#নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা
||৮ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নিবেদিতা ও মালিহা সহ আরও কয়েকজন এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে। আবরাহাম বাহিরে গিয়েছে যাত্রার ব্যবস্থা করতে।
নিবেদিতাকে একটু ফাঁকা স্থানে টেনে নিয়ে মালিহা বলে,
“দোস্ত, আমার কী মনে হয় জানিস? আবরাহাম স্যার না তোকে ভালোবাসে বা পছন্দ করে।”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় নিবেদিতা। তারপর খিলখিলিয়ে হেসে দেয়।
“মজা করছিস তাই না? কোথায় স্যারের মতোন বড়োলোক শিক্ষিত হ্যান্ডসাম হাঙ্ক, কোথায় আমি সামান্য গরীবের খেটে খাওয়া কাজকন্যা।”
“না, নিবেদিতা। আ’ম নট কিডিং। যেভাবে উনি তোর দিকে তাকায়, তোর মন ভালো করার চেষ্টা করে, কথা বলে আমি জানি না আসলে… তবুও আমার মনে হয় তার কোনো না কোনো অনুভূতি তো আছেই তোকে নিয়ে।”
একটু গম্ভীর হয় রমণীর মুখশ্রী। শ্যামা কপালে ভাজ পড়ে।
“এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। উনার কাছে প্রতিটা কর্মচারীর পার্সোনাল ডিটেইলস্ আছে, সে জানে আমি ম্যারিড। উনার মতোন সুপুরুষ কখনোই আমার মতো বিবাহিত, সাধারণ, এভারেজ লুকিং মেয়ের দিকে হাত বাড়াবে না।”
“তাহলে তোর জন্যই কেন স্যান্ডউইচ আর চিরকুট পাঠালো? আরও তো এমপ্লয়িরা ছিল।”
“কারণ আমি কাঁদছি অন্যকেউ না, আর উনি খুব যত্নশীল আর ফ্রেন্ডলি একজন মানুষ। আরাধ্যের মতোন উদাসীন, রূঢ়ভাষী না।”
“কিন্তু…”
“এই বিষয়ে আমি কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না মালিহা। এমনিতেই শত চিন্তা মাথায়, আর চাচ্ছি না। আর আমার সাথে আবরাহাম সাহেবের কোনো দিক দিয়েই যায় না, তুই নিজেই আমাদের দুজনের চেহারা মিলিয়ে দেখ।”
মালিহার এ চিন্তা বাধাপ্রাপ্ত। সে নিজেও অনুধাবন তার ভাবনা প্রকৃতপক্ষেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ, অমানানসই।
এর মাঝেই আবরাহাম ফিরে আসে সবাইকে নিতে। যাত্রা শুরু হয়, গন্তব্য হোটেল। যাত্রার পুরোটা সময় যুবক আড়চোখে নিবেদিতাকে পর্যবেক্ষণ করেই যায়।
___
সুখকে জোর করে আয়নার সম্মুখে বসান মিথিলা আজমেরি। বিয়ে নামক বিজনেস ডিলের জন্য তৈরি করতে হবে যে। বাহিরে বরপক্ষ অপেক্ষারত।
পাত্র অনেক বড়লোক, মা-বাপ ও প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছে পাঁচ বছর। বয়স একটু বেশি, কিন্তু এই ঝামেলাহীন পরিবারে বিয়ে হলে তারা ও মেয়ে উভয়ই টাকার বিছানায় ঘুমাবে। একদমই পছন্দ না হলে বাহিরে তো ফুর্তি কত করাই যায়!
“কান্নাকাটি কোরো না মাই ডল। ছেলে অনেক রিচ, যা চাবে তা-ই পাবে। টাকা থাকলে যাকে তাকে বিছানায় পেতেও অসুবিধা নেই, বুঝলে?”
ভারী সোনার হারটা গলায় পরাতে পরাতে সান্ত্বনা দেওয়ার প্রচেষ্টা মিথিলা আজমেরির।
ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসে সুখের। কোনো নারী কতটা খারাপ বা কুৎসিত মনা হলে নিজের কন্যাকে এতটা অশ্লীল ও বাজে কথা বলতে পারে?
মনে মনে ভাবে,
-আজ যা হবে, তা উচিতই হবে। যাদের নিজেদেরই মান-সম্মান বোধ নেই, তাদের সে অসম্মান করলেই বা কী আসে যায়?
দুঃখ ও প্রতিশোধ মাখা বাঁকা হাসি দেয় সে।
একটু পরেই রুমের বাহির থেকে শোরগোল শোনা যায়। সুখের মা কী হয়েছে দেখতে বের হন, বের হয় সুখ নিজেও।
পুলিশদের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলে সে। সুখের প্রিয় বান্ধুবীর বাবা এস.আই। বহু কষ্ট তাকে টেক্সট করে বিষয়টি জানিয়ে সাহায্য চেয়েছিল সে।
চোখের সম্মুখে সব স্পষ্ট থাকায় পুলিশরা খুব বেশি কথা ব্যয় করে না। মিথিলা আজমেরি সহ বরপক্ষকে জিপে করে নিয়ে যায়।
মনিশা সরদার পুলিশের জিপে আসামী রূপে সবাইকে যেতে দেখে ক্ষুব্ধ হন। খুব চতুরতার সহিত সুখকে আবরাহামের জীবন থেকে বের হওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি।
কিন্তু আফসোস প্ল্যানটা পুরোপুরিই ভেস্তে গেল। হ্যাঁ, তিনিই এমন আধবুড়ো বড়লোক পাত্রের খোঁজ দিয়েছিলেন। জানতেন সুখের লোভী পরিবার এই ফাঁদে পা দিবেনই।
এদিকে বউয়ের সাজে, লাল শাড়ি পরে বিয়ার পান করতে করতে জিপটাকে চলে যেতে দেখছে।
“গুড বাই মাই ডিয়ার বিচ!”
