Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ২৫
———————————————–
লিও দের ওয়েল ফার্নিশড কিচেন টা বড় একটা রুমের মতই। আমাদের দেশীয় কোন সরঞ্জামের সাথে তেমন সাদৃশ্য নেই। এমন কিচেন রুমে প্রবেশ করে আমি কিছুটা দমে গেলাম। আমাকে সাহায্য করার জন্য একজন মেইড ছিল। তাকে দেখে কিছুট ভরসা পেলাম। এরপর বাজার কি কি আছে চেক করলাম। আলু, মাংস, দুধ, পনির, ব্রকলি, মাসরুম, লবস্টার, শসা, টমেটো, কাঁচামরিচ ইত্যাদি এছাড়া আরো বেশ কিছু সবজি। কিন্তু এগুলোতে আমার হবে না। বিশেষ করে সব মসলা নেই। লবস্টার ছাড়া আর কোন মাছও নেই। সব প্যাকেট জাত খাদ্য। বাইরের খাবার। কাচা সবজি বলতে এই অল্প কিছু।
তাই একটা লিস্ট বানালাম। পাবদা, ইলিশ, স্যামন, তিতা করলা, সরিষার তেল, গাজর, হালাল মুরগীর মাংস, হালাল গরুর মাংস, চাল, শুটকি ইত্যাদি। বাজারের লিস্ট এত লম্বা হল যে মেইডের হাতে লিস্ট দিতেই সে হা করে কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।
.
রান্না শুরু করতে আমার মোটামুটি বেগ পেতে হল। বাংলাদেশে হলে আরো কষ্টকর হত। তবে সব কিছু হাতের নাগালে থাকায় দ্রুত শুরু করতে পেরেছি।
প্রথমেই আমি চাল আর আলু সিদ্ধ হওয়ার জন্য দিয়ে দিই। এর মধ্যে স্যামন আর ইলিশ মাছ টাকে ভালো করে কুটে ধুয়ে নিই। আলু ভর্তা টাকে একদম দেশীয় ঝাঁঝে তৈরি করলাম। গাজর আর শসা টুকরা করার সময় শাকিরা এসে আশে পাশে ঘুর ঘুর করতে লাগল। শাকিরার উপর থেকে আমার ভয় কিছুটা কমে এসেছিল। কিন্তু পুরো ভয়টা কাটেনি। ওর ঘুর ঘুর করা দেখে আমি পাক্কা শিউর হলাম যে সে গরুর মাংস ভুনার গন্ধে এ এখানে এসে হাজির। লেজ নেড়ে নেড়ে সে এপাশ থেকে ওপাশে হাটতে লাগলো। মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে জিহ্বা বের করছিল।
তখন সালাদের জন্য গাজর টুকরো টুকরো করছিলাম। মনে খেয়াল আসতেই এক টুকরো গাজর শাকিরার মুখের উপর ধরলাম। সে ভীষন খুশি হল। আমার হাত সহ চেটে পুটে গাজর টা খেল। ফলাফল আমাকে ঘসে ঘসে আবার হাত টা পরিষ্কার করতে হয়েছিল।
.
রান্না শেষ হতে কয়েক ঘন্টা লাগল। টেবিলে সব সাজানোর পপর একটা বড় স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। লিও আবার কোথায়?
আমি লিও কে খুজতে লাগলাম। বেচারা আমার রান্নার আশায় উপোস বসে আছে। মেইড কে জিজ্ঞেস করতেই বলল তার রুমে আছে। আমি উপরে উঠে কয়েক বার নক করলাম। কিন্তু ভিতর থেকে তেমন সাড়াশব্দ পেলাম না। রুমে হয়তো নেই। তারপরও চেক করার উদ্দেশ্যে দরজা টা একটু ফাঁক করে ভিতরে উঁকি দিলাম। আসলেই ভিতরে কেউ নেই। লিও হয়ত অন্য কোথাও আছে। তাই দরজা টা আবার লাগিয়ে দিতে যাব ঠিক সে সময়ে টব টার উপর আমার নজর পড়ল। এটা আমার দেয়া সবুজ ক্যাকটাস টা। আলতো পায়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম। সবুজ ক্যাকটাস টা জানালার কাছে টেবিলে রাখা। আরো একটা ফুল ফুটেছে সেটাতে। জানালার শার্সি একটু উপরে তোলা থাকায় কিছুটা সোনা রোদ ক্যাকটাস টার উপর পড়ছে। সাথে দুটো সাদা রঙা প্রজাপতি সেই ফুল দুটোর কাছে নিশ্চিন্তে ভ্রমন করছে। চমৎকার একটা দৃশ্য। আমি বিমুগ্ধ হাতে প্রজাপতির ডানা টা একটু করে স্পর্শ করলাম। স্পর্শ পেতেই প্রজাপ্রতি দুটো টুপ করে পাখা মেলে উড়তে লাগল। তারপর আবার একই জায়গায় বসে গেল। কেন জানি না আমি হেসে দিলাম।
এসময় লিওর কন্ঠ শুনতে পেলাম।
“প্রজাপ্রতি দুটো সুন্দর না?”
