রৌদ্রদেশে মেঘের বেশে পর্ব-১৩

0
510

#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা

[১৩]

নদীর দুকূল ছাপিয়ে পানি। বর্ষার প্লাবনে পানি থৈথৈ করছে চারপাশে। কাঁঠালচাপার গন্ধ ভেসে আসছে মৃদুমন্দ হাওয়ায়। কয়েকটা জেলেকে দেখা যাচ্ছে নদীর পাড়ে। নদীর পাড় থেকে দূরে কয়েকটা ছোট্ট ছোট্ট বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। স্বচ্ছ তুলো তুলো ভেসে বেড়ানো মেঘের আকাশ বুক মেলে রয়েছে। জমিনে দাঁড়ানো মানব মানবীদের মনের আশা আকাঙ্খা পূরণ করে ঝমঝম করে আবার বৃষ্টি নামানোর প্রতিশ্রুতি নিচ্ছে যেন। দূরে কয়েকটা পালতোলা নৌকা দেখা যাচ্ছে। কয়েকটা ট্রলার । ছোট বড় মাঝারি আকারের নৌকা। কয়েকটাতে বসা যাত্রী। কয়েকটাতে জেলেরা। প্রবহমান নদীর কলকল ধ্বনি কানে আসছে। সাথে কিছুটাদূর থেকে ভেসে আসছে গুনগুন করে গাওয়া মাঝির গান।

‘ নদী ভাঙে একূল ওকূল
ভাঙে বাড়িঘর
প্রেম শিখাইয়া ভাঙল শেষে
আমারি অন্তর বন্ধু আমারি অন্তর।

জিনিয়া বিমোহিত। বিপুল মুগ্ধতায় সে ফেটে পড়তে পড়তে উচ্চারণ করে,
‘ আপনাকে না ফেলে আমার এসব কিছু দেখা হতোনা গুড্ডুসাহেব।
বলতে না বলতেই জিভে কামড় বসায় জিনিয়া। সাহিল চোখ ছোট ছোট করে করে তাকিয়ে হেসে দেয় আওয়াজ করে। তারসাথে তাল মিলিয়ে জিনিয়া ও হাসে। পকেটে হাত গুঁজে হাঁটতে হাঁটতে সাহিল শুধাল।
‘ মা ও আমায় আদর করে গুড্ডু ডাকত। নাহিলকে মুন্টু ডাকত।
মা চলে যাওয়ার পর গ্রান্ডমা ডাকে। মায়ের যখন আমার উপর রাগ হতো তখন মা সাহিল ডাকত। আমার উপর না ঠিক, বাবার উপর হলে। বাবা যখন মায়ের গায়ে হাত তুলতো তখন।
জিনিয়া প্রশ্ন করল।
‘ গায়ে হাত? আপনার মা কোথায় এখন?
সাহিল ছোট্ট করে জবাব দিল।
‘ জানিনা। মা আমায় ভালোবাসেনা তাই ছেড়ে চলে গিয়েছে।
আমাকে তার প্রয়োজন নেই কিন্তু মায়ের ভাবা উচিত ছিল আমার তাকে ভীষণ প্রয়োজন। ভীষণ।
জিনিয়া আর কিছু বলার সাহস পায়না। লোকটার চোখের কোণা জ্বলছে।
কেমন মা তিনি? স্বামীর উপর অভিমান করে চলে যাওয়ার আগে ছেলের কথা কেন ভাবলেন না? ছেলের তো কোনো দোষ ছিল না।
সাহিলের হাতের ভাঁজে হাত রাখে জিনিয়া। বলে,
‘ ধরুন।
সাহিল চোখ নামিয়ে জিনিয়ার হাতটা দেখে। তার হাতের ভাঁজে হাত রাখার আপ্রান চেষ্টা মেয়েটার।
সাহিল মৃদু হাসল। জিনিয়ার হাতটা ধরে সামনে এগোতে এগোতো বলল,
‘ বাকিরা কোথায়?
জিনিয়া বলল,
‘ ওইতো জেলেদের কাছে। ওদিকে যাব প্লিজ।