___
সকল এমপ্লয়ি আবরাহাম তাদের সাথে বিচে যাওয়ার জেরা করছে আবরাহামকে। ব্যবসায়িক কারণে এসে ঘোরাঘুরি বা ফুর্তি করার মোটেও ইচ্ছে ছিল না আবরাহামের। কিন্তু সবার জোরাজুরিতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাদের সাথে গেল সে।
বিচে পৌঁছাতেই সবাই যার যার মতোন সমুদ্রের নোনাজলে পানি ছোটাছুটি ও আনন্দ করতে নেমে পড়লো, মালিহা নিজেও। একা বিচের সম্মুখে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু নিবেদিতা ও আবরাহামই।
“আগে এসেছো এখানে?”
পাশে তাকায় নিবেদিতা। উদাসীন ভাবে আমার মানব ভিড়ে পরিপূর্ণ বিশাল সমুদ্রটির দিকে তাকায়।
“না, নিম্নবিত্ত ফ্যামিলির মেয়ে। এসব জায়গায় টাকা ঘুরতে এসে টাকা খরচ করা আমাদর মতো পরিবারের সন্তানদের কাছে বিলাসিতা বৈকী কিছুই নয়।”
আবরাহাম ঘোলাটে বিকেলের ঝাপসা আলোয় দেখতে পায় এক ভাবুক ও বিষণ্ণ নারীকে। যার চাপা কষ্ট তো তাকে স্পর্শ করে, কিন্তু অনুভব বাদে কষ্ট অনুধাবণ করার ক্ষমতা তার নেই।
“ব্যাপারগুলো আপনার কাছে খুব বেশি জটিল লাগছে, তাই না? আসলে সুখের মাঝে বড় হয়েছেন আপনি আবরাহাম, গরীবদের অর্থের কষ্ট কি আর আপনি বুঝবেন?”
গোপণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবরাহাম।
“টাকা ছিল, সুখ বা শান্তি। মমি একজন আমেরিকান হিপহপ ডান্সার, বাপিকে তো চিনেনই, নামকরা বাংলাদেশী ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে। আমেরিকায় পড়তে গেলে মায়ের সাথে পরিচয় হয়, বিয়ে করে।
আমি হওয়ার পর দেশে যায়। দাদু-দাদীজানের একটুও পছন্দ হয় না মমিকে, তবে আমার দিকে তাকিয়ে প্রথমে খোশামোদি করলেপ পরে মেনে নেয়। কিন্তু মমির নাচগান করাটাতে বাধা দেন। বাড়ির বউদের বাজারের নর্তকীদের মতোন নাচ কোন পরিবারেরই সহ্য করার ছিল না।
মমি ও বাপির মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি শুরু হয় ব্যাপারটি নিয়ে। প্রতিনিয়ত মমি আর বাপির ঝগড়া, মনোমালিন্য শোনার মাঝে বড় হচ্ছিলাম আমি। এর মাঝেই বাপির বিজনেস পার্টনারের সাথে মমির ভিডিও ক্লিপ… বাপির বিশ্বস্ত কেউ সতর্ক করতে দিয়েছিল। সেপারেট হয়ে যায় তারা, আমি নিজ চয়নে থেকে যাই বাপির কাছে।
আমার দাদীজান দু’চোখে বালি ছিলেনই মমি, এরপর আরও দেখতে পারতেন না। কারণ বাপি আর বিয়ে করেননি অনেক বলার পরও, মমি তো ডিভোর্সের পরপরই বিয়ে করে। মমি চলে যাওয়ার পর তাকে আমার সামনেই খুব বাজে বাজে ভাষায় গালাগাল করতো, বাজে বাজে কতো কিছু বলতো।
যতোই হোক শি ওয়াজ মমি। আমার লাগতো, কিন্তু সাপোর্ট করার একটা জায়গাও রাখেননি তিনি। জাস্ট বিকজ আমি সবসময় হাসিখুশি, এর মানে এই নয় যে আমি অক্ষত, দুঃখ ছাড়া সুখী মানব।”
কথাগুলো বলেই অস্বস্তিপূর্ণ চেহারা নিয়ে আবরাহাম চলে যায় হোটেলের দিকে।
নিবেদিতা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে। এই যুবককে দেখে মনেই হয় না তার ছেলেবেলা এতটা কুৎসিত ছিল। আসলেই অর্থ থাকলেই সুখ মিলে না।
___
রাত্রিবেলা, সবাই ডিনার করতে জড়ো হয়েছে। নিবেদিতা গাঢ় কালচে বেগুনি রঙের গাউন আর হিজাব পরেছে। অন্যরকম মায়াবী লাগছে রমণীকে। আবরাহাম আজ ভেবেই ফেলেছে সে নিবেদিতাকে ডেটে নেওয়ার জন্য প্রস্তাব রাখবে। নিজের এই জীবনকালের লাভলাইফের উপর কনফিডেন্স তার, মেয়েটা রিজেক্ট করবে না।
তবে নিবেদিতা সে আরাধ্যের দেওয়া কষ্টের ভাবনায় ডুবে। যতো যা-ই হোক আরাধ্য নামক মানুষটির মাঝে পুরোপুরি নিমজ্জিত সে। তবে আবরাহাম আত্মবিশ্বাস ভেঙে কি প্রত্যাখ্যান পেতে চলেছে? না কি অভিমানে হাত বাড়াবে অবৈধ এক পথে?
চলবে…