Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ২৩
———————————————–
ক্লাস শেষে আমি লিওর কাছে চলে এলাম। সে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি তার সামনে বসে একটু হাসলাম। বই উল্টাতে উল্টাতে সে তীক্ষ্ণ নজরে শুধু একটু দেখল। কিছু বলল না। পুনরায় বইয়ে ডুব দিল। আমি গলা খাকড়ি দিয়ে বললাম
“হাই!”
কোনো জবাব নেই।
“লিও?”
এবারো কোনো জবাব নেই।
“লিও আই এ্যাম স্যরি। দেখ আমি মাফ চাইছি।”
এবার লিও তাকালো। চোখ ছোট ছোট করে।
“আমি তোমার উপর অনেক রেগে আছি।”
এই বলে ভ্রু টা কুচকে চোখ গুলো কে আরো ছোট ছোট করে ফেলল।
“এবারের মত মাফ করে দাও না। আর হবে না। এইতো কানে ধরেছি!”
কান ধরার ব্যাপার টা ওর কাছে ফানি বলে মনে হল। কারন তার ঠোটের কোনে একটু করে হাসির আভাস পাওয়া গেল।
“কি করছো তুমি?”
“নিজেকে শাস্তি দিচ্ছি।”
“এভাবে?”
“এভাবেই তো শাস্তি দেয়া হয়!”
লিও হা হা করে হেসে উঠলো। তারপর হাসতে হাসতে বলল
“কিন্তু এভাবে তো আমি মাফ করবোনা।”
আমার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।
“তাহলে কি করলে মাফ করবে?”
“কি করলে মাফ করবো?”
লিও খানিকক্ষন চিন্তা করলো। বেশ কিছুক্ষন ভেবে চিন্তে সে বলল
“আমাকে বাংলাদেশী ফুড খাওয়াতে হবে।”
আমি একটু হতবাক হয়ে গেলাম।
“লিও বাংলাদেশী ফুড এখানে কোথায়…!”
আমি মনে মনে চিন্তিত হলাম। একে তো ফকিরের মত অবস্থা। ধার দেনা করে চলছি। কোনো ভাবে বাঙ্গালী রেস্টুরেন্ট খুজে পেলেও খাওয়াবো কি করে? চিন্তায় চিন্তায় আমার মাথা ফেটে যাচ্ছিলো। তার চেয়ে বরং ওই দিন লিও কে বলে আসাই উচিত ছিল।
“মিইইইরা!”
“হাহ!”
“কি চিন্তা করছো!”
“এখানে বাঙালি রেস্টুরেন্ট…!”
“আমি ওটার কথা বলি নি।”
“তো?”
“তুমি নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবে।”
লিওর কথা শুনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। চিন্তিত কন্ঠে বললাম
“লিও আমি কিভাবে… আমি তো হোস্টেলে…!”
“ওহ্ মিইইইরা! তুমি আমার বাড়িতে রান্না করবে।”
লিওর কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম।
“তোমার বাড়িতে?”
“ওফকোর্স প্রিন্সেস!”
বুকের সাথে হাত দুটো মুড়ে লিও শান্ত ভাবে জবাব দিল। উজ্জল সৌম্য চেহারায় এক টুকরো হাসি ফুটে উঠেছে। ডিম্পল টা নিলর্জ ভাবে নিজেকে প্রদর্শন করছে। কিছু বলতে গিয়েও মুখে কথা আটকে গেল। ওর মুখ থেকে প্রিন্সেস ডাক টা যেন আমার কানে মধু ঢেলে দিল। এক রকম ভালো লাগায় সব কিছু ছেয়ে গেল।
.
নির্দিষ্ট সময়ের আগেই মার্থা হাউজে পৌছে গেছি। কিন্তু মিস মার্থা তখন দোকানে ছিলেন না। কোনো কাজে মিউনিসিপ্যালিটি অফিসে গিয়েছিলেন। সুতরাং মিস মার্থা অনুপস্থিতি তে ডিন আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে লাগলো। সব শেষে অন্যান্য কর্মচারী দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলো। লিলি, আনা এই দুজন হচ্ছে মেয়ে কর্মচারী। তার মধ্যে লিলি মধ্য বয়স্ক মহিলা। নড়াচড়া করতে তার ভীষন অসুবিধা। এক জায়গায় বসে যা করতে পারেন। আনা হল সেই মেয়ে যার সাথে আমার ধাক্কা লেগেছিল। আমার আনা কে মোটেও সুবিধার হবে বলে মনে হল না। এরপর ফ্রান্সিস আর টেইলর এ দুজন ছেলে কর্মচারী। এদের মধ্য টেইলর বিবাহিত ও সিনিয়র শেফ। এখানে সবচেয়ে বেতনও তার বেশি। আমার মত পার্ট টাইম এখানে কাজ করছে ফ্রান্সিস। ফ্রি সময় গুলো এখানে কাজ করে সে।
সবার সাথে পরিচিত হওয়ার পর আমার কাজের পালা। ডিন আমাকে একটা এপ্রোন দিল। এপ্রোন নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলাম। তারপর চুল গুলো উচু করে খোঁপা বেধে নিলাম। স্কার্ফের জন্য কাজে একটু সমস্যা হতে পারে। আর আমি কোন সমস্যা চাই না। তাই স্কার্ফ টাকে মাথার সাথে পেচিয়ে একপাশে পিন দিয়ে আটকে দিলাম। অনেকটা হিজাবের মত। তারপর এপ্রোন টা পড়ে নিলাম। আয়নায় নিজেকে ওয়েটার ওয়েটার লাগছে।
এরই মধ্যে ডিনের ডাক এলো। আমি দৌড়ে বেড়িয়ে এলাম। সে আমার হাতে একটা ন্যাকড়া ধরিয়ে দিল সাত নম্বর টেবিল টা মুছে দেয়ার। প্রথম কাজের নির্দেশ পেয়ে আমি দৌড়ে গেলাম। টেবিল একটা মুছতে না মুছতে আরেকটা টেবিল খালি হয়ে এলো। এখনো অর্ডার নিতে না পারায় আমার কাজ হল কিচেনে। সালাদ কেটে দেয়া, কফি তৈরি করা, টেবিলে অর্ডার পৌছানো ইত্যাদি। ডিন অনেক টা হেল্প ফুল। সে অনেক কাজেই সাহায্য করছিল। এমন কি মিস মার্থা যখন আমার উপর কাজের বোঝা তুলে দিতে চাইছিলেন তখন ডিন আমাকে হেল্প করছিল। আমাকে হেল্প করাটা মনে হয় আনা ভালো চোখে দেখছিল না। সবাই আমার সাথে মোটামুটি কথা বললেও আনা আমার সাথে কথা বলছিল না। শুধু তীক্ষ্ণ চোখের অগ্নিবর্ষন করছিল।
.
