Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ২
————————————————
রুটিন বাধা নিয়মে জীবন চলতে লাগল। ক্লাস শেষে বিকেলে আই ইএল টিএসের কোর্স করছি। এই কোর্সের কারনে মাঝে মাঝে হোস্টেলে ফিরতে দেরী হচ্ছে। আবারো বকা খাচ্ছি। আবার এরই মাঝে আমি আমার স্বপ্নের জাল বুনছি। কিন্তু বাধ সাধলেন আমার আব্বা। শেষ পরিক্ষার দিন তিনি এসে গেলেন আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। টু শব্দও করতে পারি নি। চুপচাপ তল্পি তল্পা গুছিয়ে চলে এসেছি গ্রামের বাড়িতে। মাকে জানালাম সব কথা। আর আব্বা বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনেক কেঁদে কেটে আব্বা কে রাজি করালাম কয়েকটা মাসের জন্য। যাতে রেজাল্ট টা দেখি। বাবা মানলেন। তবে এর বেশি দেরী করা যাবে না। মাথা নাড়লাম আমি। জি অবশ্যই।
দিন গড়িয়ে মাস যায়। এবার শুধু মাত্র রেজাল্টের অপেক্ষা।
পরীক্ষার বেশ কয়েক মাস পর আমার রেজাল্ট বেরুলো। আমি জি পি এ ফাইব পেয়েছি। আর আমার পাশের খবরে আম্মা পুরো গ্রাম কে মিষ্টি খাওয়ালেন। রেজাল্টের রাতে আরো একটা খুশির সংবাদ সাথে নিয়ে এলো আমার ছোট মামা। আর তা হল কানাডার ভিসা! একসাথে দুটো খুশি পাওয়ায় আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম। সাথে সাথে প্রফেসার হুড কে মেইল করে রেজাল্ট এবং ভিসার কথা কথা জানালাম। তিনি আমাকে অভিনন্দন জানালেন সাথে এও জানালেন যে আমার মত একজন স্টুডেন্ট পেলে তিনিও খুব খুশি হবেন। শুনে গর্বে আমার বুক ভরে গেল। মাকেও জানালাম। মাও খুশি হল।
এরই মধ্যে প্রফেসর হুড কয়েকবার মেইল করেছেন। আমার কাগজ পত্র, আর ভিসার কপি পাঠানোর জন্য। আমি পাঠালাম। কয়েকদিন বাদে আমার হবু শ্বশুড় শ্বাশুড়ি রা আসলেন আমাকে দেখতে। আমার সেদিন খুব কান্না পাচ্ছিল। জানি না কেন। গৃহস্থ পরিবার তারা। আমাদের মতই জমি জমা প্রভাব প্রতিপত্তি সব আছে। তাই বাবার এত পছন্দ।
তারা আমাকে আংটি পড়িয়ে চলে গেলেন। আর বলে গেলেন বিয়ের তারিখ দ্রুত পাকা করতে। শুভ কাজে তারা নাকি দেরী করতে চান না।
ঠিক তাই। শুভ কাজে দেরী করতে নেই। আর আমিও সেই শুভ কাজের খোজ নিতে লাগলাম কখন আমার স্কলারশিপ এর রেজাল্ট দেবে?
.
দিনের পর দিন যায় আর মাসের পর মাস। এরই মধ্যে ছোট মামা কে নিয়ে স্কলারশিপের শেষ প্রস্তুতি হিসেবে শহর থেকে ঘুরে এলাম। আমার হবু স্বামী কয়েকবার আমার সাথে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা চালায়। আমি যে কোনো অজুহাতে কল এড়িয়ে গেলেও হঠাৎ একদিন না দেখেই কল ধরে ফেললাম। ধরেই যখন ফেলেছি তখন না চেনার ভান করলাম।
“আসসালামু আলাইকুম তাহমিনা। কেমন আছো?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে বলছেন?”
“আমি জাওয়াদ। কাজী জাওয়াদ।”
“কোন জাওয়াদ?”
“তোমার হবু স্বামী।”
“ওহ!”
“চিনতে পেরেছো?”
“জি”
“যাক বাচঁলাম।”
“হুম।”
“আমি কি জানতে পারি কি জন্য তুমি আমার ফোন ধরছো না?”
“জি! আমার কিছু কাজ আছে। যদি সমস্যা না হয় ফোন রাখতে চাই।”
“একটু দাড়াও তাহমিনা। আমি জানি এরপর চাইলেও তুমি আমার ফোন ধরবেনা। তাই আমার কথা শোন।”
“জি।”
“তাহমিনা আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি। সেই ছোট বেলা থেকে। তুমি কি আমাকে পছন্দ কর? মানে বিয়েতে কি তুমি রাজি?”
আমি নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। কি জবাব দিব বুঝতে পারছিনা।
“কি হল কিছু বলছো না যে। অসুবিধে নেই। তুমি বলতে পারো। আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না। তুমি কি কাউকে ভালোবাসো?”
“না।”
“তাহলে সমস্যা কোথায়?”
