Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ২৬
———————————————–
হাত পা কাঁপছিল আমার। রিচার্ডের সামনে এমন কথা নিজেকে ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছিলো। চোখ ঠেলে পানি চলে আসছিল। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে পানি বেরুতে দিলাম না। খুব কষ্টে মাথা উপরে তুললাম। রিচার্ড হা করে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কি হয়ে গেল সে ও বুঝে উঠতে পারে নি। লিও এখনো ফোলা নাক নিয়ে কাটা চামচ আর নাইফ নিয়ে টুং টাং করছে। আমার গলা দিয়ে কোনো কথা বেরুচ্ছিল না। তারপরও বহুকষ্টে ভাঙা ভাঙা গলায় বললাম
“আ-আই এ-এ্যাম স-স-স্যরি লিও!”
লিও মুখ তুলে চাইলো না। আমার ভিতর টা কেমন ভেঙে যাচ্ছিলো। কোন মতে উঠে দাড়ালাম। তারপর আর পিছু তাকালাম না। দ্রুত পদক্ষেপে বেড়িয়ে এলাম। আসার সময় রিচার্ডের কন্ঠ শুনতে পেয়েছিলাম। সে আমাকে ডাকছিলো। কিন্তু আমি দাড়ালাম না। বাইরে আসতেই চোখের পানি বাঁধ মানলো না। ঝর ঝর করে কেঁদে দিলাম।
“আম্মুউউ! আম্মুরে! ও আম্মু! তুমি কোথায়?”
পুরো ইয়ার্ড কান্না করতে করতে পেরিয়ে এলাম। এই পুরো টা সময় শাকিরা আমার পাশ পাশ হাটতে হাটতে শুধু ঘেউ ঘেউ শব্দ করছিল। যেন বলছিল
“এই মেয়ে! কি হয়েছে তোমার? কেন কাদঁছো? ইয়াক্! ছি! দেখ তোমার নাকের মাথায় সর্দি জমেছে। মুছো ওটা।”
আমি স্কার্ফের সাথে চোখের পানি, নাকের পানি মুছে একাকার করে ফেললাম।
.
হোস্টেলে পৌছেও কারো সাথে কথা বললাম না। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। অথচ আমি এত রান্না করেও এক ফোটা খেতে পারি নি। খাবার খেলাম রাতে। তারপর আবারো শুয়ে পড়লাম। হাত পা অসার হয়ে আসছে। বই খুলেও দেখতে ইচ্ছে করছে না। শুধু শুয়ে শুয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। ভীষন ভাবে ঘরের কথা মনে পড়ছে। আম্মু থাকলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত আর মুহুর্তে সব বিষাদ গ্রস্থতা কেটে যেত। কিন্তু এখন কেউ পাশে নেই। আছে শুধু একরাশ হাহাকার।
.
পরদিন ভার্সিটিতে গেলাম না। শুধু শুয়ে শুয়ে প্রহর গুনলাম। বিকেলে কাজে যাওয়ার আগ মুহুর্তে হোস্টেলে বলে গেলাম যে আমার সাথে যদি কেউ দেখা করতে আসে তাকে যেন ঢুকতে দেয়া না হয়। জানিনা কেন বললাম। তবে আমার অবচেতন মন বলল কেউ না কেউ আমার সাথে দেথা করতে আসবে। কিন্তু আমি কারো সাথে দেখা করতে চাইনা।
.
