রৌদ্রদেশে মেঘের বেশে পর্ব-১২

0
464

#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা

[১২]

” আহমেদ মঞ্জিল ” টর্চের আলো পড়ার সাথেসাথে টিনের একটি গেইটে দরজায় লিখা আছে লেখাটি । জায়িদ বুঝে গেল এটিই সেই বাড়ি। আনহা গুনগুন করে গান গাইছে। জায়িদ দরজা ঠেলার সাথে সাথে কেউ একজন যেন দৌড়ে এল৷ জায়িদকে দেখার সাথেসাথে কাঁচুমাচু করে বলল,
‘ আমি সামাদ মিয়া। জাহানারা বেগমের একমাত্র পোলা।
জায়িদ বুঝল লোকটা কেন এভাবে কথা বলছে। জায়িদ স্বাভাবিক গলায় বলল,
‘ জ্বি আমি জিনিয়ার ভাই। মানে এ বাড়ির বড় বউয়ের ভাই।
বেশিকিছু বলতে হলোনা। জিনিয়া দৌড়ে এল। হোঁচট খেয়ে ও পড়ত। জায়িদ আতঁকে উঠে বলল,
‘ জুননু পড়বি তো।
আনহা চোখ ছোট্ট ছোট্ট করে জিনিয়াকে দেখল। এই তাহলে জুননু তুননু মুননু?

জিনিয়া ঝাপটে ভাইকে জড়িয়ে ধরল। জায়িদ বোনের মাথায় চুমু খেয়ে বলল,
‘ জুননু বাকিরা কোথায়?
জিনিয়া কিছু না বলে জায়িদের পকেটে হাত ডুকিয়ে দিল। দুইটা চকলেটস বের হলো। হেসে দিল জিনিয়া। আবার হাত ডুকালো। আর ও দুইটা পেল। আবার ও হাসল জিনিয়া। অন্য পকেটে হাত ডুকালো এবার। আর ও কয়েকটা চকলেটস পেল। জায়িদ তার হাতে থাকা ব্যাগ দেখিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এখানে অনেকগুলো জিনিস আছে। তোর শ্বশুরবাড়ির জন্য এনেছি। আম্মা আনতে বলেছে। দিয়ে দিস।
জিনিয়া গাল ফুলিয়ে বলল,
‘ চকলেটস আটটা কেন?
জায়িদ হেসে ফেলল। বলল,
‘ আমি খেয়েছি। অবসর সময়ে এগুলো খেতে ইচ্ছে হলো। গালে দিলাম। ওমা দেখি টেস্ট আছে। আরেকটা দিলাম। আবার আর খাইনি। তুই বকবি বলে। স্টেশনে চকলেটস পাব কই আবার? তুই তো আবার যেমন তেমন চকলেটস খাসনা।
জিনিয়া একগাল হাসে। জায়িদের পাশে দাঁড়ানো তার সমবয়সী মেয়েটাকে দেখে জিনিয়া এগিয়ে যায়। আনহার গাল ছুঁয়ে বলে,
‘ আম্মা তাহলে তোমার কথা বলছিল? কি নাম তোমার?
আনহা মিষ্টি হেসে বলল,
‘ সিদরাতুল আনহা। বয়স বিশ। বাড়ি বলব না।
জায়িদ হতবাক।
জিনিয়া হেসে দিল খিক করে। বলল,
‘ আচ্ছা বলিওনা। কিন্তু তোমার নামটা খুব মিষ্টি।
‘ তোমার নাম টাম কিছু বলো। আর তোমার ভাইয়ের নাম ও। আই মিন অফিসারের।