আনহার প্রশ্নে তীব্র বিরক্ত জেলেটা। আনহা হাতের মাছগুলো নিয়ে আবার রেখে জিজ্ঞেস করতে লাগল,
‘ এটা কি মাছ আন্কেল? এটা? ওটা?
জেলে উত্তর দিতে দিতে শেষমেশ বিরুক্ত হয়ে বলল,
‘ শরোর মেয়পো এগুন পল পাল্লার। ( শহরের মেয়েগুলো পাগল মনে হয়?)
আনহা জেলের দিকে কপাল কুঞ্চন করে তাকায়৷
জেলেটা বলল,
‘ মাছ দিই ফেলো। আর ন ঘেট্ট ( মাছ দিয়ে ফেলো, আর ঘাটাঘাটি করিওনা)
আনহা বিরক্তকর ভঙ্গিতে বলে,
‘ এসব কি বলেন মিয়া?
জেলে মাছের বালতি নিয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়ে।
আনহা দাঁড়িয়ে হাত ঝাড়ে। জায়িদ চেঁচিয়ে উঠে।
‘ এই মেয়ে তুমি হাত ধুয়ে নেবে ভালো করে। ওই হাত দিয়ে মাছ ধরেছ।
আনহার মাথায় দুষ্টুমি ভেসে উঠে। সে হাত দু’টো দেখিয়ে দেখিয়ে এগিয়ে যায় জায়িদের দিকে। বলে,
‘ পালাচ্ছেন কেন অফিসার? কাছে আসুন, লাগিয়ে দিই। আসুন।
জায়িদ দূরে চলে যায়। বিরক্ত হয়ে বলে,
‘ এই মেয়ে আমার সাথে একদম কথা বলতে আসবেনা।
আনহা হাসতে হাসতে ঢলে পড়ে নদীর পাড়ে। সাহিল আর জিনিয়া চলে আসে ইতোমধ্যে। ছিপ দিয়ে মাছ ধরা নাহিল চেঁচিয়ে ডাকে সাহিলকে।
‘ বড়ভাই এদিকে আসো তো।
সাহিল জিনিয়াকে জায়িদের পাশে রেখে যায়।
সোরা কিছুটাদূরে দাঁড়ানো। নাহিল সোরাকে একনজর দেখে নিয়ে বলল,
‘ শোনো মেয়ে বড় মাছ ধরা দিলে, তুমিও টেনে তুলতে সাহায্য করবে। ঠিকাছে?
সোরা মাথায় নাড়ায়। মনে মনে হেসে আওড়ায়,
শহুরে পাগলা, নদীর পাড়ে যদি মাছ পাওয়া যেত তাহলে জেলেদের আর নদীর মাঝখানে যেতে হতোনা।
সাহিল এসেই নাহিলের পাশে দাঁড়ায়। বলে,
‘ মাছ পেয়েছেন ছোটসাহেব?
নাহিল সাহিলের কথা শুনে হেসে ফেলে। বলে,
‘ পাইনি। তবে পাবো। ভাই মাছ যদি বড় সাইজের হয় আমার তো টেনে তুলতে কষ্ট হবে। তাই তোমাকে ডাকলাম।
সাহিল মাথা নেড়ে বলল,
‘ আচ্ছা আমি এখানে আছি।

