখে মুখে রাগ ঠিকরে পড়ছে। এর আগে আফাফ কখনোই ওকে রাগতে দেখেনি। আর এতোটা তো কোনোদিনও না। আফাফ কিছু বলার আগেই নিদ্র চিৎকার করে বলে উঠলো,
‘তুই করেছিস এসব, তাই না? তুই আমার সন্তানকে খুন করতে চাস? এতো হিংসা তোর? আনাকে তুই মারতে চাস?’
আফাফ হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নিদ্রের এই ধারণার কারণ ও খুঁজে পেলো না। আফাফ কিছু বলার আগেই নিদ্র ওর মুখে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। আরো কিছু বলতে গিয়েও আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো। আফাফের দিকে একবার রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আনাবিয়াকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলো। আফাফ শুধুই নির্বাক দর্শক ছিলো।
আনাবিয়ার মিসক্যারেজ হয়েছে। হসপিটালে নিলা শিকদারসহ পরিবারের সকলেই এসেছে। নিদ্র আফাফের নামে ডায়েরি করেছে, এটেম টু মার্ডার। যেটা সকলের সামনে বলতেই নাহিন তেতে উঠলো। নিদ্রের সামনে সটান দাঁড়িয়ে চোখে মুখে ক্রোধ নিয়ে বললো,
‘তোর পাপ বাঁচাতে নিজের বউটাকে জেলে পাঠাচ্ছিস! এতোটা অমানুষ হয়ে গেলি?’
নিদ্র ওর কথার প্রত্যুত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলোনা। নাহিন এবার ওর কলার চেপে ধরে বললো,
‘তোর অসুস্থ বউটার সাথে এমন অন্যায় করিস না ভাই।’
নিদ্র কলার ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
‘আনা নিজে ফোন করে আমাকে বলেছে, ও আনার সন্তানকে মারতে চায়। সেজন্যই গিয়েছিলো ওই ফ্ল্যাটে। আর আমি গিয়েও তো আনার কথার মাঝে কোনো ভুল পাইনি।’
‘তোর বান্ধবী যা বলে, সব সত্যি? ভাবি এটা করেনি। আমি বিশ্বাস করি তাকে।’
‘আবারও ঠকবি আগের মতো।’
‘আগে ওরই অন্যায় ভাবতাম। কিন্তু তুই যা করেছিস, তার তুলনায় ও আসলে কোনো অন্যায় করেনি। কি করেছে ও, কলেজ জীবনের বন্ধুর সাথে সম্পর্ক রেখেছে? আর তুই! তোর থেকে অনেক ভালো।’
নিদ্র আর নাহিনের কথা কাটাকাটি আরো এগিয়ে যেতো যদি না নিলা শিকদার আর আয়শা শিকদার এর ভিতর হস্তক্ষেপ না করতেন।
সকালে আফাফকে অ্যারেস্ট করা হয়েছিলো ওর বাড়ি থেকেই। আর দুপুরের ভিতর ওকে আয়শা শিকদার ছাড়িয়ে নেন। তবে ওনি কেবল ল’ইয়ারই পাঠিয়েছিলেন। নিজে যাননি। আফাফ পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে হঠাৎই নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে। গতকাল রাতে নিদ্রের ওর প্রতি আচরণের পর থেকেই ও কেমন যেন নিরব হয়ে গিয়েছে। আঞ্জুমও ওর সাথে এরপর কোনো কথা বলে উত্তর পায়নি। একদৃষ্টিতে একদিকে তাকিয়ে ছিলো যেন একটা পুতুল। আফাফের ভিতরের প্রাণটাই অনুপস্থিত।
