রৌদ্রদেশে মেঘের বেশে পর্ব-১১

0
671

#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা

[১১]

সবুজশ্যামোলা গ্রাম, চারপাশে ধানক্ষেত। সেই মাঠে মাঝেমাঝে উঁকি দিচ্ছে কয়েকজন কৃষক। চাষ না করা, পড়ে থাকা কয়েকটা ধূ ধূ করা বিল। সামান্য আকারে পানি জমা সেই বিলগুলোতে। কয়েকটা ছোট ছোট বাচ্চাছেলে ছোট্ট ঝাল দিয়ে মাছ খুঁজছে সেই পানির ভেতর।
কিছুদূরে যেতেই একটি বাড়ি। পুকুুর। বাঁশখাটের পুল সেই পুকুরের উপর। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাকাচ্চা সেই বাঁশের পুল ধরে ধরে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে পুকুরে লাফ দিচ্ছে। ভয়ে জিনিয়ার গা শিরশির করে উঠল। সাহিলের হাত শক্ত করে ধরে জিনিয়া বলল,
‘ কি সাহসী বাচ্চা! দেখেছেন?
সাহিল হাসল। বলল,
‘ ছোট বেলায় আমি ও এমন করতাম। তখন পুলটা আর ও উঁচু ছিল। ভয় পেতাম না। মজা লাগত। এখন অবশ্য ভয় লাগে।
জিনিয়া বিস্মিত সুরে বলল,
‘ আপনি আসলেই অনেক সাহসী। আমার সাহসী বর।
সাহিল এগোতে এগোতে বলল,
‘ তো আর কার?
জিনিয়া পিছু ফিরল। বলল,
‘ আম্মা আব্বাদের হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে বোধহয়।
সাহিল পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে গেল। বলল,
‘ ঠেলাগাড়ি আসবে এখন। রঞ্জু চাচাকে বলে রেখেছি।
জিনিয়া উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
‘ ঠেলাগাড়ি? কিন্তু ঠেলবে কে?
সাহিল বলল,
‘ গ্রামের ছেলেপুলেরা এখন ছুটে আসবে। দেখো।
জিনিয়া বলল,
‘ ঠেলাগাড়ি চড়ব। কি খুশি লাগছে! আপনি চড়বেন না?
সাহিল জিনিয়ার দিকে তাকাল। তার হাতের মুঠোয় থাকা জিনিয়ার হাতটা তুলে দেখাল। জিনিয়া হেসে অন্যদিকে ফিরে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যে দুইটা ঠেলাগাড়ি, দুইটা ভ্যানগাড়ি চলে এল । অনেকগুলো বাচ্চাকাচ্চা সহ তিনজন মধ্যবয়স্ক লোক। এসেই কেউ সাগর সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করল। কেউ কেউ বুকে পড়ে রইল। জিনিয়া অবাক। এই মানুষটাকে এতগুলো মানুষ ভালোবাসে?
নাহিলকে তো কয়েকজন কোলে তুলে নিয়ে লাপাতে লাগল। নাহিল, কি কি নাম ধরে ও ডাকছে তাদের। সবাইকে চেনে।

শফিক সাহেব আর জাহেদাকে চিনতে না পেরে সবাই সাগর সাহেবের দিকে তাকালো। সাগর সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন। ইনারা হলেন, বেয়াই সাহেব, বেয়াই সাহেবা।
সবার আমোদপ্রমোদ দেখে শফিক সাহেব আর জাহেরা স্তব্ধ। গ্রামের এই মানুষগুলো আসলেই সহজসরল। কাউকে আপন করে নেওয়ার মতো দুর্লভ কাজটা এরা আসলেই খুব সহজেই পারে।

তরিনা খাতুনকে কয়েকটা ছেলে ভ্যানগাড়িতে করে একা একা নিয়ে গেল। তরিনা খাতুন বেশভাবসাব নিয়ে বসেছেন ভ্যানগাড়িতে বিছানো কালো চাদরের উপর।
বুড়ি হলেও তার একটা আলাদা রেসপেক্ট আছে। যেমন তেমন বুড়ি নয়। শহরের বুড়ি বলে কথা।

সাহিল আর জিনিয়াকে সবাই পরে দেখল। সবাই সাহিলের দিকে ছুটে গেল। কিন্তু জড়িয়ে ধরতে পারল না তার হাতে ব্যান্ডেজ দেখে। একটা ছোট্ট দশ বছরের ছেলে জিনিয়াকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ ইবে হন ভাইজান ?