জায়িদ জিনিয়াকে দেখে হাসে। বলে,
‘ জুননু তোর ভালোলাগছে?
জিনিয়া হেসে বলল,
‘ খুব খুব ভালোলাগছে। তোমার কেমন লাগছে?
জায়িদ বলল,
‘ ভালো কিন্তু ওই মেয়েটাকে নিয়ে ঝামেলায় আছি। গ্রাম্য থানায় যোগাযোগ করলাম। ওখানে সিকিউরিটি নেই তেমন। মেয়েটাকে ছেড়ে আসতে মন চাইছেনা ওখানে। কোনো কিছু হয়ে গেলে আমাকেই ধরবে।
জিনিয়া ভাইয়ের হাত ধরল। বলল,
‘ ভাইয়া একটা কথা রাখবে?
জায়িদ হেসে ফেলল। বলল,
‘ আবদার কর।
জিনিয়া আনহার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ ও আমাদের সাথে আর কয়দিন থাকুক না। কত হাসিখুশি একটা মেয়ে। আমার তো ওকে ভীষণ মনে ধরেছে। ও যখন চলে যেতে চায় তখন না হয় চলে যাবে। প্লিজ ভাইয়া। আবদার করেছি না?
জায়িদ ভাবনায় পড়ে যায়। জুননু এসব কেমন আবদার করছে?
জিনিয়ার মন খারাপ হয়। চলে যাওয়ার আগেই জায়িদ বোনকে আষ্টেপৃষ্টে ধরে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,
‘ এত রাগ করিস কেন জুননু? ঠিক আছে তুই যেটা চাস সেটাই হবে।
জিনিয়া হেসে ফেলল। হঠাৎ মনে পড়ল ট্রেনের কথা। জিনিয়া মাথা তুলে বলল,
‘ ভাইয়া আমি ট্রেনে সীমান্তকে দেখেছি।
জায়িদের ভ্রুকুঞ্চন হয়।
‘ সীমান্ত? ও তোকে দেখেনি তো?
জিনিয়া মাথা নেড়ে বলল,
‘ না ৷ আমাকে দেখেনি। কিন্তু আমি সীমান্তকে স্পষ্ট দেখেছি। তার হাতে অস্ত্র ছিল একটা। ভয়ে এগোতে চাইনি কিন্তু ফোনে কেউ একজনের সাথে কথা বলছিল, আমি ভাবলাম কার সাথে কথা বলছে শুনি। কিন্তু তার কিছুটা পৌঁছানোর আগেই সীমান্ত কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। তার পুরো গ্যাংটায় ট্রেনে ছিল ভাইয়া।
জায়িদের মাথায় অন্য কিছু ভাবনা আসেনা। সে বিরক্ত জিনিয়ার প্রতি৷
‘ ও তোকে দেখে ফেললে কি হতো জুননু? তুই কেন এত সাহস দেখাতে যাস?
জিনিয়া ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ ভয় পাও কেন? তোমাকে দেখেই তো সাহস বাড়ে। কত সাহসী আমার ভাই।
জায়িদ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘ আর কখনো এমনটা করিস না জুননু। দিনশেষে আমার কার কথা মনে পড়ে জানিস তো?
জিনিয়া বলল,
‘ জানিতো। কিন্তু আমি যদি তখন ফুল ইনফরমেশন কালেক্ট করে তোমাকে দিতে পারতাম তাহলে, তোমার সুবিধা হতো তাইনা?
জায়িদ হাসল। বলল,
‘ আজ রাতে আমাদের একটা ক্যাম্প আছে এখানে। কাউকে বলিস না। গোয়েন্দা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সীমান্ত এই গ্রামের আশেপাশেই এসেছে।
জিনিয়া আঁতকে উঠে।
‘ এখানে?
জায়িদ তার মুখ চেপে ধরে।
‘ কেউ শুনবে জুননু। আমি চাইনা সবাই টেনশনে পড়ুক। এসব আমার আর তোর মধ্যে থাকবে।
জিনিয়া মাথা নাড়ায় ঘনঘন। জায়িদ বলল,
‘ কিডনি পাচার চক্র অনেক বড় চক্র। অনেক বড় বড় স্বনামধন্য লোক এই কাজে জড়িত আছে। তাই আমাদের মিশনটা ও অনেক বড়।

জিনিয়া বলে,
‘ ভাইয়া যদি কখনো মনে হয়, আমি তোমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি তাহলে প্লিজ বলো। আমি আপ্রান চেষ্টা করব।
জায়িদ বলল,
‘ আচ্ছা বলব। কিন্তু তুই সাবধানে থাকিস জুননু। তুই একা নয় তোর সাথে এখন অনেকগুলো মানুষের জীবন জড়িয়ে গেছে। সবাইকে আগলে রাখতে হবে তোকে।
জিনিয়া ছোট্ট করে আওয়াজ করে বলল,
‘ আচ্ছা।

____________

দু চারটা ডিঙি নৌকা ডেকে নিল সাহিল। নাহিলের হাত থেকে ছিপ কেড়ে নিয়ে সাদিদকে নিয়ে যেতে বলল। নাহিল ভীষণ রেগে গিয়েছে ভাইয়ের উপর। কিন্তু তা দেখানোর জোঁ নেই। সাহিল দুই তিনবার জিনিয়াকে ডাকল। জিনিয়া সোরা আর আনহার সাথে হাসাহাসিতে ব্যস্ত। সাহিলের ভীষণ রাগ উঠল। সে ডাক দিল জিনিয়াকে,