রোদ উঠেছিল। এখন আবার বৃষ্টি পরছে। রোদের মাঝেই বৃষ্টি পরছে। আফাফ হয়তো ছোট থাকলে, চিৎকার করে উঠতো খেঁকশিয়ালির বিয়ে হচ্ছে বলে। এখন ও আর এগুলো খেয়াল করে না। এই বৃষ্টি ক্ষণস্থায়ী। বড় বড় ফোঁটা আফাফের শরীরে আছড়ে পড়ছে। ফোঁটাগুলোয় রোদ মেখে হিরার মতো চকচক করে উঠছে যেন। আফাফ এই বৃষ্টির মাঝেই উদভ্রান্তের মতো রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে। ওর কোনোদিকে খেয়াল নেই। রাস্তার অনেকটা মাঝে চলে এসেছে। পিছন থেকে একটা পিকআপ বারবার হর্ণ দিচ্ছে। ওর সরার নাম নেই। পিকআপটা কাছাকাছি আসতেই কেউ ওর হাত ধরে টান দিলো একপাশে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
‘আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। মরতে চাইলে অন্যকোথাও গিয়ে মরুন৷ রাস্তার মাঝখানে নিজেও মরবেন আর অন্যদেরও ফাঁসাবেন।’
আফাফ লোকটার দিকে মুখ তুলে একবার তাকিয়ে ওনার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। কিছু না বলে আবারও হাঁটতে শুরু করলো।
লোকটা একদৃষ্টিতে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। রৌদ্রমাখা বর্ষায় মেয়েটার বিষন্ন মুখটা হঠাৎই তার মনে আঘাত করলো। একবার মনে হলো সে পাগল। কিন্তু তার সাজপোশাক দেখে পরক্ষণেই নিজের ভাবনা বদলালো। সে কয়েকবার ডাকলো তাকে। কিন্তু আফাফ আর পিছনে ফিরে তাকালো না।
‘চোখজোড়া তার রাখবে কি স্মরণ,
রৌদ্রমাখা বর্ষায় তার বিষাদপূর্ণ বদনখানি লাগে কেমন,
অথবা তার কপালের সেই ছোট্ট কাটা কাঁচা দাগটা,
তার মায়াভরা চোখজোড়া,
তার টলটলে পায়ে হেঁটে চলা,
তার ভেজা ঠোঁটের মৃদু কম্পন।’
#চলবে
**সামান্য কৌতূহল থাকলোই না হয় অপেক্ষায়,,
বাচ্চা পান্ডাটি যখন বড় হলো (যদি তার পরম সৌভাগ্য হয় পৃথিবীর আলো আঁধার দেখার), যখন সে (ধরুন আরকি) নিজের চাহিদা ব্যক্ত করতে শিখলো, গনগনে মধ্যদুপুরে, ভিড় করলো কোনো এক আইসক্রিমের দোকানে স্কুলের বাচ্চাদের কিচিরমিচিররত একটা জটলার একজন হয়ে, তার কি হঠাৎই সাক্ষাৎ হবে এমনই রৌদ্রমাখা বর্ষার সাথে? সে কি তাকে উপভোগ করতে শিখবে? ছড়া কেটে উঠবে? প্রকৃতিকে ভালোবাসবে কি? অরণ্যের মেঝেতে শুকনো পাতার খসখসে আওয়াজের মাঝে কি সে সুর খুঁজে পাবে? সে হয়তো হয়ে উঠলো (ধরে নিন) আফ্রোদিতির (রোমান পুরাণে, ভেনাস) ন্যায় সৌন্দর্যের আধার। বা হয়তোবা নার্সিসাসের মতো। অথবা তাদের মতো সুন্দর কেউই নয়। সে যখন আবদার জুড়ে নিলো (ধরুন) ওই শিশুপার্কটায় তাকে নিয়ে যেতে, সেই মেলার নাগরদোলায় চড়াতে, চিড়িয়াখানার বন্দী পশুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে, তখন তার ছোট্ট হাতটা কার হাতে আবদ্ধ থাকবে? সমাজ এখন উন্নত। কাউকেই স্কারলেট লেটার গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হচ্ছে না।
সে কি কিছু থেকে বঞ্চিত হবে, নাকি অতীতকে তার মুছে ফেলা হয়েছিল চিরদিনের জন্য?