আনহার কথা শুনে জিনিয়া আবার ও হেসে ফেলল। বলল,
‘ আমার নাম, ইনশিরাহ তালুকদার। সবাই ডাকে জিনিয়া। ভাইয়ার নাম ইশতিয়াক তালুকদার। সবাই ডাকে জায়িদ।
আনহা চোখ বড় বড় করল। গলার স্বর টেনে বলল,
‘ মা_গো_মা নামগুলো মুখস্থ রাখতে আমার কেয়ামত হবে।
জায়িদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ লেখাপড়ায় মেবি প্রচুর ডাল ছিলে?
আনহা কোমরে হাত দিয়ে নাক ফুলিয়ে তাকাল। জিনিয়া হেসে ফেলল। আনহাকে বলল,
‘ চলো আনহা। ভেতরে নিয়ে যায়। ভাইয়া এসো।
সবাই পা বাড়ানোর আগে কর্কশ কন্ঠস্বর ভেসে আসে। বৃদ্ধা জাহানারা পানের রস ফেলে চোখের চশমা ঠিক করতে করতে এগিয়ে আসে। জায়িদকে দেখে চোখ কপালে তুলে বলে,
‘ পুলিশ কেনে আসছে নাতবৌ?
জিনিয়া বৃদ্ধাকে বললেন,
‘ ইনি আমার ভাইয়া দাদু। জায়িদ।
জায়িদ সালাম দিল। বৃদ্ধা অনেক ভেবেচিন্তে সালাম নিল। বৃদ্ধা আনহাকে দেখে কপাল কুঞ্চন করল। লাঠি দিয়ে দেখিয়ে বলল,
‘ এইডা কেডা নাতবউ? তোমার কি বোন ছিল?
জিনিয়া কি বলবে খুঁজে পেলনা। আনহা চট করে বুড়িকে পা ধরে সালাম করে নিল। জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ দাদু আপনি আমাকে কি করে চিনবেন? আমি তো জিনিয়ার বান্ধবী। তার বোন ও লাগি। বান্ধবী কম বোন বেশি। বছরের বারো মাসের দশ মাস জিনিয়ার বাড়িতেই থাকি। আন্টি আমাকে মেয়ে বলে ডাকে তো তাই।
বৃদ্ধা সন্দিহান কন্ঠে বললেন,
‘ তার বান্ধবী, ভালা কথা। তার ভাইয়ের সাথে কি?
আনহার ইচ্ছে করল এই বুড়িকে লাঠি দিয়ে তাকে বাড়ি দিতে। আনহা হাসিহাসি মুখ করে বলল,
‘ তার ভাই, আমার ও ভাই।

ডাহা মিথ্যা কথা।
শেষের কথাটা বিড়বিড় করল আনহা।
জায়িদ পেছনে হাত দিয়ে দাঁড়ানো সোজা হয়ে। এসব কথা সে ভালো করে শুনছে। মেয়েটা ডেঞ্জারাস বলতে হবে।
বৃদ্ধা লাঠি দিয়ে আনহাকে গুঁতো মারল। বলল,
‘ এই মেয়ে তোমার গায়ে হলুদ শাড়ি কেন? মনে হচ্ছে তোমার আজকে হলুদ সন্ধ্যা ছিল।
আনহা চোখ বড় বড় করে বলে,
‘ হায় হায় এটা কি বললেন? হলুদ শাড়ি পড়লেই কি হলুদ সন্ধ্যা হয়? গ্রামের মানুষ তো আপনি তাই কিছু জানেন না। আমরা শহুরেরা এমনি এমনি হলুদ শাড়ি পড়ি।
বৃদ্ধা চেতে উঠলেন। বললেন,
‘ এই মেয়ে একদম চুপ। আমাকে গ্রাম্য বললা? আমি ও শহুরে। আমি জানি শহুরেরা এমনি এমনি হলুদ শাড়ি পড়ে। এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।
আনহা মুখে দুপাশে দুহাত দিয়ে বলল,
‘ ওয়াও। দাদু তারমানে ডিজিটাল? বাহ বাহ।
বৃদ্ধা খুশি হলেন। শাড়ির আঁচল টেনে মুখের কাছে এনে বললেন,
‘ হ আমি ডিটিজাল। সবসময় ভেবেচিন্তে কথা বলবে।
আনহা মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা।
বৃদ্ধা চলে গেলেন।
নাহিল আর সাহিল এল। সাহিল জিনিয়ার হাত থেকে ভারী ব্যাগটা নিয়ে নিল। বলল,
‘ আসার সময় কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
জায়িদ আনহাকে দেখিয়ে বলল,
‘ এইতো সব অসুবিধা।
আনহা গাল ফুলিয়ে সাহিলের দিকে তাকাল। সাহিল হেসে ফেলল। বলল,
‘ জিনি আম্মা কি এই মেয়ের কথা বলছিল?
জিনিয়া বলল,
‘ জ্বি। ওর নাম আনহা।
সাহিল আনহার কপালে চাপড় মারল। বলল,
‘ চলো বুনডি। জায়িদ আসার সময় বকেনি তো?
আনহা বিস্মিত। কত সহজে আপন করে নিল সবাই তাকে?
আনহা বলল,
‘ আমাকে বকবে? আনহাকে?

