Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ২২
———————————————–
ওই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসার সময় শাকিরা কে দেখলাম। সে আমার পিছু পিছু লেজ নেড়ে নেড়ে হাটছিল। তবে দুরত্ব বজায় রেখে। আমার খুব ভয় করছিল ওকে দেখে। তারপরও চোখ মুখ শক্ত করে ধীরে ধীরে চলে এলাম। যতক্ষণ না বাড়ির গেইটের বাইরে যাই নি ততক্ষণ পর্যন্ত শাকিরা আমার পিছনে পিছনে ছিল। গেইট থেকে বের হওয়ার পর আর পিছু পিছু আর আসলো না। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু শাকিরা গেইটে দাড়িয়ে ছিল ছল ছল চোখে। যেন হাজার টা অনুযোগ, অভিযোগ আমার প্রতি।
.
বাইরে কাচের দরজার উপরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি টাই আরেক বার চোখ বুলালাম। তারপর ভিতরে প্রবেশ করলাম। একজন ওয়েটার কে জিজ্ঞেস করতেই সে আমাকে কিচেনের দিকে ইশারা করল। কফি হাউজ টার মূল অংশ বাদে ভিতরের দিক টা ঝাপসা কাচের দেয়ালে ঘেরা। বাইরে থেকে ভিতরের কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমি সেদিকে প্রবেশ করলাম। লম্বাটে একটা কিচেন। সারি সারি সব জিনিস পত্র রাখা। কয়েক জন ওয়েটার দৌড়াদৌড়ি করে অর্ডার নিয়ে যাচ্ছেন। বাকিরা কিচেনেই কাজ করছে। একজন কে দেখলাম ব্লেন্ডার মেশিনে কোনো কিছু গুড়ো করছে। আমি এগিয়ে তার কাছে গেলাম। খুবই অল্প বয়সী একজন ছেলে। এ নির্ঘাত কোনো স্টুডেন্ট হতে পারে। বয়স বললে আমার চাইতে চার/পাঁচ বছরের বড় হতে পারে।
আমি তাকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি টার কথা বললাম। সেও আমাকে ইশারা করে আরো ভিতরের দিকে যেতে বললো। কি ব্যাপার? সবাই ইশারায় বা কেন করছে? যেতে গিয়ে একটা মেয়ের ওয়েটারের সাথে ধাক্কা লাগতেই সে খেকিয়ে উঠলো। আমি দ্রুত স্যরি বলে পাশ কাটালাম। আরেকটু সামনেই গনগনে আগুনের তাওয়া। সেখানে তপ্ত আগুনে বিরাম হীন ভাবে এক মোটা সোটা মহিলা কিছু ফ্রাই করছে। প্রথম দেখে আমি চিনতে পারলাম এই সে জাদরেল মহিলা যাকে কাউকে ধমকাতে আমি দেখেছিলাম। তখন আমার মনেও হয়েছিল এই মহিলাই মালকিন হবে।
তাওয়ার গটগটে আগুন যেভাবে ফুলকি দিয়ে উঠছে তাতে উনার চেহারা লাল টকটকে ধারন করেছে। এ মুহুর্তে এ চেহারা নিয়ে যদি কারো দিকে তাকায় তাহলে নির্ঘাত তার চেহারা ঝলসে যাবে বলে আমার মনে হলো।
আমি একটা ঢোক গিলে পাশে দাড়ালাম। তারপর উনাকে জানালাম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি টার কথা। শুনে ডিন বলে কাউকে ডাক দিলেন। দুপ দাপ শব্দে ডিন দৌড়ে এল। কিছুক্ষনের আগের সেই ছেলেটা। উনি তার হাতে খুন্তিটা দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। আমি পিছু পিছু হাটতে লাগলাম। ভদ্র মহিলা শরীর থেকে এপ্রোন টা খুলে চেয়ারের সাথে আটকে ক্যাশ কাউন্টারে বসে গেলেন। টক টকে লাল শরীর টা দর দর করে ঘামছে। উনি একটা কটনের রুমাল দিয়ে চোখ মুখ মুছতে মুছতে তীক্ষ্ণ নজরে আমাকে দেখতে লাগলেন। উনার দৃষ্টির সামনে আমি কেমন যেন জড়সড় হয়ে গেলাম। এবার তিনি আমাকে ইশারা করলেন টেবিল থেকে পানির বোতল টা দেয়ার জন্য। আমি এগিয়ে দিলাম। তারপর তিনি ঢক ঢক করে পানি পান করলেন। বোতল টা সামনের টেবিলে রেখে শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন
“নাম কি?”
