রৌদ্রদেশে মেঘের বেশে পর্ব-১

0
3088

#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা

[১]

খা খা রৌদ্দুর চারপাশে । মাথার উপর কমলা রঙের সূর্যটা তার নিজের তাপ ছড়িয়ে দিয়ে বাতাসও গরম বানিয়ে দিয়েছে। এমন তীব্র রোদের মাঝে মেঘের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ মেঘের মৃদু মৃদু ডাক। হয়ত রৌদ্দুরে বৃষ্টি নামার অবকাশ।
বিয়ের ক্লাবে মানুষের সমাগম। বেলা তিনটা হওয়ার পরও মেহমান আসার কমতি নেই। আসছে আবার কেউ কেউ খেয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ চেয়ার টেনে বসে রয়েছে ক্লাবের বাইরে ভেতরে।
মাত্রই খেয়ে মুখ রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে আসছিলেন শফিক সাহেব। উকিল মজনু মিয়ার মুখে অমন কথা শুনে তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। চেঁচিয়ে বললেন,

‘ আপনি বিয়ে খেতে আসছেন, বিয়ে খাবেন। ঘটকালি করবেন কেন? আপনাদের জন্য মেয়েকে বিয়েবাড়িতে নিয়ে যেতে পারিনা। মেয়ের বিয়ের সময় হলে আমরা মা বাপ আছি তো। আপনাদের এত মাথা ব্যাথা কেন?

মজনু মিয়া এক্কেবারে চুপসে গেলেন শফিক সাহেবের কথায়। ভালো পাত্র বলে সাহস করে এ কথা মুখে এনেছেন। এত অপমানিত হবে জানলে কখনোই বলত না।
শফিক সাহেব তীব্র আক্রোশ নিয়ে বলল,
‘ আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক আছে। পাত্র যতই ভালো হোক না কেন, আর সম্বন্ধ আনবেন না।

শফিক সাহেবের চেঁচানোর আওয়াজ পেয়ে জিনিয়া চলে এলো। শফিক সাহেবকে ডাক দিল।
‘ আব্বা চারপাশে সব মানুষ না? এভাবে কেউ চেঁচায়?
শফিক সাহেব বললেন,
‘ তুই যা আম্মা। আমি আসতেছি। তোর মায়ের কাছে যা ।
জিনিয়া মাথা নাড়াল। মজনু মিয়া মাথার টুপি ভালো করে পড়ে বলল,
‘ মাইয়্যার বিয়া ঠিক আছে জানলে কি সম্বন্ধ আনতাম? মাইয়্যা যখন হইছে, তার লগে সম্বন্ধ তো আইবো।
শফিক সাহেব কর্কশ গলায় বললেন,
‘ আপনাদের মতো লোকের সাথে কথা বলার কোনো রুচি নাই আমার।
শফিক সাহেব চলে গেলেন। মজনু মিয়া ব্যঙ্গ করে বলল,
‘ দেমাকে তার মাটিতে পা পড়েনা। দেখব মাইয়্যা কার হাতে দেয়?

গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে বেশ সভ্য স্টাইলে ছবি তোলা ছেলেগুলোর ভীড় থেকে একটা ছেলেকে হাত ধরে টেনে আনল মজনু মিয়া। ছেলেটা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘ কি হয়েছে চাচা? এভাবে টেনে আনছেন কেন?
মজনু মিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
‘ ওই মাইয়্যার নাকি বিয়া ঠিক আছে বাপ। হইবেনা।
সাহিল পকেটে হাত দিয়ে বলল,
‘ টাকাটা পাত্রী ঠিক হলে দেব আরকি। যেহেতু কাজ হয়নি, টাকা দিয়ে লস করার কোনো মানে দেখছিনা।
মজনু মিয়া বলল,
‘ গালি যে খাইলাম, এর জন্য তুমি আমারে টাকা দিবা।
সাহিল হা হু করে হেসে পাঁচশ টাকার নোট বের করে দিয়ে মজনু মিয়ার হাতে গুজে দিয়ে বলল,
‘ আমাকে পাঁচলাখ দিলে আমি এই কাজ কখনোই করতাম না চাচা।
মজনু মিয়া পাঞ্জাবীর পকেটে টাকা ডুকিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল,
‘ বিয়ার ঘটকালি করা কত সওয়াবের কাজ জানো মিয়া ? তোমরা জানবা কি কইরা? তোমাদের এসব শিক্ষা কেউ দিছে?
সাহিল ওয়ালেট পকেটে রাখতে রাখতে জবাব দিল,
‘ আপনাদের মতো শিক্ষাগুরু থাকতে আমরা অশিক্ষিত এটা আপনাদের লজ্জার বিষয় না? আমরা তো এখনো আন্ডাবাচ্চা।
মজনু মিয়া পান চিবোতে চিবোতে এগোলো। এসব অতিমাত্রায় শিক্ষিত পোলাপানের লগে কথা বইলা মুখ ব্যাথা করে লাভ নাই।