সাহিল ছেলেটার মাথার চুল নড়চড় করিয়ে দিয়ে বলল,

‘ ইবে তুরার ভাবিজান । ( ও তোদের ভাবিজান)

জিনিয়া সাহিলের কথা শুনে হেসে ফেলল। ছেলেটা জিজ্ঞেস করল,

‘ তোয়াই এল্লেগরি ধজ্জু কে ভাবিরে? ( তুমি এভাবে ধরেছ কেন ভাবিকে?)

সাহিল বলল,
‘ তুরার ভাবি এহোনো ছুডো, এতেল্লেই। ( তোদের ভাবি এখনো ছোট, এজন্যই )।
জিনিয়া হাত নেড়ে বলল।
‘ আমি বুঝতে পারছিনা আপনাদের কথা। কি কি বলছেন এসব?

ছেলেপুলা সবাই অট্রহাসি দিল। বলল,
‘ ভাবি আরার ভাষা ন বুঝে। ভাবিরে ছেয়ুম ভাইজান। ঘুমডা তুলতু হ।
( ভাবি আমাদের ভাষা বুঝেনা। ভাবিকে দেখব ভাইজান। ঘোমটা তুলতে বলো।)

সাহিল জিনিয়ার নিকাব তুলে দিল। ছেলেগুলা জিনিয়াকে দেখে বলল,

‘ ভাইজান তোয়াই সুন্দর বউ পেয়ু। আরা ও তো হালা, তইলি আরা ও সুন্দর বউ পেয়ুম। আরা কিন্তু তোয়াত্তুন ও হালা।
( ভাইজান সুন্দর বউ পাইছো। আমরা ও তো কালা, তারমানে আমরা ও সুন্দর বউ পাব। আমরা কিন্তু তোমার চাইতে ও কালা। তাহলে তো আরও সুন্দর বউ পাব।)

সাহিল হাসতে হাসতে ঢলে পড়ার অবস্থা হলো। জিনিয়া আপনাআপনি হাসল। সাহিলের দেখাদেখি।

সাহিল হাসতে হাসতে ওই তিনজন লোকের কাছে গেল। বলল,
‘ আসসালামু আলাইকুম চাচা। কেমন আছেন?
তিনজনই সালামের উত্তর দিল। সাহিল জিনিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল তাদের। জিনিয়া তাদের সালাম দিয়ে বেশ কথাবার্তা বলল। যদিও মাঝখানে সাহিল ভাষা ট্রান্সলেটর হিসেবে কাজ করেছে জিনিয়াকে কথা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য।

____________

গ্রামের পাশে বয়ে চলা ছোট্ট নদীটার নাম রূপসা নদী। নদীর নামানুসারে গ্রামটার নাম ও রূপসা। সুন্দর না?
জিনিয়া কন্ঠে প্রফুল্লতা ফুটিয়ে সাহিলকে বলল,
‘ কি সুন্দর নাম? রূপসা? এই নামটা যদি আমার হতো? ইশশ!
সাহিল হাসল। তারা বসা ঠেলাগাড়িতে। শফিক সাহেব আর জাহেদা ভ্যানগাড়িতে বসেছে। সাগর সাহেব, সাজেদ সাহেব, নাহিল অন্য ঠেলাগাড়িতে। জিনিয়া বলল,
‘ নদীর পাড়ে যাব। নৌকায় চড়ব। কেমন?
সাহিল মাথা নাড়িয়ে সায় জানাল।

পনের মিনিটের মাথায় সবাই পৌঁছে গেল গ্রামের বাড়িতে। কতবড় গুদাম ঘর? মাটির?
জিনিয়া বড় বড় চোখ করে বলল,
‘ মাটির ঘর? উপরে ছাদ আছে?
সাহিল মাথা নাড়ল। বলল,
‘ হ্যা দোতলার উপরে টিন। দোতলায় তখন আমার দাদামশাই থাকতেন। ঘরে একটা মাটির সিড়ি আছে, ওটা বেয়ে দোতলায় উঠতে হয়। জিনিয়া শক্ত করে সাহিলের হাত ধরল। বলল
‘ শুনুন না। আমরা ওই দোতলায় থাকব। কেমন কেমন?
সাহিলের অনেকক্ষণ পর বলল,
‘ আচ্ছা।
জিনিয়া খুশি হয়ে গেল। সাহিল ফিসফিস বলল,
‘ খুশিতে কিছু একটা দিতে ইচ্ছে করেনা?
জিনিয়া লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেলল।
‘ যাহ,, আপনি আবার শুরু করেছেন?

