আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -৩১

0
1917

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৩১
———————————————–
আকা বাঁকা স্বচ্ছ অন্ধকারের পথে কোথাও হারাতে চলেছি। এই লম্বা পথ টুকু তে লিওর সাথে বিন্দু মাত্র কথা হয় নি। ক্ষনে ক্ষনে শিউরে উঠা মুহুর্ত গুলো এক ভিন্ন অনুভুতি প্রকাশ করছিল। দমকা দমকা বাতাসে খোঁপার বাইরে বেড়িয়ে আসা কয়েক গুচ্ছ চুল এলোমেলো ভাবে উড়ছিল। আমি এখনো এক হাতে খামছি দিয়ে লিওর জ্যাকেট ধরে আছি। অপর হাতে স্কার্ট। খুব সাবধানে স্কার্ট টা ধরে আছি। কারন এই ব্লু স্কার্ট টা ভীষন ভারী। উল্টা পাল্টা কিছু হলে প্যাচ খেয়ে সিধা আল্লাহর কাছে চলে যাব।
ধীরে ধীরে অন্ধকারের ঘন চাদর টা পাতলা হতে শুরু করেছে। আবছা আবছা আলোয় রাস্তার ধারের সাড়ি সাড়ি সিডার গাছ গুলো কে মনে হচ্ছে মুর্তিমান সৈনিক। ভোরের আভাস পেয়ে পেঁচা গুলো অদ্ভুদ শব্দ করে গাছের কোটরে লুকিয়ে যাচ্ছে। কিছু নাম না জানা পাখি ডানা ঝাপটিয়ে আড়মোড় ভাঙছে। বাতাসের সাথে ভেসে আসছে চন্দনের তীব্র সুবাস।
বেশ কিছুক্ষন পর সাইকেল থামলো। মসৃন এক সবুজ পিচ ঢালা পথের ধারে। সাইকেল থেকে নেমে আমি চারপাশে তাকালাম। এমন একটা মুহুর্ত যেখানে হঠাৎ করে কাউকে দাড় করিয়ে যদি জিজ্ঞেস করা হয় এটা সকাল নাকি সন্ধ্যা? তাহলে সে বলতে পারবেনা।
লিওর দিকে তাকালাম। সে সাইকেল স্ট্যান্ডে রাখছে। আমি বললাম
“কোথায় আসছি আমরা?”
সাইকেল স্ট্যান্ডে রেখে লিওর আমার দিকে হেটে এলো। আমার প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিল না। বলল
“ঠান্ডা লাগছে?”
“নাহ্!”
যদিও বা লিও কে বললাম ঠান্ডা লাগছে না। তবে ফিন ফিনে বাতাসে একটু ঠান্ডা লাগছিল। কিন্তু সেটা খারাপ লাগছিলো না।
সবকিছু আবার নিঃশব্দে চৌচির হয়ে গেল। যদি অন্য সময় হত তাহলে স্বাস্থ্য সচেতন দের অবশ্যই দেখা মিলত। কিন্তু ঝড় বাদলের দিনে কেউই বেড়িয়ে শরীর খারাপ করতে ইচ্ছুক নয়।
নিরবতা কে ভেঙে দিয়ে গুঞ্জন করতে করতে মাথার উপর দিয়ে এক ঝাক সোয়ালো পাখি উড়ে গেল। হাত দুটো বেশ ঠান্ডা হয়ে গেল। মুটো ধরে ঘসতে লাগলাম। যাতে একটু উষ্ণ হয়। লিও বলে উঠল
“মিথ্যা না বললেও পারতে।”
“হাহ! কই মিথ্যা বললাম?”
লিও জবাব দিল না। গায়ের কালো হুডি জ্যাকেট টা এক টানে খুলে ফেলল। তারপর আমার গায়ের উপর চাপিয়ে দিল। আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম।
“লি-লিও?”
“শসসসসহ! সব সময় এত মিথ্যা বলতে হয়? খুব পাজি হয়েছো ইদানিং!”
