নীল চিরকুট’ পর্ব-১৭

0
4960

#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

১৭.

বারান্দার গ্রিলে ল্যাপ্টে থাকা লতানো গাছটির নাম জানা নেই নম্রতার। লাল টুকটুকে ফুল ফোটে থাকা গাছটির নাম কী হতে পারে, ভাবতে ইচ্ছে করছে না। কুঞ্জলতা, তরুলতা,মাধবীলতা টাইপ কিছু হবে নিশ্চয়? হলে হোক। ফুল গাছের নাম নিয়ে নম্রতার তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। নাম দিয়ে ফুল বিবেচনা করাটা বোকামো। ফুল হলো সৌন্দর্যের প্রতীক। ভালোবাসার প্রতীক। ফুল দেখে আকৃষ্ট হওয়ার নিয়ম আছে, নাম জানতেই হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। পৃথিবীর প্রায় সব ফুলই সুন্দর হয়। কিন্তু সব ফুলের নাম সুন্দর হয় না। এইযে, “রেড স্পাইডার লিলি” নামের ফুলটির আরেকটা অদ্ভুত নাম হলো, “মৃতদেহ ফুল”। কি আশ্চর্য! ফুলের মতো সজীব, প্রাণোবন্ত একটি উদ্ভিদের নাম এমন বিদঘুটে কেন হবে? ফুলের নাম শুনেই যদি চোখের সামনে ফ্যাকাশে,ভয়ঙ্কর মৃতদেহের ছবি ভেসে উঠে তাহলে তো চলবে না। ফুলের নাম হতে হবে স্নিগ্ধ, আবেগী। নম্রতার ইচ্ছে হলো ওই লাশ, ফাঁসের জনককে ধরে এনে বলে, ‘ ইউ রিয়েলি নিড টু ইম্প্রুভ ইউর কমনসেন্স, ডাফার।’ কিন্তু বলা হলো না। আমাদের জীবনে সব ইচ্ছে পূরণ করার জন্য হয় না। কিছু ইচ্ছে শুধু ইচ্ছে করার জন্যই হয়। নম্রতার এই ইচ্ছেটাও তাই। সুতরাং, ইচ্ছে পূরণের অাবশ্যকতা নেই। নম্রতা ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। টকটকে লাল ফুলগুলোতে আলতো আঙ্গুল ছোঁয়াল। সাথে সাথেই মসৃন, শীতল এক অনুভূতি খেলে গেল ডানহাতের তালুই। ফুলগুলো কী অদ্ভুত লাল! নম্রতার মাথাতে চট করেই কড়া নেড়ে গেল এক অদ্ভুত নাম। মুহূর্তেই এই অপরিচিত ফুলটির নাম ঠিক ফেলল নম্রতা। আজ থেকে এই ফুলের নাম হবে, রক্ত ফুল। blood flower। এই ফুলের নাম শুনতেই চোখে ভাসবে থোকা থোকা তাজা রক্ত। নম্রতার উলোটপালোট চিন্তার মাঝেই আর্তনাদ করে উঠলো একজোড়া কুকুর। নম্রতা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নিচে তাকাল। কুকুরগুলোকে দেখা যাচ্ছে না। নিকষ কালো অন্ধকারে, তিনতলার ওপর থেকে কুকুরের অবস্থান টের পাওয়ার কথা নয়। কুকুরগুলো আবারও ডাকছে। আচ্ছা? এই মাঝরাতে কোনো এক গোপন কষ্টে নম্রতার মতো তারাও কি কাঁদছে? দূর থেকে ভেসে আসা ওই ডাকে কী বিষণ্নতার ছাপ আছে? নিশ্চয় আছে। নয়তো তাদের আর্তনাদে অন্ধকারটা আরও একটু বিষণ্ন আর গাঢ় লাগছে কেন নম্রতার? নম্রতার বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো আরও একটি দীর্ঘশ্বাস। হলের পাশে ঝোপের মাথায় দুই একটা ঝিঁঝি পোকা নির্বিকার আলো ছড়াচ্ছে। নম্রতার বিষণ্ন চোখে তাদেরকে হঠাৎ-ই আকাশ থেকে খসে পড়া জীবন্ত তারা বলে বোধ হচ্ছে। সেগুলো যেন আকাশব্যাপী ছড়ানো ছিটানো তারক ফুলের মালা! নম্রতা এক সমুদ্র বিষণ্নতা নিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। তার চোখে রাজ্যের কান্না। বেশ কিছুক্ষণ চাঁদহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার পর নম্রতার মনে হলো, তার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। এক বুক অসহায়ত্ব নিয়ে জীবনের চাকাটা ঘুরতে চাইছে না। এবার তার বিশ্রাম চাই। আদরমাখা বিশ্রাম। কাছাকাছি কোথাও আবারও ডেকে উঠল সেই জোড়া কুকুরের দল। নম্রতা চোখ নামিয়ে আবারও নিচের দিকে তাকাল। কুকুরের তীক্ষ্ণ আর্তনাদের সাথে মিলেমিশে ঘড়িতে বারোর ঘন্টা বাজল। সেই সাথে বাজল মৃদু ম্যাসেজ টুন। নম্রতা ক্লান্ত চোখে ফোনের দিকে তাকাতেই চোখে-মুখে বিস্ময় খেলে গেল। নোটিফিকেশনে ‘আরফান আলম’ নামটা চোখে পড়তেই নিজ দায়িত্বে কুঁচকে গেল ভ্রু জোড়া।