‘ এই মেয়ে আসবে কি আসবে না? চলে যাচ্ছি আমি। তুমি ওদের সাথে এসো তাহলে।

জিনিয়ার সাথে সাথে বাকিরা ও হেসে ফেলল। আনহা জিনিয়াকে বলল,
‘ তোমার বর তোমাকে চোখে হারাচ্ছে। হায়রে আজ একটা বর নাই বলে।
জিনিয়া চিমটি মারল।
‘ ভাইয়া আছে, তুমি দেখতে পারছ না? ভাইয়া কি ভাববে?
আনহা হো হো করে হেসে উঠল।
‘ অফিসার আমাকেই ভয় পায়। হিহিহিহি। জায়িদ আড়চোখে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে চট করে সরে পড়ে।
জিনিয়া হেসে ফেলল।
সাহিলের গর্জন ভেসে এল।
‘ জিনি তোমাকে আমি ডেকেছি না? ডেকেছি? আসতে হবে না আর। আসিও না।
জিনিয়া তাড়াতাড়ি হাঁটতে যায়। সাহিল আবার ধমক দেয়।
‘ এই মেয়ে এখন দৌড়ে কোনে লাভ হবেনা। তোমাকে নৌকায় তুলব না আর। দরকার নেই। যাও।
জিনিয়ার মন খারাপ হয়। জায়িদ পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে হাসে সাহিল আর জিনিয়ার কান্ড দেখে। আহা বোনটার মুখটা দেখার মত হয়েছে।
সাহিল মাঝিকে হাত নাড়িয়ে বলে,
‘ চাচা আপনি চলেন। আর কাউকে দরকার নেই। কতবার ডেকেছি। আমার কথার কোনো দাম নেই।

জিনিয়া এগিয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ না আমি যাব। হাত ধরুন।
সাহিল ধরল না। মাঝি হা করে চেয়ে রইল দুজনকে।
জিনিয়া হাত বাড়িয়ে দিল। বলল,
‘ নিন, হাত ধরুন। কথায় কথায় রাগ করে ফেলেন কেন?
সাহিল তারপরও হাত ধরল না। জিনিয়া মুখ কালো করে ফেলল। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সাহিল ডাক দিল,
‘ ঠিকআছে আমি ও নেমে যাচ্ছি। চড়তে হবেনা নৌকা টোকা।
জিনিয়া গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। সাহিল নেমে গেল নৌকা থেকে। জিনিয়া সাহিল না দেখে মতো হেসে ফেলল। আল্লাহ লোকটা তো পুরো পাগল!
মাঝিমাল্লা ডাক দিল,
‘ ন চড়িবেন বাবু? ( চড়বেন না বাবু?)
সাহিল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিল।
জিনিয়া বলল,
‘ আমি একা একা চড়ব। তারপর মাঝ নদীতে গিয়ে টুপ করে ডুব মারব।
মাঝি জিনিয়ার কথা শুনে হেসে ফেলল। জিনিয়া নৌকায় থাকা ছেলেটির সাহায্য নৌকায় উঠে বসল। ভয়ে প্রথমেই গা ছমছম করল। জায়িদ অবাক হয়ে চেয়ে রইল। আরেহ জুননু ?
জিনিয়া জায়িদকে ডাকল,
‘ ভাইয়া তোমাদের নৌকা ওইতো। উঠে বসো।
মাঝিমাল্লা আবার ও সাহিলকে ডাক দিল।
‘ বাবু অনর বউ ডরাইবু। এয়ুন। আর গুসসনা গরি ন থেক্কুন। ( বাবু আপনার বউ ভয় পাবে। আসুন। আর রাগ করে থাকিয়েন না।)
সাহিল গেল না। আবার কি মনে করে গেল। জিনিয়ার কাছ থেকে দূরত্ব রেখে বসল। মাঝিকে বলল,
‘ কেউ পড়েটরে গেলে আমি ধরতে পারব না বলে রাখলাম৷

জায়িদ ঘাড় ঘুরিয়ে সোরাকে দেখল। ডাকল,
‘ এই পিচ্চি?
সোরা ভড়কে গেল।
‘ আমাকে ডেকেছেন পুলিশ বাবু?
জায়িদ মাথা নাড়ল। সোরা ভয়ে কাঁচুমাচু করে জায়িদের সামনে এল। জায়িদ বলল,
‘ এই নৌকাগুলো কতদূর যাবে? আচ্ছা তোমার নাম কি যেন?
সোরা ভয়ে ভয়ে জবাব দিল।
‘ সোরা। নৌকা ওইপাড়ে ও যায়।
জায়িদ বলল,
‘ আচ্ছা, বুঝেছি। তোমার ভাইয়ের নাম কি?
সোরা জবাব দিল,
‘ সাদিদ।
জায়িদ বলল,
‘ ওকে ডাকো। আমার সাথে নৌকায় উঠবে।
সোরা মাথা নাড়ল। আচ্ছা বাবু।