অতএব আর জবাব দিলাম না। একদম পরিচিত দৃ্শ্য মনে হচ্ছে এটা। সিনেমার মধ্যে দেখা। নায়িকার ঠান্ডা লাগলে নায়ক তার গায়ের উষ্ণ পোশাক টা খুলে নায়িকার গায়ে জড়িয়ে দেয়। ভাবতেই ফিক করে হেসে দিলাম।
“কি হলো? হাসছো যে?”
মাথা নাড়লাম। কিছু না। দু হাতে জ্যাকেট টাকে টেনে নিলাম। ক্যামেলিয়ার খুশবু জড়িয়ে আছে জ্যাকেট টাতে।
চারদিক একটু একটু ফর্সা হয়েছে। ম্যাপল গাছ গুলোয় সোনালী রংয়ের পাতা বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে হয়ে আছে। মাঝে মাঝে একটা দুটা দেবদারু গাছ প্রবীণ আর জ্ঞানীর মত উচু হয়ে স্বগৌরবে দাড়িয়ে আছে।
রাস্তার বাম পাশে বিশাল লেক। লেকের পানি গুলো উপচে পড়া সবুজ। পিচ ঢালা রাস্তাটাও সবুজ। ডান পাশে বিভিন্ন গাছ গাছালিতে ভরা জায়গা টাও। এ যেন চার দিকে সবুজের সমারোহ বসেছে।
আচমকা লিও কথা বলে উঠল
“এটা লেক, লেক উইনিপেগ।”
“এটা কি শহরের বাইরে? মানে আমরা কি শহরের বাইরে?”
“নাহ্! বাইরে না। তবে দূরে আছি। অনেক দূরে লেকের কাছাকাছি!”
“ভারী সুন্দর দেখতে।”
আমরা লেকের উন্মুক্ত অংশে চলে এসেছি। লেক টা দেখতে একদম গোল নয়। তবু দেখতে চমৎকার। লেকের অপর পাশেও নানা রকম গাছ গাছালী।
হাটতে হাটতে হঠাৎ লিও দাড়িয়ে গেল। আমার দিকে ফিরে বলল
“মিইইরা তুমি একটু দাড়াও। আমি আসছি!”
“কোথায় যাবে?”
“এইতো এখানে!”
লিও রাস্তার পাশের লম্বা লম্বা পাইন গাছের ঝাঁকের ভিতরে ঢুকে গেল। আমি আশ পাশ দেখতে লাগলাম। লেকের পানি সবুজ হলেও কাচের মত ভীষন স্বচ্ছ। এতই স্বচ্ছ যে বেশ দূর থেকেও ছোট ছোট সোনালী মাছ গুলোর চলা ফেরা দেখা যাচ্ছে। পরিষ্কার আকাশে এখনো পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। যে কোনো মুহুর্তে মেঘ গুলো বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়তে পারে।
রাস্তার পাশে ছোট ছোট লম্বাটে কাটাওয়ালা ফণীমনসার ঝোপ। সামনে ভ্রমন রত পথিকের জন্য উইলো কাঠের তৈরি বসার স্থান। দুই/চার জন আরামে বসে লেকের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারবে। আমি এগিয়ে গেলাম। বৃষ্টির দরুন ভিজে থাকলেও বাতাসে পানি বেশ টেনে নিয়েছে।
ছবির মত একটা দৃশ্য। ভ্যান গগ যদি সোনালী সাম্রাজ্যের বদলে এই সবুজ সাম্রাজ্য দেখতেন তাহলে কেমন করে আঁকতেন? আমার বড্ড জানতে ইচ্ছে হল। প্রকৃতির এ মুহুর্ত টা ভ্যান গগের অবশ্যই দেখা উচিত ছিল।
হালকা পায়ের শব্দে সামনে তাকালাম। লিও বেড়িয়ে এসেছে। ঠোটের কোনে একটা হাসির রেখা। একটা হাত পিছনে মোড়ানো। নিশ্চয় কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে। হাব ভাব বোঝা যাচ্ছে না।
লিও এগিয়ে আসতেই আমি উঠে দাড়ালাম। সে এসে কোন কথা না বলে আমার একটা হাত ধরলো। আমি ওর মতিগতি বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম।