‘ আপনি এখন কেমন আছেন? ‘

কাল রাতে দেওয়া অতোগুলো উলোটপালোট ম্যাসেজের পর আরফান যেচে পড়ে নক দিয়েছে ভাবতেই বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ল নম্রতার চোখে-মুখে। নম্রতা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বেশ রয়ে সয়ে উত্তর দিল,

‘ ঠিক আছি। আপনি?’

‘ আলহামদুলিল্লাহ।’

আরফানের এমন উত্তরের পর বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না নম্রতা। কী বলবে, কী বলা যায় এসব ভাবতে ভাবতেই আরফান লিখল,

‘ আপনাকে ওই অবস্থায় ফেলে আসার জন্য দুঃখিত। আমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। দিনের ওই সময়টাতেই ব্যক্তিগত মানুষগুলোকে একটু সময় দেওয়ার চেষ্টা করি। সরি, এগেইন।’

নম্রতা নিজের মনে হাসল। হুট করেই প্রশ্ন করে ফেলল,

‘ প্রিয় মানুষটিকে ভীষণ ভালোবাসেন। তাই না?’

ম্যাসেজ সীন হলো কিন্তু উত্তর এলো না। নম্রতা নিজের ভুল বুঝতে পেরে খানিকটা অপ্রস্তুত হলো। তাড়াহুড়ো করে লিখল,

‘ সরি! এভাবে আপনার পার্সোনাল বিষয়ে প্রশ্ন করাটা উচিত হয়নি আমার।’

‘ ইট’স ওকে। প্রশ্নটা ততটাও ব্যক্তিগত ছিল না। তাকে আমি ভীষণ নয় হয়ত তার থেকেও বেশি ভালোবাসি। এজন্য তার বরাদ্দ সময়টুকুর এক বিন্দুও অন্যকাউকে দিতে সাহস পাই না। পাছে, রেগে যায় বা কষ্ট পায়। বয়োজ্যেষ্ঠরা বলে, মেয়েদের রাগ নাকি সাংঘাতিক। আমি সাংঘাতিক রাগে ভস্ম হতে চাই না।’

