আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -২৭

0
1911

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ২৭
———————————————–
গেঞ্জি টা হাতে নিয়ে আমার দিকে আসতেই আমি পিছু হটতে লাগলাম। ভয়ে আমার জান বেড়িয়ে যাচ্ছিলো। মাথা নাড়তে লাগলাম যাতে আমার কোনো ক্ষতি না করে। কিন্তু তার চেহারায় কোনো পরিবর্তন নেই। সে চট করে আমাকে টেনে ধরলো। আমি শুধু প্রাণপনে মাথা এদিক ওদিক নাড়ছিলাম। মনে হচ্ছে লিও কে এতদিনেও আমি চিনতে পারি নি। সে এতটা খারাপ হবে ভাবতে পারি নি।
এরপর লিও আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার দু হাত পিছনে মুড়ে ফেলল। তারপর হাত দুটো তার গেঞ্জি দিয়ে বেঁধে ফেলল। আমি লিওর উদোম উষ্ণ বুকের স্পর্শে কান্না করে দিচ্ছিলাম। হাত বাধা শেষে লিও জড়িয়ে ধরা অবস্থায় আলতো করে আমার পিঠে হাত রেখে বুলাতে লাগল। কানে কানে শক্ত গলায় ফিসফিস করে বলল
“শসসসহ মিইইরা! ডোন্ট এফ্রেইড। আই এ্যাম ডুয়িং নাথিং! জাস্ট বি নরমাল!”
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে জোর গলায় ধমকে উঠল
“নরমাল হও মিইইরা। নিঃশ্বাস নাও!”
আমি তখনো ফোপাচ্ছিলাম। এরপরও লিও নিয়ে যেতে চাইলে আমি গেলাম না। ঠায় দাড়িয়ে রইলাম। লিও হাফ ছেড়ে বলল
“তুমি আমার জন্য কোনো চয়েজ রাখলে না প্রিন্সেস! আই হ্যাভ টু ডু ইট!”
এই বলে সে আবারো আমাকে কাঁধে তুলে ফেলল। এবার সুবিধা করতে না পারায় আমি পেটে ব্যাথা পেলাম। কিন্তু না কিছু বলতে পারলাম, না কিছু করতে পারলাম।
সরাসরি হেটে হোস্টেল গেইটে আসলে আরো দুজন কে দেখতে পেলাম। তারা গেইট টা খুলে দিল। মুখে রুমাল বাধা থাকায় চিনতে পারলাম না। গার্ডদের কেও কোথাও যাচ্ছে না। আমার মনে মনে প্রচুন্ড ক্ষোভ হতে লাগল। কিন্তু কিছু করতে পারছিলাম না।
লিও তার কারের সামনে আমাকে নামিয়ে আমার বাহু ধরে রাখল। হাত বাঁধা অবস্থায় ও আমি জোড়াজুড়ি করছিলাম ছাড়ানোর জন্য। কিন্তু সে আমাকে পাত্তা ও দিল না। এক হাতে আমাকে ধরে রেখে অপর হাতে ডোর খুলে ভিতরে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। তারপর ডোর লাগিয়ে দ্রুত অপর দিকে ঘুরে এসে ড্রাইভিং সিটে বসে গেল। আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে অনেক কিছুই বলছিলাম। কিন্তু সে গুলো গো গো শব্দ বাদে অন্য রুপে বেরুলো না।
লিও গাড়ি স্টার্ট দিল। এখনো সে তার খালি গায়েই আছে। কিন্তু এ মুহুর্তে সেটা কোন ভাবেই আকর্ষন করছে না। মাথায় ঘুরছে কিভাবে ছাড়া পাবো?
ওর দিকে ফিরে আমি অনেক কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করছি। বিনিময়ে সে শুধু এক টুকরো বিদ্রুপের হাসি উপহার দিল। তারপর নিজ থেকেই কথা বলতে লাগলো,
“রিচার্ডের সাথে ডেটে যাবে, তার সাথে ডিনার করবে, ফূর্তি করবে, ঘুরে বেড়াবে তাই না?”