লিও একবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। তারপর বলল
“একটা ছোট্ট পরী এলো রুপকথার দেশ থেকে ডাগর ডাগর চোখ আর সুচালু কালো লম্বা চুল নিয়ে। যাকে আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। যখন পেয়েছিলাম মনে হয়েছিল আমি পথ হারা পথিক এগিয়ে যাচ্ছি আর গড টুপ করে আকাশ থেকে একটা পরীকে আমার সামনে আমার জন্য ফেললো। মনে হচ্ছিলো পরীটার ডানা নেই। তাই উড়তে পারছে না। আমি সযত্নে তুলে নিলাম। পরীটাকে! উঁহু… আমার পরীটাকে। যে ছিল আমার জন্য ব্লেসিং। যাকে দেখে প্রথম হার্টবিট মিস করলাম, যার হাসি তে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সেই পরীটা কিভাবে যে আমাকে চুরি করে ফেলল বুঝতেই পারলাম না। বুঝতে পারলাম না কখন চুরি করে ফেলল। তার মধ্যেই দুনিয়াটা খুজে পেলাম। এত দিনের সমস্ত কিছু নকল মনে হতে লাগলো। আমি তড়পাতে লাগলাম একটু খানি স্পর্শের জন্য। কাতরাতে লাগলাম একটু ভালোবাসার জন্য। কিন্তু সে মুহুর্তে ছোট্ট একটা ঝড় আসে। ঝড় আসে আমার পরীটাকে নিয়ে যেতে। আমি তা দিব না। কখনোই দিব না ঝড় টাকে আমার পরী কে উড়িয়ে নিয়ে যেতে। তাকে আমার সাথে আষ্টে পৃষ্টে বেঁধে ফেলবো। যাতে কেউ নিয়ে যেতে না পারে।”
.
লিও থামল। তার চোখ জোড়ার সাথে ঠোঁট জোড়াও কাপছে। আর সাথে কাপঁছে আমার হৃদপিন্ড। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম
“কে-কে সেএ প-পরী?”
জবাবে কাঁপতে থাকা ঠোট টাকে লিও একবার ভিজিয়ে নিল। আলতো করে তার বলিষ্ট হাতে আমার গাল স্পর্শ করতে লাগলো। স্পর্শে পুরো শরীরে উষ্ণ শিহরন বয়ে গেল। লিওর চোখের দিকে তাকালাম। তার ঘোলাটে ছল ছল করা দৃষ্টি অনেক কিছুই প্রকাশ করতে লাগল।
ক্যামেলিয়ার গন্ধটা ছড়িয়ে চারদিক টা মোহনীয় করে তুলেছে। ফিন ফিনে বাতাস কাপুনি বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি নিজের অজান্তেই লিওর বুকে হাত রাখলাম। ঠিক সেখান টাই, যেখান টাই বুক অবিরত ধক ধক করে। লিওর বুকেও সেই শব্দ হচ্ছিল। আমি অনুভব করছিলাম। অনুভব করছিলাম প্রত্যেক টা শব্দ কে। অনেক কিছু বলছিল সে শব্দ টা। যেটা আমার বোঝার বাইরে।
লিওর শীতল ঠোট জোড়া টুপ করে আমার কপাল স্পর্শ করল। শিউরে উঠলাম আমি। পিঠের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। এক ভিন্ন অনুভুতি। যেটা আগে কখনো অনুভব করি নি। যেন এক স্বর্গীয় অনুভুতি। যে অনুভুতি টা পাওয়ার জন্য প্রেমের সাধক রা হাজার হাজার বছর প্রেমসাধনা করে।
স্পর্শ টা ধীরে ধীরে হালকা হলো। আমি চোখ খুললাম। আমার চোখের নিচটাই এখনো লিওর চঞ্চল বৃদ্ধা আঙ্গুল ঘুরে বেড়াচ্ছে। গভীর দৃষ্টিতে ফিস ফিস গলায় লিও আমার প্রশ্নের উত্তর দিল। বলল
“আর সেই পরীটা হচ্ছে তুমি মিইইরা। আমার পরী, আমার প্রিন্সেস, আমার এনজেল সব তুমি!”
আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। যা শুনছি বিশ্বাস হচ্ছেই না। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছি। আর এ সুন্দর মোহনীয় মুহুর্ত টা স্বপ্নে দেখছি। ভয় হচ্ছে ঘুম ভাঙলে স্বপ্ন টা হারিয়ে যাবে। কিন্তু এ মুহুর্তে ঘুম থেকে জাগ্রত হতে ইচ্ছা করছেনা।
লিও এক পা পিছিয়ে গেল। তারপর ডান পা টা হাটু গেড়ে বসলো। সেটা দেখে আমার বুক পা ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো। একটা ঢোক গিললাম। অজানা আশঙ্কায় কাঁপতে লাগলাম। লিও পিছন মোড়ানো হাত টা সামনে এগিয়ে আনলো। আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। তার হাতে এক গুচ্ছ ক্যামেলিয়া। হালকা হালকা বাতাসে সেগুলো অল্প অল্প দুলছিল। যেন জানান দিচ্ছে তাদের সুবাসতার। লিও পলক বিহীন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। তারপর বলল
“I-I love you mira! হা-আমি টো-টোমাকে ভা-ভা-ভাহ্…
“ভালোবাসি!”
বাক্য টা আমি পূর্ন করে দিলাম। শুনে সে একটু করে হাসি দিল। চোখ বড় বড় করে নিঃশব্দতাই কিছু বলছিলো। আর বাতাস এসে আমার কানে কানে সেই নিঃশব্দতার অর্থ বলে দিচ্ছিলো।
আমি একটু এগিয়ে আসলাম। ওর ফর্সা গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলো নিজেদের উপস্থিতি ঘোষনা করছে। আরো একটা নির্ঘুম রাতের জাগ্রত চোখ দুটো ফোলা ফোলা উচ্ছাসতায় ভেসে যাচ্ছে। চিক মিক করছে চোখ দুটো। কেন জানি না ওকে ছুতে মন চাইলো। অবাধ্য হাত টাকে শাসন করতে পারলাম না। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলো হাতে বিধছিল। একটা অন্যরকম অনুভুতি। ধীরে ধীরে অবাধ্য হাত টা ওর কাঁধ হয়ে বুকে নেমে এলো। ওর বুক টা এখনো প্রচুন্ড শব্দে শব্দ করছিল। ঠিক তার হৃদপিন্ড বরাবর বুক টাই স্পর্শ করছি। স্পর্শে শীতল ঠান্ডা কিছুর ছোয়া পেলাম। ছোয়া পেয়ে সেই শীতল বস্তু টা হাতে নিয়ে নিলাম। লকেট, লিওর ক্রুশ লকেট। থমকে গেলাম এক মুহুর্তের জন্য। স্পন্দন বেড়ে গেল বুকের। বাস্তবতা আমার মাথায় টোকা মারলো। লকেট ছেড়ে ঝট করে পিছিয়ে গেলাম। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। এ আমি কি করছিলাম?
আমাকে পিছিয়ে যেতে লিও উঠে দাড়ালো। চেহারায় ছেয়ে এলো এক রাশ কালো মেঘে। উদভ্রান্ত গলায় আমাকে ডাকলো
“মি-মিইইরা?”
আমি ছোট ছোট নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললাম
“তু-তুমি ক্রিশ্চিয়ান লিও! তুমি ক্রিশ্চিয়ান!”
“মিইইরা!”
সে এক পা এগিয়ে আসতেই আমি দু পা পিছিয়ে গেলাম। ভড়কে গেল সে আমাকে পিছিয়ে যেতে দেখে। এক বার আমার পায়ের দিকে একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল
“কি-কি হলো?”
আমি ঢোক গিলে বললাম
“এ-এ হয় না লিও! কখনো হওয়ার না!”
এ বলে লিওর জবাবের অপেক্ষা করলাম না। পিছু ফিরে দ্রুত হাটা শুরু করলাম। শুধু ভাবছিলাম বেরুতে হবে, এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরুতে হবে। না হলে অঘটন ঘটে যাবে।
.
(চলবে)
.
চলছে এবং চলতে থাকবে আমার সবচেয়ে প্রিয় পার্ট গুলো। হ্যাপি রিডিং ♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here