রৌদ্রমাখা বর্ষা পর্ব-৬

0
848

#রৌদ্রমাখা বর্ষা
আলহীনা ইনাম [ছদ্মনাম]

০৬,,

৩২ বছর বয়সী লোকটি, বিপত্নীক। যার স্ত্রী একটি কন্যাসন্তান জন্মদানের সময় মারা গিয়েছিলেন এবং সেই দুর্ভাগ্যের দেখানো রাস্তা ধরে সাতদিনের মাথায় তাঁর নবজাতক কন্যাটিও মারা গিয়েছে। তখন থেকে তিনি একা বসবাসের সিদ্ধান্তে অটল। বাড়ি থেকে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ায় তিনি ঘর ছেড়েছেন। লোকটি স্ত্রীকে, যিনি কিনা ক্ষুদ্র তেলাপোকাকেও আতঙ্কবাদী জ্ঞান করতেন (Katsaridaphobia-ক্যাটসারিডাফোবিয়া), তিনি তাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তার শোক কাটিয়ে ওঠার চিন্তাও তিনি করেননি কখনো। লোকটির গাত্রবর্ণটি এমন যেমনটাকে ফ্রেঞ্চরা বলবেন, দুধ দেওয়া কফির মতো (দুধের পরিমাণটা খুবই কম), যেটা, পুরুষ হিসাবে বেমানান নয়।

এই মূহুর্তে তিনি বেশ বিরক্ত সামনে বসে থাকা মেয়েটির প্রতি। বেশি বিরক্ত সে, তাঁর মৃতা স্ত্রীর একটা শাড়ি পরিহিত অবস্থায় তাঁর সামনে মেয়েটি জবুথবু হয়ে বসে আছে। হাঁটু ভাজ করে সোফার উপর পা তুলে হাতে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ রংচা তার। ঠান্ডা লাগছে হয়তো। জ্বর আসতে চলেছে। মেয়েটির মুখ থেকে তেমন কোনো কথাই তিনি বের করতে পারেননি। নামটি জানতে পেরেছেন। মেয়েটির নাম, ফাবলিয়া আফাফ। আর সামান্য তার জীবন কাহিনী। এখন ওনার নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে, যেচে ঘরে ডেকে আনাটা মনে হচ্ছে ভুল। ওনার ১৪৫০ স্কয়ারফিটের মোটামুটি ব্যয়বহুল ফ্ল্যাটটার লিভিং এ সোফায় সামনাসামনি বসে আছে তারা। পার্থক্য রচনা করছে মাঝখানের দেড়ফিট জায়গা। লোকটা আবার আফাফকে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘আপনি আপনার বাড়িতে কি সত্যিই ফিরতে চান না?’

আফাফ বামহাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নাক মুছে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো।

‘তবে কোথায় যাবেন?’

এই পর্যায়ে লোকটারও হাঁটু ভাজ করে পা উপরে উঠিয়ে নিতে হলো। তাদের পা ঘেঁষে চলে গেলো লোকটার বাড়ির কাজের মহিলা, ছোট একটা হাঁসের মতো মেঝের উপর থেকে টেনে টেনে নিজেকে নিয়ে চলেছে, তীক্ষ্ণ গন্ধের একটা কিছু দিয়ে মেঝেটা মুছতে মুছতে, লাইজল গতকালই শেষ হয়ে যাওয়ায় এই মহিলা আজকে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করছেন। হঠাৎই লোকটার আফসোস হলো, কিছু সাধারণ আদবকায়দা অন্তত তাকে শিখিয়ে কাজে নেওয়া উচিত ছিলো। তার কি খুব সমস্যা হতো একদিন লাইজল না দিয়ে সাধারণ পানি দিয়ে ঘরটা মুছতে বা এই মূহুর্তে অন্য কাজগুলো শেষ করে পরে এই অংশটুকু মুছতে? এই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের কয়েকটা বাসায় কাজ সেরে বিকালে লোকটার বাসায় আসে ঘর পরিষ্কারের পাশাপাশি রাতের খাবার তৈরি করতে।

