”স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৩৪
‘ছিহ!দূরে যাও প্লিজ। ঘেন্না লাগছে আমার। ‘
স্কুলের ক্যান্টিনে দাঁড়িয়ে সিংগারা খাচ্ছিলো পায়রা। ছুটি হয়েছে দুপুর সাড়ে বারোটায়। সকাল বেলা ঘুম দেরিতে ভাঙায় তাড়াহুড়া করে এক পিস ব্রেড খেয়ে চলে এসেছিলো। তাও হয়তো খাওয়া হতো না। যদি না নীলাংশ তাঁকে খাইয়ে দিতো। প্রায় প্রায় নীলাংশের হাতে খাবার খেতে হয় পায়রাকে। যখন মন খারাপ থাকে খেতে ইচ্ছে করে না বা নিজহাতে খাওয়ার সময় পায়না তখন নীলাংশ একটু একটু করে খাওয়ায়। কোনরকম খেয়ে আসায় পেটে ইদুর দৌড়াদৌড়ি করছে। নীলাংশ মাসের শুরুতেই ওকে হাতে কিছু টাকা দেয় যাতে নিজের কিছু খেতে ইচ্ছে করলে কখনো খারাপ না লাগে। এছাড়াও আয়মান সাহেব মাঝে মধ্যেই হাজার খানেক টাকা দেয়। ক্যান্টনে এসে
গরম সিংগারাটাই একটু ভালো লাগলো পায়রার। অর্ডার করে দাঁড়ালো পাশে। অন্যমনস্ক হয়ে ছিলো।
হঠাৎ-ই একটা মেয়ে অন্য পাশে থেকে এমন একটা মন্তব্য ছুঁড়ে দিলো। পায়রা তাকালো সেদিকে। এই মেয়েটাও ক্লাসে নতুন। দারুণ রকমের সুন্দরী। শারীরিক গঠন চমৎকার। একসময় পায়রা এর থেকেও দেখতে সুন্দর ছিলো। কিন্তু কখনো নিজের থেকে অসুন্দর কাউকে দেখে এমন আচরণ করেনি। মনে মনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সে। একজন ভিক্টিমকে আশেপাশের ভালো মানুষেরা হয়তো অনুপ্রেরণা দিতে পারে বেঁচে থাকার বা লড়াই চালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু কখনোই সেই ভিক্টিমের জীবনের দুঃখ গুলো নির্মূল করতে পারে না। এটা সম্ভবও না। সবসময় ইচ্ছে করে না পাল্টা জবাব দিতে। পায়রারও ইচ্ছে হলো না। সে চুপ করে পাশের সিটে বসে একটা সিংগারা খেলো। দ্বিতীয় সিংগারাটা একটু আগে হলেও খেতো কিন্তু এখন গলা দিয়ে নামবে না। মেয়েটা একটা স্যান্ডউইচ কিনে হাতে নিয়েছে। ক্রসবেল্টের বাম পাশে নেমপ্লেটে
লেখা ‘জাফরা’। পায়রা টিস্যু দিয়ে হাত মুছে বিলটা পে করলো। জাফরা মেয়েটা আড়চোখে পায়রাকে পর্যবেক্ষণ করছে। এটা হয়তো ‘সি’ সেকশনের মেয়ে। মোট তিনটা সেকশন। তাঁর মাঝে পায়রা সবার প্রথম ‘এ’ সেকশনে। জাফরা মেয়েটা হয়তো এর আগে পায়রাকে দেখেনি। নাহলে, বর্তমানে কেউ পায়রার দিকে আঙুল তুলতে সাহস পায় না। পায়রা হাত ভাজ করে বললো –
‘চেহারা বা সৌন্দর্যের অহমিকা করতে নেই জানো?’