_____________

বৃদ্ধ এক মহিলা এল লাঠি ঠকঠক করে। চোখে মোটা ফ্রেমের পাওয়ারি চশমা। কন্ঠ ঝনঝন করা।
আর ও আসলেন বৃদ্ধার ছেলে, ছেলের বউ। তরিনা খাতুন আসলেন পেছন পেছন। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বৃদ্ধাকে সালাম করার জন্য জিনিয়াকে ইশারা করলেন তরিনা খাতুন। জিনিয়া সালাম করল। বৃদ্ধা জিনিয়ার থুতনি ধরে মুখ আগলে ধরলেন। শফিক সাহেব আর জাহেদার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ মাইয়্যা তো এক্কেবারো সোনায় সোহাগা। বাপের চেহারা পাইছে।

শফিক সাহেব গর্ব করে বললেন,
‘ জ্বি। আমার মেয়েটা আমার মতো হয়েছে, ছেলেটা মায়ের মতো।
জাহেদা মুখ ভাঙলেন। বৃদ্ধা বললেন,
‘ আসো সবাই। কলপাড় থেকে মুখ ধুয়ে নাও। খেতে বসবে সোজা।

সাহিলকে বললেন,
‘ বড়মিয়া তুমি বউরে কইয়া মুখ ধুইয়া লও। জিনিয়া বলল,
‘ দাদু এভাবে কথা বলবেন। আমার ওসব বুঝতে অসুবিধা হয়।
বৃদ্ধা জাহানারা বললেন,
‘ আমার বাপের বাড়ি ওই শহরে । তোমার দাদামশাই আমারে বিয়া কইরা এহানে লইয়্যা আইছে। আমি ও তার দেশের ভাষায় কথা কইতে কইতে নিজের দেশের ভাষা ভুইলা গেছিগা। তবে, আমার বাড়িত সবাইরে আমি আমার ভাষা শিখায়ছি। আমার পোলা, পোলার বউ, নাতি, নাতনিরে ও শিখাইছি।
জিনিয়া বলল,
‘ আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলতে জানেন।
বৃদ্ধা তার ঝনঝন করা কন্ঠে বলল,
‘ হয়ছে পাম দিওনা আর। আমার বড় মিয়ার গলায় ঝুলছ এইটা তোমার রাজকপাল।
জিনিয়ার মুখ কালো হয়ে গেল। সাহিল হাত টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘ তুমি কল চাপবে, আমি মুখ ধুবো। কেমন কেমন?
জিনিয়া বলল,
‘ এভাবে টানছেন কেন? পড়ে যাবো তো।
সাহিল ছেড়ে দিল। বলল,
‘ আচ্ছা। আস্তে আস্তে টানছি।
জিনিয়া কল চাপল। সাহিল মুখ ধুলো। সাহিল চাপল, জিনিয়া মুখ ধুলো।

শফিক সাহেব আর জাহেদাকে বালতি করে পানি এনে দিল বৃদ্ধার ছেলে সামাদ মিয়া । নিজের ছেলে মেয়েকে ডাক দিল,
‘ সুরা , সাদি ? কার কি লাগবে দেখতো? কোথায় আছিস দুজন?
ঘরের ভেতর থেকে একটি বারো বছরের ছেলে ছুটে এল। নাম তার সাদিদ। সামাদ মিয়াকে বলল,
‘ আব্বা আপাকে পাইতাছিনা। ঘরদোর গুছায় কোথায় গেছে জানিনা ৷
সামাদ মিয়া নিজের স্ত্রীকে ডাক দিলেন,
‘ সুরার মা গেলে কই? তোমার মেয়েরে ডাইকা লও। এত কাজ এক হাতে কিভাবে সামলাইবা?

বৃদ্ধা হাঁক ছাড়লেন ঘরের ভেতর থেকে। সাহিলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘ বড় মিয়া তোমার বউ, শ্বাশুড়ি আর শ্বশুড়রে লইয়্যা ভেতরে আসো। ছোড মিয়া কই? সাহিল বলল,
‘ নাহিল কলপাড়ে।