কালো মেঘে ডুবে থাকা নম্রতার মনটা একটু নড়েচড়ে উঠল। ভালোবাসা নামক অনুভূতিটা এত অদ্ভুত কেন? ভালোবাসার ছোট্ট একটা গল্প শুনলেও এত সুখ সুখ অনুভূতি হয় কেন? বুকের কোথাও একটা তীক্ষ্ণ ঈর্ষা জাগে আবার সেই মন-ই মিষ্টি আনন্দ নিয়ে প্রার্থনা করে, বেঁচে থাকুক ভালোবাসা। সুখে থাকুক ভালোবাসা-বাসীর মানুষগুলো। কি আশ্চর্য এই নিয়ম! কি আশ্চর্য এই মন! নম্রতা ছোট্ট শ্বাস টেনে নিয়ে উত্তর দিল,

‘ কথাটা খুব একটা মিথ্যে নয়। মেয়েদের রাগ সত্যিই সাংঘাতিক। তবে তারা বিনা কারণে রাগ করে না। রাগের পেছনে শক্ত কোনো কারণ থাকে।’

ওপাশ থেকে উত্তর এলো,

‘ তাই নাকি? পৃথিবীতে তাহলে আপনিই একমাত্র নারী যার রাগের পেছনে কোনো কারণের প্রয়োজন হয় না। অযথা রণচণ্ডী রূপ নিয়ে ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলেন।’

আরফানের ম্যাসেজে কপাল কুঁচকে গেল নম্রতার। বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘ ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলি মানে কী? আপনি কী মাঝরাতে ঝগড়া করার জন্য নক দিয়েছেন আমায়?’

আরফান যেন বেশ বিস্মিত হলো। বলল,

‘ ঝগড়া আর আমি? আমি ঝগড়া করি না। সত্যটা বললাম। ঝগড়া করাটা আপনার স্বভাব আমার নয়।’

নম্রতা ফুঁসে উঠে বলল,

‘ আপনি অসহ্য একটা মানুষ। আমি কখনই অযথা ঝগড়া করি না। আপনিই সেই কালপ্রিট যে প্রথম থেকে আমায় বিরক্ত করছেন।’

‘ ওসব ছাড়ুন। অনাধিকার চর্চা না হলে একটা কথা বলি? নিষাদকে ভালোবেসে খুব একটা সুখী আপনি হবেন না। আপনি বরং তাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করুন।’

আরফানের ম্যাসেজ দেখে বেশ অবাক হলো নম্রতা। লিখল,

‘ আপনি অনুমতি চাইলেন ঠিক। কিন্তু অনুমতি দেওয়ার মতো সময়ই দিলেন না। আর নিষাদে কী সমস্যা আপনার? কোনভাবে আপনি ভিলেন হওয়ার চেষ্টা করছেন না তো? এমনও হতে পারে নিষাদের বিয়ে টিয়ের কথা আদৌ হচ্ছেই না অথচ আপনি বাংলা সিনেমার ভিলেনদের মতো কথা বাড়াচ্ছেন।’

‘ সবসময়ই উল্টো বুঝাটা নিশ্চয় আপনার জন্মগত রোগ? আজব কথা-বার্তা। আপনাদের মধ্যে কথা বাড়িয়ে আমার কী লাভ? আমি আপনার ভালোর জন্যই বলছিলাম। বলার পর বুঝতে পারছি, বলাটা উচিত হয়নি। আল্লাহ হাফেজ।’

ম্যাসেজটা সেন্ট করেই ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল আরফান। পুরো ব্যাপারটিই ঘটল নিঃশব্দে। কোথাও কোনরূপ শব্দ হলো না। ফোনের কোন প্রকার ক্ষতি হয়েছে বলেও মনে হলো না। ঘরের পরিবেশ রইল আগের মতোই নিস্তব্ধ, শীতল। হুট করে রেগে যাওয়ার স্বভাব আরফানের নেই। চোখের সামনে ভয়ানক কিছু ঘটে গেলেও রাগ হয় না আরফান। কিন্তু এখন রাগ লাগছে। নিজের উপর প্রচন্ড রাগে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে। বিকেলে মেয়েটির এহেন দুর্দশা দেখে সত্যিই খুব মায়া হচ্ছিল আরফানের। তাই ভেবেছিল, মেয়েটাকে একটু সাবধান করা যেতে পারে। কতই আর বয়স হবে মেয়েটার? বাইশ অথবা তেইশ। কিন্তু মেয়েটা তো ধানী লঙ্কা। সব সময় উলোট পালোট এক্সকিউজ লাগানোর চেষ্টা করে আরফানের গায়ে। আরফানের ভাবনার মাঝেই ম্যাসেজ টুন বাজল। নম্রতার ম্যাসেজ,