তবে লোকটা নিজেকে লক্ষ্য করেও বেশ অবাক হচ্ছেন, ওনার এতোদিনের ওনিকে ওনি হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছেন হয়তো। মেয়েটার মাঝে কিছু একটা আছে, যা তাকে দিয়ে এমন আচরণ করাচ্ছে যেরকমটা তিনি একদমই নন – ব্যাকুল আর কিছুটা অতিআগ্রহী। তিনি কি দয়া করছেন? নাহ্, তেমন কিছু ওনার নিজেরই মনে হচ্ছে না। দয়া অপেক্ষা একটু বেশি কিছু এটা। তিনি আগ্রহবোধ করছেন, তার সামনে বসা সুন্দরী হিসাবে নাকচ হয়ে যাওয়া মেয়েটির প্রতি। তবে বোঝা যাচ্ছে সে সবসময় এমন ছিলো না। তার রূপ ঢাকা পড়ে আছে, যত্নহীন পিঠ ছেঁয়ে থাকা আধভেজা চুলগুলোর নিচে যেগুলো সোজাও নয়, কোঁকড়াও নয়, তিনি কল্পনা করছেন সেখানে ছোট ছোট পাখিরা বাসা বেঁধেছে। সেটা শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনের পূর্বের অংশটি খুব সহজেই হতে পারতো। সেখানে বলা হতো, ‘আপনি কি চিন্তিত আপনার রুক্ষ চুলগুলো নিয়ে, তবে ব্যবহার করুন……,’ কিছুটা এমন। তার মলিন মুখটা মায়াবী ঠিকই। কিন্তু দীর্ঘদিনের অযত্নে তাকে সুন্দরী বলা যাচ্ছে না।

আফাফ নিজের রূপের প্রতি একসময় যত্নশীল ছিলো। বিশেষ করে তার মা! তার মোটামুটি রূপটার যত্ন নিতেন খুব বেশি যেহেতু তিনি এটাকেই অস্ত্র হিসাবে গণ্য করতেন। তবে বিয়ের পর যখন নিদ্র তার রূপের মায়ায় আটকা পড়লো না, তখন থেকে একে আফাফ অপ্রয়োজনীয় মানতে শুরু করলো। সে তখন থেকে মেকাপ করতোনা আর কিছুই করতোনা – সেসব আনন্দময় কাজগুলোর কোনোটাই না, যেগুলো মেয়েরা করে, নিজেদের চুল নিয়ে বা চোখগুলো নিয়ে বা হাত পা মুখ কোনোটা নিয়ে – নিজের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য। আসলে তার মন উঠে গিয়েছিলো।
তবে পরীক্ষার সময় মেকাপ করা ভালো। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যারা মেকাপ করে পরীক্ষা দিতে আসেন তারা সাধারণত ১০ থেকে ১২ শতাংশ বেশি নাম্বার পান। ২০০ জন শিক্ষার্থীকে দুটো দলে ভাগ করে গবেষণাটা চালানো হয়। লিপস্টিপ ইফেক্টের কারণে এটা হয় বলে ধারণা করা হয়। যারা মেকাপ করেন, তারা নিজেদের শারীরিকভাবে আকর্ষণীয় মনে করার দরুন তাদের দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।

লোকটা ভরাট কন্ঠে বললেন,
‘অনার্স তো পাশ করেননি। কোন ভরসায় বাড়ি ছেড়েছেন? আপনার জন্য আত্মহত্যাটাই একটা পথ ছিলো। কি করতেন এই অসুস্থ শরীরে?’

আফাফ করুণ চোখে একবার ওনার দিকে তাকালো। সে আসলেই ভেবে দেখেনি, কোথায় যাবে। গলার ছোট স্বর্ণের চেনটা বের করে ওনার সামনে ধরে বললো,
‘এটা আর হাতের এই আংটিটা দিয়ে কিছুদিন কোথাও জায়গা নিয়ে চলতাম। এরপর একটা ব্যবস্থা করে নিতাম।’

লোকটার হঠাৎ বেশ হাসি পেলো। নিজেকে সামলালেন না। হেসে দিয়ে বললেন,
‘কোনোদিন ঘরের বাইরে বেরিয়েছেন? আমাদের সমাজটাকে চেনেন? আপনার মতো একটা মেয়ে, যেভাবে রাস্তায় চলছিলেন, তাতে যেকেউ অসহায় মনে করতো। আর অসহায় এমন মেয়েদের সাথে কি হতে পারে তার কোনো ধারণা আছে আপনার? খুব বেশি হলে রাত হওয়ার অপেক্ষা। কাল খবরের কাগজে উঠতেন হয়তো। আর আপনি! আপনার মতো বিলাসিতায় জীবনযাপন করা স্বামীর অর্থে চলা মেয়ে কিভাবে পারতেন দুস্ত জীবনকে মেনে নিতে?’