নাহিল দৌড়ে আসল। বলল,
‘ তুমি শহুরে। নইলে তোমার সাথে জমিয়ে দিতাম। আমার গ্রামের মেয়ে পছন্দ। বোকাবোকা মেয়ে। তুমি তো চালাক। হব্বে না। হব্বেনা বুনডি।
আনহা হাসে। নাহিলের গাল টেনে জায়িদের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ তোমাকে ও তো আমার বড় ভাইয়ের মতো লাগে ভাইডি। তোমাকে ও হব্বে না। হব্বেনা।
সবাই একসাথে হো হো করে হেসে উঠল।

উঠানের কোণায় দাঁড়িয়ে কৌতূহল চোখে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে। এগোতে চাইলে ও নাহিলকে দেখে আর এগোলো না। জিনিয়া ডাক দিল।
‘ সোরা এদিকে এসো। আমার ভাইয়া এসেছে। সোরা?
সোরা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এল। আশপাশে তাকাল না। জিনিয়া সাহিলকে বলল,
‘ শুনছেন ব্যাগটা সোরাকে দিন।
সাহিল সোরাকে ব্যাগটা দিল। বলল,
‘ না ও। চাচিকে দাও।
সোরা মাথা নাড়ল। জায়িদের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ পুলিশ?
সবাই হেসে উঠল। জিনিয়া বলল,
‘ পুলিশ কি বাঘ?
জায়িদ তার হাত সোরার মাথার উপর দিয়ে চাপড়িয়ে বলল,
‘ ভয় পেয়েছ?
সোরা হেসে দেয়। মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ না পুলিশ বাবু।
পুলিশ অফিসারকে এভাবে স্বাভাবিক কথা বলতে দেখে ভয় কেটে গেল তার। নাহিলের দিকে আড়চোখে তাকাতেই খেয়াল হয় নাহিল হাসছে। সোরা তাড়াতাড়ি কেটে পড়ল।

জায়িদ ঘরে ডুকতেই জাহেদা ছুটে এল। জায়িদ সাগর সাহেব আর সাজেদ সাহেবের সাথে কোলাকুলি শেষ করে মা বাবাকে দেখে এগিয়ে গেল। শফিক সাহেব জায়িদকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। জাহেদা বলল,
‘ ডিউটি কেমন হয়েছে আব্বা? ছুটি কয়দিনের পেয়েছিস?
জায়িদ বলল,
‘ বেশিদিন না আম্মা। জুননুর বিয়ের জন্য ও ছুটি নিয়েছিলাম তো তাই ছুটি বেশি পাইনি। আর তোমরা তো জানো, আমি না থাকলে কনস্টেবলরা কাজে ফাঁকি দেয়। আমাদের কি ছুটি আছে আম্মা? সন্ত্রাসমুক্ত দেশের জন্য রাতদিন আমাদের চোখে ঘুম থাকেনা। জুননুর খারাপ লাগবে তাই চলে এসেছি। আমার ডিউটির মতো জুননুর মন ভালো করাটা ও আমার অনেক বড় ডিউটি। আমার একটা মাত্র বোন।

জাহেদা হেসে ছেলের কপালে চুমু আঁকেন। বলেন,
‘ ভাই বোনের বন্ধন অটুট থাকুক হাজারবছর ধরে।
জায়িদ হাসে। মাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। বলে,
‘ আমাদের মাথার উপর ও ঢাল হয়ে থেকো হাজার হাজারবছর।