সোরা এক দৌড় লাগাল। জায়িদ হেসে দিল সোরার দৌড় দেখে।

সোরা সাদিদকে গিয়ে বলল,
‘ তোকে পুলিশবাবু ডাকছে ভাই।
সাদিদ বলল,
‘ আমি আর কয়জনের কাছে যাবো। ছোটদাভাই তো ছাড়ছেই না আমাকে। নাহিল প্যান্টের পা গোটাতে গোটাতে বলল,
‘ সাদিদ তুমি যেতে পারবে, কিন্তু শর্ত আছে।
সোরা মুখ ভাঙায়।
সাদিদ জিজ্ঞেস করে,
‘ কি শর্ত?
নাহিলের সহজসরল জবাব,
‘ আমার সাথে কেউ একজনকে তো থাকতে হবে। তাইনা?
সাদিদ মাথা নাড়ল। বলল,
‘ আপা থাকুক। আমি পুলিশ বাবুর কাছে যাই।
সোরা না না করে উঠল। নাহিল বলল,
‘ তাহলে জায়িদভাইকে বলি, তুমি ওনার কথা অমান্য করছ।
সোরা না না করে উঠে। পুলিশবাবুকে ভয় করে আমার। নাহিল হো হো করে হাসল। সাদিদ চলে গেল।

তরিনা খাতুনকে সাথে নিয়ে আনহা আবার ও চলে গেল। জায়িদ বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করল,
‘ এই মেয়েটা চলে গিয়েছে, আবার এসেছে কেন?
আনহা এসেই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল। এদিকওদিক হেঁটে বলল,
‘ সবাই দাদুকে রেখে চলে এসেছে। দাদু কত রাগ করেছে?
তরিনা খাতুন হাসে। বলেন,
‘ আহারে কেউ আমার কথা ভাবল না, এই দুইদিনের মেয়েটা কত ভাবল আমাকে নিয়ে।
আনহা একগাল হাসল বলল,
‘ নৌকায় উঠে বসুন দাদু। সাদিদ কই? সাদিদ যাবে আপনার সাথে।
সাদিদকে তরিনা খাতুনের সাথে বসিয়ে দিল আনহা।
জায়িদ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
‘ আরেহ এই মেয়েটা সবসময় আমার সাথে লাগতে আসে কেন?
সাদিদ ভয়ার্ত চোখে জায়িদের দিকে তাকিয়ে থাকল। আনহাকে বলল,
‘ আপা আমাকে পুলিশ বাবু তার সাথে যাওয়ার জন্য ডেকেছে।
আনহার ভুরু কুঞ্চন হলো। পরক্ষণে হো হো করে হেসে দিল সে। ফিসফিস করে সাদিদকে বলল,
‘ আরেহ চিন্তা নাই ভাই। আমি আছি কি করতে? পুলিশ বাবুর সাথে আর কেউ না থাকুক। এই আনহা আছে।
সাদিদ হেসে বলল,
‘ বেঁচে গেলাম আপা। আনহা সাদিদের চুল এলোমেলো করে দেয়। বলে , বুড়িকে দেখে রেখো।
তরিনা খাতুন ভ্রু উচিয়ে বলে,
‘ এই মেয়ে তোমার আমাকে বুড়ির মতো লাগে? আমি কি লাঠি নিয়ে হাঁটি?
আনহা ঘনঘন মাথা নেড়ে বলল,
‘ না না না আপনি তো এখনো তরুনী। আমার চাইতে ও মর্ডান।
তরিনা খাতুন ভাবসাব নিয়ে বসেন৷

আনহা হাসতে গেল। আনহাকে এগোতে দেখে জায়িদ তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠে পড়ে। মাঝিকে ছেড়ে দিতে বলে তাড়াতাড়ি। আনহা চেঁচায়,
‘ এই মাঝি আমাকে না নিয়ে কই যান ? হ্যা? শোনেন আমাকে নিলে মামু বেশি পাবেন। আমি দেব।
জায়িদ ব্যঙ্গ করে বলল,
‘ টাকার গরম?
আনহা ভেংচি কাটল।
‘ তো?
মাঝি বলল,
‘ এয়োন আপা। ( আসুন আপা)
আনহা গিয়ে উঠল নৌকায়। ধপ করে গিয়ে পড়ল জায়িদের পায়ের কাছে। কোমরে হাত দিয়ে আর্তনাদ করে উঠল সে।
‘ মাগোমা গেল রে গেল। কোমরটা গেল।
সাহিল জিনিয়া তাকাল। সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে থাকল।
জিনিয়া ডাক দিল,
‘ ভাইয়া আনহাকে তুলো না? পড়ে গেছে তো? ভাইয়া?
জায়িদের জিনিয়ার উপর রাগ হলো। জুননু কি জানে? মেয়েটা এগুলো অভিনয় করছে। অসভ্য মেয়ে।
জায়িদ হাত বাড়াল। বলল,
‘ এই মেয়ে উঠো। একদম ভং ধরবেনা। ননসেন্স।
আনহা উঠে জায়িদের মুখের কাছে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
‘ কমনসেন্স।
জায়িদ ঘাড় ফিরিয়ে নিল। নৌকা ছাড়ার সাথে সাথে জায়িদের উপর ঢলে পড়ল আনহা । জায়িদের পড়নের শার্ট খামচে ধরল পেছনে। জায়িদ তার পিঠ নাড়াতে নাড়াতে বলল,
‘ অসভ্য মেয়ে ছাড়ো আমার পিঠ। ছাড়ো বলছি।
আনহা ছেড়ে দাঁড়ায়। মিটিমিটি হেসে মিনমিন করে,
‘ পুলিশ বাবু আপনাকে মজা দেখাব আজ।