“জি?”
“নাম কি তোমার?”
ভদ্র মহিলা কর্কশ কন্ঠে চেচিয়ে উঠলেন। কর্কশ কন্ঠে আমার মাথা ঝি ঝি করতে লাগলো। বললাম
“তাহমিনা!”
“কিহ!”
“তাহমিনা!”
“ওহ টারমিনা! তোমাকে তো এখান কার মনে হয় না। কোথ থেকে এসেছো?
“বাংলাদেশ থেকে।”
“বেংলাডেশ! সেটা আবার কোথায়?
মুখ টা বাঁকা করে উঠলেন তিনি। আমার মোটেও পছন্দ হল না যেভাবে তিনি মুখ বাঁকিয়ে কুশ্রী ভঙ্গিতে আমার প্রিয় দেশের নাম নিলেন। তবুও নিজেকে সংযত রেখে বললাম
“সেটা এশিয়াতে। ইন্ডিয়ার কাছাকাছি দেশ!”
“ইন্ডিয়া থেকে এসেছো তুমি?”
“না বাংলাদেশ থেকে।”
“যাই হোক। দুটোই একই হবে। সব এশিয়ান এক। ধোকাবাজ, আর ফাকিবাজ। তুমি এমন নয়তো?”
আমি মাথা নাড়লাম। নাহ্ আমি ধোকাবাজ বা ফাকিবাজ কোনটাই না।
নিশ্চিত মহিলাটি কোনো এশিয়ান পুরুষের কাছ থেকে কোনো ভাবে ধোকা খেয়েছেন। না হলে এশিয়ান দের জন্য মনে বিদ্বেষ পুরে রাখতেন না। উনার ভঙ্গি দেখে উনাকে কিভাবে বুঝায় ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশ দুটো আলাদা কান্ট্রি। একই না। ভদ্রমহিলা আবার বললেন
“কফি বানাতে জানো?”
আমি মাথা নাড়ালাম জানি না।
“কফি বানাতে জানোনা? তাহলে কেন এসেছো?
বাজখাঁই কন্ঠ শুনে একটু ভয় পেলাম। আমতা আমতা করে বললাম
“আ-আমি শিখে নিবো!”
“কি কি রান্না করতে পারো?”
“বাংলাদেশি রান্না প্রায় সব পারি। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের সালাদ, ভর্তা, জুস, বার্গার, কেক, পুডিং, নুডলস ইত্যাদি এসব ভালো বানাতে পারি।”
.
ভদ্রমহিলার নাম মিস মার্থা। এ হোটেল টা তার এক মাত্র সম্পত্তি। মিস মার্থা বলার কারন তিনি জীবনে বিয়ে করেন নি। একাধিক প্রেমে অসফল এ মহিলা জীবনে বিয়ে করবেন না বলে পণ নেন। একটা ছেলে দত্তক নিয়ে বাকি জীবন টা পাড়ি দেন। সে সাথে এ হোটেল টা প্রতিষ্টা করেন। উপরের তলায় নিজের বাস গৃহ আর নিচ তলায় হোটেল নির্মান করেন। প্রথমে কফি হাউজ থাকলে পরবর্তী তে চাহিদা দেখে সেটা কে হোটেলে রুপান্তর করেন। মার্থা হাউজ নামে পরিচিত এ দোকান টি মূলত তিনি আর তার দত্তক নেয়া ছেলে ডিন চালায়।
.
মার্থা হাউজ থেকে বেড়িয়ে আসার সময় মিস মার্থা বললেন
“তোমাকে বেশি ডলার দিতে পারবোনা। পোষালে কাল কে থেকে সঠিক সময়ে চলে আসবে।”
আমি সায় জানিয়ে চলে আসলাম। পোষাবে না মানে! এ মুহুর্তে এ চাকরী টা আমার কাছে সোনার হরিন তুল্য।
.