আমি অবাক হলাম। রিচার্ডের সাথে কখন ডেটে গেলাম? আর ডিনারই বা করা হলো কখন? ঘুরে বেড়াবার সুযোগ তো হয়ও নি। তাহলে লিও মিথ্যা বলছে কেন?
আমি লিওর দিকে বড় বড় চোখে তাকালাম। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম সে যা বলছে সব মিথ্যা। কিন্তু সামনে নজর রাখতে রাখতে বলল
“একদম এভাবে তাকাবেনা? আমার সাথে সাধারন লাঞ্চ করতে বললে দুনিয়ার সব এক্সকিউজ চলে আসে আর রিচার্ডের সাথে বলতে বলতেই ডেট? ডেটের মজা আমি বুঝাচ্ছি।”
লিও আমাকে ভুল বুঝছে। আমি কখনোই রিচার্ডের সাথে ডেটে যাওয়ার প্ল্যান করি নি। শুধু মাত্র ডিনারে যাওয়ার কথা হয়েছিল তাও ওর কারনে ক্যানসেল হয়ে গেছে।
কার টা একটা গেইটের ভিতর প্রবেশ করলো। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম এটা লিও দের ম্যানশন। কারন মাঝ রাত হলেও ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সব কিছু বোঝা যাচ্ছে। চার দিকে একটানা ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কালা বাদুড় গুলো চি চি করে উড়ে বেড়াচ্ছে।
কার নিঃশব্দে থামলো বাড়ির মুখে গিয়ে। থামতেই শাকিরা লেজ নাড়াতে নাড়াতে চলে এল। এরপর লিও নিজে নেমে আমাকে বের করলো। আমাকে বন্দি দেখে শাকিরা ঘেউ করে উঠল। আর সাথে সাথে লিও তাকে ইশারা করল চুপ থাকতে। শাকিরা চিকন সুরে আর্তনাদ করেই চুপ হয়ে গেল।
লিও আমার বাহু ধরে ভিতরে নিয়ে গেল। ওর দ্রুত হাটার সাথে তাল মিলাতে না পারায় বার বার হোচট খাচ্ছিলাম। ভিতরে প্রবেশ করতেই আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেলো। বিকট আওয়াজে সেটা হাতুরি পেটা করছিল। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। অজানা আশঙ্কায় মনটা ভারী হয়ে যাচ্ছিলো।
লিও আমাকে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসিয়ে দিল। গেইটের ভিতর ঢোকার পর থেকে সে আমার সাথে কথা বলেনি। বসিয়ে দিয়েই কড়া চোখে বলল
“একদম নড়াচড়া করবেনা। এখান থেকে যদি চুল পরিমানও নড়তে দেখি তাহলে টুকরো টুকরো করে তোমাকে রিচার্ডের কাছে পাঠিয়ে দেব। তারপর আয়েশ করে ওর সাথে ডেটে যেও!”
ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে এলো। সায় জানালাম মাথা নেড়ে। আমি এখান থেকে উঠবো না।
লিও ভিতরে চলে গেল। আমি একা একা শুধু আমার হৃদপিন্ডের ঢিপ ঢিপ শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। ভয়ে মুখটা এদিক ওদিক ও নাড়াচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিলো লিও পিছনে দাড়িয়ে আছে। আর আমাকে নড়তে দেখে খপ করে মুখ ধরে বলবে
“তোমাকে না নড়তে বারন করেছি? তারপরও কেন নড়লে?”
এই বলে বড় একটা রামদা নিয়ে আমাকে কোপাতে আসবে।
অথচ আমি কি সুন্দর স্বপ্ন দেখেছিলাম যে লিও আমার কাছে মাফ চাইবে, কান ধরে উঠ বস করবে।
কিন্তু তেমন কিছুই হচ্ছে না বরং আমার জানটা নিয়ে ফেলার জন্য সমস্ত প্রস্তুতি করে রেখেছে।
শাকিরা আশ পাশে ইতস্থত ভাবে ঘোরা ফেরা করছে। কিন্তু কাছে আসছে না। পুরো ঘরটা নিরবতা নামকে নিঃশব্দে মেতে আছে।
সবাই কোথায়? তারা কি দেখছেনা তাদের ছেলে খুন করার জন্য কাউকে অপহরন করেছে?