জাহেদা দেখে জিনিয়ার সাথে হেসেহেসে কথা বলা মেয়েটিকে। কপাল কুঞ্চন হয় তার। জায়িদকে বলে
‘ আব্বা এটাই কি সেই মেয়ে?
জায়িদ জাহেদাকে ছেড়ে আনহাকে দেখে। বলে,
‘ হ্যা আম্মা। এটাই সেই মেয়ে।
জাহেদা আগাগোড়া দেখে আনহাকে। শফিক সাহেবকে দেখে আনহা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। ভ্রু নাচিয়ে বলে,
‘ কি দেখেন?
সাগর সাহেব কপাল কুঁচকে তাকান। শফিক সাহেব হেসে দেয়। বলে,
‘ তোমার নাম কি আম,হা?
আনহা হেসে দেয় আওয়াজ করে। হাসতে হাসতে বলে,
‘ আনহা আন, হা। আনহা। বুঝতে পেরেছেন?
শফিক মাথা দুলায়। আনহা সবাইকে পা ছুঁয়ে সালাম করে নেয়। জায়িদের কাছে যেতেই জায়িদ জাহেদার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় একলাফে। জাহেদা ভ্রু কুঞ্চন করে তাকিয়ে থাকে। আনহা ও জাহেদার মতো করে জাহেদাকে চেয়ে থাকে। জাহেদা ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছ?
আনহা চোখমুখের ভঙ্গি এবার পাল্টে যায়। সরল ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে সে। জায়িদের দিকে একবার তাকায়। জাহেদা আনহাকে নিরুত্তর দেখে আবার ও জিজ্ঞেস করে।
‘ পালিয়েছ? এই মেয়ে কথা বলছ না কেন?
আনহা ভীতসন্ত্রস্ত চেহারায় চেয়ে থাকে জাহেদার দিকে। কোনো উত্তর দেয়না।
জিনিয়া জাহেদার কাছে চলে আসে। বলে,
‘ আম্মা ওরা তো অনেকদূর থেকে এসেছে। আগে খেয়েদেয়ে একটু রেস্ট নিক। তারপর না হয় কথা হবে। জাহেদা ভেতরে ডুকে যায় জায়িদকে নিয়ে।
জিনিয়া আনহাকে নিয়ে যায় ভেতরে। সোরার রুমে আনহার থাকার ব্যবস্থা হয়। কিছুক্ষণের ব্যবধানে তারা দুজনের মধ্যে ভালো একটি সম্পর্ক তৈরি হয় । আনহা জানতে পারে সোরা দাদ্বশ শ্রেণীতে পড়ে। কত ছোট? আনহা বলল,
‘ তুমি তো এখনো পুঁচকি। আমি তোমার দুই বছরের বড়।
সোরা হেসে বলল,
‘ তাইলে আমি তোমাকে আপা ডাকব।
আনহা খুশি হলো। বলল,
‘ ঠিকাছে। জিনিয়াকে কি ডাকো?
সোরা বলল,
‘ ভাবি ডাকি। বড়দাভাইয়ের বউ না? তাই।
আনহা ঘুরেঘুরে পুরো ঘর হাঁটল। বলল,
‘ মাটির ঘর। আসলেই সুন্দর। মায়ের মুখে শুনেছি আমার বাবার বাড়ি ও নাকি মাটির ছিল। কিন্তু আমি কখনো দেখিনি।
সোরা জিজ্ঞেস করল।
‘ তোমার মা বাবা কোথায়?
আনহা কেঁপে উঠে এই সামান্য প্রশ্নে। মা? বাবা?
আনহা বিড়বিড় করে।
‘ আমার মা’ ই আমার বাবা। আমার বাবাকে আমি কোনোদিন দেখিনি। মায়ের কিছু মনে পড়েনা। তাই বলতে পারেনা কিছু। যখন মনেপড়ে তখন একটু একটু বাবার কথা বলে কাঁদে। বাবা মাকে দেখতে পারত না।
সোরা জিজ্ঞেস করল,
‘ তোমার মায়ের কিছু মনে পড়েনা কেন আপা?
আনহা কন্ঠ কাঁপে। কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে আনহা উচ্চারণ করে,
‘ আমার মা মানসিক ভারসাম্যহীন। আমার মা মাঝেমধ্যে আমাকে ও চেনেনা।
সোরার বুক কাঁপে।
‘ তোমার মা তোমাকে ও চেনেনা?
আনহা ঘনঘন মাথা নাড়ে। বলে,
‘ ডাক্তার দেখিয়েছিলাম একবার। টিউশনির টাকা জমিয়ে। ডাক্তার বলেছেন মায়ের চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা লাগবে। প্রায় দুইলাখের মতো। অনেক সেবাযত্ন লাগবে। কিন্তু আমি মাকে কোনোটাই দিতে পারিনি। না সেবা, না চিকিৎসা? টিউশনি দুটো ও গেল।
সোরার কৌতূহল আর ও বাড়ল।
‘ তুমি পালিয়ে এসেছ কেন তাহলে? তোমার মা এখন কোথায়?