মার্থা হাউজে গিয়ে প্রথমে আমাকে মিস মার্থার মুখোমুখি হতে হলো। উনার রাগান্বিত ভয়ানক চেহারা দেখে মাথা নিচু করে ছিলাম। তিনি আমার উপর প্রায় আধ ঘন্টা চিল্লালেন। চিল্লানোর সময় উনার মুখ থেকে থু থু ছিটকে আসছিলো। তাই বার বার পিছু হটছিলাম। আর টিস্যু দিয়ে মুখ মুছছিলাম। উনি মনে করেছিল উনার ভয়ে পিছু হটছি। তাই হয়ত আধ ঘন্টায় ছেড়ে দিলেন। তবে হুমকি দিলেন যে আমার বেতন থেকে কিছু ডলার পানিশমেন্ট হিসেবে কেটে নেয়া হবে। ভীষন ক্ষোভ হলেও কিছু বলার থাকলো না।
কয়েক দিন ধরে ভার্সিটিতে গেলাম না। গেলে লিওর সামনে চোখ তুলে তাকাতে পারবোনা। তারচেয়ে বরং না যাওয়াই ভালো। শুধু মাত্র মার্থা হাউজে যেতে লাগলাম। রিচার্ডের সাথে ডিনারের প্ল্যান থাকলেও সেটা ক্যানসেল হয়ে গেলো।
.
রাতে হোস্টেলে ফিরলে খবর এল যে আমাকে খুজতে কয়েক জন ছেলে মেয়ে এসেছিল। কিন্তু তাদের ভিতরে ঢুকতে দেয়া হয় নি আমার মানার কারনে। আমি জানতাম কেউ নাহলেও এডালিন আর রিচা অবশ্যই আমার খোঁজ নিবে।
ইদানিং পড়ালেখায় ও মন বসছে না। কোথায় যেন মন টা ঘাপটি মেরে বসে আছে। বার বার বলছি আমার কাছে চলে আসো। কিন্তু সে আসছে না। সে নাকি স্বাধীন। কারো পরোয়া নাকি করে না। তার ইচ্ছা হলে আসবে না হলে ফুড়ুৎ করে উড়ে বেড়াবে। অসভ্য বেপরোয়া মন!
.
রাতে স্বপ্নে লিও কে দেখলাম। সে এসে বলছিল
“মিইইরা এই যে দেখ! কানে ধরেছি। এবার মাফ করে দাও। প্লিজ!”
আমি গোসসা করে মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে ফেললাম। লিও আবারো অনুরোধ করে বলল
“প্লিজ মিইইরা! দেখ আমি কান ধরে উঠবস করছি।”
আমি আড় চোখে তাকালাম
দেখলাম লিও কান ধরে উঠ বস করছে। আমি হেসে দিলাম। আমার হাসি দেখে সে উঠবস বন্ধ করে দিল। কান ধরে ঠায় দাড়িয়ে রইল। আমি এবার হাসি বন্ধ করে শক্ত গলায় ধমকে উঠলাম
“উঠবস বন্ধ করলে কেন? উঠ বস কর!”
কিন্তু লিও উঠবস করলো না। সে আমার কাছে এগিয়ে এলো।
“লিও…”
কিছু বলার আগে সে আমার মুখ চেপে ধরল।
আমি দুহাত দিয়ে তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না। চোখ ছুটে গেল স্বপ্নের চাপে। কিন্তু আমি আওয়াজ করতে পারছিনা। সত্যিই আমার মুখ কেউ চেপে ধরছে। অন্ধকারে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। জ্বীন নয়তো? নিশ্চয় বোবা জ্বীন! আমি মনে মনে সুরা পড়তে লাগলাম। আর হাত ছাড়ানোর প্রচুন্ড চেষ্টা করতে লাগলাম। এদিকে জ্বীন টা আরো শক্ত করে আমাকে চেপে ধরলো। খেয়াল করলাম আমার পা অবশ না। তাই পা দিয়ে দুপ দুপ শব্দ করতে লাগলাম। পায়ে শব্দ করতে করতে জ্বীন টা আমার মুখ আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। কানের মধ্যে ফিস ফিস শব্দ শুনতে পেলাম
“স্টপ ইট মিইইরা!”
আমি কি ভুল শুনছি। গলা টা পরিচিত মনে হচ্ছে
“আই সেইড স্টপ ইট।”
পা নাড়ানো বন্ধ করলাম। নিঃশ্বাসে বুকটা উচু নিচু হচ্ছে।
আমি চোখ খুলে ভালো করে তাকানোর চেষ্টা করলাম। ডিম লাইটের আবছা আলোয় একটা আবছা মানব শরীর কে দেখা যাচ্ছে। গলার ঝুলন্ত লকেট টা বার বার আমার মুখের উপর পড়ছে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ডাকলাম
“লিও?”
