আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -২৯

0
1933

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ২৯
———————————————–
কাজ করতে করতে বার বার অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ছিলাম। কয়েক বার মিস মার্থা এসে আমার উপর চিল্লিয়ে গেলেন। কিন্তু তাতে আমার বিন্দু মাত্র খারাপ লাগে নি। মাথায় ঘুরছে শুধু মিসেস উইলিয়ামের কথা গুলো। আসলেই কি আমার আর লিওর সম্পর্ক কোনো দিকে গভীর ভাবে এগুচ্ছে?
.
কাজ শেষে হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে অনেক দেরী হয়ে গেল। তড়িগড়ি গোসল খেয়ে দেয়ে পড়তে বসলাম। ফাইনাল এক্সামের আর বেশি দেরী নাই। ফাঁকি দেয়াতে বেশ পড়া জমে গেছে। সেগুলো দ্রুত শেষ করতে হবে। লিও থাকার কারনে বেশ সুবিধা হয়েছিল। পড়া সব গুছিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে না।
নোট টুকতে টুকতে মাথায় এলো যদি লিও সাহায্য না করে তাহলে আমার চলবে কি করে? অথচ ওর মম বলে গেলো ওর কাছ থেকে দূরে থাকতে? দূরে থাকাটা এতটাই জরুরি? কই এডালিন, রিচা, অড্রি, লুনি এদের কাউকে তো বলে নি। কিন্তু এরা তো আমার চাইতে বেশি ঘনিষ্ট।
.
পরদিন ক্লাসে কোন ভাবেই মন বসছে না। এক অপরিচিত অস্থিরতা কাজ করছে। প্রফেসার এত গুরুত্বপূর্ণ লেকচার দিচ্ছে আর সবাই ঠুকেও নিচ্ছে। কিন্তু আমি মনযোগ দিতে পারছিনা। এডালিন পাশেই বসে মনযোগে লেকচার শুনছিল। আর নোট টুকছিল।
“এডালিন?”
“হুম!”
এডালিন মুখ না তুলেই জবাব দিল
“তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?”
“কর!”
“লিও কি এংগেইজড?”
এডালিন মুখ তুলে চাইলো।
“হুম। কেন তুমি জানো না?”
“আমি…!”
কথা কেটে গেল। কথা বলতে দেখায় আমাদের দুজন কে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যেতে হলো। দুজনে সেটা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না। এডালিন বলল
“লিও এংগেইজড। তোমার মনে আছে লিওর বার্থ ডে পার্টির কথা?”
“হুম!”
“ওখানে টিনা এন্ডারসনের সাথে তোমার দেখা হয়েছিল। মি. এন্ডারসনের কন্যা। ওর সাথেই লিওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।”
“কিন্তু লিও তো কখনো এ ব্যাপারে কিছু বলে নি!”
“বিয়েটা অনেক টা পারিবারিক হচ্ছে। এরেঞ্জম্যারেজ। এখানে লিওর সম্মতি আছে কিনা আমি জানি না। তবে দ্বিমত করতেও দেখি নি। হয়ত ইচ্ছা করেই জানায় নি”
.
আজকে ক্লাসে আমি লিওর দিকে ভালোভাবে তাকাই। সে চুপচাপ নিজের কাজ করে চলেছে। আমাকে তাকাতে দেখে ভ্রু কুচকে ইশারা করলো কি হয়েছে। জবাবে একটু হেসে মাথা নাড়লাম কিছু না।
লিও কে আমি পছন্দ করি। ওর ডিম্পল টা আমার বেশ ভালো লাগে। শুধু আমি না ক্লাসের প্রায় মেয়ে লিও কে পছন্দ করে। রিচা ও সেখানে বাদ নেই। ক্লাসের কম বেশি মেয়ের সাথে রিলেশনে থাকলেও আমি কখনো দেখি নি।
আমি হয়তো পছন্দ করি কিন্তু আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক টা ভালো লাগার মধ্যে সীমিত। এর বাইরে কেউই পা বাড়ায় নি। পা বাড়ানো ও উচিত না। দুজনে পৃথিবীর দু মেরুর বাসিন্দা। এখান থেকে পড়া শেষ করে কিছু হোক বা না হোক আব্বা আমাকে বিয়ে করিয়ে দেবে সেটা আমি জানি। সুতরাং এত উড়ো উড়ো মন টাকে আমার কাবু তে আনা প্রয়োজন। কখন আবার লিওর মমের চোখে পরে যাই আর উনি আমাকে মেইলে করে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেবে আর আমি বুঝতেও পারবোনা।
.
