Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ২১
———————————————–
আমি নায়াগ্রা ফলস দেখতে এসেছি। কানাডা আসছি আর নায়াগ্রা ফলস দেখবোনা তা কি করে হয়। কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না কেন? এত বড় একটা জলপ্রপাত অথচ একজন পর্যটকও নেই। আশ্চর্য্য!
নিচে ফাটলে জল পড়ার একটানা শব্দটা কানে এল। অন্য কিছু পাত্তা না দিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম জলপ্রপাতটা দেখতে। ভোরের সূর্য টা সবে মাত্র উঁকি দিতে শুরু করেছে। তবে জলপ্রপাতের পানির বিন্দু বিন্দু কনা গুলো কৃত্রিম কুয়াশার সৃষ্টি করেছে। সূর্যের সোনালী আলোর ছিটকে পড়তেই সেখানে কয়েকটা রং একসাথে খেলে গেল। যেন বর্ষার শেষের আকাশে উদিত রংধনু।
আমি নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে যাচ্ছি। স্রষ্টার সৃষ্টি এত টা অকৃত্রিম হতে পারে তা কখনো কল্পনা করিনি। সামনে এগিয়ে যেতেই আছি। উন্মুক্ত পরিবেশে ঝিরিঝিরি বিশুদ্ধ হাওয়া বইছে।
.
যেতে যেতে একদম কিনারায় দাড়ালাম। আশ্চর্য্য! এখানে তো এমন খোলা ছিল না। অন্তত টিভিতে এমন দেখি নি আমি।
বাস্তবে তো বেশ ভয়ঙ্কর জায়গা। পা হের ফের হলেই সোজা আল্লাহর কাছে।
.
আমি আরো এগিয়ে যাচ্ছি। যেন সৌন্দর্য্য টা আমাকে চুম্বকের মতো টানছে। আর আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছিনা।
যেতে যেতে কিনারার খাড়া স্থানটিতে দাড়ালাম। আর এক পা ফেললে নির্ঘাত এ ভয়ঙ্কর সুন্দরীর ফাটলে হারিয়ে যাবো। কিন্তু! একি! আ-আমার পা টা কোথায় যেতে চাচ্ছে! আমি থামাতে পারছিনা কেন? অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু পা টা সেই অদৃশ্য চুম্বকের টানে পদক্ষেপ ফেলল। আর সাথে সাথেই আমার শরীর হালকা হয়ে এলো। ধপাস করে নিচে পড়ে গেলাম। ইয়া আল্লাহ! এত ব্যাথা! উঠে বসে হাতের কনুই টা ডলতে লাগলাম। ভীষণ ব্যাথা পেয়েছি। চোখটা টেনে খুলতে পারছিনা। নায়াগ্রা তলদেশে কি আমি পৌঁছে গেছি? এত ছোট তলদেশ টা!
.
মনে মনে এত কিছু ভাবছি আর জবাবে কারো খিক খিক শব্দ শুনতে পেলাম। নায়াগ্রা তলদেশে কি ভুত প্রেত আছে? তাহলে আমার সামনে কি ভুত বসে আছে? ঝট করে চোখ খুলে ফেললাম। খুলতেই দেখলাম একটা ছেলে আমার সামনে বসে হেসে গড়া গড়ি খাচ্ছে। আশ্চর্য্য! কে এই ছেলে? সে কি করে এল নায়াগ্রার তলদেশে? নায়াগ্রার তলদেশ!! চারদিকে ভালো করে তাকালাম। ভুল দেখছি মনে করে আবার চোখ কচলে ভালো করে তাকালাম। এটা কোথায় আমি? আর ছেলেটাই বা কে? হুট করে মনে পড়লো আমি এখন লিওর বাসায়। গতকাল রাতে এখানে সোফাতে শুয়েছিলাম। সামনের ছেলেটার দিকে তাকালাম। সে হাসি থামিয়ে অদ্ভুদ দৃষ্টিতে দেখছে। অতিরিক্ত হাসার কারনে চোখে পানি চলে এসেছে। গায়ে হালকা নীল শার্ট আর ত্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরিহিত। মাথা চুলকাতে চুলকাতে চারদিকে তাকালাম। রিচা এখনো উল্টে পড়ে আছে। মুখ থেকে খানিকটা লালা গড়িয়ে পড়ছে। কয়েকজন সোফায় গড়া গড়ি করে শুয়ে আছে। আরেক জন কে দেখলাম ফ্লোরে শুয়ে আছে উদ্ভট ভাবে।
“হেই আই এ্যাম রিচার্ড!
