#এক_সমুদ্র_ফুল
#পর্ব_15
Writer:: Shaanj Nahar Sanjida
।
।
চোখ খুলতেই দেখি আমি হসপিটালের বিছানায় শুয়ে আছি।ডক্টর এসে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে।
আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া ফুল।তুই চোখ খুললি।জানিস আজ দুদিন হলো তুই অজ্ঞান ছিলি।(সোনালী আপু আমার পাশে বসে)
আচ্ছা পেশেন্ট কি বিবাহিত?(ডক্টর কিছু কাগজ ঘাটাঘাটি করতে করতে বাবাকে প্রশ্ন করলো)
জ্বি।ডক্টর।কেনো?(আরমান অবাক হয়ে)
ও মা হতে চলেছে।(ডক্টর)
আমি এই কথা শুনে অবাক হয়ে।সাথে সাথে পেটে হাত রাখলাম।বাবা,,মা সোনালী আপু সবাই অবাক হয়ে গেলো।
তবে এতো অল্প বয়সে প্রেগনেট হাওয়ার কারণে ওর মৃত্যুর ঝুঁকি আছে।এমনি ও ঠিক মত খাবার খায়না বলে শরীর দূর্বল।একটুর জন্য miscarriage হওয়া থেকে বাঁচলো।(ডক্টর)
তাহলে ডক্টর এখন কি করতে হবে?(আয়শা ভয় পেয়ে)
আমার মনে হয় আবর্শন করা উচিত। বেচেঁ থাকলে বাচ্চা আবার হবে।(ডক্টর)
আবর্শন?(আয়শা অবাক হয়ে)
হুম।এখনও সময় আছে।(ডক্টর)
ডক্টর আপনি যা ঠিক হয় তাই করুন।(আরমান)
না।আমি এই বাচ্চা চাই।(আমি)
ফুল?(সোনালী)
ফুল।তোর এখন শরীর ভালো না।দেখলি তো ডক্টর কি বললো?(আরমান)
আমি বাচ্চা রাখবো তো রাখবই।(আমি কঠিন গলায়)
ওকে বলে কোনো কাজ হবে না।সমুদ্রকে ফোন করে বলো।(আয়শা)
খবরদার।কেউ যদি আমার মা হওয়ার ব্যাপার বা আমার সন্তানের খবর ওকে জানাও তাহলে আমি যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে যাবো।(আমি রেগে)
আরমান একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে
ঠিক আছে।তুই যা চাস তাই হবে।
আমি চাই তুমি ফিরে এসো সমুদ্র।এই বাচ্চাটার অস্তিত্বও আমি তোমাকে জানতে দেবো না।(আমি মনে মনে)
।
।
কয়েকমাস পর
আমার 17 বছর বয়সে আমি মা হয়।আমার মেয়েটাকে কোলে নিয়েই আমি ওর নাম দেই আলো।আমার অন্ধকারের আলো।আমার পরিবার।সেদিন বাসর ঘরে সমুদ্র আমাকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে উনার পরিবার আমার পরিবার না।কিন্তু এখন আমি বলতে পারি আমারও পরিবার আছে।এখন আমি ওর পরিবারকে ছাড়তে রাজি।আলো হওয়ার ছয় কি সাত মাস পর আমি কলেজে ভর্তি হই।যদিও আমার এক বছরের বেশি সময় গ্যাপ গেছে তবুও আমি তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি।কারণ আমার শক্তি,,আমার মেয়ে ছিলো আমার পাশে।হাসিখুশির মধ্যে দিয়ে আমি খুব সুখেই আছি আমার আলোর সাথে।
।
।
বর্তমান
আমি এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই প্রায় রাত দুটো বেজে গেলো।এতক্ষন বেলকনিতে দাড়িয়ে থাকা দেখে সমুদ্র আসলো।এসেই আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আমার ঘাড়ে মুখ গুজে দিল।
ফুল এতো রাতে এখানে কি করছিস?(সমুদ্র ঘাড়ে মুখ গুজে)
ভালো লাগছিলো না।তাই ঠান্ডা হাওয়ার খেতে এসেছি।(আমি)