বেখেয়ালে জবাব দিলাম
“অনেক সুন্দর!”
আমি আবারো স্পর্শ করতে হাত বাড়াতেই লিও হাত টা ধরে ফেলল। তারপর কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো
“এভাবে না।”
“তো?”
আমার হাতটা মুটোয় নিয়ে শুধু মাত্র তর্জনী দ্বারা একটু করে স্পর্শ করতেই প্রজাপ্রতি দুটো উড়ে লিওর হাতের আঙ্গুলে বসে গেল। আমি আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম। বিস্ময় আর আনন্দ একসাথে হচ্ছিল। লিও একটু করে ঠোঁটে শিষ দিল। শিষের সাথে সাথে প্রজাপ্রতি গুলো আস্তে আমার আঙ্গুলে চলে এল। অনেকটা পোষা প্রজাপ্রতির মতই। লিও হাত টা ছেড়ে দিল। আমি প্রজাপ্রতি দুটো কে চোখের সামনে নিয়ে হা করে দেখতে লাগলাম। এতটাই ঘোরের মধ্যে ছিলাম যে আমার গালে হালকা নরম একটা স্পর্শ হল। স্পর্শে পুরো শরীরে একটা শিহরন বয়ে গেল। সাথে সাথে প্রজাপতি দুটো উড়ে গেল। আমি গালে হাত দিয়ে ফেললাম। একটা অদৃশ্য অনুভুতি হতে লাগল। বুঝতে পারলাম না। পিট পিট করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে লিওর দিকে তাকালাম। সে মিট মিট করে মৃদু হাসছে। পুরো ধবে ধবে আগুনের মত ফর্সা শরীর নিয়ে। পরক্ষনেই আমি গলা ফাটা চিৎকার দিয়ে চোখে হাত দিয়ে তাড়াতাড়ি সামনে ফিরে গেলাম। লিও ভেজা শরীরে শুধু টাওয়েল টা পরে দাড়িয়ে আছে।
“হোয়াট ইজ দিস লিও? তো-তোমার কাপড় কোথায়?”
“এই ভাবে চিৎকার দিও না মিইইরা! আমি ভয় পেয়ে গেছি। মনে হচ্ছে তোমার সামনে নেকেড দাড়িয়ে আছি?”
“লিও তুমি নেকেড ই দাড়িয়ে আছো!”
“তুমি দেখ একবার মিইইরা, আমি নেকেড না।”
“শাট আপ লিও। যাও কাপড় পড়।”
লিও হাসতে হাসতে আবার ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল। আমি আড় চোখে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তারপর এক দৌড়ে নিচে চলে এলাম। বাপরে! কি ভয়ঙ্কর না ছিল ব্যাপার টা।
.
লিও কিছুক্ষনের মধ্যে নিচে নেমে এলো। মুখের মধ্যে সেই মিচকা হাসি।
সে নেমে এসে টেবিলের কাছাকাছি দাড়ালো। আমি তখন পায়েস টা ঢাকনা দিয়ে রাখছিলাম। টেবিলে এসে লিওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল এত গুলো খাবার দেখে।
“এত খাবার!”
“কোথায় এত খাবার?”
“মিইইরা তোমার এগুলো কম মনে হচ্ছে?”
“অবশ্যই!”
“সিরিয়াসলি মিইইরা!”
লিও হা করে তাকালো। আমি সব ঢাকনা তুলে দিলাম।
“কি কি রান্না করলে? ওই ডিশটার নাম কি?”