আমি আবার নজর ফিরিয়ে ছেলেটির দিকে তাকালাম। হাসিমুখে আমার দিকে হাত বাড়িয়েছে। মুখে হাসি টেনে হাত বাড়াতে গিয়েও অটোমেটিক ভাবে আমার হাত মাথায় চলে গেল। ইশশ! খোঁপা টা কখন খুলে গেছে আল্লায় জানে। তাড়াতাড়ি অবিন্যস্ত চুল গুলো দ্রুত হাতে খোঁপা করে নিলাম। রিচার্ড ছেলেটি এখনো হা করে তাকিয়ে আছে। একটু ইতস্তত করে বললাম
“উমম স্যরি!”
“নেবার মাইন্ড!”
“আই এ্যাম তাহমিনা!”
“টামিনাহ! নাইস নেইম!”
“থ্যাংকস!”
ছেলেটি এখনো বসে আছে। আমি কি করে উঠি? এতটা আনকম্পরটেবল আগে কখনো বোধ করি নি। আবারো মুখে হাসি টেনে বললাম
“এক্সকিউজ মি। আ-আমি একটু আসি।”
এই বলে উঠে যাচ্ছিলাম। কিন্তু রিচার্ড আবারো আমাকে থামিয়ে দিল
“ওয়েট টামিনা!”
আমাকে থামতে বলে ফ্লোর থেকে কিছু একটা কুড়িয়ে নিল। তারপর আমাকে দেখিয়ে বলল
“আমার মনে হয় এটা তোমার!”
তাকিয়ে দেখলাম আমার হাতের পাথরের ব্রেসলেট টা। ঘুমের ঘোরে হয়ত খুলে পরে গিয়েছে।
“হ্যাঁ এ-এটা আমার!”
এই বলে নেওয়ার জন্য আবারো হাত বাড়ালাম। কিন্তু আমি হাত বাড়াতেই রির্চাড ব্রেসলেট টা সরিয়ে ফেলল। চোখে মুখে শয়তানি মনোভাব ফুটে উঠেছে। আমি ভ্রু কুচকে ফেললাম।
“উহু এভাবে না।”
“তো”
“হাত দাও!”
কিছু বুঝলাম না। একটু ইতস্তত করে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। রির্চাড আমাকে ব্রেসলেট টা পড়িয়ে দেবে অমনি কেউ একজন খপ করে তার হাতটা ধরে ফেলল। আমি একটু চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখলাম লিও! ঘুম জড়ানো শরীরে উঠে এসেছে। ঘুমের ঘোরে চোখটাও নিবু নিবু। পা গুলো কিছুটা টল মল। মাথার চুল উসকো খুসকো। ব্লেজার, শার্ট কোথায় উড়ে গেছে আল্লায় জানে। উদোম ফর্সা গায়ে শুধুই হাফ প্যান্ট পরিহিত। পেটানো চওড়া শরীরে গলায় শুধু লকেট টা ঝুলছে। এর আগে কখনো লিও কে আমি খালি গায়ে দেখি নি। লিওর চোখের দিকে তাকাতেই বুকের মধ্যে নিজের হৃদপিন্ডের ধুক পুক শব্দ শুনতে পেলাম। দ্রুত আমার অশুভ দৃষ্টিটা আমি সরিয়ে নিলাম।
লিও রিচার্ডের হাত থেকে ব্রেসলেট টা কেড়ে নিলো। রিচার্ড শুধু হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমার মত সেও কিছুই বুঝতে পারছেনা। ব্রেসলেট টা কেড়ে নিয়ে ওটা কিছুক্ষন দেখলো। তারপর আমার দিকে তাকালো।
ওর দৃষ্টি দেখে আমি শুধু একটা ঢোক গিললাম। তারপর শুকনো গলায় বললাম
“গুড মর্ণিং লিও!”
লিও জবাব না দিয়ে একটু নিচু হয়ে আমার বাহু ধরে বসা থেকে টেনে তুলে ফেলল। হঠাৎ টেনে তোলায় আমি একটু চমকে উঠলাম। সেই সাথে শিরায় টান পড়ায় একটু ব্যাথাও পেলাম।
আমার সাথে সাথে রিচার্ড ও উঠে দাড়িয়েছে। পরিবেশ টা স্বাভাবিক করার জন্য সে হাসি মুখে বলে উঠলো
“হেই ব্রো! হ্যাপি বার্থ ডে টু ইয়ু!”
রিচার্ডের উইশ শোনার পরও তার চোখে কোনো ভাবান্তর নেই। সেই ব্রেসলেট টির হুক খুলে আমার বাম হাত টেনে ধরলো। তারপর ব্রেসলেট টা পড়িয়ে দিলো। আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। ব্রেসলেট পড়ানো শেষে আমার দিকে তাকালো। অদৃশ্য অনুভূতি মেশানো দৃষ্টিতে যেন আমাকে এখান থেকে চলে যেতে বলছে। আমিও দেরি করলাম না। ওখান থেকে রিচার্ডের সাথে চোখ না মিলিয়েই চলে এলাম।
.