আনহা প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
‘ বইনা আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছ। জানো?
সোরা লাফ দিয়ে খাট থেকে নামে।
‘ আপা তুমি কলপাড়ে আসো। মুখ ধুবে। আম্মা এখুনি চুলা থেকে গরম ভাত নামিয়েছে। দেশী মুরগি রান্না করছে। ঝাল ঝাল আলু ভর্তা আর ডাল রান্না করছে। খাবে। চলো।

সোরা বলল,
‘ ওয়াও সব তো দেশী, দেশী। কতদিন খাইনা? মা ও? হোটেলের কেনা খাবার মা খেতেই চায়না।
সোরা বলল,
‘ মন খারাপ করোনা আপা। তোমার মাকে নিয়ে একদিন এসো। আমার আম্মার হাতের রান্নায় সবাই পঞ্চমুখ। বড়চাচা তো মাকে সেরা রাধুঁনি উপাধি দিছে। আম্মার হাতের রান্না খেয়ে তুমি ও বলবে। দেখো।
আনহা হাসে।

দুজনই কলপাড়ে যায়। আনহা মুখে পানি দিতে দিতে বলে,
‘ সবার সাথে একসাথে খাব। সবার সাথে বসে একসাথে খেতে কি মজা!
সোরা হাসল। বলল,
‘ আচ্ছা আপা। সবাই এমনিতে ও খেতে বসবে।
আনহা মুখ ধুয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
‘ এই অফিসার কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে বলোতো? আর দেখিনা তাকে।
সোরা হেসে ফেলল। বলল,
‘ পুলিশবাবুকে তুমি ভয় পাও না বুঝি?
আনহা হো হো করে হাসে। বলে,
‘ পুলিশবাবু আমাকে ভয় পায়।
সোরা অবাক। পুলিশকে ভয় পায়না? সে তো খুব ভয় পায়। পুলিশরা কিভাবে মারে? ওরেবাপ!

______________

গোলগাল বড় সাইজের টেবিল বসানো বারান্দায়। সাহিলের দাদার আমলের বানানো। কালো কাঠের টেবিল। অনেক মজবুত আর টেকসই। আজকাল এমন কাঠ পাওয়া দুষ্কর। এতবড় টেবিলটা বারন্দার প্রায় অর্ধেকাংশ জুড়ে। বারান্দায় বসা খাটটা ও কালো কাঠের। খাটের উপর বসা বৃদ্ধা জাহানারা সাদিদ আর সোরাকে আদেশ করায় ব্যস্ত। রান্নাঘর থেকে ভাত-তরকারির বাটি টানাটানি করার এক পর্যায়ে ক্লান্ত ভাইবোন দুজন। সাদিদ বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ কেন যে এই শহুরে গুলো এল?
সোরার মা সালমা হাঁক ছাড়ছেন রান্না ঘর থেকে। সোরা দৌড়ে যাওয়ার একপর্যায়ে কারো বুকের সাথে লেগে দুম করে বাড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ে দূরে। নাহিল বিরক্তি ভঙ্গিতে বুকের কাছে মুছতে মুছতে বলে,
‘ চোখে কি দেখোনা মেয়ে? তোমার নাকের উপর লেগে থাকা তেলাপোকার হাগু লাগিয়ে দিয়েছ আমার শার্টে। তুমি জানো এটা কেমন ব্র্যান্ডের শার্ট?
সোরা নির্বাক। সে ছিটকে পড়েছে আর এই লোক পড়েছে তার শার্ট নিয়ে?
নাহিল চোখ তুলে দেখল সোরাকে। বলল,
‘ কি দেখছ ওভাবে?

নাহিল ভাবে, এটুকুনি একটা মেয়ে? বয়স কত হবে? নিশ্চয়ই আঠার ? তার দশ বছরের ছোট হবে এই মেয়ে। অথচ কত রাগ?
নাহিল আবার ডাকল,
‘ এই পিচ্চি? নাক ফুলিয়েছ কেন?
সোরা কাঁদোকাঁদো মুখে বলল,
‘ ছোটদাভাই আমি আপনার সাথে কথা বলিনা। জানেন না?
নাহিল অবাক হওয়ার মতো বলল,
‘ না জানিনা তো। এখনি জানলাম। কখন থেকে কথা বলছ না?
সোরা ভীষণ রাগ হয়। লোকটার সামনে দাঁড়াতে তার ভীষণরকম অস্বস্তি হয়। লজ্জা, আড়ষ্টতা ঘিরে ধরে একদম। সোরা বিরক্ত নিজের উপর। সে কালো চামড়ার কেন হতে গেল? ভাবি কিংবা আনহা আপার মতো হলে কি হতো?
পরক্ষণে মনে পড়ল বড়দাভাই ও তো তার মতো। শ্যামবর্ণের। বড়দাভাইকে তো অনেক সুন্দর দেখায়। তাহলে তাকে ও কি দেখায়?