জাফরা বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে। কারো কড়া কথা সহ্য করতে পারে না। চোখ মুখ খিঁচে বললো-
‘ইউ ব্লাডি! তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি কোন লেভেলের। চেহারা দেখে আমার পেটের খাবার উল্টে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আবার আমাকে শেখাতে এসেছো আমার কী করা উচিত? ‘
চোখের তীর্যক দৃষ্টি দিয়েই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো জাফরা। পায়রা কিছুক্ষণ পর বের হলো। সাধারণ দিনের মতোই নীলাংশ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। পায়রা এগিয়ে এসে ম্লান হাসলো। না ভুল, হাসার চেষ্টা করলো একটু। পায়রার হয়তোবা মনেই ছিলো না,নীলাংশ তাঁর মনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শব্দ গুলোও বিশ্লেষণ করে ফেলে৷ তাঁর পিচ্চির মন খারাপটাও সে ধরেই ফেললো। পায়রাকে গাড়িতে বসিয়ে রওনা হলো। কিন্তু, পথিমধ্যে কোনো প্রকার কথাই হলো না অন্য দিনের মতো। যেখানে রোজ স্কুলে কার কার সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে সব পইপই করে বলে। বাসায় আসতেই গোসল সেরে নামাজ পড়লো পায়রা। নীলাংশ বাসায় এসে অন্যান্য সময়ে পড়তে বসে। কিন্তু আজ গোসল করেই খাবার হাতে পায়রার ঘরে ঢুকলো। এখন আর আগের মতো সংকোচ দ্বিধা কাজ করে না। বরং এই ঘরটায় ঢুকলেই একরাশ মুগ্ধতা ছেয়ে যায় মনকোণে। খুবই সাদাসিধা একটা ঘরকে পায়রা অসাধারণে রূপ দিয়েছে। হাতে বানানো বিভিন্ন রঙের আর্ট তৈরি করে দেয়ালের একসাইডে এক সারিতে সাজিয়েছে। বারান্দায় দুটো ফুলের টব। মেঝেতে সবুজ রঙের ঘাসের ডিজাইনের কার্পেট বিছানো। একদিনে এসব হয়নি। নীলাংশ যখনই জিজ্ঞেস করে কোনো কিছু লাগবে কিনা তখন পায়রা একটু অস্বস্তি নিয়েই বলে তাঁর ঘর সাজিয়ে রাখতে ভালো লাগে। প্রতিটি জিনিস নীলাংশকে বলেই এনেছে। নীলাংশ খুব খুশি মনেই আনে। কারণ তাঁর পিচ্চি এসব ছাড়া আর কোনো কিছুর আবদার মুখ ফুটে করেনা।
এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘরে ঢুকলো নীলাংশ। পায়রা আলমারিতে জামা কাপড় রাখছিলো। নীলাংশকে আসতে দেখে এগিয়ে আসলো। নীলাংশ বিছানায় বসে ভাতের উপরে লেবুর রস ছিটাচ্ছে। পায়রা ভ্রু কুচকে বললো-
‘আপনি ভাত খাবেন এখন?’
নীলাংশ মাখাতে মাখাতে বললো-
‘হ্যা।’
পায়রা অবাক হলো ৷ কারণ নীলাংশ এসব খায়না। সে সকালে উঠে ব্রেড বাটার, দুপুরে চাইনিজ মিক্সড ভেজিটেবল, আর রাতে লাল রুটি দিয়ে সবজি খায়।
ভাত খেলেও খুবই স্বল্প । আচমকা হাতে টান অনুভব করলো পায়রা। নীলাংশ তাঁকে পাশে বসিয়ে দিলো।
ভাতের লোকমা তুলে বললো-
‘খাও। ‘
‘আমি?’
‘হুম, তুমি। একটা সিংগারা খেয়ে বুঝি পেট ভরে?’
‘আপনি কীভাবে জানলেন আমি সিংগারা খেয়েছি, তাও আবার একটা?’
নীলাংশ ভ্রুক্ষেপহীন রইলো। পায়রা লোকমাটা মুখে পুড়ে নিলো। পুরো খাবার শেষ হতেই নীলাংশ হাত ধুয়ে পায়রার রুমে আসলো। পায়রা বিষন্ন মুখে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘন ঘন দীর্ঘ শ্বাসই বোঝাচ্ছে তাঁর বিতৃষ্ণা। নীলাংশ পায়রার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। পায়রার মাথায় স্নেহের হাতটা রাখতেই পায়রা না তাকিয়েই নীলাংশের উপস্থিতি টের পেলো। নীলাংশ মৃদু কন্ঠে বললো-
‘পিচ্চি, সবসময় কান্না আঁটকে রাখতে নেই। এতে মন শক্ত হয়ে যায়। ‘
পায়রা খাটে বসে আছ,আর নীলাংশ দাঁড়িয়ে। কথাটা বলার দুই মিনিট পরই পায়রা নীলাংশের কোমরের কাছের টিশার্ট মুঠোয় আঁকড়ে ধরলো। মুখ গুঁজে ফুপিয়ে উঠলো। অনেক দিন পর আবারও হতাশা বেরিয়ে আসতে চাইছে। পুরনো ক্ষত খোঁচালে ঘাঁ দগদগে হয়ে ওঠে তেমন পুরনো স্মৃতিগুলো মনে পড়লে পুরনো কষ্ট গুলোও সতেজ হয়ে ওঠে। যতই শক্ত হোক দিনশেষে সেও মানুষ। তাঁরও ইচ্ছে করে সাজতে, নিজের মনমতো কোথাও যেতে। কিন্তু পারেনা। চেহারায় একথালি দাগ যে একটা জীবন নষ্ট করে দিতে পারে তা দুর্ঘটনাটা না ঘটলে জানতেই পারতো না পায়রা। নীলাংশ দুই হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে তাঁর পিচ্চিকে। পায়রার কান্নার বেগ বাড়তে থাকলো। ভীষণ হতাশাজনক গলায় বললো –
‘জীবন এত কঠিন কেনো সুন্দর সাহেব? আমার যে আর বাঁচতে ইচ্ছে করেনা! ‘
পায়রার মনে পড়ে কোথাও দেখা কিছু লাইন-
বিস্বাদ যদি না থাকে তো,
স্বাদ পাবে না কভু।
আধার আছে বলেই হয়তো,
সুখের আলো অমৃত,
মরণের ভয় আছে বলেই তো,
জীবন এতো আমোদিত।
~রোদসী৷
চলবে….