“না মানে আ-আমি এখনি বি-বিয়ে…”
“আমি বুঝতে পেরেছি তাহমিনা। কোনো সমস্যা নেই। সব আমি দেখবো।”
এই বলে জাওয়াদ ফোন রেখে দিলো। আর আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক বাবা অন্তত বিয়ে তো আটকানো গেলো।
জাওয়াদ আমার ছোট বেলার বন্ধু। একসাথে খেলা ধুলা করেছি অনেক। একই গ্রামের হওয়ার সুবাদে পুরো পরিবারের আমাদের এখানে আসা যাওয়া ছিল। আর ঘনিষ্টতা ঠিক এভাবেই। দেখতে জাওয়াদ খারাপ না। উজ্জল শ্যামলা রংয়ের এই ছেলেটি কে হ্যান্ডসাম উপাধি দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। আর যদি কোট টাই দিয়ে ভালো ভাবে পালিশ করলে হিরোদের কাছাকাছি অবস্থানে ও নিয়ে আসা যাবে। খুবই লাজুক আর ভদ্র ছেলে। পড়ালেখা এস এস সি পর্যন্ত হলেও ইতিমধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য করে যথেষ্ট পয়সা কড়ি যথেষ্ট কামিয়েছে। গ্রামের সব মেয়েদের শকুনের নজর তার উপর। একেতো পয়সা ওয়ালা তার উপর কাজী বাড়ির ছেলে।
তার নজর পুরো গ্রাম ফেলে আমার উপরেই পড়তে হল? থাক! অন্তত বন্ধুত্বের সুবাদে জাওয়াদ কাউকে কিছু না বলে বিয়ে আটকে দেবে। ভাবতেই মনে মনে খুশি হয়ে গেলাম।
হুট করেই একদিন প্রফেসার হুডের মেইল পেলাম। সে জানালো আমার প্রাপ্তির কথা। আম্মা আর ছোট মামা কে জানালাম। আহা! কি স্বপ্নের দিন! এখন শুধু অপেক্ষার পালা। কখন নির্ধারিত তারিখ টা আসবে।
আরামে দিন কাটতে লাগলো। এরই মধ্যে আব্বাকে দুশ্চিন্তা গ্রস্ত দেখলাম। মনে হল বিয়ে সংক্রান্ত কোনো ঝামেলায় পড়েছেন। তার মানে সত্যিই আমার বিয়ে ভেঙে গেছে। খুশিতে আমার লুঙ্গি ড্যান্স দিতে ইচ্ছে হয়েছিল।
তবে খুশি বেশিদিন ঠিকলো না। কারন পরদিনই দেখলাম আমার হবু শ্বশুড়, হবু মামা শ্বশুড়, আব্বা, বড় মামা, চাচা জান এবং আরো কয়েক জন গোল মিটিংয়ে বসলেন। আম্মা কে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে তা জানার জন্য। আম্মা কিছু জানেন না বলে জানালেন।
সন্দেহে আমার বুক দুরু দুরু করতে লাগলো। অবশেষে আমার সন্দেহ কে সত্যি করে আব্বা সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালেন এ বলে যে আগামী শুক্রবারে তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে।
শুনে আমি আধা ঘন্টার মত বিছানায় মুর্তির মত বসে রইলাম। হাসবো নাকি কাঁদবো বুঝতে পারছিনা। বৃহস্পতিবার আমার ফ্লাইট। ওই দিন যেতে না পারলে এই বিয়ের গ্যাঁড়াকলে ওই কাজী বাড়িতে আমি চিরদিনের জন্য আটকে যাবো। জানি না কি করা উচিত।
আম্মা কে বললাম। আম্মা আমাকে চিন্তা করতে মানা করছিলেন। শুধু বলছিলেন
“তাহমিনা এই তোমার আম্মা বেঁচে থাকতে তুমি এত চিন্তা কেন করছো”
আম্মার কথায় মুর্তির মত তাকিয়ে রইলাম। তারপর উনার কথায় আশ্বস্থ হলাম বটে তবে চিন্তা মুক্ত না।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বাড়ি তে সাজ সাজ রব শুরু হয়ে গেল। আর আমি ঢোক গিলতে গিলতে শুধু চারপাশ টা দেখছিলাম। আম্মা হাসি মুখেই মেহমান দের আপ্যায়ন করছিলেন। দেখে মনে হচ্ছে উনি এ বিয়েতে সব চেয়ে বেশি খুশি।
এদিকে প্রফেসার হুড খবর পাঠালেন যে ঠিক সময় যেন এয়ারপোর্টে নামি। আমার জন্য উনি অপেক্ষা করবেন। কাল যে আমার বিয়ে সে কথা আমি উনাকে জানাই নি। জেনে কি ভাববে আল্লায় জানে। দুপুরের পরে মেহেদির তত্ত্ব আসলে সবাই আমাকে হুড়োহুড়ি করে গোসল করাতে নিয়ে গেল।
আমি তখন করুন চোখে আম্মার দিকে তাকালাম। আম্মার দৃষ্টি তখনো খুব শক্ত ছিলো। সে শক্ত দৃষ্টির চাপে আমার চোখের পানি বিয়ের গোসলের পানির সাথে একাকার হয়ে গেল।
.
(চলবে)