সোরার হাত শক্ত করে ধরে নাহিল। বলে,
‘ যাও তুমি আগে নৌকায় উঠো।
সোরা হাতটা তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে নিল। বলল,
‘ ছোটদাভাই দাদি যদি,,
নাহিল সোরাকে কিছু বলতে দিল না। বলল,
‘ তুমি আগে উঠো। তারপর আমি উঠব। আমার আগে উঠতে ভয় লাগে। ওরা সবাই কতদূর চলে গিয়েছে। আমরা এখনো এখানে।
সোরা অন্যকিছু বলতে চাইলে নাহিল ঠোঁটের উপর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল,
‘ যেটা বলেছি করো। বেশি কথা বললে এখন গিয়ে ধাক্কা মারব একদম।
সোরা ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ায়। নাহিল হাত বাড়ায়। বলে,
‘ এই মেয়ে আমার হাতটা শক্ত করে ধরো।
সোরা কাঁপা-কাঁপা হাতে নাহিলের দিকে হাত বাড়াল। গলা শুকিয়ে কাঠ।
নাহিল তার হাত সোরার হাতের উপর না রেখে শক্ত করে নিজেই সোরার হাত ধরল। সোরার মুখ দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ বের হলো। তরতর করে কাঁপতে কাঁপতে সে শুধাল,
‘ ছোটদাভাই আমি, আমি নেমে যাব।
নাহিল এক ধমক দিল।
‘ ঠাস করে চড় মেরে ফেলে দেব একদম। ছোট মেয়ে ছোট ছোট কথা বলবে। আমি পড়েটরে গেলে ধরবে কে?
সোরা বিড়বিড় করে বলল,
‘ আমি কেন ধরব?
নাহিল ভালো করে বসতে বসতে জবাব দিল।
‘ তুমিই ধরবে। কালো মেয়ে ভালো হয়ে বসে থাকো।
অপমানে থমথমে হয়ে গেল সোরার মুখ। নাক, ঠোঁট কাঁপল তরতর করে। গাল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়ালে ও তা দেখাল না সে নাহিলকে। নাহিলকে পিছু করে বসল সে। নাহিল ততক্ষণে অন্য পাশে গিয়ে বসল। নৌকা কিছুদূর এগোতেই নাহিল মাথা নিচু করে হাতে পানি নিল। নদীর পানি। কি ঠান্ডা?

স্বচ্ছ জল হাতে নিয়ে চোখ উপরে তুলতেই নাহিলের চোখ গেল সোরার কাছে। কেঁদেছে মেয়েটা? কেন? কি এমন বলেছে নাহিল? গ্রামের মেয়েগুলো কি কথায় কথায় কেঁদে ফেলে? কালো তাই কালো বলেছে। ভুল কি বলেছে?