লিও আমার কথার জবাব না দিয়ে বললো
“মিইইরা আমি হাত সরিয়ে নিচ্ছি বাট ফর গড সেইক চিল্লাবে না। না হলে আস্ত গিলে ফেলবো তোমাকে। বুঝছো?”
আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। চিল্লাবো না। একদম চিল্লাবো না। আমার বুকে ও দুপ দুপ শব্দ হচ্ছে।
লিও আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার হাটুর উপর আলতো করে বসে গেল। আমি কোনো মতে উঠে বসলাম। ফিসফিসিয়ে বললাম
“লি-লিও তু-তুমি?”
“শসসসসহ!”
“কিভাবে ঢুকলে রুমে!”
“পাইপ বেয়ে উপরে উঠে এসেছি। এবার চুপ করো!”
আমি চুপ হয়ে গেলাম। সে ইশারা করলো উঠে আসার জন্য। কিন্তু আমি নামলাম না। হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। কি হচ্ছে এসব?
আমাকে উঠতে না দেখে লিও আবার ফিরে এসে আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো। শব্দ হবে বিধায় কিছু বলতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে পিছু পিছু হাটতে হচ্ছিলো।
হোস্টেলের সিড়িতে উপস্থিত হলে আমি আর থাকতে পারলাম না। ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলাম।
“লিও কি করছো এসব? কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে?”
দাঁত কিড়মিড় করে লিও বলল
“স্টপ টকিং মিইইরা। জাস্ট ফলো মি।”
এ বলে ও হাত ধরতে চাইলে আমি হাত সরিয়ে নিলাম।
“না বললে আমি যাবো না!”
ভ্রু কুচকে লিও এবার ঠাণ্ডা চোখে আমার দিকে তাকালো। অদৃশ্য চঞ্চলতা খেলা করছে তার চোখে।
“কি বলছো তুমি?”
“আমি বলেছি আমাকে না বললে আমি যাবো না!”
লিও ভ্রু উপরে তুলে ফেলল
“সত্যিই!”
“হুম।”
হাত দুটো মুড়ে আমি শক্ত করে দাড়ালাম। সেটা দেখে লিওর ঠোটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। তারপর একটু করে আমার কাছাকাছি এসে আমি কিছু বুঝে উঠার আগে ঝট করে আমাকে কাঁধে তুলে ফেলল। তারপর দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে নামতে লাগলো। আমি ভীষন ভাবে চমকে গেলাম। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলতে লাগলাম
“লি-লিও! কি করছো! আমাকে নামাও বলছি। না হলে আমি চিৎকার করবো!”
“করো।”
লিওর মধ্যে কোন ভাবান্তর না দেখে মোটামুটি রকম ভাবে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তাই ভয়ার্ত গলায় বললাম
“লিও নামাও আমাকে। আমি সত্যিই চিৎকার করবো!”
এবার কাজ হল। সিড়ির নিচে নেমে সে আমাকে কাঁধ থেকে নামালো। আর আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাবো তার আগেই আমার মুখে কিছু চাপা পড়লো। কিছু বলার সুযোগ পেলাম না। তার আগেই লিও রুমাল বের করে আমার মুখ বেঁধে ফেলল। আমি জিজ্ঞেস করতে লাগলাম কি করছে এসব? কিন্তু মুখে গো গো ছাড়া আর কোন শব্দ বেরুলো না। সে এত শক্ত করে গিট দিয়ে রুমাল বেঁধেছে যে আমি চেষ্টা করেও খুলতে পারছি না। এরপর লিও হঠাৎ করে তার গায়ের গেঞ্জি টা খুলে উদোম হয়ে গেল। আমি ভয় পেয়ে পিছু হটে গেলাম। মনে মনে ঢোক গিলতে লাগলাম। কি করতে যাচ্ছে লিও?
.
(চলবে)