আমি অর্ডারের জুস তৈরি করছিলাম ব্লেন্ডার মেশিনে। সে সময় আনা এসে হাঁক দিয়ে গেল
“আট নম্বর টেবিলের জন্য ক্যাপাচিনো এন্ড ব্ল্যাক কফি উইদ আউট সুগার।”
শুনে ডিন প্লেট সাজাতে সাজাতে আমাকে নির্দেশ দিল নিয়ে যেতে। জুস টা রেখে আমি কফি মেকারের কাছে গেলাম। ওয়ান ক্যাপাচিনো এন্ড ব্ল্যাক কফি উইদ আউট সুগার। মনে মনে জপতে জপতে আট নম্বর টেবিলে পৌছলাম। অর্ডার রেখে মাথা তুলতেই চমকে গেলাম।
কারন রিচার্ড টেবিলে বসে আছে। সেও আমাকে হঠাৎ দেখে হা করে আছে। আমাকে এভাবে দেখবে হয়তো আশা করে নি। আমি তাড়াতাড়ি ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুত চলে এলাম। কিছুটা ভয় হচ্ছিল। রিচার্ড হয়ত সবাইকে বলে দিবে আমি এখানে কাজ করি। তারপর সবাই আমার উপর হাসাহাসি করবে। ভাবতেই আমার শরীর শিউরে উঠলো। আনার কন্ঠে আবারো চমকে উঠলাম। আবারো আট নম্বর টেবিলে যাওয়ার কথা বলছে। আমি নির্ঘাত শিউর রিচার্ড ইচ্ছা করেই এটা করছে। ডিন ধমকে উঠল
“কি হলো তুমি এখনো যাচ্ছো না কেন?”
“যাচ্ছি!”
অর্ডার নিয়ে মাথা নিচু করে টেবিলে রেখে চলে আসতেই রিচার্ড পিছন থেকে ডাক দিল
“টামিনাহ ওয়েট!”
দুরু দুর বুকে রির্চাডের সামনে দাড়ালাম। সমবয়সী আরো একটা ছেলে বসা আছে। একটু ইতস্থত করে বিনীত ভাবে আমি বললাম
“আপনার আর কিছু প্রয়োজন স্যার?”
“টামিনাহ ফর্মালিটি ছাড়ো। আর এখানে বসো।”
আমি একবার সিটের দিকে একবার রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে বললাম
“স্যরি স্যার। কাষ্টমার দের সাথে আমাদের বসার অনুমতি নাই।”
“ওহ্ হো টামিনাহ! তু…!”
“সবকিছু ঠিক আছে স্যার?”
রিচার্ডের কথা কেটে ডিনের চলে আসায়। আমার দেরী হচ্ছে দেখে সে চলে এসেছে।
“নো। সবকিছু ঠিক আছে। আমি ওকে আমাদের সাথে বসতে বলছিলাম।”
ডিন বিনম্র কন্ঠে বললো
“স্যরি স্যার! এটাতো আমাদের রুলে নেই। তবে ওর কর্ম ঘন্টা শেষ হওয়ার পর ও চাইলে আপনি বসতে পারবেন।”
“তাহলে ওর কর্ম ঘন্টা কখন শেষ হবে?”
“কয়েক ঘন্টা পর।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ডিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আমি ওকে চিনি কিনা। আমি বললাম যে এক পার্টিতে দেখা হয়ছিল একবার। এর বেশি কিছু না। শুনে ডিন একটু করে হাসলো। কিন্তু কিছু বললো না।
মার্থা হাউজ থেকে যখন বেরুলাম তখন অন্ধকার ঝাকিয়ে বসার সময়। কিন্তু ঝলমলে আলোর বাতিতে বেচারা অন্ধকার চোখে অন্ধকার দেখছে। কোনভাবে পুরো শহর টাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করতে পারছে না।
আমি রোডে উঠতেই পি পিপ শব্দের হর্নে চমকে উঠলাম। পিছন থেকে কালো মার্সিডিজ এর কাচ নামিয়ে রিচার্ড মাথা বের করলো। আমি একটু অবাক হলাম।
“হেই টামিনা!”
“রিচার্ড তুমি?”
“গাড়িতে উঠো। তোমাকে লিফট দিই।”
“আমি যেতে পারবো। তুমি চলে যাও।”
“উঠই না। তোমার সাথে কথা আছে।”
“কি কথা?”
“উঠলে বলবো!”
“স্যরি রিচার্ড!”
এই বলে আমি চলে আসতে লাগলাম।
.
(চলবে)