বৃদ্ধা জাহানারা ধমকে ডাকলেন সোরাকে। সোরা বের হয়ে গেল ঘর থেকে। রান্নাঘরে ডুকতেই জাহানারা সোরাকে জেরা করল।
‘ সুন্দর পোলা দেখছস তাই, ঘুরঘুর করা শুরু হইছে তোর? উল্টাপাল্টা কিছু কানে আসলে পা কেটে ঘরে বসায় রাখব দেখিস।
সামাদ মিয়া যেন কোথা থেকে ছুটে আসে। জাহানারা ভেবে পায়না তার মেয়েকে কিছু বলতে গেলেই সে হাজির। সামাদ মিয়া মায়ের মুখের উপর কথা বলার সাহস পায়না। তারপরে ও মেয়েকে যখন বকল। তখন বলল,
‘ আম্মা আমার সুরা ভালা। রঞ্জু চাচার বড় মিয়ার ছেড়িরে দেখোনাই। পরপুরুষ লইয়্যা পালাইছে। ছোডটার নাকি আবার কার সাথে লেনদেন আছে। আমার সুরার নামে কখনো এসব কথা কাউকে বলতে শুনছ? আমার ছেড়ি আমার কথা ভাবে আম্মা। আমার ছেড়ি ভালা মাইপো। রংটা একটু শ্যামা, নইলে আমার ছেড়ির ও বিয়া হয়ে যেত এতদিনে । তবে চিন্তা কইরোনা রঞ্জু চাচারে কইছি ভালা পোলার সন্ধান পাইলে কইতে। আমারে আশ্বাস দিছে, ভালো পোলার সন্ধান শীগগির এনে দিবে। রং দেইখা যে বিয়া করবে, তারকাছে তো আমার ছেড়ি সুন্দর হইলে ও ভালা থাকবো না আম্মা। আমার ছেড়িরে ভালাবাসতে হইবো আম্মা। ভালা রাখতে হইবো।

জাহানারা আর কিছু বলতে পারেন না। ছেলে তাকে উচিত কথা বলে থামিয়ে দিয়েছে। তাই বলেন,
‘ সেজন্যই কইছি এই রং লইয়্যা আমার নাতিদের সামনে ঘুরঘুর করিস না। তারা সভ্য ঘরের ছেলে। গায়ে ধাক্কাধাক্কি করা আমার চক্ষুশূল একদম। মেয়ে মানুষ তাদের থেকে দূরে দূরে থাকবি।
সালমা বলেন,
‘ সুরা, সাদি ও তো আপনার নাতি নাতনি আম্মা।
জাহানারা তেজ গলায় বলেন,
‘ তো? আমি কি তাদের ভালোবাসিনা? আমি না খেয়ে তাদের খাওয়ায় না? আমার জন্যই তো তোমার ছেড়া ছেড়িরে কেউ কিছু কইতে পারেনা। তোমরা বউ জামাইরে ও কিছু কইতে পারেনা। আমি মরলে বুঝবা আমি কি ছিলাম?
সোরা মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সামাদ মিয়া মায়ের কাছে গিয়ে বলে,
‘ ও আম্মা রাগো কেন? তোমারো বউ এমনি এমনি বলছে। রাগ করোনা আম্মা। সবাই খেতে বসছে মনেহয়। আসো তুমি ও খেতে বসবা। আসো।