চল একসাথে মিলে হাওয়া খাই।
বলেই সমুদ্র আমার হাত ধরে বেলকনিতে বাধা দোলনায় নিয়ে বসালো।আর আমার পাশে ও বসলো।সমুদ্র আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।আর আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছি
ওর করা কাজ গুলো কি আমি ভুলতে পারবো?ক্ষমা করা খুব সহজ।কিন্তু ভুলে যাওয়া খুব কঠিন।ওর করা কাজ গুলোকে ক্ষমা করে দিয়েছি।কিন্তু আমি এখনও তা ভুলতে পারছি না।(সমুদ্রের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম)
সোনালী আপুর বিয়েটা হলেই আমাকে সমুদ্রের সাথে কথা বলতে হবে।এই দোটানা জীবন নিয়ে চলা যায় না।সমুদ্র আমাদের আলাদা হতেই হবে।(আমি মনে মনে)
ফুল।তুই আকাশের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছিস?(সমুদ্র আকাশের দিকে তাকিয়ে)
আমি চুপ।
ফুল চল না আমরা আবার শুরু থেকে শুরু করি!(সমুদ্র আমার দিকে তাকিয়ে)
আর কষ্ট সহ্য করার মতো মন মানুষিক আমার নেই সমুদ্র।আমরা চাইলেও শুরু থেকে শুরু করতে পারবো না।কিছু জিনিসের হাত মাঝ পথেই ছেড়ে দিতে হয়।
বলেই আমি উঠে যেতে লাগলাম।পরেই সমুদ্র আমার হাত ধরে বললো
যদি আমি হাত ধরে থাকতে বাধ্য করি?
সবাই তো আমাকে বাধ্যই করে চলেছে।এ আর নতুন কি?(আমি শুকনো হাসি দিয়ে)
আজ তুই এমন কথা বলছিস কেনো ফুল?(সমুদ্র অবাক হয়ে)
কিছু না।শুধু কিছু অতীত এসে হাতছানি দিয়ে গেলো।(আমি মুচকি হাসি দিয়ে)
আই অ্যাম সরি ফুল।(সমুদ্র নিচের দিকে তাকিয়ে)
আমি শুধু তাচ্ছিল্য হাসি দিলাম।
আমি এখন তোকে কোনো কিছুতেই বাধ্য করবো না।(সমুদ্র)
হাত ছাড়ো ঘুমাবো।(আমি)
সমুদ্র হাত ছেড়ে দিলো।আমি এসেই সোফায় শুয়ে পড়লাম। সমুদ্রও কিছুক্ষণ পর এসে বেডে শুয়ে পড়লো।পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সমুদ্র বেডে নেই।আলো বেডেই ঘুমিয়ে আছে।আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলাম।আর আমার মনে পড়লো আজ সোনালী আপুকে দেখতে আসবে।আমি নিচে নামতেই
ফুল ভালো হয়েছে তুই উঠে পড়েছিস!উনারা ফোন করেছে।বলেছে উনারা নাকি দশটা এগারোটার মধ্যে চলে আসবে।এখন তোর বাবা আর সমুদ্র গেছে বাজার করতে।মিতু আমার সাথে রান্নার কাজ দেখছে।তুই একটু সোনালীকে টেনে তুলে তৈরি করে দে।আর শোন ওকে ভালো দেখে একটা শাড়ি পরিয়ে দে।দূর তুই তো শাড়িও পড়াতে পারিস না।এখন কি করা যায়?(আয়শা টেনশনে মাথা চুলকাতে চুলকাতে)
মা তুমি এত চিন্তা করো না তো।আমি গিয়ে আপুকে টেনে তুলছি।তুমি একটু পর মিতু ভাবীকে পাঠিয়ে দিও উনি আর আমি মিলে শাড়ি পড়াবো।(আমি)
তাই বরং ভালো।তুই আমাকে বাচালি ফুল।
বলেই আয়শা রান্না ঘরে ঢুকে গেল।
মাও না।খালি টেনশন নেয়। যাই হোক আমি মহা রাণীকে তুলি।
বলেই আমি সোনালী আপুর রুমের কাছে গেলাম।
এই সোনালী আপু।উঠো তোমাকে দেখতে আসবে মনে আছে তোমার।(আমি দরজায় টোকা দিতে দিতে)