ঢং ঢং ঢং শব্দে দেয়াল ঘড়িটা ডেকে উঠল। আমি চমকে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম। ভোর হতে আর কয়েক ঘন্টা বাকি মাত্র। ভোর হতেই সবাই জেনে যাবে আমি কিডন্যাপ হয়েছি। খোজ খোজ রব চারদিকে পড়ে যাবে। কিন্তু আমাকে খুজবে কে?
ভাবতে ভাবতে দেয়াল ঘড়ির নিচে চিকন লুকিং গ্লাস টাই নজর গেল। আতকে উঠলাম সেটাতে নিজেকে দেখে। কি অদ্ভুদ বিভৎস দেখা যাচ্ছে আমাকে! লিওর ওয়ার্নিং এর কথা মাথা থেকে চলে গেল। আমি উঠে গিয়ে লুকিং গ্লাস টার সামনে দাড়ালাম। চুল গুলো খোলা ছিল। এমনিতেই আমার চুল লম্বা আর গোছানো থাকে। কিন্তু এত ধস্তা ধস্তিতে চুলো গুলো পাখির বাসার ন্যায় চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কয়েক গাছি চুল মুখের উপর পড়ে আছে। কালো রুমালের সাথে কিছু চুল মুখের সাথে আটকে প্রচুন্ড চুলকানি হচ্ছে। চোখ দুটো কান্নার জন্য ফুলে আছে। ঘুমানোর আগে লং স্কার্ট আর সিজুকার লাফানোর দৃশ্য সম্ভলিত একটা গেঞ্জি পড়েছিলাম। সেটা অবিন্যস্ত হয়ে আছে। গেঞ্জিটার গলা বড় হওয়ায় আমার ডান কাঁধের এক পাশ টা প্রায় বেড়িয়ে এসেছে। সেখানে আমার লাল অন্তর্বাসের ফিতা টা একটু করে দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে বুকের ছোট তিল টাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ইশশ! কি লজ্জার কথা! আমার স্কার্ফ টাও নেই! এ অবস্থায় আমি লিওর সামনে ছিলাম! লজ্জায় মাটির সাথে আমার মিশে যেতে ইচ্ছা করছে। তাড়াতাড়ি মাথা দিয়ে গেঞ্জির এক পাশ টা টানার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তেমন সফল হলাম না। তাই মাথা এপাশ ওপাশ নাড়িয়ে চুল গুলো বহু কষ্টে কাঁধের উপর নিয়ে আসলাম। অন্তত চুল দিয়ে হলেও খোলা কাঁধ টা ঢেকে দিলাম।
“মিইইরা?”
আমি চমকে উঠে পিছু ফিরলাম। লিও আমার বেশ কিছু দূরে দাড়িয়ে আছে। হাত দুটো বুকের কাছে মোড়ানো। কিন্তু চোখ দুটো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। আমি ঢোক গিললাম। বুকটা আবারো ভীষন শব্দ করছে।
ওর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে এক পা এক পা করে এগিয়ে এসে চেয়ার টাতে বসে গেলাম। যেখানে লিও বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। তারপর আড় চোখে লিওর দিকে তাকালাম। সে কোনো কথা বললো না। সোজা কিচেনে চলে গেল। কিছুক্ষন পর আবার ফিরে এলো। সাথে দুটো প্লেট। সেগুলো রেখে আবার কিচেনে গেল। এভাবে বেশ কয়েক বার। আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। কি করছে এসব লিও?
.
