স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-২৬

0
1015

“স্বপ্নচূড়ার আহবান ”
পর্ব-২৬

রাত ঠিক দুইটা উনপঞ্চাশ। ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ
করে জানান দিচ্ছে সময় জীবন থেকে ধীরে ধীরে কমছে। ঘন ঘুটঘুটে আঁধারে তাকিয়ে আছে জ্বলজ্বলে দুটো চোখ। হাত পা টানটান করে গুছিয়ে শুয়ে আছে নীলাংশ। আজ জীবনে প্রথম বার সে উপলব্ধি করছে
অন্ধকারের নিজস্ব রূপ আছে। যা শুধুমাত্র এই একা থেকেই অনুভব করছে। চোখের দুই পাতা এক হচ্ছে না কিছুতেই।
সে উঠে বসলো। দুই হাতের তালুতে চোখ মুখ ঘষলো।
নাহ ঘুম আসছেনা। উঠে দাঁড়িয়ে অন্ধকারেই হাতড়ে
রুম থেকে বের হলো। একটা হালকা আলোবাতি জ্বলছে। সে শোয়ার পর থেকে অদ্ভুত ভাবেই পায়রার জন্য চিন্তা করছে৷ মনমস্তিষ্কের পুরোটা জুড়ে শুধু চিন্তা ছিলো ‘পিচ্চিটার, মাথা ব্যাথা কমেছে তো?’
ঘরে আসার আগে সে যখন গিয়েছিলো তখন ব্যাথায় ছটফট করছিলো পায়রা। নিজের উপর রাগ লেগেছে তখন, মেয়েটার সিট বেল্টটা সে আগে খেয়াল করেনি বলে। শুয়ে এই কথাগুলোই পোকার মতো কিলবিল করছিলো৷
আরও কিছুটা হেঁটে সে পায়রার রুমের সামনে দাঁড়ালো। ঠোঁট চেপে ভাবছে, ভেতরে কী যাওয়া উচিত? এত রাতে একটা মেয়ের রুমে ঢোকা কী সমীচীন? দোমনা করতে করতে শেষমেষ লক চেপে ভেতরে ঢুকলো। নীল ডিম লাইটের আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে পায়রার শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকা নিস্তেজ শরীরটা। নীলাংশ সম্মোহনের মতো এগিয়ে গেলো।
বিছানার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো৷ সে কী দেখতে এতো উদগ্রীব জানেনা। তার মন শুধু বলছে -‘ এখানে থাকতে ভালো লাগছে। ‘
সে মনকে সায় দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। কেটে গেছে আরও অনেকক্ষণ৷ সম্বিত ফিরে আসতেই সে চটপট উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। বাহিরে যেয়েও আবার ফিরে আসলো৷ পায়রার হাতটা খাট থেকে নিচে ঝুঁকে পড়েছে। নীলাংশ হাতটা খুব ধীরে উঠিয়ে রাখলো। পাশে এলোমেলো কাঁথাটা টেনে দিলো। মুখে পড়ে থাকা ছোট ছোট চুল গুলো গুছিয়ে বালিশের এক সাইডে রেখে দিলো। লম্বা চুল ফ্লোরে গড়াগড়ি খেতে চাচ্ছে বোধ হয়। পায়রা ঘুমের ঘোরেই মুখে খাবার খাওয়ার মতো করছে৷ নীলাংশ মৃদু হেঁসে চলে যেতে নিলো। কিন্তু হাত লেগে অন্ধকারে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থাকা চিরুনিটা ঠাস করে নিচে পড়ে গেলো স্ব শব্দে। পায়রা ধড়ফড় করে উঠে বসেছে। ঘুম পাতলা সে। নীলাংশের দিকে তাকিয়ে প্রথমে সে ভয় পেয়ে গেছিলো। এই অন্ধকারে কে ঢুকলো। কিন্তু নীলাংশ সামনে ফিরতেই বুকে থুতু ছিটালো ৷ নীলাংশ চোর ধরা পড়ার মতো ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে আছে। পায়রা হাঁপড়ের মতো শ্বাস ফেলে বললো-

‘সুন্দর সাহেব,আপনে এই নিশুতি বেলায় ভূতের মতো দাঁড়ায় আছেন ক্যান?’