আফাফ নাক টেনে বললো,
‘আপনাকে বলেছি, কি করতে পারেন আপনি যখন আপনার মা বলেন, আপনার ভাই মারা যাচ্ছে? কি করতে পারেন, যখন ব্যাংকের লোকেরা তাদের মাথার ছাদ কেড়ে নিচ্ছে? যখন আপনার উপায় আছে, তাদেরকে বাঁচানোর, তাদের কি বাঁচাতেন না? যতোই হোক, তারা আমার পরিবার।’

লোকটা আরেকদফা হাসলেন।
‘আপনি তাদের লাগাম টানতে পারতেন। একবার দিতেনই না হয়, ভাইকে মরতে। এমনিতেও এমন কীটের কারণে সমাজটা নষ্ট হয়। দোষটা আপনারও ছিলো। আর আপনার স্বামী! তিনি তো আরো বেশি কিছু!’

‘আমি অস্বীকার করিনি। কিন্তু আমি জানি ওনার কোনো দোষ নেই।’

‘সাইকোলজি বলে, যখন কেউ কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসে, তখন তার কোনো অন্যায় তার প্রতি অনুভূতি বদলাতে পারে না বরং তার দোষটাও দোষ মনে হয়না এবং সবকিছুর ইতি ঘটে তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার মধ্যে থেকে। আপনি জানেন, তিনি দোষী। শুধু মানেন না।’

‘হ্যাঁ, আমি নিদ্রকে ভালোবাসি।’
কথাটা বলে আফাফ নিজেই চমকে উঠলো। ভালোবাসা!! উন্মাদনায় পরিপূর্ণ বেপরোয়া শব্দটাকে নির্লজ্জের মতো একজন অপরিচিত ব্যাক্তির সামনে সে লাগামহীনভাবে ব্যবহার করেছে শুধুমাত্র এইজন্য যে, তার নিদ্রের প্রতি অনুভূতি প্রকাশের জন্য শব্দভান্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ নয়। তার ভাষা আত্মসমর্পণ করে সেই গোলক ধাঁধাঁটির নির্দিষ্ট প্রকৃতিকে বর্ণনা করার জন্য, অনুভূতির সেই অরণ্যটি যার গভীরে সে অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছে। তাকে দেখা মাত্র আফাফের শরীরের একটা অংশ শরীর ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো এবং জড়িয়ে ফেলেছিলো নিদ্রকে আষ্টেপৃষ্টে বিমূর্তভাবে, যার অস্তিত্বের টের পায়নি নিদ্র।
সে যেন আফাফের জীবনে তেমনি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, যেমনটা আফাফ দেখে। আফাফ দেখে সে শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতোই। বরং তার থেকে বেশি কিছু। তার শ্বাসপ্রশ্বাসের উপরও নিদ্রের প্রভাব রয়েছে। ও সামনে আসলেই আফাফের নিশ্বাস ঘন হয়ে আসে। দূরে সরে গেলে যেন দম বন্ধ হয়ে যায়।
ভালোবাসা!! যার অনুভূতি হৃদয়ে সর্বদা বিরাজমান হওয়া সত্ত্বেও, তার বাস্তব রূপ অনেক ক্ষেত্রেই অপরপক্ষের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। যেমনটা আফাফের পাশাপাশি তার সামনে বসা লোকটার ক্ষেত্রেও ঘটেছে।

আফাফ বেহায়ার মতো পারলো কি করে কথাটা বলতে! লোকটা তাকে বাঁচিয়েছে এবং ওর অসহায় অবস্থায় কিছু একটা ব্যবস্থা করার প্রত্যাশা দিয়েছে বলেই কি ও এতোটা সহজ এবং সাবলীল হয়ে যেতে পেরেছে তার সাথে! আফাফ খানিকটা দমে গেলো। লোকটাও বিষয়টা বুঝতে পেরে বললেন,
‘এই বিষকে অন্তরে জায়গা দিবেন না। আর নিরব শ্রেণির নারী হয়ে নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার করলেন, সে বিষয়ে আপনার কোনো আক্ষেপ নেই?’