সেদিন থেকে লিওর কাছ থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। যেসব ক্লাস আমার আর লিওর এক সাথে পড়তো সেসব এড়িয়ে চলতাম। সাবজেক্ট পাল্টিয়ে ফেললাম। পড়াশোনায় আরো মনোযোগ দিতে লাগলাম যাতে লিওর সাহায্য প্রয়োজন না হয়। কোনো গেট টুগেদার অসুস্থতার বাহানায় এড়িয়ে যেতাম। এত সব করে ও লিওর কাছে ধরা খেয়ে যেতাম। নজর এড়াতে পারতাম না তার। সে চিন্তিত গলায় বলতো
“মিইইরা! কিছু হয়েছে? আমাকে বলো!”
আমি হেসে বলতাম
“কই? কিছু নাতো!
“তাহলে সাবজেক্ট পাল্টালে কেন?”
“তুমি নিজেও জানো লিও। ওই সাবজেক্ট আমার কাছে কঠিন লাগে। আমি পারি না।”
“আমাকে বলতে আমি সাহায্য করতাম!”
জবাব দিলাম না। তবে মনে মনে বললাম তোমার সাহায্য নিতে পারবোনা বিধায় ছেড়ে দিতে হচ্ছে।
এত চেষ্টার পরেও ডেইলি লিওকে দেখা দিতে হত। একদিন দেখা না দিলে হৈ চৈ করে তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিত। বলতো
“মিইইরা তুমি কি আমাকে কোনো ভাবে ইগনোর করতে চাইছো?
তাই নিয়ম করে কাজে যাওয়ার আগে ওকে দেখা দিয়ে যাই।
.
ফাইনাল এক্সামের রেজাল্ট এসেছে। সবাই মোটামুটি ভালো করেছে। আমার ও তাই। ফ্যাকল্টির সবাই চান্স পেয়েছে। তবে টপ লিস্টে লিওর নাম দেখলাম না। একটু চিন্তিত হলাম। কারন শুধু টপ লিস্টেই না কোথাও ওর নাম খুজে পেলাম না। শুধু আমি না সবাই চিন্তিত হল।
ওকে খুজতে লাগলাম। কিন্তু ওকে খুজতে গিয়ে একজনের সাথে দেখা হয়ে গেল।
“ম্যাম!”
“ওহ্ টামিনা। কেমন আছো? আমি তোমার কাছেই এসেছিলাম।”
মিসেস উইলিয়াম কে অনেক চিন্তিত মনে হচ্ছিলো। এমন কি বিষয় যার জন্য আমার কাছে আসতে হলো?
“আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনি…!”
“টামিনা গত দুদিন ধরে এডওয়ার্ড আমার সাথে কথা বলছেনা। এমন কি বাড়িতে ও যাচ্ছে না!”
আমি বুঝতে পারলাম না কথা টা। এক ছেলে তার মায়ের সাথে কথা বলছে না সেখানে আমার কি ভূমিকা হতে পারে?
“লিও মনে হয় ক্যাম্পাসে। আজ ওর ম্যাচ আছে। আপনি কি যাবেন?”
“না থাক। রেগে যাবে আমাকে দেখলে। হয়ত ম্যাচ ছেড়ে চলে যাবে!”
“ওহ্!”
“কয়েকদিন আগে ওর বাগদত্তা এসেছিল। কিন্তু লিও নাকি তার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। এ ব্যাপারে এডওয়ার্ড কে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল সে নাকি টিনা কে বিয়ে করতে রাজি না। অথচ এ নিয়ে আগে কখনো কোনো সমস্যা হয় নি!”
“তাহলে!”
“ও বলল ও নাকি কাউকে ভালোবাসে। হি ইজ ইন লাভ।”
আমি একটু ইতস্থত করে জিজ্ঞেস করলাম
“মেয়েটা কে!”
মিসেস উইলিয়াম চশমাটা একটু ঠিক করে বলল
“সে আমাদের বলে নি। তবে আমার বিশ্বাস এডওয়ার্ড তোমাকে ভালোবাসে!”
আমি চমকে উঠলাম।
“আ-আম-ম-মি মানে!”
.