“ওটা চিংড়ির মালাইকোপ্তা, এটা গরুর মাংস ভুনা, এটা মুরগীর রোস্ট, এটা করলা ভাজি, এটা স্যামন, এটা আলুর ভর্তা, এটা মুগ ডাল, এটা ভাত, সালাদ, ওটা শুটকি ভর্তা, পায়েস।”
তারপর পরোটার দিকে নির্দেশ করে বললাম
“এটা পরোটা।”
“আচ্ছা আ-আর এটা?”
“এটা ইলিশ ভাজা। জানো তো এটা কিন্তু বাংলাদেশ জনপ্রিয়। কিন্তু কাটা বেশি।”
“মিইইরা!”
“হুম!”
“এরকম যদি আমি নিয়মিত খেতে থাকি তাহলে এক সপ্তাহে বেলুনের মত হয়ে যাব!”
সে মুখের ভিতর বাতাস আটকে গাল ফুলিয়ে দেখালো। আমি হেসে দিলাম।
“বসো এবার।”
লিওর সাথে আমিও বসতে যাব ঠিক সে সময় কলিং বেলের শব্দ এলো।
আমি দরজার দিকে তাকিয়ে বললাম
“মনে হয় তোমার প্যারেন্টস চলে এসেছে!”
“উহু! তারা এত জলদি আসার কথা না!”
একজন মেইড দরজা খুলে দিল। প্রবেশ করলো রিচার্ড। সে ঢুকেই আমাদের দেখতেই থমকে গেলো। আমরাও হতভম্ভ হয়ে গেলাম। তারপর সে উচ্ছাসিত কন্ঠে বলল
“হেই টামিনা! হোয়াটস আপ!”
“হ্যালো!”
কিন্তু লিও সেরকম কিছু বলল না। শুধু কটমট দৃষ্টিতে বলল
“রিচার্ড তোমার না রাতে আসার কথা?”
রিচার্ড হেসে দিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বলল
“রাতে আসি বা এখন সব তো একই তাই না!”
আমি বললাম
“ভালো করেছো রিচার্ড। আমাদের সাথে বস। আমি আজকে বাংলাদেশী ফুড রান্না করেছি। খেয়ে দেখ কেমন হয়েছে?”
“কই! ওয়াও! রাতে আসলে তো এটা মিস করতাম। তাই না ব্রো?”
লিও এখনো চুপচাপ। আমি তাড়াতাড়ি বললাম
“অবশ্যই। এখন খাওয়া শুরু কর।”
খেতে খেতে রিচার্ড আমার রান্নার প্রশংসা করতে লাগলো। বিশেষ করে আলুর ভর্তাটার। আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। সে বলল
“টামিনা আমাদের সানডে ডিনার তাহলে বাঙালি রেস্টুরেন্টে করবো। কি বলো?”
আমি একটু হেসে সায় দিলাম।
কিন্তু লিও বিস্মিত গলায় বলল
“ডিনার! তোমরা দুজন?”
রিচার্ড মুখ তুলে বললো
“ব্রো! আমি আর টামিনা এ সানডে তে ডিনারে যাচ্ছি!”
লিও আমার দিকে তাকাতেই আমি মাথা নাড়লাম।
হুট করে খেতে খেতে লিও ঝাঝড়া গলায় বলে উঠলো
“একদম বাজে হয়েছে ভর্তাটা। আর এটা কি? চিংড়ির মালাই? কেমন যেন তেল চুয়ে চুয়ে পড়ছে, আর ওটা বীফ না? বীফ টা এত স্পাইসি যে মুখে দেওয়া যাচ্ছে না। তুমি জানো না এখানে এত স্পাইসি খাওয়া হয়না, তারপর এটা ইলিশ ভাজা? ইলিশ টা যখন এত বেশি কাটা তাহলে করতে গেলে কেন? কাটার জন্য ওটা খেতে পারছি না। এটা করলা ভাজি? তিতার জন্য তো মুখে দিতে পারছি না। আর তোমার সালাদ। সেটাও কেমন যেন বাসি মনে হচ্ছে। কি সব রান্না করেছো? আমার এখনি বমি করে সব ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে।”
আমি লিওর হঠাৎ পরিবর্তনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। কোন রান্নায় আমি ঝাল দিই নি। আমি জানিই ওরা বাঙালি দের মত ঝাল খাই না। তারপরও লিওর কাছে এত খারাপ লাগল কেন বুঝলাম না। ওর কথা শুনে এতটা অপমান বোধ করছিলাম যে মুখ তুলে উপরে তাকাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছে মাটির সাথে মিশে যাই।
.
(চলবে)