____________

কল চাপতে চাপতে একসময় বিরুক্ত হয়ে পড়ল সোরা। শহর থেকে আসা এই ধলা চামড়ার ছেলেটা কখন থেকে মুখ ধুচ্ছে, থামার নামনিঃশ্বাস নেই। আশ্চর্য!
তাকে কি চাকরানী পেয়েছে? সে কি ছেলেটার বাপের খায় না পড়ে? আর এই কলের পানি তো শেষ হয়ে যাবে।
সোরা কল ধীরে ধীরে চাপতে লাগল। নাহিল পানি কম পড়ায় বিরক্ত হয়ে তাকালো সোরার দিকে। বলল,
‘ এই মেয়ে জোরে চাপো। পানি কম পড়ে কেন? গায়ে কি বল নেই? এত খাও, যায় কই? দেখতে ও তো শুকনা পাটকাঠির মতো।
সোরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে কলচাপা বন্ধ করল। কোমরে হাত দিয়ে অগ্নিমূর্তির রূপ নিয়ে বলল,
‘ আমি আপনার বাপের খায়না।
নাহিল মুখ মুছতে বলল,
‘ খাওনা তো কি হয়েছে? আমার বাপের বিটায় তো থাকো।
নাহিল খেয়াল করল,
অপমানে সোরার শ্যামবর্ণের তৈলাক্ত ত্বক চকচক করছে। রাগে দুঃখে সোরা বিড়বিড় করল,
‘ ধলা মিয়ার তলার গরম!
নাহিল মাথার চুল থেকে পানি ঝাড়ল। ভাঁজ করা প্যান্টের পা নামাল। তারপর যেতে যেতে বলল,
‘ এই মেয়ে তোমাদের এই গ্রামে কি কোনো সুন্দরী মেয়ে নেই? সবাই দেখছি কালা! একটাকে ও তো মনে ধরছেনা।
সোরা গলা ফাটিয়ে বলল,
‘ আমাদের গ্রামে ধলা মাইয়্যা নাই। থাকলে ও তাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আপনি অন্য জায়গা দেখতে পারেন। আপনাকে এই গ্রামের কেউ বউ দেবেনা।
নাহিল অপমান বোধ করলে ও দেখালো না। বলল,
‘ এই গ্রাম থেকে বিয়ে করছেটা কে? সব কালা কালা। তুমি ও তো কালা। তোমার নাম কি রাগিনী?
নাহিল পিছু ফিরে দেখল। সোরা ততক্ষণে বাড়ির দাওয়ায় গিয়ে পৌছেছে। নাহিল বলল,
‘ এ নিশ্চয়ই সামাদ চাচার মেয়ে? বাপরে বাপ কি তার তেজ?

_______________

জায়িদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। এখান থেকে সোজা ফিরবে রূপসা গ্রামে। ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছে। গায়ের পুলিশের ইউনিফর্মটা ও চেন্জ করা হয়নি। সবাই ভয়ে ভয়ে দেখছে জায়িদকে। পুলিশের সামনে মানুষ এত ভীতু হয়ে থাকে, পুলিশ সরলেই পুলিশের মারে বাপরে তুলে গালি দিতে ভাবেনা পাবলিক।
স্টেশন পেরোতেই সে পড়ল আরেক ঝামেলায়। বধূবেশে একটি মেয়ে বসে অনবরত কাঁদছে। মেয়েটিকে ঘিরে ধরেছে মানুষ। একেকজন একেক কথা জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু মেয়েটি কোনোকথা বলছে না। সবাই যার যার রাস্তা দেখল। জায়িদ বিরক্ত হয়ে মেয়েটিকে বলল,
‘ এই মেয়ে তোমার বাড়ি কোথায়? বিয়ে থেকে পালিয়ে এসেছ?
মেয়েটি ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ অফিসার আমি বাড়ি ফিরব না। আমাকে বাড়ি ফিরতে বলবেন না।
জায়িদ পড়ল মহাঝামেলায়। কেন সে পুলিশ হতে গেল? এখন কি করবে? পুলিশ দেখায় একে একে সবাই কেটে পড়ল। জায়িদ দেখল ফাঁকা স্টেশন। ফাঁকা না থাকলে ও সে মেয়েটিকে ছাড়তে পারেনা। মেয়েটির জায়গায় যদি জুননু হতো? আর তাছাড়া এটা গ্রাম। মেয়েটির কোনো বিপদটিপদ হয়ে গেলে তাকে সহ নিয়ে নিউজ ছাড়বে। যে ইন্সপেক্টর জায়িদ তালুকদার ছিল গতরাতে মৃত মেয়েটির সাথে। ছিঃ ছিঃ জলজ্যান্ত মেয়েটিকে মৃত বানিয়ে ফেলেছে জায়িদ। যদি জুননু হতো? জুননু কোথায়? ভালো আছে? চার্জ শেষ হওয়ায় ফোন ও দিতে পারছেনা। বড় স্যার গ্রামে পৌঁছে কল দিতে বলেছেন। হায়েনার দল যেকোন সময় আ্যাটাক করার জন্য বসে থাকে।