তারমধ্যে জিনিয়া চলে আসে। সোরাকে ডেকে বলে,
‘ সোরা আসো। তোমার ভাইদের সাথে বসবে। আনহা ডাকছে তোমায়। সাদিদ কোথায় চাচা?
সামাদ মিয়া হাসিমুখে বলে,
‘ সাদিদ আছে বৌমা। তোমরা যাও সুরা সাদি পরে খাবে।
জিনিয়া বলল,
‘ না না। ওরা আমাদের সাথেই খাবে। ওদের বড়দাভাই ডাকছে না?
ওনি ওদের ছাড়া খাবেনা বলেছে। আসো। সোরা?
সোরাকে জিনিয়া হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে। সাদিদকে ও পেয়ে যায়। দুইভাইবোনকে সাহিলের পাশে বসিয়ে দেয়। সাহিল দুজনকে বলে,
‘ এত লজ্জা ফেলে চলবে? এত লুকিয়ে থাকো কেন?
সোরা, সাদিদ দুজনই মাথা নামিয়ে বসে থাকে। নাহিল শিষ বাজাতে বাজাতে বলে,
‘ সাদিদ সাহেবের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখার আছে ভাই। আজান দিলেই সোজা মসজিদে চলে যায়। মাথা থেকে টুপিটা সরেনা।
সাহিল বলল,
‘ তুই শিখ। তোর তো নামাজ কাযা করার অভ্যাস বেশি। সাদিদ তুমি কিছু শিখাও। সাদিদ মাথা নামানো। কি লজ্জা তার?
সাহিল জিজ্ঞেস করল,
‘ কিসে পড়ো ভাই?
সাদিদ মিনমিন করে জবাব দিল।
‘ ক্লাস সিক্সে।
সাহিল তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘ পড়ো। তোমাকে শহরে নিয়ে যাব।
সাদিদ চমকে তাকায়।
‘ শহরে?
সাহিল হেসে বলল,
‘ হ্যা। শহরে। কিন্তু তারজন্য ভালো রেজাল্ট থাকতে হবে। ভালো করে পড়তে হবে।
সাদিদের মুখে খই ফুটল।
‘ আমি ক্লাস ফাইভে জিপিএ পেয়েছি ভাইজান। স্যারেরা বলছে আমি আর ও ভালা করুম।
সাহিল সাদিদের পিঠ চাপড়ে বলে,
‘ বাহ, তাহলে তো তোমাকে শহরে নিয়ে যেতে হবেই।
সোরা বলল,
‘ ভাই ফর্সা। ভাই শহরে যেতে পারবে। শুধু আমি পারব না। আমি তো,,,
সবাই হু হা করে হেসে উঠে। জায়িদ এসে চেয়ার টেনে বসে জিজ্ঞেস করে,
‘ কি নিয়ে হাসা হচ্ছে?
নাহিলের হাসি থামেনা। সে টেবিল চাপড়ে হাসে। সাহিল হাসি থামিয়ে সোরাকে বলে,
‘ শহরে যেতে হলে ধলা চামড়া লাগেনারে পাগলী।
সোরা অবাক হয়। সে এমন কি বলল?
নাহিলের হাসি থামেনা। জিনিয়া নাহিলের চুল টেনে ধরে। বলে,
‘ সোরা লজ্জা পাচ্ছেনা? এত হাসতে হয় ভাইয়া?
নাহিল কোনোমতে হাসি আটকায়। সাহিল হাসতে হাসতে বলে,
‘ তোমাকে ও নিয়ে যাব শহরে। দুজনকেই নিয়ে যাব।
সোরা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে। সাহিল বলল,
‘ আমি ও কালা না? আমি শহরে কিভাবে থাকি?
সোরা সায় দিল।
‘ ঠিক তো। তারমানে সে অসুন্দর না। বড়দাভাইয়ের মতোই। ভাবিকে জিজ্ঞেস করে নেব, বড়দাভাই কেমন সুন্দর? ভাবি নিশ্চয়ই মিথ্যে বলবেন না।

আনহা এল। জায়িদের পাশের চেয়ার টেনে বসল। বলল,
‘ অফিসার!
জায়িদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। জিনিয়ার পাশে গিয়ে বসল। ফিসফিস করে বলল,
‘ জুননু মেয়েটা সুবিধার না।
জিনিয়া মিটিমিটি হাসে।
‘ কোনোমেয়েকেই তো তোমার সুবিধার মনে হয়না ভাইয়া। আল্লাহ জানে কি আছে তোমার কপালে?
জায়িদ বলল,
‘ জুননু সব মেয়েদের দেখলেই তোর কথা মনে পড়ে। জুননুকে খুঁজি সবার মাঝে।
জিনিয়া হেসে ফেলে। বলে,
‘ সবাইকে জুননু মনে করলে হবে? আমি ছোটবোন হয়ে তোমাকে ওসব শিখাতাম?
জায়িদ হাসে। বলে,
‘ না শিখাতে হবেনা। আমি শিখতে চাইনা।
জিনিয়া সবাইকে খাবার বেড়ে দিল। শফিক সাহেব,সাগর সাহেব,সাজেদ সাহেব চলে আসে। সামাদ মিয়াকে ও বসিয়ে দেয় জিনিয়া।

শফিক সাহেব আর সাগর সাহেবের মাঝের চেয়ারে বসা আনহা। সবাইকে শফিক সাহেব আর সাগর সাহেবকে দেখিয়ে দিয়ে বলে,
‘ সবাই দেখো এই বুইড়ারা আর জায়গা পাইল না। আমার পাশে বসার জায়গা পাইল।
শফিক সাহেব আর সাগর সাহেব মুখ ফুলায়। ‘ তারা কেমন বুইড়া আবার? লাঠি ধরেনা তো।
আনহা দুজনকে মুখ ফুলিয়ে রাখতে দেখে উঠে দাঁড়ায়। মাথায় ভালোভাবে ওড়না পেঁচিয়ে দুজনকে খাবার বেড়ে দেয়। বলে,