যা না ফুল ঘুমাতে দে।মাত্র তো নয়টা বাজে।আর উনারা তো শুনেছি দুপুরে আসবে(সোনালী ঘুম ঘুম চোখে)
জ্বি না মহারানী।উনারা দশটা এগারোটার দিকে আসবে।(আমি চিল্লিয়ে)
ওহ।আচ্ছা।
কি?এতো তাড়াতাড়ি আমি কি করে তৈরি হবো।(সোনালী আরো টেনশন নিয়ে)
এইজন্য তো আমি এসেছি।(আমি দরজায় দাড়িয়ে দাড়িয়ে)
ফুল।মজা নিস না।তুই make up এর নামও জানি না,,কোনটা কোন জায়গায় লাগাতে হয় তাও জানিস না।আর তুই করবি আমার make up থাক বাবা।(সোনালী বেডে বসে বসে)
দেখো ইনসাল্ট করার দরজা খুলে করো।(আমি)
আচ্ছা খুলছি।
বলেই সোনালী এসে দরজা খুলে দিল
কি যেনো বলছিলে?(আমি কোমর ধরে)
রাগ করছিস কেনো ফুল।আমি তো এমনি বলেছিলাম।তুই কত ভালো।(সোনালী আপু আমাকে পাম মেরে)
হইছে হইছে।আমাকে আর পাম মারতে হবে না।এখন ফ্রেশ হও।আমি মিতু ভাবীর কাছ থেকে শাড়ি নিয়ে আসছি।(আমি)
ওকে।তুই যা।তৈরি হচ্ছি।
বলেই সোনালী আপু ওয়াশরুমে ঢুকলো আর আমি মিতু ভাবীর রুমে গিয়ে কাবার্ড থেকে একটা শাড়ি বের করলাম।উনার কাবার্ড আজকে উনি খোলাই রেখেছে।
।
।
আমি সোনালী আপুর রুমে বসে আছি।সোনালী আপু ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে বসে চুল মুছতে লাগলো।আমি বেলকনিতে দাড়িয়ে আছি।
ফুল!আজকে তুই কেমন যেনো চুপ হয়ে আছিস!ভাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে?(সোনালী)
না।কি হবে?(আমি সোনালী আপুর দিকে তাকিয়ে)
তাহলে তুই কি ভাবছিস?(সোনালী)
কিছু না।তুমি কি শাহাদাত আংকেলের ছেলেকে রাকিবের ব্যাপারে সব কিছু বলবে?(আমি)
আমি জানি না ফুল।উনার সাথে আমার নতুন করে জীবন শুরু করার কথা।কিন্তু বিশ্বাস কর আমার ভয় হয় উনি জেনে যদি আমাকে খারাপ মেয়ে ভাবে তখন কি হবে?আর এখন তো বাবার সম্মানও জড়িত।(সোনালী চিন্তিত হয়ে)
হুম।উনি তোমার বিষয়ে কি ভাববে তা নিয়ে একটা দুবিধা থেকেই যাবে।তাই বলে তুমি উনার কাছে সত্যিটা লুকাবে এইটাও তো ঠিক না।সব কিছু ঠিক থাকলে তুমি উনার সাথে জীবন কাটাবে।তাই এই সম্পর্কের শুরুতেই মিথ্যাকে এনো না।রাকিবের ব্যাপারে সব উনাকে বলে দেয়াই আমার ভালো মনে হয়।আর উনি যদি তোমার অতীত জেনে বর্তমানকে গ্রহণ করে।তবে ভবিষ্যতে তোমার থেকে সুখী আর কেউ হবে না।(আমি মুচকি হেসে)
ফুল।আমি সব বলবো উনাকে।(সোনালীও মুচকি হেসে)
কাকে কি বলবি তোরা?(মিতু রুমে ঢুকে)
ককই কিছু না।(সোনালী তুতলিয়ে)
দেখ আমি কিন্তু কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে।তোরা কি ভাবছিস ভালোয় ভালোয় বল!কিছু তো একটা করেছিস তোরা?আমাকে বলবে,,না আমি গিয়ে বাবাকে বলবো।(মিতু রুমের বাহিরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলো)
আমি বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে রইলাম।
এই না না।ভাবী বলছি।
বলেই সোনালী আপু মিতু ভাবীর হাত ধরে উনাকে আটকে সব কিছু খুলে বললো।