‘ আল্লাহ হাফেজ পরে বলুন। আগে আপনার বন্ধুর নাম্বারটা দিন। তাহলেই বুঝব আপনি স্টোরি ক্রিয়েট করছেন না-কি না।’

নম্রতার ম্যাসেজে আবারও মেজাজ চটে গেল আরফানের। স্টোরি ক্রিয়েট করছে মানে কী? এই মেয়ে তাকে ভাবেটা কী? আরফানের রাগের পারদ তরতর করে বাড়ছে। নম্রতার আইডিকে ইগনোরে রেখে দিয়ে গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাঁড়ল আরফান। মেয়েটাকে ব্লক করা যাবে না। আরফান যে রেগে আছে তা ওই উদ্ভট মেয়েকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। বোকারা হুটহাট রেগে যায়, আরফান কখনই বোকাদের দলে পড়ে না। ভবিষ্যতেও পড়বে না। আরফান ফোন রেখে ল্যাপটপটা কোলে তুলে নিল। কাজে মন বসছে না। মেজাজ খারাপ ভাবটা কিছুতেই কাটানো যাচ্ছে না। রাগ আর জেদগুলো দলা পাকিয়ে মস্তিষ্কে তীক্ষ্ণ ব্যথা তৈরী করছে। আরফান দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল, এই উদ্ভট, ঝামেলাপূর্ণ মেয়েটির সাথে কথা বলা তো দূর। তাকে নিয়ে একরত্তিও ভাববে না। বেশিরভাগ মানুষই ভাবনা আর কাজ দুটো গুলিয়ে ফেলে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু আরফান পারে। তার ভাবনা এবং কাজ একই গতিতে চলে। সুতরাং, নম্রতা নামক অতি অদ্ভুত মেয়েটির সাথে যে আরফানের ভবিষ্যৎ কালে কোনোরূপ কথা হবে না তাতে আরফান মোটামুটি নিশ্চিত, চিন্তহীন।