বুঝতে পারলাম না হঠাৎ করে লিওর হলো টা কি? এটা তার আচরনের সাথে যাচ্ছে না। এমন লিও কে তো আমি চিনিও না। ভাবতে ভাবতে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়লাম।
ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে আসতেই মিসেস উইলিয়াম মানে লিওর মমের সাথে দেখা হল।
“হেই সুইট হার্ট! গুড মর্ণিং!”
“গুড মর্ণিং ম্যাম!”
“তুমি কি আমার ছেলেকে দেখেছো?”
“সে মনে হয় হলে! রিচার্ড নামের কারো সাথে!”
“ওহ্ রিচার্ড এসে গেছে!”
“জি!”
রিচার্ডের কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে মিসেস উইলিয়াম সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলেন। আমি ও হলে চলে এলাম। এতক্ষনে প্রায় সবারই ঘুম ভেঙ্গেছে। মেইড রা জুস দিয়ে যাচ্ছে সবাই কে।
কিন্তু রিচা পাখির বাসার মত এক ঝাক এলো মেলো চুল নিয়ে এখনো বসে আছে। মাথা হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে। তার গালে লালা শুকিয়ে সাদা দাগ হয়ে আছে।
“রিচা দ্রুত উঠো! কলেজে যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে!”
“ওহ্ টামিনাহ আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে!”
“কেন কি হয়েছে মাথায়!”
রিচা জবাব দিল না। মেইডের কাছ থেকে জুস টুকু চেয়ে নিলো। আমিও নিলাম। জুসে চুমুক দিতেই কড়া টকে শরীর টা চিনচিন করে শিউরে উঠলো। লেমন জুস! এই ভোরে! সবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। সবাই নির্বিঘ্নে খাচ্ছে এটা। কারো কোনো সমস্যা নেই।
সবার দেখাদেখি আমিও একটু একটু করে খাচ্ছি। লিওর কোনো দেখা সাক্ষাত নেই। রিচার্ড নেমে এসেছে। সবার সাথে হাসি মুখেই আলাপ করছে। নিশ্চয় লিও দের পরিচিত কেউ হবে। আমি রিচার দিকে তাকালাম। সে লেমন জুস টা এখনো পান করছে।
“রিচা!”
“হুম!”
“এই ছেলেটা কে?”
“কোন ছেলেটা?”
“ওই যে ওই রিচার্ড নামের ছেলেটা!”
“ওহ্ এটা মি. এন্ডারসনের ছেলে। রিচার্ড এন্ডারসন!”
“মি. এন্ডারসন…”
“কালকে কথা বললে না টিনার সাথে!”
“হুম!”
“তার ভাই। দুজনে জমজ! এ বার্থ ডেতে ভ্যানকুভার থাকায় আসতে পারে নি। এজন্য বোধ হয় সকাল সকাল চলে আসছে!”
“ওহ্ আচ্ছা!”
আমি আবারো জুসের গ্লাসে চুমুক দিলাম।
“আমাকে নিয়েই বুঝি কথা হচ্ছে!”
মাথা তুলে দেখলাম রিচার্ড। রিচা হেসে বলল
“হ্যা। টামিনা কে তোমার পরিচয় দিচ্ছিলাম।
রিচার্ড হাসলো তারপর যেন আপন মনেই বলল
“আমি তো পরিচিত হতেই এসেছিলাম। যাক বাদ দাও। হ্যাং ওভার কমেছে?”
“একটু একটু!”
রিচা জবাব দিল। হ্যাংওভার! আমি ভাবতে লাগলাম। তারপর এতক্ষনে লেমন জুসের ব্যাপার টা বুঝতে পারলাম। ইশশ এতক্ষন এটা আমার মাথায় আসেনি কেন?
.
কাল রাতে কম বেশি সবাই ড্রিংক করেছে। শুধু আমি বাদে। নিজেকে খুব সাবধানে রেখেছি। যাতে কেউ ভুলেও আমাকে ড্রিংক করাতে না পারে। রিচার্ড জিজ্ঞেস করলো
“তোমার টামিনা?”
“কি?”
“হ্যাংওভার!”
“আমি ড্রিংক করি না!”
“কেন? গড মানা করেছে বুঝি?”
এ বলে হো হো করে হাসতে লাগলো। আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম
“আমি মুসলিম। ড্রিংক আমার জন্য হারাম। এটা সত্যি আমার গড আমাকে এটা পান করতে মানা করেছে!”
মুহুর্তে রিচার্ডের হাসি থেমে গেল। সে হয়ত এখনো জানে না আমি মুসলিম। আমি দেরী করলাম না। উঠে গেলাম সেখান থেকে।
.
(চলবে)
.
এ পর্বের আন্দাজ ওয়ালীরা কই? কতটুকু হয়েছে তাদের আন্দাজ!