___________________

সাহিল বন্ধু-বান্ধব সহ ক্লাবে ডুকল। স্টেজে বর বেশে বসে থাকা ছেলেটাকে বলল,
‘ কাজ হয়নি মামা৷ সিট নাকি বুকিং। শুকনো ছ্যাঁকা খাইলাম।
রাহুল হাসল। বলল,
‘ আশা রাখ ভাই। বিয়া তো এখনো হয়নি?
সাহিল বলল,
‘ বিয়ে করব না। আগে দেখি তুই কত ভালা আছিস। তারপর ভেবে দেখব।
রাহুল বলল,
‘ তাহলে এখন আর কোনো মেয়ের দিকে চোখ দিসনা ভাই।
সাহিল ধমকে বলে,
‘ আমি চোখ দেই? চোখ কি আমার কথা শোনে? চোখই তো পিটপিট করে তাকায়। এখানে আমার কি দোষ? সব চোখের দোষ। রাহুল হাসল।

সাহিলের ফোন বাজল। কিছুটা দূরে সরে ফোন রিসিভ করে কানে দিয়ে বলল,
‘ বাবা দেখো, মেয়েটাকে আমার পছন্দ হয়েছে শুধু। এমন না যে তাকে না পেলে আমি মরে যাব। নিশ্চিয় মজনু আন্কেলের মুখে সবটা শুনেছ। এবার চুপ হয়ে যাও প্লিজ।

সাগর সাহেব বিদ্রুপ করে বললেন,
‘ তোমার জন্য পাত্রী দেখতে দেখতে আমার বয়স চার এক্সটা চলে গিয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে তোমার তো আবার পছন্দ হয়না। এতদিন পর মুখ খুলে একটা মেয়ের কথা বলেছ, আমি এই সুযোগ কি করে হাতছাড়া করি?

সাহিল হাসল। বলল,
‘ বাবা ওটাতো বুকিং হয়ে আছে অনেক আগে থেকে। আমি ওসব কেড়ে নেওয়ার তালে নেই। দেশে মেয়ে কি কম পড়েছে?

সাগর সাহেব কড়া কন্ঠে বললেন
‘ তুমি কোনোকথা বলবেনা। আমি নিজেই মেয়েটার বাবার সাথে কথা বলবো।
সাহিল ফোন কেটে দিল সামনে তাকিয়ে। ওই মেয়েটাকে আবার দেখা গেল।

‘ ডেন্জারাস মেয়ে তো। একটু পছন্দ লাগছে তাই বলে বারবার সামনে পড়তে হবে?

সাহিল নিজের মাথা নিজে চাপড়ে বলল,
‘ ধুরর বোকা। মেয়েটা কি জানে নাকি এসব?