শহরে দিগন্ত নেই। ইট- পাথরে আঁটা বিল্ডিং-এর সারি গুলোকে দিগন্ত বলা যায় কি-না বুঝতে পারছে না নাদিম। নাদিমের হাতে গিটার। কপালে চিন্তার ভাঁজ। অন্যমনস্ক মনে গিটারের তারে উলোট পালোট সুর তুলে দিগন্ত বিষয়ক চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে সে। দুইদিন থেকে নতুন একটা টিউশনি জুটেছে তার। জেলা জাজের মেয়ে। বেতনের অঙ্ক বিরাট। মাসে দশ হাজার তো অবশ্যই। তারসাথে ভিন্ন ভিন্ন নাস্তার ব্যবস্থা। প্রথম সুযোগে টিউশনিটা লুফে নিলেও দুই দিনের মাথাতেই বিরক্ত ধরে গিয়েছে তার। কি-সব অদ্ভুত প্রশ্নে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে মেয়েটা। কাল হঠাৎ বলছে, ‘ফসলের মাঠ দিগন্ত বিস্তৃত হয়। দিগন্ত বিস্তৃত শহরের মাঠ হয় না? এই ধরুন পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠছে। ঢাকা শহরের বিরাট বিল্ডিং-এর পেছন থেকে সূর্য উঠলেও কী সেটা দিগন্ত বিস্তৃত? নাকি অন্যকিছু?’ প্রশ্নটা শুনে নাদিম কিছুটা থতমত খেয়ে গিয়েছে। সাংঘাতিক প্রশ্ন। বিষয়টা এভাবে ভেবে দেখেনি নাদিম। সাইকোলজির স্টুডেন্টদের দিগন্ত নিয়ে অত ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন হয় না। দিগন্ত বিস্তৃত খেলার মাঠ না পাটের ক্ষেত তা নিয়ে ভাবার কাজ বাংলা বিভাগের ছাত্রদের হলেও হতে পারে কিন্তু নাদিমের না। সে গিয়েছে ইংরেজি পড়াতে। ইংরেজি পড়িয়ে চলে আসবে। সেখানে দিগন্ত ফিগন্ত কোথা থেকে আসছে বোঝা যাচ্ছে না। নাদিমের শতভাগ ধারণা মেয়েটা ইচ্ছে করে নাদিমকে হেনস্তা করার চেষ্টা করছে। নাদিমকে বিব্রত হতে দেখে পুচকো মেয়েটা ভীষণ মজা পাচ্ছে। বড়লোকের মেয়েদের এই এক সমস্যা। এরা অন্যকে বিব্রত করে আলাদা একটা মজা পায় যা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা করে না। নাদিম ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। সাদা শার্ট পরে চা স্টলের সামনে এসে দাঁড়াল রঞ্জন। গরমে ফর্সা রং-টা টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। পাতলা ঠোঁটজোড়া কিশোরী মেয়েদের মতো হাতে আঁকা, সুন্দর। নাদিম অন্যমনস্ক চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। রঞ্জনের মতো এমন সুপুরুষ আজকাল চোখে পড়ে না বললেই চলে। রূপকথার রাজকুমারগুলো হয়ত রঞ্জনের মতোই হয়ে থাকবে। নাদিম হঠাৎ-ই হেসে উঠে বলল,

‘ শালা! তোরে মাঝে মাঝে মাইয়া মনে হয় আমার। তুই সত্যিই পোলা তো? প্রুভ দে তো। আই হ্যাভ বিরাট সন্দেহ। দেখা দেখা।’

রঞ্জনের সুন্দর ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। ভার্সিটিতে পা রাখতেই বন্ধুর এমন কথায় খানিকটা অপ্রস্তুত হলো। পরক্ষণেই রাগে লাল হয়ে বলল,

‘ একদম মুখ খারাপ করাবি না বলে দিলাম। সকাল সকাল মুখ খারাপ করতে চাই না।’

কথাটা বলে ডানপাশের ব্রেঞ্চটাতে আরাম করে বসল রঞ্জন। ঘন চুলগুলোতে হাত চালিয়ে বলল,

‘ মামা এক কাপ কড়া চা দাও তো। সঙ্গে দুইটা বিস্কুট। তুই নাস্তা করছিস?’

নাদিম গিটারে নিরন্তর বাজনা বাজিয়ে সুর তুলে বলল,

‘ পকেটে টাহা নাই মামা। ও মামা রে! পকেটে টাহা নাই আমার। ওওও মামা…. ‘

রঞ্জন হেসে ফেলল। আরেক কাপ চা দিতে বলে এদিক-ওদিক তাকাল। কপালে কুঁচকে বলল,

‘ অন্তু, নম্রতা ওরা সব কই? হারামিরা পড়তে পড়তে মরে যাচ্ছে নাকি?’

নাদিম পাত্তা না দিয়ে বলল,

‘ বাল পড়ছে। ও..’

নাদিমের কথা শেষ হওয়ার আগেই কোথা থেকে ছুটে এলো ছোঁয়া। গায়ে থাকা নীল ফতুয়া কাঁদায় মাখামাখি। এক পায়ে জুতো। অন্য পা খালি। ডানহাতে ব্যাগ আর বাম হাতে এক পাটি ছেঁড়া জুতো। মোটা ফ্রেমের চশমাটা নেমে এসেছে নাকের ডগায়। ছোঁয়ার এমন অবস্থায় খনিকের জন্য কথা বলতে ভুলে গেল নাদিম, রঞ্জন। হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইল। ছোঁয়া হাঁটুতে ভর করে হাঁপাচ্ছে। রঞ্জন বিস্ফারিত চোখে চেয়ে প্রশ্ন করল,

‘ এ-কি হাল তোর! এই অবস্থা কেন?’