হোস্টেলে ফিরে গোসল করে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম আসছিলো না। সে মুহুর্তে ইভিলিন প্রবেশ করলো।
সে মাত্রই তার ভার্সিটি থেকে ফিরেছে। আমাকে দেখে দ্রুত আমার কাছে চলে এল।
“টামিনা! কি হয়েছে? বাড়িতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“না ইভি। তেমন কিছু না। থ্যাংকস আমার ফি দেওয়ার জন্য। আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। চেষ্টা করবো দ্রুত শোধ করার।”
“ওহ কাম অন টামিনা! আমাকে লজ্জা দিও না। আমি জাস্ট ছোট্ট একটা কাজ করেছি।
.
Radioactivity চ্যাপ্টার টা পড়ছিলাম। Bকণা = উৎপাদনের প্রোটন সংখ্যা – বিক্রিয় 6m প্রোটন সংখ্যা।
ইন্টু মাইনাস কনা = ফোর বাই ভর সংখ্যা…
খেই হারিয়ে ফেললাম। আঙ্গুল ঝুলে থাকা জুলফি পেচাতে স্কাই আর রেইনের দিকে তাকালাম। রেইনের প্রচুন্ড জ্বর। কথাও বলতে পারছেনা। হয়ত বৃষ্টিতে ভিজেছিল। তাই জ্বর চলে এসেছে। কিন্তু স্কাই সব কিছু বাদ দিয়ে রেইনের সেবা যত্নে ত্রুটি রাখছে না। হাতে পায়ে তেল মালিশ করা, ঔষুধ খাওয়ানো, শরীর কাপড় দিয়ে স্পঞ্জ করে দেয়া, জ্বর পট্টি দেয়া এক নাগাড়ে করে যাচ্ছে। বেচারি ঘাম ছুটে যাচ্ছে এসব করতে। কিন্তু একমাত্র ঝগড়ার সঙ্গীকে নিশ্চুপ শুয়ে থাকা হয়ত সহ্য হচ্ছে না। এটা কি রক্তের টান নাকি ঝগড়ার টান বুঝতে পারলাম না।
.
বাইরে প্রচুন্ড বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আজ রাতেও ঝড় হবে বোঝায় যাচ্ছে। ফিন ফিনে বাতাস ঢুকছে জোরালো ভাবে। আমি বই বন্ধ করে ফেললাম। পড়ায় তেমন মন বসছে না। শুধু ছুটতে চাইছে তেপান্তরের পানে।
.
পরদিন ফোর্ট গ্যারি ক্যাম্পাসে রিচার সাথে দেখা। সে হন্তদন্ত হয়ে কোথ থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। এত সুন্দর গোছানো কার্লি চুল গুলো বাতাসে উড়ছে। বেখেয়ালে ফ্রকের একটা কাঁধ পড়ে রয়েছে। সেখানে অন্তর্বাসের ফিতা টা বেড়িয়ে এসেছে। এটা কি স্টাইল নাকি সত্যিই জামাটা কাঁধ থেকে পড়ে গেছে বুঝতে পারলাম না।
রিচা একটু দম নিয়েই বলল
“আমাদের ফেলে চলে এলে কেন?”
হঠাৎ প্রশ্নের আক্রমনে থমকে গেলাম। আমতা আমতা করতে বললাম
“আমার জরুরী একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল রিচা!”
“জানো এর জন্য আমরা সবাই কত টা রাগ করেছি! লিও বলেছে সে তোমার সাথে আর কথায় বলবে না!”
“আই এ্যাম স্যরি রিচা!”
“বাদ দাও এটা। একটা গ্রেট নিউজ আছে!”
“কি নিউজ?”
“নিজের চোখেই দেখবে। চলো আগে।”
রিচার মুখ টিপে টিপে হাসি দেখে মনে হল পেটে প্রচন্ড গোপন কথা লুকিয়ে আছে। বলতে না পারায় সেটা পেটের ভিতর হাঁসফাস করছে। আবার বলে দিলে সারপ্রাইজ নষ্ট। তাই দেখাতে চাচ্ছে। না হলে শান্তি পাবে না।
.