সব আনা শেষে প্লেট সব গুলোর ঢাকনা তুলে দিতে লাগলো। এসব কি প্লেটে? কি সব রান্না? এতসব কিছুর মধ্যে একটা প্লেটে গাজর, শসা, পিয়াজ গোল করে কাটা অপরটাতে আস্ত একটা ছিন্ন ভিন্ন মাছ রাখা। মনে হচ্ছে মাছ টাকে ভাজতে গিয়ে সেটার খিচুড়ি বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে লিওর দিকে তাকালাম। সে প্রথমে বড় একটা নিঃশ্বাস নিলো। তারপর আমার মুখের রুমাল টা খুলে ফেলল। এরপর হাতের বাধন টাও। মুখ টা অনেকক্ষণ ধরে বাধা থাকায় ভীষন রকম ব্যাথা করছিল।
তারপরও হাত ছাড়া পেতেই গেঞ্জি ঠিক করে চুল গুলো কে মুড়িয়ে একপাশে নিয়ে আসলাম। তারপর তাকালাম লিওর দিকে। সে আমার কিছু দূরে দাড়িয়ে আছে।
ওর চোখে অদৃশ্য অনুভুতি খেলা করছে। বোঝা যাচ্ছে না কি সেটা।
.
হঠাৎ সে তার কান ধরলো। ওকে কান ধরতে দেখে আমি কিছুটা চমকে গেলাম। হা করে ওর কান্ডকারখানা দেখতে লাগলাম।
লিও ভাঙা ভাঙা গলায় বলল
“আই এ্যাম স্যরি মিইইরা!”
এই বলে কান ধরে বসে পড়লো। তারপর আবার উঠে দাড়ালো। দাড়িয়েই বলল
“তোমাকে ইনসাল্ট করার জন্য আমি দুঃখিত!”
এ বলে আবার বসলো। তারপর উঠে দাড়ালো। আমি বিস্মিত চোখে হা করে আছি। লিও আবার বলল
“কিন্তু এখানে আমার কোনো দোষ নেই। সব তোমার দোষ!”
এই বলে আবার বসে পড়লো। তারপর উঠলো।
“তুমি রিচার্ডের সাথে ডেটে যাবে কেন? তাকে তোমার হাতের রান্না খাওয়াবে কেন?”
এরপর আবার উঠবস করে বলল
“আমার খুব রাগ হচ্ছিল। তাই কি করে ফেললাম নিজেও জানি না। পরে ভুল বুঝতে পেরে তোমাকে খুজছিলাম। কিন্তু তুমি ভার্সিটিতে আসছিলে না। হোস্টেল থেকে বেরুচ্ছিলেও না, হোস্টেলে আমাকেও ঢুকতে দিচ্ছিলো না! তো! তো আমি আর কি করতাম! কিডন্যাপ করা ছাড়া আমি আর কোনো পথ দেখলাম না।”
.
এতক্ষন আমার ভয় হচ্ছিলো। কিন্তু এখন এসব শুনে ভয় উবে গিয়ে প্রচুন্ড রাগ হলো। মনে হচ্ছিলো ওর চুল সব গুলো মুটো ধরে ছিড়ে ফেলি।
এরপর লিও একটু এগিয়ে এসে বলল
“এ দেখ! সেদিন তুমি যা রান্না করেছিলে সব আমি নিজ হাতে রান্না করেছি। চিংড়ির মালাই কোপ্তা, ইলিশ ভাজা, আলু ভর্তা, শুটকি ভর্তা আর ওটা কি যেন? নাম ভুলেই গিয়েছি!”
লিও আমাকে এসব দেখাচ্ছিল কিন্তু আমি ওকে দেখছিলাম। আমার রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছিলো। শরীর থর থর করে কাপছিল। হাত নিশ পিশ করছিল। কিডন্যাপ করার সময়, বিশেষ করে যখন সে গেঞ্জি খুলে ফেলছিল তখন আমি কি পরিমান ভয় পেয়েছিলাম সেটা শুধু আমিই জানি।
লিও আমার দিকে তাকিয়ে বলল
“এসব আমি নিজ হাতে রান্না করেছি। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও।”
রাগ টা নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেল। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। হামলে পড়লাম লিওর উপর। চড়, ঘুষি, কিল, আচড়, কামড় যা পারলাম, যতক্ষণ আমার শক্তিই কুলালো ততক্ষণ লিও কে মারলাম।
.
(চলবে)
.
আপনাদের রেসপন্স আমাকে প্রচন্ড উৎসাহিত করে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here