ছোঁয়া জোরে জোরে শ্বাস ফেলে কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেই চোখে-মুখ কুঁচকে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠল নাদিম,

‘ এই তুই ক্যাডায়? যা ভাগ। ইশ কি বিশ্রী! আমার তো ঘেন্না পাচ্ছে।’

শেষ কথাটা অনেকটা ছোঁয়াকে নকল করে বলল নাদিম। ছোঁয়া টলমলে চোখে একরাশ ক্রোধ নিয়ে তাকাল নাদিমের মুখে। নাদিমের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। এর মধ্যেই রাস্তা-ঘাট উড়িয়ে বাইক নিয়ে এসে পৌঁছাল অন্তু। বাইরা পার্ক করেই হতবিহ্বল কন্ঠে বলল,

‘ এই বিশ্রী মহিলাটা কে?’

কথাটা বলেই মুখ টিপে হাসল অন্তু। তার সাথে হাসি ফুটলো বাকি দু’জোড়া ঠোঁটেও। ছোঁয়ার রাগ যেন এবার আকাশ ছুঁলো। মুখ ফুলিয়ে কাঠের বেঞ্চিতে বসতেই লাফিয়ে উঠল নাদিম,

‘ ওই! তুই আমার লগে বসবি না। তুই একটা এলার্জি। আমি কোনোরূপ এলার্জির পাশে বইতে চাই না। উঠ তুই। উঠ শালী।’

ছোঁয়ার চোখ-মুখ দেখে মনে হলো সে যেকোনো সময় ভ্যা করে কেঁদে দিবে। তার এমনিতেই মন খারাপ তারওপর বন্ধুদের ব্যবহারে সে মোটামুটি বিক্ষিপ্ত। তার এখন কেঁদেকেটে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। দুই তিন মিনিটের মাথায় নীরা আর নম্রতায় যুক্ত হলো আড্ডায়। ছোঁয়াকে নিয়ে একটু আধটু চোখ টিপাটিপি করার পর ভীষণ গম্ভীর আর সিরিয়াস হয়ে কাহিনী জানতে চাইল। ছোঁয়া কাঁদো কাঁদো কন্ঠে যতটুকু বলল তার অর্থ এই, শাহাবাগের বিশাল জ্যামে আটকে পড়েছিল তার বিশাল বাপের বিশাল পাজেরো গাড়ি। সেই গাড়িতে টানা এক ঘন্টা বসে থাকার পর ছোঁয়ার মনে হলো সে হেঁটে হেঁটে ভার্সিটি অব্দি আসতে পারবে। এটা আহামরি কঠিন কোনো কাজ নয়। তাছাড়া, একঘেয়েমী জীবনে খানিকটা এডভেঞ্চার হলেও মন্দ হয় না। ভাবনা মতে গাড়ি থেকে নামল ঠিক কিন্তু কিছুক্ষণ চলার পরই বাঁধল এক বিপত্তি। রাস্তার পাশে বাচ্চা কোলে নিয়ে হেঁটে আসছিল এল পাগলী। তার বক্ষদেশ উন্মুক্ত। বাচ্চাটি তার ক্ষুধা নিবারণে ব্যস্ত। জনবহুল একটা জায়গায় এমন বিদঘুটে দৃশ্য দেখে চোখ-মুখ কুঁচকে এসেছিল ছোঁয়ার। খানিকটা ঘৃণাভরে তাকিয়েছিল মাত্র। তাতেই ক্ষেপে গেল পাগলী। বাচ্চা কোলে রেখেই রাস্তার পাশ থেকে একটা ইট তুলে ধেয়ে এলো ছোঁয়ার পিছু। চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘ তুই তাকাইলি ক্যান। খাঁড়া ছেমড়ি, খাঁড়া।’ সেইসাথে মা-বাপ তুলে অকথ্য গালি। যার বেশিরভাগের অর্থই ছোঁয়ার অজানা। পাগলীকে ধেঁয়ে আসতে দেখে প্রথমে হাঁটার গতি বাড়িয়ে তারপর দিগবিদিক শূন্য হয়ে দৌঁড়ে পালিয়েছে ছোঁয়া। সেই দৌড়াদৌড়িতেই এই কাঁদা মাখামাখি আর জুতো ছেঁড়া। ছোঁয়ার গোটা কাহিনী শুনে সবাই কিছুক্ষণ চোখ-মুখ গম্ভীর করে বসে রইল। তারপর হঠাৎ-ই হুহা করে হেসে উঠল সবাই। নাদিমের হাসির বহর দেখে মনে হচ্ছে, সে পারলে মাটিতে গড়াগড়ি করে হাসে। নীরা হাসতে হাসতে কেঁদেই ফেলল। ছোঁয়া শুধু বোকার মতো তাকিয়ে রইল। তার আবারও কান্না পাচ্ছে। যেনতেন কান্না নয়। কান্না করতে করতে পৃথিবী ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। হাসাহাসি শেষ করে ছোঁয়াকে রিক্সায় তুলে বাসায় পাঠিয়ে দিল রঞ্জন। রিকশাওয়ালাকে সাবধানে চালাতে বলে নম্রতার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘ তোর প্রেম কাহিনীর কি খবর জানেমান?’