‘ খাও বাছারা, আর মুখ ফুলিয়ে রাখিওনা।

ভেতর রুম থেকে জাহেদা একনজরে দেখে আনহাকে। সবার সাথে মিশে যাওয়ার মতো অপূর্ব ক্ষমতা আছে মেয়েটার। কার মেয়ে? কোন বাপের রাজকন্যা? কোন মায়ের ধন? কোন ভাইয়ের কলিজা এই মেয়ে?
জাহেদা আবার হাসিখুশি জিনিয়াকে দেখে। সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। কত সুন্দর সংসারী মেয়ের মতো লাগছে তাকে! কত সুন্দর সংসার তার? মেয়েটা ভালোআছে এটাই অনেক? সাহিলকে যত দেখে ততই মুগ্ধ হয় জাহেদা। এই একটা ছেলে কি জাদু জানে? মেয়েটাকে কিভাবে সব ভুলিয়ে হাসিখুশি করে দিল। কিভাবে তাদের আগের মেয়েকে ফিরিয়ে দিল! জাহেদা মনথেকে দোয়া করে, তাদের এই বন্ধন ভালোবাসা যুগযুগ ধরে বাঁচুক। যুগযুগ ধরে তারা একে অপরের থাকুক। একে অপরের জন্য বাঁচুক। সবসময় দুজন দুজনের পাশে থাকুক।

সাহিল বিরসবদনে জিনিয়ার দিকে তাকায়।
‘জিনি তুমি আমাকে সবার শেষে দিচ্ছ কেন?
জিনিয়া হেসে ফেলল সাহিলের অভিযোগে। বলল,
‘ আপনি অভিযোগ করলে ও কিছু হবেনা তাই। ওরা অভিযোগ করলে ক্ষতি আছে।
সাহিল গালে হাত দিয়ে বসে থেকে বলে,
‘ এটা কোনো কথা? বর হওয়ার জন্য এত বড় শাস্তি?
খাবার টেবিলে সবাই আর হা হু করে হাসে। আনহা বলল,
‘ ভাইডি জিনি তো অনেক কম প্যারা দিচ্ছে তোমাকে। আমি তো বরকে সেইরকম প্যারা দেব। উঠতে, বসতে, হাঁটতে,,,
জায়িদের কাশি উঠে যায়। জিনিয়া দৌড়ে যায়। জায়িদের মাথায় হাত চাপড়াতে চাপড়াতে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। পানি খাওয়া শেষে জায়িদ আনহার দিকে রেগে তাকায়।
‘ এই মেয়ে খাবার টেবিলে বসে বকবক করতে নেই শেখায়নি তোমার মা বাবা?
আনহা চুপ হয়ে যায়। মাথা নামিয়ে ভাত নড়াচড়া করতে থাকে।
মা বাবা টানল কেন এই লোক? খুব নরম জায়গা আনহার, লোকটা কি জানেনা?
জিনিয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে আনহার কাছে যায়। বলে,
‘ আনহা মন খারাপ করলে তোমাকে পেঁচার মতো লাগে।
আনহা অনেক্ষণ পর দাঁত দেখিয়ে হাসে। বলে,
‘ আমার মা এমনটাই বলে। বলে, আমাকে নাকি হাসলে অনেক সুন্দর দেখায়। কাঁদলে পেঁচার মতো লাগে।
সাহিল বলল,
‘ ঠিক বুনডি। তুমি সবসময় হাসবে। হাসলে শরীর ও সুস্থ থাকে।
আনহা হাসল আবার।
সাহিল জিনিয়ার দিকে তাকাল। আনহার গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়ে জিনিয়া সামনে তাকাতেই সাহিলের চোখাচোখি হয়ে গেল। জিনিয়া শফিক সাহেব আর সাগর সাহেবকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করল। আবার তাকাতেই সাহিলের চোখাচোখি। জিনিয়া অবাক। এই লোকটা কি পাগল? জিনিয়া এবার সরাসরি তাকাল। ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল,
‘ কি?
সাহিল মাথা দুলাল এপাশ-ওপাশ। তারপর খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
জিনিয়া আনমনে হাসল। তার পাগল বর!

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here