ইস!তোরা আমাকেও নিয়ে যেতি আমিও মারতাম।(মিতু আফসোস নিয়ে)
হ্যা??(আমি আর সোনালী আপু অবাক হয়ে)
হুম।কেনো?তোরা এতো অবাক হচ্ছো যে!(মিতু)
ভাবী রাখো।তুমি একটা তেলাপোকাও মারতে পারো না।আর তুমি মারবে মানুষ!(আমি)
তোমার কি মনে হয় আমার সাহস নেই।আর্মি ম্যানের বউ কি আমি এমনি এমনি!শুনো বাঘের বউও কিন্তু বাঘিনী হয়।(মিতু গর্ব করে)
হইছে তোমার।এখন তোমার নোনোদিনিকে তৈরি করো।না হলে নিচে থেকে বাঘের মা লিডার বাঘিনী(আয়শা) এসে তোমার আর আমার হাওয়া ফুস করে দিবে।(আমি)
ও হ্যা হ্যা।চল চল।
বলেই মিতু ভাবী সোনালী আপুকে তৈরি করতে লাগলো মাঝে মধ্যে আমি হেল্প করছি।
মিতু ভাবী সব সময় সাগর ভাইয়াকে নিয়ে গর্ব করে।উনাদের বিয়েটা লাভ ম্যারেজ ছিলো।সাগর ভাইয়া মিতু ভাবীকে তাদের রিলেশন চলা কালীন বেশি টাইম দিতে পারতো না এখনও বেশি সময় দিতে পারে না।কিন্তু মিতু ভাবীর এতে কোনো কষ্ট নেই।উনি সাগর ভাইয়ার মত একজন দেশ প্রেমিকের স্ত্রী এতেই অনেক খুশি।সত্যিই বাঘের সাথে বাঘিনীকেই মানায়।মিতু ভাবীর অনেক ধৈর্য।যখন ভাইয়া ট্রেনিংয়ে যেতো মাসের পর মাস ওদের কথা হতো না।কিন্তু এতেও তাদের মধ্যে ভালোবাসা এক চুলও কমে নি।বরং আরো বেড়েছে।উনাদের কথা ভেবেই মনটা ভালো হয়ে যায়।
কি হলো ফুল?কি ভাবছো?কালো ক্লিপটা দে। কখন থেকে চাইছি।(মিতু)
ও হ্যা।এই নাও।
বলেই কল্পনার জগৎ থেকে বাড়িয়ে আসলাম।
আচ্ছা।তোরা যে ছেলেটাকে পিটালি কোনো ভয় করে নি তোদের?(মিতু ভাবী সোনালী আপুর চুল বেঁধে দিতে দিতে)
আমার তো ভীষণ ভয় করছিল ভাবী।আমি তো কান্নায় চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না।হাত পা কাঁপতে ছিলো।কিন্তু তখনই ফুল কোথা থেকে যেনো দুটো ব্যাট এনে দিলো।ফুলকে দেখে আমার শরীরেও জোশ চলে আসলো।দিয়ে দিলাম ধুরুম ধারুম কয়েকটা।(সোনালী জোশ দেখিয়ে)
ফুল। তুইও না।দুজন মেয়ে ছিলি তোরা কিছু একটা হয়ে গেলে কি হতো?
এতো সাহস কিন্তু ভালো না।(মিতু)
((আমার এক বেস্ট ফ্রেন্ড আমাকে বলেছিল,,সাঞ্জি বেশী সাহস ভালো না — লেখিকা🙂))
এতো সাহস ভালো না?তাই না?কিন্তু সেদিন যদি সাহস করে সমুদ্রকে বলতে পারতাম “”আমি কোনো প্রমিজ করবো না””।আর সেদিন যদি সাহস করে বলতে পারতাম “”না,বাবা আমি সমুদ্রকে বিয়ে করতে পারবো না””।তাহলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতো।তখন আমার সাহসের খুব প্রয়োজন ছিলো।সাহস দরকার ছিল আমার “না” বলার।সাহসের দরকার ছিল আমার ইচ্ছা জানানোর।সাহসের দরকার ছিলো আমার কারো কথার অবাধ্য হওয়ার।সাহসের বড্ড প্রয়োজন ভাবী।তুমি বুঝবে না!একটু সাহস দেখাতে পারলে জীবন পাল্টে যায়।আবার একটু সাহসের অভাব জীবন নষ্ট হয়ে যায়।আমি আর কোনো দিন সাহসের অভাবে ভুক্তে চাই না। অন্তত নিজের ইচ্ছে গুলো আমি প্রকাশ করার সাহসটা অর্জন করতে চাই।(আমি মনে মনে)
।
।
চলবে,,,