রাঘবি কোর্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। মাথায় কিছুক্ষন আগে মিসেস উইলিয়ামের বলা কথা গুলো ঘুরছে। মিসেস উইলিয়াম আমার হাত ধরে বলেছিলেন আমি যেন এমন কিছু করি যাতে লিও বিয়েতে রাজি হয়। কিন্তু আমি কি করবো সেখানে? লিও যে আমাকেই ভালোবাসে সেটাই বা কিভাবে শিউর হলেন? আর বিয়েতে যদি লিওর অমত থাকে তাহলে জোর করে বিয়েটা করাচ্ছে কেন? বিজনেস কি ছেলের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ?
“টামিনা!”
ভাবনার সুতো ছিড়ে গেল। কেউ আমাকে ডাকছে। তাকিয়ে দেখলাম রিচা। হাত নেড়ে আমাকে ইশারা করছে। সবাই খুব মজা করছে। ম্যাচ প্রায় টান টান উত্তেজনায়। আমি গিয়ে সিটে বসে পড়লাম। ম্যাচে দারুন লড়াই হচ্ছে। অনেক টা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। লিও ও সেখানে আছে। সবাই তাকে সাপোর্ট করছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ম্যাচে হার হলো। বিমর্ষ মুখে সাপোর্টার্স রা বেড়িয়ে গেল। সবাই ক্যান্টিনের জন্য বেড়িয়ে গেলে আমি তাদের কে বলে চেঞ্জিং রুমের বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনেক দিন তাকে এড়িয়ে চলেছি। ইগনোর করেছি। কিন্তু সত্য বলতে লিও কে প্রচুন্ড মিস করেছি। মিস করেছি তার হাসি টাকে। মিস করেছি সেই মজার মুহুর্ত গুলো কে।
.
দরজা খুলে লিও বেড়িয়ে এলো। সে আমাকে খেয়াল করেনি। ভেজা চুলে টাওয়াল টা কাঁধে ঝুলিয়েই হাটতে লাগল। মাঝে মাঝে একটু একটু চুল মুচছে। ও বেড়িয়ে এসেছে খেয়াল হতেই আমি পিছন থেকে ডাক দিলাম
“লিও।”
ডাক শুনে সে পিছন ফিরে তাকালো। হাফ ফ্যান্ট আর সাদা স্পোর্টস গেঞ্জিতে তাকে ভিন্ন রকম সুন্দর লাগছে। কাঁধে লম্বাটে স্পোর্টস ব্যাগ। ভেজা চুল গুলো টাওয়েল দিয়ে মোছায় চারদিকে এলোমেলো হয়ে আছে। জুলফি তে এখনো কিছু পানি গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু চোখ দুটো দেবে গেছে। মুখে হাসি নেই। চেহারা উজ্জলতা কোথাও যেন হারিয়ে গেছে।
“মিইইরা!”
দৌড়ে আসায় একটু হাপিয়ে গিয়েছিলাম। একটু নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম
“তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
“হুম বলো!”
“এক মিনিট!”
“কি করছো!”
আমি নিচু হয়ে বসে লিওর কেডসের ফিতা টা বেঁধে দিলাম। হয়ত ফিতা বাঁধতে সে বেমালুম ভুলে গিয়েছে।
“থ্যাংকস!”
“ইটস ওকে!”
যেতে যেতে লিও জিজ্ঞেস করলো
“রেজাল্ট কেমন হয়েছে?”
“ভালো তোমার?”
“আমি জানি না। এখনো দেখি নি।”
“লিও?”
“হুম!”
“আমার সাথে লাঞ্চে যাবে? প্রচুন্ড খিদা পেয়েছে!”
লিও থমকে দাড়ালো
“সত্যি!”
“হুম!”
লিও খুশি হয়ে গেল। তার খুশি টা অনেক দিন পর দেখছি। সে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল
“বাহ! আজকে নিজে থেকে লাঞ্চের কথা বলছো! ব্যাপার খানা কি? আমার প্রেমে পড়েছো নাকি!”
“ফানি জোকস!”
“হা হা হা!”
হাসতে হাসতে লিও আমার গাল ধরে টেনে দিল।
আমি বিরক্তির সাথে গাল সরিয়ে নিলাম।
.
(চলবে)
.
আজকে থেকে আমার স্কুল খুলেছে। রেজাল্ট তৈরির ভেজালে আছি। কয়েকদিনের মধ্যে রেজাল্ট জমা দিতে হবে। তাই এই কয়েক দিন রেগুলার দিতে পারবো কিনা জানি না। তবে চেষ্টা করবো। আজকের পর্বটাও অনেক তাড়াহুড়ো করে লিখেছি। কেমন হয়েছে জানি ও না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here