‘ও আমার ভুল। আমাকে তাকে সামলাতে দিন।’

লোকটা কাঁধ নাড়িয়ে ভ্রু উঁচু করে গভীর একটা শ্বাস নিলো ভঙ্গিমাটা, ‘তাহলে আর কি করবো’ ধরনের। লোকটা বুঝলেন না, তার সন্তান তার ভুল হবে, এই ধারণা আফাফ কোথা থেকে পেলো। ও কারো স্ত্রী এবং অবশ্যই ওরও চাহিদা আর প্রত্যাশা ছিলো। সে ভুল তো করেনি।
ওনি উঠে দাঁড়াতে নিতেই আফাফ ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
‘আপনার নামটা?’

‘সাফাত মির্জা।’

লোকটা বেরিয়ে গেলো অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। আফাফ হাতে ধরা চায়ে একচুমুক দিয়ে দেখলো সেটা সম্পূর্ণ ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। সংকোচের কারণে শীর্ণ মহিলাটিকে বলতেও পারলোনা আর নিজেও উঠতে পারলোনা। ওটাই খেয়ে নিলো।

সন্ধ্যার পর সাফাত বাড়ি ফিরে দেখে আফাফের জ্বর এসেছে। ও ডাক্তার ডাকে আর ওর ট্রিটমেন্ট করায়। আফাফের থাকার ব্যবস্থা সে করেছে। তার বন্ধু, ফারুক, একটা এনজিওর দ্বায়িত্বে আছেন। এটা নির্যাতিত, নিপিড়ীত মেয়েদের পাশেও দাঁড়ায়। তাদেরই একটা আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সেটা এই শহরেই। সাফাত সেখানেই আফাফের জন্য একটা ব্যবস্থা করেছে।

নাহিন আর নীলাভ, নাহিনের নিদ্রের সাথে ঝামেলার পর হসপিটাল ছেড়েছে আর যায়নি। আনাবিয়ার কী হলো না হলো, সেটা নিয়ে ওদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। শুধু আয়শা শিকদারের সাথে নিরের কথোপকথনে যতোটা জানতে পেরেছে – আনাবিয়ার জ্ঞান ফিরে আসার পর নাকি ও ভীষণ ভেঙে পড়েছে। নিদ্রকে আঁকড়ে ধরে তার কান্না নাকি থামছিলোই না।
নাহিন শুনে শুধু মুখ ভেঙচি কেটে উপরে চলে এসেছে। আনা তো ওর থেকে কয়েক ডিগ্রি উপরে! ও তো ছেলেগুলোর সাথে কেবল সময়ই পাস করে আর এতো আরো বেশি! নাহিন একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছে, নিদ্র আনাবিয়াকে বলেছিলো, আফাফ ওর অ্যাপার্টমেন্টে যাবে। আনার ধারণা হয়েছিলো, নিদ্রের এই কেয়ারিং, আফাফের প্রতি দূর্বলতা হতে পারে। আর এটা আনাবিয়ার সহ্য হয়নি। যতোই হোক, নিদ্রের স্ত্রী আফাফ। দূর্বলতা থেকে ওর মন ঘুরে গেলে! নাহিনের দৃঢ় বিশ্বাস, আনা সবকিছু ইচ্ছা করে করেছে। কি সাংঘাতিক! নিজের শরীরের কথাও ভেবে দেখেনি!

নাহিন আর নীলাভ আফাফের বাড়িতে গিয়েছিলো ওর সাথে দেখা করতে। ওকে না পেয়ে এখন ওরাই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। আফাফ সারাদিন বাড়ি ফেরেনি! নীলাভ আর আফতাব পুলিশের কাছে গিয়েছিলো। ওরা ২৪ ঘন্টা হওয়ার পরই কেস নেবে বলেছে।

#চলবে

*পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here