কালো মানেই কি খারাপ কিছু বলা?
কালো মানেই তো ধলার চাইতে ও ভালা।

হাতের সবটুকু পানি সোরার মুখে ছুড়ে মারল নাহিল। সোরা চোখমুখ বন্ধ করে নিল খিঁচে। মনে মনে ভয়ানক গালি দিল নাহিলকে। নাহিল হো হো করে হেসে শুয়ে পড়ল নৌকার পাটাতনে। মাথাটা এসে পড়ল সোরার কিছুটা কাছাকাছি। মুখে হাত রাখল নাহিল। সোরা চোখ খুলল ধীরেধীরে। ছোট্ট গোলগাল মুখটাতে জমেছে ছোট্ট ছোট্ট পানির কণা। চোখের নিচে আঁকা গাঢ় কাজলের রেখা থাকে সবসময় ল্যাপ্টানো। এমনি কালো, তার উপর কালো কাজল দিয়ে রাখে মেয়েটি। মাথা খারাপ করার ধান্ধা।
সোরা ভয়ার্ত চোখে নাহিলের দিকে একবার চেয়ে আবার মাথা নামিয়ে রাখে। এরা মানুষের মন বুঝেনা। এরা মানুষকে কোথায় আঘাত করলে মানুষ ভেঙ্গেছুড়ে তছনছ হয়ে যায় তা বুঝে। ভালোভাবেই বুঝে।
নাহিল আবার পানি ছিটকে মারতেই সোরার অগ্নিমূর্তি প্রকাশ পায়। ভয়ানক ভাবে চেঁচিয়ে সোরা বলল,
‘ আমাকে কি পুতুল পেয়েছেন? যা ইচ্ছা তাই করছেন? আপনাদের শহরের মেয়েদের সাথে করিয়েন এসব। আমার সাথে না। আমি এসব সহ্য করতে পারব না। আমি কালো তা আমি জানি, বারবার সেটা বলে হেয় করে কি মজা পান আপনি? আমাকে মনে করিয়ে দিতে হবেনা, আমি কালো। আমি সবসময় মনে রাখি সেটা। মনে থাকে। আমি আমার লিমিট জানি, আপনি ও আপনার লিমিটের মধ্যে থাকবেন।
ঘনঘন শ্বাস ফেলে সোরা মাথা নামিয়ে রাখে। নাহিল বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে।
‘ সে কি এমন বলল যার কারণে এত রাগ দেখাতে হবে?
নাহিল কিছু বলতে গেলনা আর। মুখ ফুলিয়ে বসে থাকা সোরার গাল বেয়ে অনবরত গড়ালো জল। নাহিল পকেট থেকে টিস্যু বের করে দিল। সোরা নিলনা। হাতের কব্জি দিয়ে গাল মুছল। সেই গাল আবার ভিজে গেল। যার জন্য মনগহীনে নীরবে নিভৃতে সূক্ষ্ণ অনুভূতিদের জন্ম দিয়েছে কথায় কথায় সে কালো বলে অপমান করে। সোরার নিজের উপর রাগ, ঘৃণা বাড়তে লাগল তরতর। এইসব তার লোভ করার ফল। এত লোভ তার তো কখনো ছিল না। লোভ করতে না করতে তার ফল সে পাচ্ছে। বাবার সম্মানহানি করতে যাচ্ছিল সে। কতবড় অন্যায়! ভালো হয়েছে তার জায়গা দেখিয়ে দিয়েছে। খুব ভালো হয়েছে।
নাহিল গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। মেয়েটা এভাবে কেন কাঁদছে? সে কি খুব বেশি আঘাত দিয়ে ফেলল?
কালো বললে কাঁদতে হবে কেন? কালো মানেই তো ভালো।