নম্রতা হেসে ফেলে বলল,

‘ কুত্তা! আবার জানেমান বললে মাইর খাবি।’

পরমুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ আমার প্রেমকাহিনী ঘন কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে আছে। সব কাহিনি নিষাদ সাহেবের কাছে গিয়ে জট পাকাচ্ছে। নিষাদ সাহেবের সাথে আমার কথা হওয়াটা খুবই জরুরি দোস্ত। কিন্তু ওই ডাক্তার তার নাম্বারটা দিচ্ছেই না। বেয়াদব ডাক্তার।’

রঞ্জন গম্ভীর মুখে বেঞ্চিটিতে বসল। কপালের ভাঁজ গাঢ় হলো। অন্তু প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘ কেন! কি বলে ব্যাটায়? নাম্বার দিতে টাকা চায়?’

‘ ধূর! টাকা চাইবে কেন? টাকা চাইলে তো হতোই। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। ব্যাটার সাথে আমার যখনই কথা হয় তখনই কোনো না কোনো একটা ঝামেলা লেগে যায়। এখন তো ম্যাসেজের রিপ্লাই-ই দিচ্ছে না। কিছু একটা কর দোস্ত।’

নাদিম এতোক্ষণ গিটারটা বুকের উপর রেখে বেঞ্চে লম্বালম্বিভাবে শুয়ে ছিল। নম্রতার কথায় উঠে বসল। দুর্বোধ্য হেসে বলল,

‘ রিপ্লাই কি রে? শুধু রিপ্লাই নয় ব্যাটা আরও অনেক কিছু দিবে। জাস্ট অপেক্ষা বন্ধু। অপেক্ষা।’

নাদিমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো চার জোড়া প্রশ্নবিদ্ধ চোখ।

#চলবে….

[ বিঃদ্রঃ কিছু সমস্যা আর ব্যস্ততায় জড়িয়ে পড়েছিলাম বলে এই দীর্ঘ অবসরের পর আমার গল্প দেওয়া। যদিও গ্রুপের সদস্যরা জানত কিন্তু পেইজে জানানো হয়নি বলে আমি দুঃখিত। এখন থেকে নিয়মিত গল্প দেওয়ার চেষ্টা করব, ইন-শা-আল্লাহ। আজকে আরও তাড়াতাড়ি দিতাম গল্পটা কিন্তু কিছু টেকনিক্যাল কারণে পেরে উঠিনি। সেজন্যও আমি দুঃখিত। এতোদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ এবং ভালোবাসা ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here