মেয়েটির গুনগুন করে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। জায়িদ পড়ল মহাবিপদে। বাড়িতে নয় সে গ্রামে যাচ্ছে। তা ও বোনের শ্বশুর বাড়ি। এখন কি করবে সে? এতরাতে কোথায় নিয়ে যাবে এই মেয়েকে?
মেয়েটির কান্না থামল অনেক্ষণ পর। গায়ের পড়নে গায়ে হলুদের শাড়ি। মাথায় পড়া গাজরা। হাতের ফুলের চুড়ি ও। পায়ে একজোড়া কালো বেল্টের জুতো।
জায়িদ মেয়েটিকে পর্যবেক্ষণ করে নোট করল। তারপর মেয়েটির কাছে হাঁটুমুড়ে বসে জিজ্ঞেস করল,
‘ তোমার নাম? বয়স? বাড়ি?
মেয়েটি তার চিকনসুরে ফটাফট জবাব দিল।
‘ নাম সিদরাতুল আনহা। বয়স বিশে পড়েছে। বাড়ি বলব না। যদি পৌঁছে দেন?
জায়িদ বিরক্তি নিয়ে নোট করল সব। এই মেয়েকে দেখলে কেউ কি বলবে যে মেয়েটা কিছুক্ষণ আগে ও কাঁদছিল?
আনহা খেয়াল করল আলো আঁধারিতে দাঁড়ানো জায়িদকে।
‘ গম্ভীর, খিটখিটে মার্কা সুদর্শন পুলিশ। হাতের কব্জিতে থাকা কালো ঘড়িটা চকচক করছে।
আনহা মনে মনে ভাবল। আচ্ছা এই লোকটা বেশি সুন্দর? নাকি সে?
আনহা জায়িদকে একবার দেখল, নিজের হাত একবার দেখল। বলল,
‘ আনহা ও সুন্দর, লোকটা ও সুন্দর। দুজনেই সেম সেম। আনহা একটু বেশি সুন্দর।
জায়িদ আনহার দিকে তাকালো। আনহা ভড়কে গেল। বলল,
‘ অফিসার আমাকে হেল্প করুন প্লিজ। আজ রাতটা কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দিন। আপনার বাড়িতে হলেও একটা রাত আশ্রয় দিন। আপনার বাড়ির দাওয়ায় রাত কাটাবো দরকার হলে । পুলিশের বাড়ি তো চিন্তা নেই।

জায়িদ পড়ল মহাসংকটে। মেয়েটা বেশি বকবক ও করছে। কি করবে সে? বিরক্তিকর!

পাশের দোকানে গিয়ে ফোন খুঁজে জাহেদাকে ফোন দিল সে । সবশুনে জাহেদা মেয়েটিকে সহ নিয়ে আসতে বললেন।
জায়িদ আনহাকে ডেকে বলল,
‘ শোনো মেয়ে, আমি বোনের শ্বশুড়বাড়িতে যাচ্ছি। গ্রামে। তোমাকে আমি সেখানে কি করে নিয়ে যায়? গ্রামের লোক কি ভাববে? তারা এমনিতে ও তিলকে তাল করে।