জিনিয়া ফোনে কথা বলছে ভাইয়ের সাথে। কথা বলা শেষ করে ফোনের দিকে তাকিয়ে হেঁটে হেঁটে সামনে এগোতেই চুপসে গেল। ভয়ার্ত চোখে সাহিলকে দেখল। সাহিলের চোখ ততক্ষণে মেঝের দিকে। জিনিয়ার দিকে তাকাল না। জিনিয়া চোখ সরিয়ে অন্যপাশ দিয়ে হাঁটা ধরল। সাহিল তাড়াহুড়ো করে সরে পড়ল। পিছু ফিরে জিনিয়াকে দেখল না। বিড়বিড় করে বলল,
‘ নো নো একটু করে পছন্দ হয়েছে। বেশি না। এই একটুকে পায়ের তলা দিয়ে পিষে ফেলতে হবে।

সাহিল পায়ের জুতোর নিচে টিস্যু পেপার চাপা দিল। পিষতে পিষতে বলল,
‘ ঠিক এভাবেই। পছন্দ খতম। ভালোলাগা খতম। সাহিল কাউকে পছন্দ করেনা। কখনোই না। নো নেভার।

জিনিয়া পিছু ফিরে একবার ছেলেটাকে দেখল। জুতোর তলায় কাকে বলি দিল ছেলেটা? ছেলেটা একটু কেমন যেন?

________________

বিয়ের শেষের দিকে মজনু মিয়া কোথাথেকে ছুটে এসে সাহিলের হাত চেপে ধরল। ফিসফিস করে বলল,
‘ তোমার বাপ মাইয়্যাটার বাপের নাম্বার যোগাড় কইরা ফেলছে। মাইয়্যার বাসা তো তোমাগো পাশেই। ভদ্রবাড়ির মাইয়্যা। তাই তেমন কেউ দেখেনাই।
সাহিল হাতঝেড়ে বলল,
‘ বাবা কি পাগল হয়ে গেছে? এসব বিয়ে টিয়ে আমি করব না।
মজনু মিয়া হাসে। সাহিল রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। ফোন দিয়ে সাগর আহমেদকে ইচ্ছে মত ঝাড়ি দেয়। ভালো লাগছে এই কথাটা বলা যেনই পাপ। কেন বলতে গেল সে?

ডাগর ডাগর চোখের মেয়েটি সিএনজিতে বসে মাথার হিজাব ঠিক করতে লাগল ফোনের স্ক্রিনে দেখে। সুইচ পিন ছুটে গিয়েছে। সাহিল তাড়াতাড়ি চোখ সরালো৷ এদিকওদিক তাকাতেই চোখ গেল পাশের গাড়ির মিররে। তৈলাক্ত মসৃণ চেহারার একটি মুখ দেখে আবার চোখ সরিয়ে নিল। চরম অস্বস্তিতে বিড়বিড় করল,

‘ আমার ভালোলাগোনি একটু ও। চোখের কাজল লেপ্টে ভূতের মতো লাগছে।

জিনিয়া হিজাব ঠিক করে দেখল ছেলেটাকে। ভ্রু কুঞ্চন করে বিড়বিড় করল,
‘ ছেলেটা কি পাগল? এমন জায়গায় কেউ দাঁড়িয়ে থাকে?
সাহিল আবার ফিরল। জিনিয়ার চোখে চোখ পড়ায় মাথা চুলকালো। ফোনের ওপাশে কেউ না থাকলে ও গর্জে নিজে নিজে বলল,
‘ আমার একটু ও ভালোলাগেনি। বুঝেছ মেয়ে আমার তোমাকে একটু ও ভালো লাগেনি। লাগবে ও। নো নেভার।

জিনিয়া হাসল।
‘ বাহ জিনিয়াস তো। কোন মেয়েকে এভাবে সোজাসাপটা বলে দিল যে ভালোলাগেনি?
সাহিল রাস্তা পার হয়ে পাশের একটি দোকানে ঢুকল। বেনসন সিগারেটের প্যাকেট কিনে ধোঁয়া ছাড়ল। যতক্ষণ গাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকল ততক্ষণ ধোঁয়া ছাড়ল। দুই প্যাকেট বেনসন মুহূর্তেই শেষ করল। খতম করল। খতম হলো সিগারেট।
গাড়িটা চলে যাওয়ায় সাহিল সিগারেটের তিননম্বর প্যাকেটটা ছুড়ে মারল। নিজের হাত নিজে নাক দিয়ে শুঁকে বলল,
‘ ইয়াকক কি গন্ধ রে। কেন খেলাম? আর কখনোই খাব না। নো নেভার।

চলবে,

এটা থ্রিলার টাইপের হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here