________________

সাহিলের খুব কাছে গিয়ে বসল জিনিয়া। সাহিলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে সাহিলের হাতের উপর হাত রাখে। সাহিল চট করে হাত নিয়ে ফেলে৷
‘ দূরে সরো মেয়ে। ভালো লাগছেনা।
জিনিয়া হেসে ফেলল। আর একটু কাছে গিয়ে বসে সাহিলের। সাহিল নড়েচড়ে দূরে গিয়ে বসতেই জিনিয়া সাহিলের হাত ধরল। বলল,
‘ আপনি হাতটা ছেড়ে দেখান, আমি ও ছেড়ে দেব।
সাহিল কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে থাকে জিনিয়ার দিকে। জিনিয়া ভ্রু নাচাল।
‘ কি দেখছেন?
সাহিল চোখ সরিয়ে নিল তাড়াতাড়ি। বলল,
‘ কাউকে দেখিনা। দেখার কি আছে?
জিনিয়া হেসে ফেলল। বলল,
‘ তাকান। দেখুন।
সাহিল আঁড়চোখে তাকালো।
বাতাসের ঝাপটা এসে মাথার ঘোমটা সরিয়ে দিল জিনিয়ার । জিনিয়ার আগে সাহিল বিরক্ত হলো। ঘোমটা মাথার উপর তুলে দিয়ে বলল,
‘ জিনি তুমি তো সুন্দর না।
জিনিয়া মুখ কালো করার বদলে হেসে দিল। বলল,
‘ আমি অসুন্দর তো কি হয়েছে? দিনশেষে রাত নামলে কিংবা রাত ফুরিয়ে প্রহর নামলে আমাকে কিন্তু এই অসুন্দর, জঘন্য বলা মানুষটা কাছে টানে। ভালোবাসে। আর আমি তার আহ্বানে ছুটে যায়। তার ভালোবাসায় পাগলপারা হই। দিনশেষে এই অসুন্দর বলা মানুষটার কাছেই আমি ভালো থাকি। সে ভালোবাসে তো আমায়। আমি জানি।
সাহিল অস্বীকৃতি জানায়।
‘ ভুল কথা। আমি তোমাকে ভালো করে দেখিওনা। ভালোবাসা অনেক দূর।
জিনিয়া আবার ও হেসে ফেলল। বলল,
‘ আপনি তো আমার দিকে না তাকিয়ে ও দেখেন। না ধরে ও ছুঁয়ে ফেলেন। না বাসবেন বলে ও ভালোবেসে ফেলেন। না জড়াবেন বলে নিজের সাথে জড়িয়ে ফেললেন। এখন আপনার এই মুখের কথা কি করে বিশ্বাস করি আমি?
সাহিল নদীর পানিতে চোখ রাখে। কিছুই বলেনা।
জিনিয়া তার চওড়া বুকে আলতোকরে মাথা রাখে। বলে,
‘ আমি এখানকার কথাগুলোকে বিশ্বাস করি। তারা আমাকে মিথ্যে বলেনা।
সাহিল হেসে মুখটা রাখে জিনিয়ার মাথার উপর।
জিনিয়ার চোখ যায় ওই দূরের নৌকায়। জায়িদ দাঁড়িয়ে রয়েছে নৌকার পাটাতনের উপর। মুখটা পানির কাছে নিবদ্ধ। পেছনে দাঁড়ানো আনহা।
অজানা আশঙ্কায় জিনিয়ার বুক ধুকপুক করতে থাকে। পানি তেষ্টা পায়। সাহিলের বুকে মুখ ঘষে জিনিয়া উচ্চারণ করে, পানি, পানি।
পানির নাম ধরতেই গলা আর ও শুকিয়ে উঠে জিনিয়ার। সাহিল বলল,
‘ দিচ্ছি।
জিনিয়া আবার তাকায় ওই দূরের নৌকায়।

বাতসের শাঁ শাঁ শব্দ স্পষ্ট। মাঝনদী। ভালো লাগছে জায়িদের। পকেট থেকে ফোন বের করে কয়েকটা ছবি নেয় সে। অনেকবার জাহাজে চড়েছে সে। নৌকায় চড়ার অভিজ্ঞতা ও আছে। কিন্তু তারপর ও আজকের এই মুহূর্তটা দারুণভাবে উপলব্ধি করছে। একটু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সে। মেয়েটা দুহাত মেলে দাঁড়িয়েছে। আশ্চর্য পড়ে যাওয়ার ভয় নেই।
জায়িদ আবার সামনে তাকাল। তীব্র বাতাসে গায়ের শার্ট ও নড়ছে। মাথার উপর হঠাৎ পাতলা এক ওড়না আবিষ্কার করে জায়িদ। পুরো মুখ মাথা ঢেকে গিয়েছে। ওড়না সরাতে ওড়নাটি ধরল জায়িদ। সরাতে পারল না জায়িদ। তার আগেই ঢলে পড়ল নদীর জলে।

সাহিলের বুকে থাকা জিনিয়া ছটপট করতে লাগল শুধু। মোচড়ামুচড়ি করতে লাগল। মুখ দিয়ে কথা বেরোলো না। সাহিলের বুকে আঁচড় কাটতে লাগল শুধু। সাহিল জিনিয়ার এমন অবস্থা দেখে ভড়কে গেল হঠাৎ।
মুখ ধরে জিজ্ঞেস করল,কি হয়েছে? কি হয়েছে জিনি? আমাকে বলো? পানি খাবে?
অন্যদিকে ভেসে আসা চিৎকার সাহিল কানে নিলনা। জিনিয়ার কি হয়েছে তা কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। সাহিল খেয়াল করল জিনিয়ার গাল ভিজে উঠেছে। সাহিল গর্জে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে জিনি? কেন এমন করছ?
জিনিয়ার আপনাআপনি হিঁচকি উঠে। সাহিলের গর্জনে তার বুক ফাটে এবার। গলার আওয়াজ স্পষ্ট হয়। এলোমেলো সুরে কেঁদে দিয়ে বলে,
‘ আমার ভাইয়া। ভাইয়া। ভাইয়াকে বাঁচান। আনহা ধাক্কা মেরেছে। আমার ভাই।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here