আনহা চট করে জায়িদকে বুদ্ধি দিল।
‘ অফিসার শুনুন,,,আপনি তো পুলিশ অফিসার। আপনার ডান্ডা দেখলেই সবাই ঠান্ডা হয়ে যাবে। চিন্তা তো নেই, তাইনা? আমি ও কোনো ঝামেলা করব না। চুপচাপ আপনার প্রেমিকা সেজে ,,
জায়িদ চেঁচাল।
‘ কিহ?
আনহা ভয় পেল। দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিল। বলল,
‘ ভয় পেয়েছি অফিসার।
জায়িদ চোয়াল শক্ত করে বলল,
‘ একদম চুপ থাকবে। আমি তোমাকে নিয়ে যাব ঠিক কিন্তু কাল আবার গ্রাম্য থানায় পাঠিয়ে দেব। তারা তোমার ব্যবস্থা করবে। আমি মেয়েদের কেস নিইনা।
আনহা মাথা দুলালো। হেসে মিনমিন করে বলল,
‘ এবার মেয়েদের কেস নেবেন। সমস্যা কি অফিসার?
জায়িদ ধমকে বলল,
‘ আমার কথামতো চললে,চলো। নইলে এখানে থাকো।
আনহা হাঁটা ধরল। তার এলোমেলো হাঁটা দেখে জায়িদ বিরক্ত হলো। আনহার হাত শক্ত করে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘ এত তিড়িংবিড়িং করে হাঁটো কেন মেয়ে? আমার বোন ও তো তোমার বয়সী। কত ভালো আমার বোন? তুমি জানো? আমার জুননু,,,,,
আনহা অবাক। এই লোকটা কোনো মুননু না তুননুর গল্প শুরু করে দিয়েছে? আচ্ছা বাচাল লোক তো?
জায়িদ থামল। আমার জুননুর কোনো গুন আছে তোমার মাঝে?
আনহা বলল,
‘ আমি আপনার বোন হতে যাব কেন? হ্যা?
জায়িদ থেমে গিয়ে বলল,
‘ তো?
আনহা হেসে বলল,
‘ আমি তো অপরিচিতা।
জায়িদ আবার হাঁটা ধরল। সাবধানে হেঁটে আনহাকে নিয়ে অটোতে বসে পড়ল। আনহা স্তব্ধ, বিমোহিত। একটা অপরিচিত মেয়ের জন্য একটা মানুষ কি করে এতকিছু করতে পারে? ভালো শিক্ষা না পেলে কখনোই একটা ছেলে এতটা কেয়ারিং হতে পারেনা। নিজের দিকে তাকিয়ে হাফঁ ছাড়ে আনহা। এতটা কেয়ারিং আদৌ তাকে কেউ করেছিল? মন পড়ছেনা কেন?

জায়িদে গলা খাঁকারিতে হুশ ফিরল আনহার। জায়িদ বলল,
‘ শোনো মেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেনা একদম। আমি আর ঝামেলা নিতে পারব না।
আনহার দুষ্টুমি পায়। সে হাই হাই তুলতে তুলতে জায়িদের কাঁধে মাথা রেখে বলল,
‘ অফিসার, আমার এত এত ঘুম পায় কেন?
আমার এত নেশা নেশা লাগে কেন?
আমার এত এত মাথা ঘুরে কেন?

জায়িদ ঠেলে দিল আনহাকে। শক্ত কন্ঠে বলল,
‘ এই মেয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেব একদম। সোজা হয়ে বসো। গায়েপড়া স্বভাবের মেয়ে আমার পছন্দ নয় একদম। আমার জুননু হলে কখনো এমন করতনা কোনো ছেলের সাথে।
আনহা সরে বসে। আল্লাহ লোকটা তাকে গায়েপড়া বলল?
ছিঃ সে ও কম না। আনহা সরে পড়ে। অনেক দূরত্ব রেখে বসে। সে কি ভুলে গিয়েছিল এই লোকটা একজন পুলিশ অফিসার। ইশশ কত্ত বড় ভুল হয়ে গেল? লোকটা তাকে কি ভেবেছে কে জানে?
গ্রামের বাড়ি পৌঁছাতেই অন্যউপায় না দেখে ভ্যানগাড়ি ডাকল জায়িদ। আনহা তার ব্যাগপ্যাক তুলল। ভ্যানগাড়ি ছাড়ার সাথে আনহা ঢলতে ঢলতে লাগল। চোখবন্ধ করে জায়িদকে খুঁজতে খুঁজতে বলল,
‘ অফিসার? ওই অফিসার আমি পড়ে যাচ্ছি। পড়ে যাচ্ছি। আমি মরে যাচ্ছি। আমাকে ধরুন।
জায়িদ আনহার কথা শুনে হেসে ফেলল। যা দেখা গেল না। আনহার হাত ধরে রেখে বলল,
‘ এই মেয়ে শক্ত হয়ে বসো। মেয়েদের এত নরম হলে চলেনা।
শক্তপোক্ত এক হাতের ভেতর নিজের হাত আবিষ্কার করল আনহা। আকাশে মস্ত বড় চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। সেই চাঁদের আলোয় দেখাযাচ্ছে রাস্তাঘাট। ভ্যানগাড়ি চলা লোকটাকে। আর ভ্যানগাড়ির উপর বসে থাকা একটি গম্ভীর মূর্তি । আনহা ভেবে ভেবে নিজে নিজে হাসল। আর জায়িদের কাছ থেকে পাগল উপাধি পেল।

চলবে,

মাঝখানে চট্রগ্রামের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।
ভালা ভালা গরি কমেন্ট গরোন অনোরা 😊

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here