নীলাংশ বোকা হাসলো৷ আমতা আমতা করে বললো –

‘ভূত? না তো, আমার ঘুমের ঘোরে হাঁটার অভ্যাস আছে আরকি। ছোট বেলা থেকেই স্লিপ ওয়াকিং করি।’

পায়রা ভ্রু কুচকে কিছু ভাবলো ৷ নীলাংশের দিকে তাকিয়ে অবুঝের মতো বললো-

‘ঘুমে হাঁটার রোগ! ‘

নীলাংশ সাহস পেলো একটু মনে। ভয় পেয়ে গেছিলো খুব। পায়রা আবার তাকে ভুল বুঝবে না তো! কিন্তু পায়রা উল্টো পাল্টা কিছু ভাবেনি যাক। সে হেঁসে বললো-

‘হ্যা তো! শুধু হাঁটা না আমার অন্ধকারে হাঁটতে ভালো লাগে। যাকে বলে অন্ধকার বিলাস। ‘

‘অন্ধকার বিলাস! এইডা আবার ক্যামনে করে? আমিও করুম ‘

নীলাংশ সহসা হেঁসে দ্রুত ভঙ্গিতে বললো –

‘ঠিক আছে, আরেকদিন তোমাকে নিয়ে অন্ধকার বিলাস করবো কেমন? আজ ঘুমাও। ‘

___________________

সকালে দ্রুত ঘুম ভেঙে গেলো পায়রার। সে নিজেই কাপড় পড়ে তৈরি হয়ে নিলো৷ নীলাংশ নাস্তা খেয়ে পায়রাকে স্কুলে নিয়ে গেলো। পায়রা উৎসুক হয়ে আছে নতুন স্কুলে প্রথম দিন ক্লাস করতে। নীলাংশও বেশ ফুরফুরে। কেন যেন পায়রার হাসিখুশি মুখটা ভালো লাগছে তার। স্কুলের সামনে গাড়ি থামলো। নেমে গেলো পায়রা। প্রথম দিন তাই নীলাংশ ক্লাস রুমে পর্যন্ত এগিয়ে দিলো পায়রাকে। ক্লাসে তখন দুই একজনের ব্যাগ রাখা। কেউ-ই ক্লাসে নেই। নীলাংশ পায়রাকে নতুন দিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বেরিয়ে গেলো। পায়রা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। কেউ নেই বলে হেড ডাউন করে বসলো। মুখ গুঁজে থাকায় চোখ বুঁজে এসেছে। যেহেতু কেউ আসেনি। তাই পায়রা ভাবলো এভাবেই কিছুক্ষণ বসে থাকতে।

আধা ঘণ্টা পর অনেক স্টুডেন্টরাই হৈচৈ করে ক্লাসে আসলো৷ টিচার ঢুকে ডাস্টার দিয়ে সামনের বেঞ্চটায় বাড়ি লাগাতেই সকল স্টুডেন্ট দাঁড়িয়ে গেলো। পায়রা তৎক্ষনাৎ সজাগ হয়ে গেলো৷ বেঞ্চ থেকে মাথা উঠিয়ে
দাঁড়াতেই সবার দৃষ্টি পড়লো। সকলে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো৷ পায়রার বেঞ্চে মেয়েটা ছিটকে যাওয়ার মতো বেঞ্চ থেকে নেমে গেলো। আগে পরের দুই বেঞ্চও পেছনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। যেনো ময়লা ডোবার কোনো জিনিস এখানে রাখা হয়েছে। পায়রা সবার দৃষ্টিতে বুঝতে পারলো তার মুখের কুৎসিত দাগই এর কারণ। টিচার তাসনুভা, পায়রার দিকে এগিয়ে আসলেন। রুক্ষ থেকেও রুক্ষ স্বরে বললেন-

‘এই মেয়ে! তুমি ক্লাসে কেনো ঢুকেছো? সাহস হলো কী করে? ‘

পায়রা হতবাক হয়ে কিছু বলার আগেই তাসনুভা শক্ত হাতে বেঞ্চ থেকে বের করলো। তারপর এক প্রকার টেনে হিঁচড়ে ক্লাস থেকে বের করে দিলো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here