রিচার আমাকে এক টানে ব্যানাটাইম ক্যাম্পাস ইয়ার্ডে নিয়ে এল। ম্যানিটোবার অন্যান্য ক্যাম্পাসের তুলনায় এটি একটু বড়। তা দেখলেই বোঝা যায়।
ক্যাম্পাস ইয়ার্ডে আসতেই ছোট খাট একটা জটলা দেখলাম। অপরিচিত কেউ নেই। সবাই পরিচিত। দৌড়ে আসার কারনে একটু হাপাচ্ছিলাম। তাই নিশ্বাস নিতে নিতে সামনে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম এডালিন আর রাঘব পাশাপাশি অপরাধীর মত দাড়িয়ে আছে। আর তাদের ঘিরে সাত/আট জনের একটা জটলা। মনে হচ্ছে শালিস বসেছে আর রাঘব এবং এডালিন দুইজনই অপরাধী।
রিচাকে জিজ্ঞেস করলাম
“ব্যাপার টা কি?”
“আরে দেখই না মজা! হঠাৎ করে চোর দুটো ধরা পড়েছে!”
আমি সন্দিগ্ন চোখে বললাম
“কি চুরি করেছে?”
রিচা শয়তানি হাসি দিয়ে বলল
“একে অপরের মন!”
.
হা করে তাকালাম রইলাম। ব্যাপার টা আত্মস্থ করতে সময় নিচ্ছিলো। কাছে যেতেই বিভিন্ন প্রশ্ন শুনতে পেলাম
“কয়দিন ধরে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছো?”
“কে আগে প্রপোজ করেছে?”
“তোমরা কি এখন গেট টুগেদারে আছো?”
প্রশ্ন শুনে ভিরমি খাওয়ার মত অবস্থা। এডালিন শুধু মুচকি মুচকি হাসছে আর রাঘব বেচারা লাজুক ছেলেটা ঘেমে নেয়ে একাকার হচ্ছে।
“আরে তোমরা কিছু বলছোনা কেন? এতদিন সব করে বেড়িয়েছো আর এখন লজ্জা পাচ্ছো?”
রিচা খেকিয়ে উঠলো। রিচার সাথে তাল মিলিয়ে কার্ল বলে উঠলো
“আমার লজ্জাবতীরা কি কি নির্লজ্জের কাজ করেছো তাড়াতাড়ি বলে ফেল দ্রুত। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।”
এরা যদি চুপি চুপি প্রেম করেও থাকে তাহলে আমার কাছে দল বেধে এ জুটি কে নাস্তানাবুদ করা টা অনর্থক মনে হল। বেচারা রাঘব তো মাথা তুলে তাকাতেই পারছেনা। তাকে কথা বলার জন্য এডালিন কনুই দিয়ে বার বার গুতো মেরেই যাচ্ছে।
অবশেষে এডালিন গলা খাকড়ি দিয়ে কথা বলে উঠলো। সাথে সাথে কথা শোনার জন্য সবাই চুপ হয়ে গেল
“আমি আর রাঘব…!”
একজন বলে উঠলো
“তুমি আর রাঘব আমরা জানি। তারপরে কি সেটা বল।”
“আমি আর রাঘব রিলেশন শীপে আছি। উমমম গ-গত দু মাস ধরে!”
পুরো দল টা হৈ হৈ করে উঠলো। কেউ শিষ দিতে লাগলো। কেউ নতুন সম্পর্কের জন্য স্বাগত জানাতে লাগলো। আমি সব বাদে বেচারা রাঘব কে দেখছিলাম। পা দিয়ে অনবরত মাটি খুটছিল। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে এ মুহুর্তে মাটি দু ভাগে ভাগ হয়ে ফাটল হোক আর সে ফাটলে সে ঝাপ দিয়ে নিজের চেহারা লুকোয়।
আমি ধীরে ধীরে রাঘবের পাশে দাড়ালাম। তারপর ফিসফিস করে রাঘবের কানে কানে বললাম
“বাদায় হো জনাব! কিয়া নিউজ হে!”
“তাহমিনা তুম বি!”
রাঘবের চেহারা দেখে আর থাকতে পারলাম না। হো হো করে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়লাম।
.
(চলবে)